আজকের শিরোনাম :

রাজনীতি : টাকার খেলা

  ফজলুল হক

০৮ জুলাই ২০১৯, ১২:২৩ | অনলাইন সংস্করণ

(এক)
ছাত্ররা লেখাপড়া করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তার লক্ষ্য ক্যারিয়ার বিল্ডিং এবং সে জন্য দরকার পরীক্ষার ভাল রেজাল্ট করা। কিন্তু অনেক ছাত্রছাত্রী রাজনীতির সাথে নিজেকে জড়িত করে। কেন ছাত্রছাত্রী রাজনীতি করে, এর একক কোন উত্তর আছে বলে আমার মনে হয়না। এ নিয়ে একেকজন এক এক রকম বক্তব্য দিবে।
আমি কেন ছাত্ররাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম? আমার রাজনীতিতে জড়ানোর কারণ ছিল, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ। তারা বাঙালিকে মানুষ মনে করতনা। অথচ ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাঙালি সব চাইতে বেশি অবদান রেখেছিল। বাঙালি কেবল অর্থনৈতিক শোষণের শিকার ছিল তা নয়, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্বে থাকা সামরিক জান্তা, সেনা আমলা, মন্ত্রীরা, এস্টাব্লিশমেন্টের নিয়ন্ত্রকদের জুলুমের শিকার ছিলাম আমরা। আমাদের উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছিল। ভাষাগত আগ্রাসন ছিল। চাকরি বাকরিতে বাঙালিকে বঞ্চিত করা হতো। কথা বললে বাঙালিকে অপমানিত করা হতো। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমার ক্ষোভ, বিদ্রোহের বহিঃ প্রকাশ ঘটাতে আমি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হই। আমাদের সময়ে রাজনীতি টাকার খেলা ছিল না।
অবাঙালি ও বিহারীদের অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ ছিলাম। ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদিঘীর মাঠে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ব্যাখ্যা করে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সে বক্তৃতা অনেকের মতো আমাকেও আকৃষ্ট করেছিল। মধ্য ষাটের দশকে ৬ দফা প্রচারে আমি ও অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মীর মতো কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমাদের বিশ্বাস ছিল ৬ দফাই মুক্তি সনদ। ৬ দফা আমাদের মুক্তি এনে দিতে পারবে। এটা জীবন মরনের প্রশ্ন ছিল। আমাদের মতো রাজনৈতিক কর্মীদের প্রেরণায় ৭১ এর রণাঙ্গনে লাখ লাখ তরুণ জীবন দিতে ছুটে গিয়েছিল। ছয় দফার কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা, তিনি ছয় দফার প্রণেতা। টাকার চিন্তা আমাদের মাথায় ছিলনা। মাথায় ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ।
আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ করতাম। ১৯৬২ সাল থেকে ছাত্রলীগ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন তাদের রাজনীতির লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের কথা আপনারা শুনেছেন। আমার স্কুলে অবাঙালির ছেলেমেয়ে পড়ত। আমাদের হালিশহর তখন নিতান্তই একটা গ্রাম ছিল। আমাদের স্কুলে দুটি শাখা ছিল, উর্দু (মিডিয়াম) শাখা এবং বেংগলি (মিডিয়াম) শাখা। বিহারি ও অবাঙালি ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমাদের বন্ধু বান্ধবী ছিল। বন্ধুত্ব সত্ত্বেও লক্ষ্য করতাম তারা আমাদের “মালাউন” ভাবত। বলত, “তুম আউর মালাউন ক্যায়া ফারাক পড়তা?” এই বৈষম্য সহ্য হতোনা। হাত নিশপিশ করত। আমি নিজ ভুমে পরবাসী? পাকিস্তানবিরোধী মাইন্ডসেট আমার এখনো বদলায়নি। পাকিস্তানি দেখলে আমার হাত নিশপিশ করে। পাকিস্তানের দালালদের আমি সহ্য করতে পারি না। আমার ছাত্র রাজনীতিতে ঢোকার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানকে খতম করা। এখন বিএনপি ছেড়ে অনেকে আওয়ামী লীগে এসে টুপি বদল করছে। আমি মনে করি, কোন রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী, জামায়াতপন্থীকে আওয়ামী লীগ নেতা, তার দলে এন্টারটেইন করবে না, লালগালিচা বিছিয়ে তাদেরকে দলের চেয়ারে বসাবে না। আওয়ামী লীগের ডাকে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ডাকে ৩০ লক্ষ মানুষ যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ দিয়েছে। সে আওয়ামী লীগের নেতা যদি আলবদর, আলশামসের পরিবারের সদস্যদেরকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বসাতে চায়- তাহলে সে আওয়ামী লীগ নেতাকে আপনারা একবার ডালিম হোটেলে যেতে বলুন। আলবদরের সেদিনের সে নির্যাতনের কথা স্মরণ করতে বলুন। বিহারী ও অবাঙালিদের অত্যাচারের কথা স্মরণ করতে বলুন।
তখন বামধারায় কাজ করত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। তাদের কথাবার্তা আমাকে প্রভাবিত করত। আমাদের অনেক বন্ধু ওই দলে ছিল। তারা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতনা, আন্তর্জাতিকতার বিষয় আমাদের বোঝাত, তারা বলত, “দুনিয়ার মজদুর এক হও।” আমার ভেতরে গভীর অন্তজালা ছিল। আমার মনে ছিল তীব্র বাঙালি জাতীয়তাবোধ। আমি বাম রাজনৈতিক কর্মীদের পছন্দ করলেও এবং আমরা এক সাথে ১১ দফা আন্দোলন করলেও- তাদের কাছ থেকে আমি দুরে ছিলাম। তখন আমাদের মনে ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স কাজ করত। ছাত্রলীগের রাজনীতি করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসি। উনার ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা অতুলনীয় ছিল। উনি রাজনীতিতে অনেক উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। পাকিস্তানের জুলুমের প্রতিশোধ নেয়ার তাগিদ অনুভব করতাম। আমার অন্য কোন টার্গেট ছিল না। এখন আমার মনে হয়, “টাকা- সর্বস্ব” রাজনীতি কোনদিন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকেনি। এই রাজনীতিকে আমি ঘৃণা করি। যে রাজনীতি- পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং তৈরিতে ইন্ধন দেয়, সে রাজনীতিকে ঘৃনা করি। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে এখন। এটা ভাল রাজনীতির সুফল। এই উন্নয়ন ও বাড়তি প্রবৃদ্ধির সুফল, গরিবের কাছে পৌঁছাতে হবে, সেটাই হওয়া দরকার আজকের অগ্রগামী ও অদম্য বাংলাদেশের রাজনীতির লক্ষ্য। ত্রুটিপুর্ণ ও লক্ষ্য বিহীন রাজনীতি “টাকা- সর্বস্ব” হয়ে পড়ে। “টাকা- সর্বস্ব” রাজনীতির প্রতি রেন্ট সিকিং ও কমিশনভোগী শ্রেণির মানুষ আকৃষ্ট হয়। এখন রাজনীতি মধ্যস্বত্বভোগীদের কব্জায় চলে গেছে। গণতন্ত্র মানে সকল মানুষের অংশগ্রহণ। ধনী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা যদি সংসদের সকল আসনে আসীন হন, তাহলে গরিবের কথা বলবে কে? গরিবের জন্য রাজনীতি করবে কে?
(দুই)
আমরা যখন ছোট, তখন যারা রাজনীতি করতেন, লোকে তাদের উদ্দেশ্যে বলত, “ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে।” এখন যারা রাজনীতি করেন, তারা চায় বনে যত মোষ আছে, সবকটা নিজের দখলে নিতে। রাজনীতিতে এখন টাকার দরকার কেন? এখন সংসদ নির্বাচনে জিততে হলে ১০ কোটি টাকার ক্যাশ এন্তেজাম আগে ভাগে করতে হবে। কোন কোন রাজনৈতিক দল নাকি মনোনয়ন বাণিজ্য করে। রাজনৈতিক নেতা, নির্বাচনে জেতার জন্য পুঁজি বিনিয়োগ করেন। নির্বাচনে জিতে উনি সে টাকা উঠাবেন- এটা স্বাভাবিক। দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও এখন রাজনীতি মানে “টাকার খেলা।” রাজনীতি মানে, “নির্বাচনে টাকা ঢালা।”
আমরা নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে পারি, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী, ন্যাপ নেতা মোজাফ্ফর আহমদ- উনারা কি কোটিপতি ব্যবসায়ী ছিলেন? উনারা নির্বাচন করার এবং দল চালানোর টাকা কোথায় পেতেন? আগের দিনে নেতাদের টাকা দিতেন গরিবরা। এখন রাজনীতিতে টাকা ঢালে ধনীরা।
প্রশ্ন হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে নির্বাচনের সময় কেবল টাকাওয়ালাকে মনোনয়ন দেয়া হয়? দৈনিক প্রথম আলো (৫/৭/১৯) পত্রিকায় হাসান ফেরদৌসের লেখা একটি প্রবন্ধ পড়েছি। তিনি লিখেছেন, (মার্কিন দেশে) রাজনীতিবিদদের মাথায় এই চিন্তাই ঘোরে কি করে পরবর্তী নির্বাচনের জন্য টাকা তোলা হবে। টেঙাসের রিপাবলিকান সিনেটর টেড্ ক্রুজ বলেছেন, রাজনীতি করতে হলে, সবার আগে নিজের লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ফেলতে হবে। কারণ যার সঙ্গেই দেখা হয়, তাকে বলতে হবে, গুড মর্নিং, ভালো আছেন তো? আমার জন্য দয়া করে কিছু টাকা দিবেন কি?
আমেরিকায় সিনেটর সদস্য পদের জন্য গড় পরতা খরচের পরিমাণ, প্রায় সোয়া এক কোটি ডলার। এটা যার যার ব্যক্তিগত প্রচারণার খরচ। তার উপর রয়েছে, দলগত ব্যয়। সেটা ধরলে আমেরিকায় একজন সিনেটে জিততে ২ কোটি ডলার ব্যয় করে। আমাদের দেশের প্রায় ১৫০ কোটি থেকে ২০০ কোটি টাকা তারা চাঁদা তোলে। কিন্তু এত টাকা নির্বাচনী ব্যয় সত্ত্বেও এটা হয় না যে- আমেরিকার সংসদ চলে গেছে বিলিওনারের দখলে। ট্রাম্প তার আগামী নির্বাচনের জন্য ১০ কোটি ডলার ডোনেশন এর মধ্যে তুলে ফেলেছেন। আমাদের দেশে নির্বাচন বলেন, দল পরিচালনা বলেন, তাতে ব্যক্তিগত টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে। রাজনীতি টাকার খেলা নয়। রাজনীতি মানে মানুষের সেবা করা। রাষ্ট্রের কাজ হলো- মানুষের কল্যাণ করা। (দৈনিক আজাদী খেকে সংগৃহীত)

লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ