প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর
রোহিঙ্গা সংকট ও কূটনীতির নতুন প্রেক্ষাপট
ড. আকমল হোসেন
০৭ জুলাই ২০১৯, ১০:০৫ | অনলাইন সংস্করণ
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশকে আর্থ-সামাজিক নেতিবাচক অভিঘাতসহ নিকট এক প্রতিবেশীর সঙ্গে জটিল সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর যখনই মিয়ানমার প্রশাসন বর্বর আচরণ করেছে; প্রাণ-সম্মান বাঁচাতে তারা বাংলাদেশের মাটিকে বেছে নিয়েছে। অতীতে তারা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও পরে অনেকে নিজ নিজ ভূমিতে ফিরে গেছে। কিন্তু এবার তাদের ফিরে যেতে প্রতীক্ষার অবসান হচ্ছে না মিয়ানমারের অপকৌশলের কারণে। সে দেশের সরকারের বিদেশি বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষকরা প্রশ্রয় দিয়ে তার একগুঁয়ে আচরণকে ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের নানা কূটনৈতিক উদ্যোগ সত্ত্বেও মিয়ানমারকে দৃঢ়ভাবে মোকাবেলা করার নীতির বদলে তার প্রতি এক মোলায়েম মনোভাব প্রকাশ করে এসেছে, যা মিয়ানমার তার স্বার্থে ব্যবহার করেছে। খুব দেরিতে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীন বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপলব্ধি হয়েছে- মিয়ানমার মিথ্যাচার করেছে!
রোহিঙ্গাদের জন্য এতদিন ধরে অনুসৃত কূটনীতিতে পরিবর্তন আনার জন্য ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকে ব্যবহার করার চেষ্টা হয়েছে। তার আগ পর্যন্ত কূটনীতিক ও মন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনা, মতবিনিময় বা আন্তর্জাতিক জনমত তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে নিজে উদ্যোগ নিতে হয়েছে, যা তাৎপর্য বহন করছে। এবং এটা দ্বিপক্ষীয় কূটনীতিতে সর্বোচ্চ পর্যায়। চীনকে লক্ষ্য করে এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং সংকটের শুরুতে আওয়ামী লীগদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু লাভ হয়নি। চীনের সঙ্গে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব থাকার ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে সে দেশের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর ঢাকা সফরের সময় দুই দেশ সম্পর্ককে যে উচ্চতায় উন্নীত করতে চেয়েছিল, তাকে আখ্যায়িত করা হয়েছিল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ অব কো-অপারেশন। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বর্তমান সরকারের আমলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, তা আগে ছিল না। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে এ দুই মিত্র বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়নি। অথচ সংকটের মানবিক দিক উপলব্ধি এবং বাংলাদেশের ওপর এর অভিঘাত কী, তা বিবেচনা করে তাদের বস্তুনিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, যা তারা নেয়নি। মিয়ানমারের ওপর তারা কেউ প্রভাব খাটাতে চায়নি।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে নতুন করে রোহিঙ্গারা বন্যার ঢলের মতো বাংলাদেশে আসতে থাকলে মানবিক দায়িত্ববোধ থেকে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। টেকনাফ-কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষকে অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথিদের জন্য নানা ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এবং তা তারা করেও যাচ্ছে। নতুন করে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষ যে মাত্রায় নিপীড়ন চালিয়েছে, সংখ্যা ও গুণগত মানে তা এত বেশি ছিল যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের ব্যাপারে দ্রুত সহানুভূতি দেখিয়েছিল। বিশেষ করে জাতিসংঘ মহাসচিবের এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ার মতো ছিল। ২০১৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে সংকট নিয়ে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় তিনি অবিলম্বে সামরিক অভিযান বন্ধ করা, সহিংসতায় উদ্বাস্তু মানুষের কাছে ত্রাণকর্মীদের বাধাহীন যেতে দেওয়া এবং উদ্বাস্তু লোকজনকে নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও টেকসইভাবে নিজেদের বাড়ি ফিরে যেতে ব্যবস্থা করতে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানান। কিন্তু মিয়ানমারের শঠতায় ভরা পদক্ষেপ এবং তাকে বাধ্য করার মতো আন্তর্জাতিক উদ্যোগের অভাবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশের কূটনীতি কোনোভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। বলা দরকার, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর প্রায় সবাই মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থেকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দুর্বলতাকে প্রমাণ করেছে।
বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের দুটি দিক যে কোনো আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, তাদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য বিশ্বাসযোগ্য অঙ্গীকারসম্পন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ; দ্বিতীয়ত, ঘুরেফিরে তৈরি হওয়া এ সংকটের মূলোৎপাটন করার লক্ষ্যে তাদেরকে রোহিঙ্গা জাতি-পরিচয়ে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে মেনে নিয়ে নাগরিকত্ব আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা। দ্বিতীয় পদক্ষেপটি মিয়ানমার সরকার দ্বারা গঠিত কফি আনান কমিশনের সুপারিশে অন্তর্ভুক্ত ছিল। মিয়ানমার যেমন রোহিঙ্গাদের ভিন্ন জাতি হিসেবে স্বীকার করে না; বাংলাদেশও মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় তাদের আরাকানি মুসলিম বলে আখ্যায়িত করে তাদের দাবিকে দুর্বল করে দেয়। তবে বাংলাদেশ সরকার সংকটের সূত্রপাতের পর থেকেই প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়েই তার কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এ-সংক্রান্ত একটি চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ, যা বাস্তবায়িত হয়নি মিয়ানমারের কূটকৌশল এবং বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে মোলায়েম দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।
রোহিঙ্গাদের 'সন্ত্রাসী' হিসেবে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রচারণা তাদেরকে নির্যাতিত মানুষ হিসেবে তুলে ধরার তুলনায় বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী অভিধা বর্তমান যুগের মুসলমানদের কিছু গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কাজের কারণে বলা যায়, কোনো কোনো দেশের কাছে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু রোহিঙ্গাদের তাদের পর্যায়ভুক্ত করা এক বড় ভ্রান্তি। ২৯ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় চীন ও রাশিয়ার প্রতিনিধির বক্তব্যে মিয়ানমারের প্রতি পক্ষপাত ফুটে উঠেছিল। চীনা প্রতিনিধি বলেছিলেন, রাখাইনের পরিস্থিতি শান্ত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হযেছে। রাখাইনের পরিস্থিতি এখন ক্রমেই স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। মিয়ানমার সরকারকে যে অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে দেখতে হবে। অন্যদিকে রুশ প্রতিনিধি বলেছিলেন, রাখাইনের পরিস্থিতি সমাধানে এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের বক্তব্যের অনেক পরও মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের বর্বরতা চালিয়ে গেছে।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে নতুন করে রোহিঙ্গা সংকটের সূত্রপাত হওয়ার পর যে জোরালো আন্তর্জাতিক মত তৈরি হয়েছিল, তা প্রধানত মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীকে কোণঠাসা করে দেওয়ার মতো বিষয় ছিল। তা থেকে উত্তরণ লাভে মিয়ানমার তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটা 'অ্যারেঞ্জমেন্ট' করেছিল, যা অনুসরণ করে প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মিয়ানমার ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করেছে, আবার বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও বিদেশি ত্রাণ সংস্থাকে দায়ী করেছে রোহিঙ্গাদের ফিরে না যেতে প্ররোচিত করার জন্য। বলা বাহুল্য, এ ধরনের সমালোচনায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে অবশ্যপালনীয় শর্ত পূরণ করার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে অংশ নেওয়ার সঙ্গে বেজিং সফর করে চীনের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার অংশ হিসেবে ৯টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর। তবে বাংলাদেশের দিক থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা তার সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে বিবেচিত হয়েছে। প্রথমে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং-এর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন তিনি। পরদিন চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে বৈঠক করেন। চীনা পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস এসব বৈঠক নিয়ে যে সংবাদ পরিবেশন করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, চীনা পক্ষ দু'দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি করে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ অব কো-অপারেশনকে এগিয়ে নেওয়াসহ 'রোড অ্যান্ড বেল্ট' প্রকল্প নিয়ে কথা বলেছে। সেখানে রোহিঙ্গা বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে চীনা দুই নেতাই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারকে প্রভাবিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলে উল্লেখ আছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট শি প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে বলেছেন, তার দেশ আগেও রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেছেন, মিয়ানমারের তরফ থেকে একটি প্রতিনিধি দল শিগগির বাংলাদেশ সফর করবে এবং তাতে সংকট নিরসনের আরেকটি সুযোগ তৈরি হবে।
তাদের সংবাদমাধ্যম বিষয়টির উল্লেখ না করলেও বিশ্বাস করার কারণ আছে যে, দুই পক্ষ এ নিয়ে আলোচনা করেছে। বিষয়টি উল্লেখ না করা মিয়ানমারকে নিয়ে চীনা কোনো কৌশলের অংশ হতে পারে। তবে রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হলে এর প্রভাবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক অভিঘাত ফেলবে বলে বাংলাদেশ মনে করে। তাতে মিয়ানমারে চীনের যে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ আছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করা যায়। তা ছাড়া চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের আলোকে চীনা পক্ষকে ইস্যুটি নিয়ে ভাবার জন্য বাংলাদেশের দিক থেকে বলাই স্বাভাবিক।
লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্নেষক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই বিভাগের আরো সংবাদ