আজকের শিরোনাম :

পথে পথে বাধা

  সুভাষ সিংহ রায়

০৪ জুলাই ২০১৯, ০৯:৫৯ | অনলাইন সংস্করণ

আমাদের ঢাকা শহরে জনসংখ্যা কত? বলা মুশকিল, যেদিকে তাকাব সেদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। দিনে মানুষ, রাতে মানুষ। দুপুর ২টায় মানুষ, রাত ২টায় মানুষ। ঢাকা মহানগরীর রাস্তার কথা বলছি। আসলে কি ঢাকা শহর খুব একটা বড়। আমার তো তা মনে হয় না। গাদাগাদি করা মানুষ, গাদাগাদি করা গাড়ি। এ কারণেও ঢাকাকে বড় দেখায়। দু-তিন দশক আগে শুনতাম। ‘কলকাতা আছে কলকাতাতেই’—এক বিখ্যাত বইয়ের নাম। বলা বাহুল্য, নিশ্চয়ই কলকাতা কলকাতাতে নেই। অনেক অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কতটা ভালো, কতটা খারাপ, সেটা নিয়ে লম্বা আলোচনা হতে পারে। সত্তরের দশকের কলকাতা, আশির দশকের কলকাতা, নব্বইয়ের দশকের কলকাতা কী যে দুর্বিষহ ছিল, সেটা অভিজ্ঞজনরা ভালো বলতে পারবেন। যানজট ছিল ভয়াবহ। তখন আমাদের ঢাকা ছিল অনেক অনেক ভালো। ইদানীং আমরা সুযোগ পেলেই কলকাতায় যেতে পারি। ভিসাপ্রক্রিয়া অনেক সহজ হয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাস ১৪ লাখের মতো ভিসা দিয়েছে। তার মানে একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ঢাকা থেকে কলকাতায় যাচ্ছে। রাজশাহী থেকে যাচ্ছে, খুলনা থেকে যাচ্ছে, দিনাজপুর থেকে যাচ্ছে, রংপুর থেকে যাচ্ছে, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে যাচ্ছে। বাসে যাচ্ছে, ট্রেনে যাচ্ছে, বিমানে যাচ্ছে। কলকাতার উদাহরণ এসেছে সংগত কারণে। যানজট ব্যবস্থাপনা কতটা স্বস্তি এনে দিতে পারে তার উত্কৃষ্ট উদাহরণ ‘এখনকার কলকাতা’। আমরা এখনো ‘স্পিড গান’ ব্যবহার করতে পারিনি। শহর কলকাতা ও বিস্তৃত কলকাতা, যেখানেই যান না কেন, গাড়ির গতি বাড়লেই এসএমএস। নির্ঘাত কম করে হলেও ৩০০ রুপি জরিমানা। আমাদের ঢাকায় লাল লাইট জ্বললে ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি চালাতে বলে, সবুজ লাইটে থামতে বলে।

এখন অবস্থাটা খুবই দুর্বিষহ, অসহনীয়। গুলশান থেকে মতিঝিল যেতে-আসতে কম করে চার ঘণ্টা। লালমাটিয়া থেকে এয়ারপোর্ট যেতে কম করে দুই ঘণ্টা। এই মহানগরীর নাগরিকদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। এখানে নাগরিকদের সময় ব্যবস্থাপনা বলতে কিছু নেই। সড়ক ব্যবস্থাপনা পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের অবস্থা খুবই করুণ। পৃথিবীর একমাত্র নগরী, যেখানে মোটরসাইকেলচালক, রিকশাচালক, লেগুনাচালক, মিনিবাসচালকদের কোনো আইন মানতে হয় না। উল্টো পথে রিকশা যাবেই, মোটরসাইকেলচালকদের কে ঠেকায়। এখন আবার এসেছে পাঠাও। কোনো বাধাই তারা মানে না। ফুটপাতে গাড়ি ওঠাবেই। প্রতিদিন পঙ্গু হাসপাতাল গেলেই দেখা যায় মোটরসাইকেল অ্যাকসিডেন্টে আহতের সংখ্যা সর্বাধিক। মিনিবাস কখনোই আইন মেনে চলবে না। এত অনিয়ন্ত্রিত গণপরিবহন সারা দুনিয়ার কোথাও নেই। গণপরিবহনের অর্ধেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। বিশেষ করে খুব সকালবেলার দিকে বেশির ভাগ গাড়ি চালায় অপ্রাপ্ত বয়স্করা, অর্থাৎ কিশোর বয়সী হেলপাররা তখন চালক বনে যায়। এটাই যেন আমাদের এখানকার স্বাভাবিক বিষয়। গণপরিবহন কতটা অনিরাপদ হয়ে গেছে, তা ভালো করেই বোঝা যায়। আমরা পথচারীরা যেন পথভোলা পথিক। প্রায় সবাই মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হই। রাস্তা পারাপার কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তা দেখতে বিশ্বের যেকোনো দেশের নাগরিকদের ঢাকা শহরে ভ্রমণে আসতে হবে। আবার সাধারণ মানুষ বলে যাদের ভেবে থাকি, তারাই বা কী করছে? ফুট ওভারব্রিজ বাদ দিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে রাস্তা পারাপার করে থাকে। আমাদের দেশে সাধারণ মানে তারাই, যারা কোনো কিছু তলিয়ে ভাবে না। গণপরিবহনে বসে থেকে বা দাঁড়িয়ে থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাইরে হাত বের করে রাখি।

২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ‘হাইড্রোলিক হর্ন’ ব্যবহার করা যাবে না। ট্রাক থেকে শুরু করে সিএনজিচালিত অটোরিকশা (তিন চাকার) পর্যন্ত হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করছে। এই হচ্ছে আমাদের নাগরিক সচেতনতার সার্বিক চিত্র।

ঢাকা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দিন দিন ভেঙে পড়ছে, দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকার সড়কে এখনো ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় চলছে গাড়ি। লাল-সবুজ আর হলুদ বাতিগুলো জ্বলুক আর না জ্বলুক গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হয় ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায়। ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্যে দেশ এগিয়ে গেলেও ট্রাফিক সিস্টেম এখনো অ্যানালগ পদ্ধতিতে চলছে। মানা হচ্ছে না কোনো সিগন্যাল।

২০০৯ সালের ২২ নভেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক প্রকল্প শেষ হয় এবং রাস্তায় তা চালুও হয়। কিন্তু এখনো সেই পুরনো নিয়মেই চলছে রাজধানীতে ট্রাফিক ব্যবস্থা।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্টের আওতায় ২০০৫ সালে রাজধানীর ৫৯টি সড়কের মোড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ শুরু হয়।

স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পদ্ধতি স্থাপনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হলেও দুই বছরের মাথায় সব সিগন্যাল বাতি অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ ছাড়া যানবাহনের চাপের ওপর ভিত্তি করে বাতি জ্বলা-নেভার সময় নির্ধারণ না করা, চালকদের সিগন্যাল বাতি মেনে চলায় অনীহা, বিদ্যুৎ না থাকাসহ নানা অজুহাতে তা মানা হচ্ছে না।

আইনটি চালুর সময় অমান্যকারী চালকদের জন্য এক হাজার টাকা জরিমানা, তিন মাসের জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল এবং নকল লাইসেন্সধারী চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে বলে জানানো হয়েছিল।

স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পদ্ধতি স্থাপনে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হলেও বর্তমানে কয়েকটি স্থান বাদে রাজধানীর প্রায় সব সিগন্যাল বাতি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পুলিশ হাতের ইশারায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে বর্তমানে সিগন্যাল বাতি কার্যকর করার কোনো পদক্ষেপ নেই।

যানজটের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে নিয়ম না মানার অভ্যাস। সিগন্যালের যন্ত্র তো যন্ত্রের মতোই কাজ করে। কিন্তু কার আগে কে যেতে পারে, সেটা নিয়ে সবার প্রতিযোগিতা।

রাজধানীতে স্বল্প সময়ে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শহরে চলাচলের সময় গাড়ির মূল দরজা বন্ধ রাখা, অটো সিগন্যাল এবং রিমোট কন্ট্রোল অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগন্যালিং পদ্ধতি চালুসহ বেশ কিছু নির্দেশনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ৮৮টি সড়ক-মোড়ের মধ্যে ৬২টি ইন্টারসেকশনকে রিমোট কন্ট্রোল অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগন্যালের আওতায় আনা হচ্ছে। যন্ত্রের মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করে রিমোট কন্ট্রোল ব্যবস্থায় ট্রাফিক পুলিশ বক্স থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে এই সিগন্যাল বাতিগুলো চালু করার উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন। তবে এতে সময়ের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থাকবে সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক পুলিশের কাছে। রিমোটের মাধ্যমে এটি কন্ট্রোল করা হবে। আপাতত স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের মাধ্যমে নগরীর ২০টি স্থানে ট্রাফিক কন্ট্রোল চালু করে যানবাহনচালকদের জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাতায়াতে এই অসহনীয় পরিস্থিতির প্রধান কারণগুলোর একটি ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা এবং এই ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার পেছনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ঢাকা শহরে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের যানবাহনগুলো। এ শহরে ফুটপাত দিয়ে মানুষ হাঁটতে পারে না। বলতে গেলে গোটাটাই হকারদের দখলে থাকে।

আমরা শিক্ষিতরা বেশি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাই। একবার এক রিকশাওয়ালা ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ সব কিছুর সমাধান কোথায়? মজার এক কথা শুনেছিলাম। ‘স্যার, আইন বদলায় দেন। আমরা রিকশাওয়ালা আইন না মানলে দু-চার ঘা দিয়ে দেন। কিন্তু আমাদের লাঠির মার খেতে খেতে অভ্যেস হয়ে গ্যাছে। আর বড়লোকদের ৫০০ ও এক হাজার টাকা জরিমানা করে। আমাদের লাঠির মার গায়ে লাগে না। বড়লোকদের ৫০০ টাকা-এক হাজার টাকা গায়ে লাগে না। আমাদের ৫০০ টাকা জরিমানা করেন। আর না দিলে হাজতে পাঠান। আর বড়লোকদের পাঁচটা না হলে দুইটা লাঠির বাড়ি দেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আমরা বলে থাকি, সচেতন নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা বিশেষভাবে জরুরি। পাড়া-মহল্লার রাস্তার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় উচ্চবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের শিক্ষিত মানুষরা কতটা দায়িত্বজ্ঞানশূন্য। নিজের বাড়ির সামনের ফুটপাতে ময়লা ফেলে রাখে। পাড়া-মহল্লার রাস্তার অবস্থা ভালো না। বড় বড় গর্তে বিপদাপন্ন হয়ে থাকে। রাস্তা মেরামতে দুর্নীতি তো আছেই, ভদ্রলোকদেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। পানি নিষ্কাশনের সব পথ আমরা বন্ধ করে রাখি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের ১৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের মধ্যে কয়জন সঠিকভাবে কাজটি করছেন? কাজের লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমরা ভালো করেই জানি, কয়জন সে দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করে থাকেন?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলাম লেখক, গবেষক, প্রধান সম্পাদক (এবিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম)।

এই বিভাগের আরো সংবাদ