আজকের শিরোনাম :

চিরকাল ট্র্যাজিক নায়ক হয়েই কি থাকবেন রাহুল গান্ধী?

  রাজদীপ সরদেশাই

০২ জুলাই ২০১৯, ১৫:০১ | অনলাইন সংস্করণ

একজন রাহুল গান্ধী হয়ে ওঠাও চাট্টিখানি কথা নয়! তাঁর পরিচয় শুধুমাত্র এই নয় যে তিনি একটি রাজবংশের প্রতিনিধি। এহ বাহ্য, তিনি একটি ঐতিহ্যময় সাম্রাজ্যের পঞ্চম উত্তরসূরিও। দেখতে দেখতে মোতিলাল নেহরুর কংগ্রেসের সভাপতির আসন অলংকৃত করার পুরো একটা শতক কেটে গেল। ইতিমধ্যে আনন্দ ভবন ঘিরে অনেক জল গড়িয়েছে। মোঘল সাম্রাজ্যের বিস্তার ও স্থায়িত্ব উদাহরণ হিসাবে কাছাকাছি আসতে পারে। নইলে আর তো কোনও বংশানুক্রমিক নেতৃত্বের কথা মনে পড়ছে না, যা নেহরু-গান্ধী ঐতিহ্যের তুল্যমূল্য টক্কর হয়ে উঠতে পারে।

কিন্তু আজ, যথেষ্ট ক্যাঁচম্যাচ শব্দ তোলা সেই সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার এমন একজনের হাতে সঁপে দেওয়ার তোড়জোড় চলছে, যাঁর কাছে সাম্রাজ্যের কৌলীন্য অক্ষুণ্ণ রাখার খিদে, চাহিদা বা আকুলতা ততটাও আগ্নেয়ও নয়। তদুপরি রাহুল গান্ধী যখন সদ্যনির্বাচনী পরাজয়ের যাবতীয় খামতি ও দায়ভার নিজের কাঁধে নিয়ে সভাপতিত্ব থেকে অব্যাহতি চাইছেন– যে কাজটা গণতন্ত্রের দিক থেকে এবং পরিস্থিতির দিক থেকেও একশো শতাংশ ঠিক- তখন দল সেই সিদ্ধান্তকে সাদরে গ্রহণ করার বদলে ‘গান্ধী-নেহরু বংশের প্রতিনিধি ছাড়া আমরা কোথা যাই’ অবস্থান নিয়ে বসে আছে। একটি রাজনৈতিক দলের গতিবিধির সঙ্গে প্রাচীন ভারতের একটি রাজশাসনের তুলনা টানা অনেকের উচিত মনে নাও হতে পারে। কিন্তু সত্যি এই যে- কংগ্রেস গত ৫০ বছরে পরিবারতন্ত্রের কারাগারে আটকে পড়েছে। যে দল একদা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল, কী আশ্চর্য, সেই দলটি অভ্যন্তরীণ সংগঠন মজবুত করার স্বার্থে গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে শুদ্ধিকরণের পথে কখনওই হাঁটেনি! সাতের দশকে ইন্দিরা গান্ধী যখন তাঁর সন্তান সঞ্জয় গান্ধীকে রাজনীতির আলোয় আনলেন, এবং পরে অনিচ্ছুক রাজীব গান্ধীকেও ঠেলে দিলেন রাজনীতির ময়দানে- সেই সময়ই বোঝা গিয়েছিল, কংগ্রেস দলটির সঙ্গে পরিবারতন্ত্রের যোগাযোগ মা ও ভ্রূণের সম্পর্কের মতোই অচ্ছেদ্য।

তা, কংগ্রেস কি সত্যিই গান্ধী-নেহরু পারিবারিক সমীকরণ ছাড়া, বংশ-নামের শিরস্ত্রাণ বিনা, এক পা-ও চলতে পারে না? ৫০ বছরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের দলিল বলছে, দু’টি অধ্যায়ে, যখনই কংগ্রেসের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল গান্ধী-নেহরু পরিবারের বাইরের কারও কাঁধে– দল অনিশ্চয়তায় দীর্ণ হয়েছিল। কাতর হয়ে উঠেছিল অবিরাম বিশৃঙ্খলায়। ১৯৯১-’৯৬। পি. ভি. নরসিমা রাওয়ের নেতৃত্বে কেন্দ্রের সংখ্যালঘু সরকার সাফল্য ধরে রাখতে পারলেও চিড় ধরেছিল পার্টির অভ্যন্তরে। অর্জুন সিং, এন. ডি. তিওয়ারি-সহ বেশ কিছু নেতা দল থেকে সরে যান। কূটাভাস মেলে: এই ভাঙন ও অবনমনের পিছনে নাকি গান্ধীদেরই ভূমিকা ছিল প্রবল। আরও একটা অধ্যায় এসেছিল নরসিংহ রাওয়ের নেতৃত্বের প্রায় পিছনে পিছনে, যখন সীতারাম কেশরী উঠে এসেছিলেন নেতৃত্বের শীর্ষে। তিনি হতে পারেন গান্ধী-নেহরু পরিবারের বিশ্বস্ত, কিন্তু আখেরে তো পরিবারের কেউ নন। সেটা ছিল এক ধরনের ক্ষণস্থায়ী বন্দোবস্ত। তার বেশি কিছু নয়। আর যেভাবে রাতারাতি তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার সঙ্গে রক্তপাতহীন সেনা অভ্যুত্থানের খুব মিল পাওয়া যায়। সৌজন্য, শিষ্টাচার ও ভদ্রতার লেশ তাতে ছিল না।

এরপর শুরু হয় সোনিয়া-সাম্রাজ্য। তিনিই এখনও অবধি সবচেয়ে বেশি দিন পদ অলংকৃত করা কংগ্রেস সভাপতি। ১৯ বছর সভাপতি ছিলেন। কিন্তু এই ১৯ বছরে তিনি কি আদৌ পেরেছিলেন দলের ভাগ্য-চাকা ঘোরাতে? কিছু কৃতিত্ব নিশ্চয়ই তিনি দাবি করতে পারেন। তাঁর আমলেই কংগ্রেস স্থায়ী জোট গঠনে মুন্সিয়ানা অর্জন করেছিল। শরদ পাওয়ারের মতো বিরুদ্ধ-নেতার আস্থাও তাঁর আমলেই কংগ্রেস অর্জন করেছিল। এটা বিরাট ব্যাপার! কারণ শরদ পাওয়ার বরাবর সোনিয়া গান্ধীর ‘বিদেশি’ তকমায় বাতাস দিয়ে গিয়েছেন। সেই অস্থির সময়ে সোনিয়া গান্ধী যেভাবে কারিগরি দক্ষতায় অন্য দলের সঙ্গে জোট বুনেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে তারিফযোগ্য। দল এতে স্থিতি পায়। সোনিয়াজির নেতৃত্বও প্রশ্নের মুখে পড়েনি। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ‘জননেত্রী’ রূপে তাঁর সীমাবদ্ধতা আছে। তেমনই বুঝেছিলেন, ভোট আকর্ষণ করার সম্মোহনী ক্ষমতাও তাঁর সীমিত। তাই তিনি নেপথ্যেই রয়ে যান, মেঘনাদ হয়ে। তা সত্ত্বেও এ প্রশ্ন উঠবে যে, কংগ্রেসকে কি তিনি ভোটসফল দল রূপে প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছিলেন? কারণ, এ দেশে ভোটই সবচেয়ে বড় বালাই। নাহ, তেমনটা বলতে পারছি কই!

১৯৯৯ সালে ১১৪টি আসন জিতে সোনিয়াজির যে-যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার শেষ পর্যায়ে ২০১৪ সালে, আমরা দেখি যে, কংগ্রেস দেশজুড়ে মোটে ৪৪টি আসন জিতেছিল। অগ্রগমনের বদলে অবনতি ও স্খলন ঘটে। সংগঠন হয়ে ওঠে ভঙ্গুর ও প্রতি-আক্রমণ সহ্য করার পক্ষে খুকু-হাড্ডিসার। দলের ক্রমান্বয়িক নামতে থাকা, মাটিতে পা গেঁথে যাওয়ার বিপন্নতা কোনওভাবেই সারিয়ে তুলতে পারেননি তিনি। ব্যতিক্রম, ২০০৯। বিজেপির ভুল রণনীতির কারণেই সেবার কংগ্রেসের উত্থান ঘটে। প্রবৃদ্ধ লালকৃষ্ণ আডবানীকে ‘নেতা’ হিসাবে তুলে ধরে বিজেপি রণনৈতিক ভুল করেছিল। অন্যদিকে, ইন্দো-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তির সময় সিদ্ধান্তে অটল থেকে মনমোহন সিং অর্জন করেছিলেন ভারতবাসীর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস।

আসলে, গত তিন দশকে কংগ্রেসের শুধুই অবনমন ঘটেছে। ক্রমাগত তাচ্ছিল্যের দিকে অগ্রসর হয়েছে দলটি। ১৯৮৪-তে ইন্দিরা গান্ধীর অমন দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু না ঘটলেও যে এমনটা ঘটত না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। আটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আস্তে আস্তে কংগ্রেসের পায়ের তলা থেকে জমি পিছলে যাচ্ছিল। আদর্শগত অবক্ষয়, মিইয়ে পড়া নেতৃত্ব, সাংগঠনিক একতার অভাব, স্বেচ্ছাচারী হাইকম্যান্ড-নির্ভর রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে তৃণমূল স্তরের উৎসাহী কর্মীদের সংযোগহীনতা ও দূরত্ব- কংগ্রেসের বিপর্যয়ের কারণ। আর একটা পর্যায়ে, এই ইন্দ্রপতনকে, কাকতালীয় হলেও, বিজেপির উত্থানের বিপরীত ভাষ্য বলে মনে হবে। সে সময় ছিল বাজপেয়ী-আডবানীর মতো অদম্য হিন্দুত্ববাদী নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ। আর, এখন কংগ্রেসের মহড়া নিচ্ছে মোদি-শাহ জুটি, যার সমতুল্য ভোট-চুম্বক মেশিনারি আর কারও নেই।

২০১৪-য় কংগ্রেসে যে ধস নামে, সেই বিপর্যয় থেকে রাহুল গান্ধী কি পাঁচ বছরে দলকে তুলে আনতে পারতেন? না কি তিনিও শেষমেশ এই পরিবারতন্ত্র জারিত দলগত সমস্যার অংশভাগ হয়ে যাবেন? এটাই ছিল সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা। বাস্তবে, কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে রাহুল গান্ধীর অবস্থান নরেন্দ্র মোদিকে ‘কামদার বনাম নামদার’-এর ন্যারেটিভ ভাঙাতে আরও সুবিধাই করে দিয়েছিল। এবারের নির্বাচনের একটি প্রচার-ছবির কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিই। রাহুল গান্ধী আমেঠিতে মনোনয়ন পত্র পেশ করতে যাচ্ছেন ধুমধাম করে। সঙ্গে কে কে যাচ্ছেন? না, বোন প্রিয়াঙ্কা, ভগ্নিপতি রবার্ট ভডরা এবং ভাগনে-ভাগনিরা। আর কী বলার থাকতে পারে? কে বিশ্বাস করবে, এই দলটাই এক সময় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করেছিল? অথচ, আজ সেই দলটিই একটি পরিবার-সর্বস্ব মুখের মিছিলে পর্যবসিত হয়েছে!

আরও সত্যি হল, কংগ্রেসের দলীয় সংকট ব্যক্তি-সংকটকে এতদিনে অতিক্রম করে গিয়েছে। তারা এ যাবৎ মেনেই নিতে পারেনি, বা মেনে নিলেও মুখোমুখি হতে চায়নি যে কথাটার, তা হল– ‘কংগ্রেস’ কী এবং তা কীসের তরফদারি করছে? কংগ্রেস একটি বড় ‘ব্র‌্যান্ড’। এটা সত্যি। অনেক দিকপাল নেতানেত্রী আছেন দলে। এটাও ঠিক। কিন্তু এরপরেও তো এই দলের একদফা সংস্কার দরকার, শুদ্ধিকরণ দরকার। দরকার নতুন উদ্ভাবনের। কংগ্রেস কিছুতেই প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক ভাবমূর্তির ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না। ক্ষমতার টইটম্বুর মৌচাক হয়ে ওঠা থেকে বিরত থাকতে পারল না। পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি দূরে ঠেলে এই দলটি পারল না সবল গণ সংগঠনের রূপ পরিগ্রহ করতে। যেখানে মেধা ও যোগ্যতার স্থান হবে সবার উপরে। যেখানে বংশলতিকা চূড়ান্ত কথা বলবে না। কিন্তু কংগ্রেস না পারল নিচুতলার কর্মীদের প্রাণবন্ত করে তুলতে, না পারল কর্মীদের আরও বেশি করে জনতার আবেদন নিয়ে জনতার হয়ে জনতার স্বার্থ সুরক্ষিত করার জন্য এগিয়ে দিতে।

গান্ধী-নেহরু তকমা বাদ দিয়েও কংগ্রেস ফুলেফেঁপে উঠতে পারবে- তা যদি ধরেও নেওয়া যায়- মনে রাখতে হবে, অন্তর্লীন রক্তক্ষরণের বিপদ কিন্তু আজ অনেকটাই চারিয়ে গিয়েছে। মহারাষ্ট্রে শরদ পাওয়ার, পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এখন অন্ধ্রতে জগন রেড্ডি– দেখিয়ে দিয়েছেন মাতৃকাস্বরূপ দলটি থেকে বেরিয়ে এসেও অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়, আঞ্চলিক শক্তি রূপে পেশি প্রদর্শনও করা যায়। এই কারণেই বলব, রাহুল গান্ধী যে পদত্যাগ করতে চাইছেন, তা মোটেই তেমন ভুল সিদ্ধান্ত নয়। এটাই হয়তো বা উপায়, যে পথে হেঁটে কংগ্রেস এবং রাহুল গান্ধী নিজেও, পুনর্গঠন সম্পূর্ণ করে তুলতে পারবেন। এই সম্ভাবনার দু’টি দিক খুবই উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, নিজের ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে হয়তো রাহুল গান্ধী আরও প্রগতিশীল জননেতা হিসাবে উঠে আসতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেসও নতুন প্রজন্মের আঞ্চলিক নেতৃত্ব তৈরি করার ঝুঁকি নেওয়ার অবকাশ পাবে।

এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্ব তারা মহারাষ্ট্র থেকেই শুরু করতে পারে। যে রাজ্য ছিল এককালীন কংগ্রেস দুর্গ। যে রাজ্যে এখন গেরুয়া রঙের সমুদ্রঢেউ ক্রমশ উঁচু হয়েই চলেছে। উত্তরপ্রদেশ বাদ দিলে, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসের এই অবনমন আরও সাম্প্রতিক। রাহুল গান্ধীর পক্ষে এই তো সময় দিল্লির আভিজাত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে জনতার মাঝে যাওয়ার। মহারাষ্ট্রের নানা প্রান্ত খরার ভূত দেখছে। এদিকে, অক্টোবরে আবার বিধানসভা নির্বাচন। এমন সময়ে, রাহুল তো রাজ্য জুড়ে ১০০ দিনের পদযাত্রার পরিকল্পনা করতেই পারেন। মানুষের মাঝে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে পারেন কৃষিসমস্যার হাল-হকিকত। ৩৫০০ কিলোমিটারের এক পদযাত্রাই কিন্তু জগন রেড্ডির রাজনৈতিক কেরিয়ার পালটে দিয়েছিল। রাহুল কি পারবেন জগনের মতো হেঁটে বদলাতে? না কি শেক্সপিয়রের ‘ট্র‌্যাজিক নায়ক’ হয়েই শেষ করতে চাইবেন রাজনীতির দৌড়? শেক্সপিয়রের সেই নায়ক, যে কী করতে চায় নিজেই জানে না, সেজন্য দ্বিধায় ভুগে দণ্ড পায়! রাহুলের এই ভূমিকা যে কংগ্রেসের পক্ষে আরও দুর্বহ হয়ে উঠবে, তা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না।

পুনশ্চ: কংগ্রেসের তুমুল ব্যর্থতার ফল বেরনোর পরের দিন, একজন বরিষ্ঠ কংগ্রেস নেতা আড়ালে বলছিলেন: মোদি-চ্যালেঞ্জের বিপরীতে রাহুল যে সাঁতার কাটতে ব্যর্থ হলেন, তার কারণ নাকি সুপরিকল্পিত নির্বাচনী স্ট্র‌্যাটেজি না থাকা। এর পরের দিনই সে নেতাকে পাওয়া গেল সেই ভিড়ের সর্বাগ্রে, যে ভিড় রাহুলকে ‘যেতে নাহি দিব’ বলে হাহাকারে মথিত হচ্ছিল!

লেখক : সংবাদ উপস্থাপক

এই বিভাগের আরো সংবাদ