আজকের শিরোনাম :

সত্য কথাতো সকলে পছন্দ করে না

  আবদুল মান্নান

২৯ জুন ২০১৯, ১৮:৫৫ | অনলাইন সংস্করণ

বর্তমান যুগে সত্য কথা বলা সকলে পছন্দ করে না। আর এই সত্যটা যদি তার বা সমগোত্রীয়দের বিরুদ্ধে যায় তা হলেতো কথাই নেই। শুরুতেই ১৯৭৫ সালে জাতীয় সংসদে বাকশাল গঠনের পর বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণ হতে সামান্য কিছু উদ্বৃতি দিতে চাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশটা  রাতারাতি একশ্রেণীর টাউট, বাটপার, ধান্ধাবাজ, টেন্ডারবাজ, চোরাকারবারি, মজুদদার আর চশমখোরদের দখলে চলে যায়। সকলে তখন হয় মুক্তিযোদ্ধা অথবা আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড গলায় ঝুলিয়েছে। দেশে এই সব দুর্বৃত্তদের কারণে এক ধরণের অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। এদের অনেকে মুদিদোকানদার হতে ব্রীফ কেস নির্ভর ব্যবসায়ী বনে যায় রাতা রাতি। কী করেন তা জানতে চাইলে সোজা সাপটা উত্তর ‘ফ্লাইং বিজনেস’, মানে যখন যে ব্যবসা সুবিধার তখন সেই ব্যবসা। তখন যুদ্ধ বিধ্বস্থ বাংলাদেশে সব চেয়ে লাভবান ব্যবসা হচ্ছে চোরাকারবারি অথবা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদদারী। এমন অরাজক অবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করলেন। আসলে এটি কোন রাজনৈতিক দল ছিল না। ছিল একটা প্লাটফরম।

যারা দেশের স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে তাদের সকলকে তিনি এক পতাকা তলে আনার জন্য এই ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে আওয়ামী লীগ ছাড়াও গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিষ্ট পার্টি, বিভিন্ন পেশাজীবী ব্যক্তিবর্গ, সিভিল সোসাইটির সদস্যরা স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন চারিদিকে যে ভাবে দেশের শত্রুরা কিলবিল করছে তাদের সকলকে প্রতিহত হরতে হলে দেশপ্রেমিক সকল দল ও গোষ্ঠিকে এক প্লাটফরমে এনে একটি সহায়ক ব্যবস্থা তৈরি  করতে হবে। কিন্তু জাতির দূর্ভাগ্য এই ব্যবস্থার সঠিকভাবে প্রণয়ন হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। ১৯৭৫ সালে সংসদে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন “আওয়ামী লীগ একটি মাল্টি-ক্লাস পার্টি। আমি তার নামের আগে কৃষক শ্রমিক লাগিয়েছি বৈকি, কিন্তু দলটির চরিত্র এখনও বদলাতে পারিনি, রাতারাতি সব সম্ভবও নয়। আমার দলে নব্য-ধনীরাও আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তাদের লুটপাটের সুযোগ বহুগুণ বেড়ে গেছে। আমি তাদের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই বাকশাল করেছি। যদি এই ব্যবস্থা সফল করতে ব্যর্থ হই এবং আমার মৃত্যু ঘটে তাহলে দলকে কব্জা করে ওরা আরও লুঠপাটে উন্মত্ত হয়ে হয়ে উঠতে পারে। এমনকি শত্রুপক্ষের নীতি ও চরিত্র অনুসরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের মূলমন্ত্র, এমনকি আওয়ামী লীগের চরিত্র ও নীতি পাল্টে ফেলতে পারে। যদি তা হয়, সেটাই হবে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু। সেজন্য আগেই বলেছি, আমার দল, আমার অনুসারীদের হাতেই যদি আমার এই দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে তাহলে দীর্ঘকালের জন্য বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে যেতে হবে। কবে ফিরব তা জানি না ।” বঙ্গবন্ধু একজন অসম্ভব দূরদর্শি শুধু নেতা নন রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। সংসদে তাঁর এমন সাহসী বক্তব্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাতারাতি গজিয়ে উঠা ‘ফ্লাইং বিজনেসম্যান’ আর নব দুর্বৃত্তদের পছন্দ হয় নি।

বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তি কালে এদের অনেকেই উল্লাস করেছিলেন আর জিয়া ক্ষমতা দখল করে এই সব দুর্বৃত্তদের নিয়েই তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। কালো টাকা সাদা করার সংষ্কৃতি তিনি চালু করেছিলেন এই অজুহাতে যে সেই টাকা শিল্পে বিনিয়োগ হবে। পানির দরে তিনি রাষ্ট্রায়িত্ব কলকারখানা তার বশংবদ লুঠেরাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তারই ধারাহিকতায় বিশ্বের বৃহত্তম পাটকল আদমজী তাঁর স্ত্রী বেগম জিয়া বন্ধ করে দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিককে রাতারাতি বেকার করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের খুব ভালবাসতেন। তাদের উপর অতিমাত্রায় বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তিনি জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন তাঁর কাছের মানুষের উপর এত বেশী আস্থা আর বিশ্বাস একটি মারাত্মক ভুল ছিল। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কী একই ভুল করছেন? এই প্রশ্ন এখন অনেকের। গত ঈদে ঢাকার বাইরে গিয়ে এমন প্রশ্ন শুনতে হয়েছে একেবারেই সাধারণ মানুষের কাছে যারা বঙ্গবন্ধু কন্যাকে মন থেকে ভালবাসেন। যাদের কাছে আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম অর্থহীন তারা এত ভাল ভাল পদে পদায়ন কী ভাবে হলো জানতে চায় তারা। বলা বাহুল্য সেই প্রশ্নের উত্তরতো আমার কাছে নেই।

ধন্যবাদ জানাতে চাই দেশের নূতন প্রজন্মের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে যিনি গত রবিবার জাতীয় সংসদে দেশের তিনশত শীর্ষ ঋণখেলাপির একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন যাদের কাছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা একান্ন হাজার কোটি টাকা আর ঋণের উপর দেয় সুদ মওকুফ করা হয়েছে এক বছরে ১২০০ কোটি টাকা। এর অর্থ হচ্ছে এরা জনগণের টাকা নিয়ে নানা ছলচাতুরি করে তারা ফেরত দিচ্ছেন না, সাধারণ কথায় এরা জনগণের তথা রাষ্ট্রের এই বিশাল পরিমাণের অর্থ মেরে দিয়েছেন।  

পূর্বের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমন ত্রিশজনের একটা তালিকা সংসদে প্রকাশ করেছিলেন। যেই পরিমাণের ঋণ খেলাপি হয়েছে সেই পরিমাণের অর্থ দিয়ে দু’টি পদ্মাসেতু তৈরী সম্ভব। সিলেটের কুলাউড়ায় রবিবার রাতে ট্রেন দূর্ঘটনায় কম পক্ষে পাঁচজন নিহত হলে রেল মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন ট্রেনে মানুষ হুড়াহুড়ি করে উঠতে গিয়ে এই দূর্ঘটনা ঘটেছে। ভাগ্যিস অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেননি দেশের কোষাগারে এত বিশাল পরিমাণের অর্থ জমা থাকলে চুরির পরিমাণটাও একটুতো বেশী হবেই। এই বিশাল পরিমাণের অর্থ যারা মেরে দিয়েছেন তাদের কোম্পানির নাম প্রকাশ করা হয়েছে দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বোর্ডের চেয়ারম্যানের বা মালিকের নাম প্রকাশ করা হয় নি। এটি নিছক জনগণের অর্থ নিয়ে শুধু খেলাপি হওয়া বিষয় নয় এটি একেবারেই রাষ্ট্রের কোষাগার হতে অর্থ লুঠ করা। যারা এই কাজটি করেছে তারা সমাজে যে খুব বেশী অপরিচিত তাও নয় আর এই কাজটি কোন একটা সরকারের আমলে ঘটেছে তাও নয়। যারা করেছে এটি তাদের স্বভাব। যেমন প্রধানমন্ত্রী প্রায়শঃ বলে থাকেন সরকারি কর্মচারিদের এত বেতন ভাতা বৃদ্ধির পরও তারা কেন দূর্নীতি করেন? দূর্নীতির সাথেতো বেতন ভাতার কোন সম্পর্ক নেই। এটাতো লোভ আর অভ্যাস। যারা ঋণখেলাপী হয়েছেন তারা সমাজে খুব অপরিচিত নন। তাদের অধিকাংশের পরিচয় তারা শিল্পপতি।

পরিবারের সদস্যদের প্রায় কেউ দেশে থাকেন না। সকলে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, কানাডা, বৃটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ি ভাবে বসবাসের জন্য কোটি ডলারের বাড়ি কিনেছেন। পরিবার ওখানেই থাকেন। কানাডার টরেন্টো শহরে একটি  বিরাট এলাকার নামই তো ‘বেগম পাড়া’।  জানতে চাইলে পরিবারকে ওই সব দেশে কেন পাঠিয়ে দিয়েছেন ? কমন উত্তর হচ্ছে ওখানে জীবনের নিরাপত্তা আছে, ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া ভাল হয়। আপনি কেন বাংলাদেশে পরে আছেন এমন প্রশ্নের সহজ উত্তর হবে ‘এখানে জনগণের অর্থ মেরে বেশ নিরাপদে থাকা যায় কারণ সরকারের উঁচু মহলে আমার যোগাযোগটা বেশ ভাল’।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলি। পনের জনের বোর্ড সদস্য। নয়জনকে জোরপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়টির কাছে আসতে দেয়া হয় না। বাকি ছয়জন পরিচালকের ফ্লোর নামে একটি বিলাসবহুল ফ্লোরে ততধিক বিলাস বহুল অফিস বানিয়েছেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে একজন শিক্ষার্থীতে গড়ে পনের লাখ টাকা খরচ করতে হয়। ওই ছয়জন পরিচালক শিক্ষার্থীদের অর্থে বিএমডাব্লিউ গাড়ী হাঁকান। কিছু দিন আগে সিদ্ধান্ত হয়েছে সকলে মার্সিডিজ বেঞ্জ কিনবেন। একটি বোর্ড সভার সিটিং এলাউন্স এক লক্ষ টাকা। মাঝে মধ্যে বোর্ড সভা বিদেশে করতে হয় কারণ দেশে খুব গরম। শিক্ষা সফরের নামে বোর্ডের কোন কোন সদস্য শিক্ষার্থীদের অর্থে সপরিবারে বিজনেস ক্লাসে উড়াল দিয়ে সভায় যোগ দিতে বিদেশ ভ্রমণ করেন, পাঁচ তারকা হোটেলে থাকেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক কীর্তি ওপেন সিক্রেট। কারো কিছু হয় না কারণ তাদের সাথে উঁচু মহলের যোগাযোগ খুব গাড়।

বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে নিবিড় ভাবে কাজ করার দু’বার সুযোগ হয়েছে। অনেক বিষয় নিয়ে তিনি  আলাপ করেছেন। সব সময় মনে হয়েছে তিনি তাঁর পিতার মতো অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখেন। তাঁর পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন কারণ তিনি বাঙালিদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা তাঁর কর্মকাণ্ড দ্বারা ইতোমধ্যে ইতিহাসে তাঁর জন্য একটি জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি এখন আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি বিশ্বে একজন স্বীকৃত রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর একটা প্রিয় কবিতা রবার্ট ফ্রস্টের

‌“Stopping by woods on a snowy evening” যার একটি লাইন have miles to go before I sleep তিনি প্রায়ই আবৃত্তি করেন। সামনা সামনি তাঁকে বলতে পারিনি ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাদের নিয়ে এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করবেন? আপনি যাদের বিশ্বাস করে দায়িত্ব দিয়েছেন আপনার প্রতি তাদের ক’জনার অঙ্গিকার আছে? ক’জন আপনার মতো বাংলাদেশকে ভালবাসেন? স্বাভাবিক ভাবে আপনি চান তরুণ নেত্রত্ব আগামী দিনের বাংলাদেশের হাল ধরুক। যাদের হাতে কিছু দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে দেখলে বুঝা যাবে তাদের ক’জন তাদের উপর দেয়া আপনার আস্থা আর বিশ্বাস রাখতে পেরেছেন। সব খবরতো আপনার কাছে পৌঁছায় না। অযোগ্য অপদার্থ মানুষের উপর দায়িত্ব দিলে শেষ পর্যন্ততো পস্তাতে হবে’। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িতের সন্তান আওয়ামী লীগের চেতনা ধারণ করবেন এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর বেলজিয়ামে দায়িত্ব পালনরত রাষ্ট্রদূত সানাউল হককে সেই দায়িত্ব না দেয়ার জন্য অনেকে বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন।

উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ও আমার সন্তান তুল্য, তাকে অবিশ্বাস করা ঠিক নয়। কিন্তু সানাউল হক ১৫ আগষ্ট হত্যাকা-ের পর বঙ্গবন্ধুর দু’ই কন্যাকে এককথায় সপরিবারে জোরপূর্বক তার বাড়ী হতে বের করে দিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়ার সার্ভিস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে। জিয়া এই আদেশ বাতিল করার জন্য বঙ্গবন্ধুর একজন অত্যন্ত কাছের মানুষের শরণাপন্ন হয়েছিলেন । তার অনুরোধে বঙ্গবন্ধু সেই আদেশ বাতিল করেছিলেন। বাকিটাতো ইতিহাস।

ঋণ খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করার জন্য অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ আর তাকে তা প্রকাশ করার  অনুমতি দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা। কিন্তু মানুষের ধারণা তালিকা ভূক্তদের কোন কিছু হবে না কারণ উপরের মহলের সাথে তাদের সখ্যতা সর্বজন বিধিত। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি একটু কঠোর হন এই সব দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব। আসল কথা হচ্ছে আপনি যাদের নিয়ে অনেক দূর যেতে চান তারা তা চান কী না তা খোঁজ নিয়ে দেখুন সত্যটা প্রকাশ হতে খুব কষ্ট হবে না। সব শেষে ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েলের একটি উক্তির উদ্বৃতি দিতে চাই। তিনি বলেছিলেন “সত্য হতে একটি সমাজ যত বেশী দূনে সরে যাবে ততবেশী যারা সত্য বলেন তারা ঘৃণার পাত্র হবেন”। (The further a society drifts from truth the more it will hate those who speak it”

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক।

এই বিভাগের আরো সংবাদ