আজকের শিরোনাম :

রাজনীতিতে আপাতত কোনও ঝড়ের পূর্বাভাস নেই

  বিভুরঞ্জন সরকার

২৫ জুন ২০১৯, ০৯:৫৮ | অনলাইন সংস্করণ

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন–এই প্রশ্নের জবাবে কেউ নিশ্চয়ই খারাপ কিছু বলবেন না। আন্দোলন-সংগ্রাম নেই। সরকারবিরোধিতা নেই। রাজনৈতিক দলের উল্লেখযোগ্য কোনও তৎপরতা নেই। এখন চলছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা। মানুষ মেতে আছে ক্রিকেট নিয়ে। বাংলাদেশ দল নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস-আবেগ চরমে। এমন বিশ্বাসও শুরুতে ছিল, এবার বাংলাদেশই হবে চ্যাম্পিয়ন। তবে কয়েকটি খেলা হয়ে যাওয়ার পর এখন আবেগ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে, যদিও স্বপ্নটা ঠিকই রয়ে গেছে। এও সঠিক, বাংলাদেশ দল এবার অনেক ভালো খেলছে। ক্রিকেট বিশ্বের মোড়লেরাও বাংলাদেশ দলকে সমীহ করতে শুরু করেছে। এটা আপাতত আমাদের জন্য একটি ভালো খবর। সুসংবাদ। এই ধারা অব্যাহত থাক। চারদিক থেকেই যেন আমরা সুখবর পেতে থাকি।

প্রত্যাশা থাকলেও আমরা সাধারণত ভালো খবর তেমন পাই না। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিতে নেতিবাচক খবর বেশি। প্রতিদিন সকালে সংবাদপত্র হাতে নিয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠার পরিবর্তে আমরা কষ্ট পাই, দুঃখ পাই। বেদনা বোধ করি। কখনও কখনও আমাদের চোখ ভিজে আসে। আমাদের মন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। সড়ক দুর্ঘটনার খবর, আগুনে পুড়ে মরার খবর, ধর্ষণের শিকার নারীর অসহায় কান্নার খবর আমাদের ভারাক্রান্ত করে। স্বস্তি কেড়ে নেয়, উৎকণ্ঠা বাড়ায়।

আমরা ভালো থাকবো, ভালোমতো বাঁচবো, আমরা আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াবো। বিশ্বসম্প্রদায় মাথা নত করে আমাদের অগ্রযাত্রা দেখবে, আর বিস্মিত হবে। এটাই আমাদের স্বপ্ন, এটাই আমাদের আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া। আমরা উন্নতি করছি, এগিয়েও যাচ্ছি। আমাদের অর্থনীতি অনেক দেশের তুলনায় ভালো। আমাদের প্রবৃদ্ধি ভালো।  বিশ্বব্যাংকের এক সাম্প্রতিক  প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এত বড় আনন্দ সংবাদেও আমরা উচ্ছ্বাস-উল্লাস প্রকাশ করতে পারছি না।  কেন? কারণ আমাদের রাজনীতি। একটি দেশ কেমন চলছে, তা বোঝার জন্য সে দেশের রাজনীতির প্রতি নজর দিতে হয়। গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনীতি হলো সবকিছুর চালিকাশক্তি। রাজনীতির মাধ্যমেই দেশ পরিচালিত হয়, কৌশল প্রণয়ন করা হয়। আমাদের দেশের রাজনীতি সঠিক ধারায় অগ্রসর হচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন উঠলে ইতিবাচক জবাব পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আমাদের দেশের চলমান রাজনীতিকে অনেকেই ভালো রাজনীতির মডেল বলে মানতে চান না।

আমাদের দেশে নির্বাচন হয়। কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় বলে মনে করা হয় না। নির্বাচন পরিচালনা করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। পাঁচ সদস্য নিয়ে আমাদের নির্বাচন কমিশন। কমিশনের একজন সদস্য প্রকাশ্যে যেসব কথা বলছেন, তা থেকে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক, দেশে আসলে নির্বাচনের নামে তামাশা চলছে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার মনে করেন, ‘জাতি এক গভীর খাদের দিকে অগ্রসরমান’। উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের কম উপস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনবিমুখতা গণতন্ত্রের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার নামান্তর। আমরা গণতন্ত্রের শোকযাত্রায় শামিল হতে চাই না। রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের বিষয়টি  গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখা প্রয়োজন।’

৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ওই নির্বাচন নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। সরকার এবং নির্বাচন কমিশন একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর বললেও অন্যরা তা বলছেন না। বিএনপিসহ নির্বাচনে অংশগ্রহণকরী বেশিরভাগ দলই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যাবে না যাবো না করে বিএনপি শেষ পর্যন্ত সংসদেও গিয়েছে। সংসদে গিয়ে আবার বলছে, এই সংসদ ‘অবৈধ’। বিএনপির সংসদমুখী হওয়াকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হলেও এতে রাজনীতিতে গুণগত কোনও পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনে নানা ধরনের কারচুপির আশ্রয় নিয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার সমর্থক-সহযোগীদের বিপুলভাবে জিতিয়ে আনা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। আগের রাতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ হচ্ছে। আওয়ামী লীগের পক্ষে অস্বাভাবিক ভোট পড়ায় এখন এসব অভিযোগ অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনেও প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলো কোনও কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। সাধারণ ভোটারদের যারা ভোট দিতে পারেননি, তারাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কিন্তু প্রতিবাদী হননি। ভোট দেওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে প্রবল আগ্রহের বিষয়টিও লক্ষ করা যায়নি।

বিএনপি দায়সারাভাবে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা চালানোতে মানুষ এটা ধরেই নিয়েছিল, বিএনপি জেতার জন্য ভোট করছে না। আওয়ামী লীগ জেতার জন্য ভোট করেছে এবং তার জন্য যা যা করা দরকার তারা তার সবই করেছে। আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে ব্যবহার করে কী কী কৌশল নিতে পারে, সে বিষয়ে কারো কোনও ধারণাও হয়তো ছিল না। নির্বাচন কমিশনও সবদিকে সমান নজর দিতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনে মাত্র সাতটি আসন পেয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হতচকিত হয়ে পড়ে। তারা অন্তত ৬০-৭০টি আসন পাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য যারা ভোট ম্যাকানিজম করেছে, তারা কাঁচা কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত হলেও দেশের নির্বাচনি রাজনীতির বড় ক্ষতি করেছে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন। নির্বাচন ব্যবস্থায় যে একটি মারাত্মক ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেটা এখন আর গোপন করা যাচ্ছে না। কীভাবে এই ক্ষত নিরাময় হবে, ভাবনার বিষয় এখন সেটাই।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। ফলে ওই নির্বাচন ছিল একতরফা। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি তখন উঠেছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলো, কিন্তু সুষ্ঠু হলো না। এই ধারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও অব্যাহত আছে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি নেয়নি। এটাও প্রায় একতরফা নির্বাচন। শতাধিক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিনাভোটে জয়ী হয়েছেন। একসময় ভোট আমাদের দেশের মানুষের কাছে উৎসবের মতো ছিল। কিন্তু উপজেলা পরিষদের নির্বাচন শেষ হলো নিষ্প্রাণ পরিবেশে। ভোটার উপস্থিতি খুবই কম। তারপরও আছে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ। আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরার চেষ্টাও চলেছে। সব মিলিয়ে আমাদের দেশের নির্বাচনি রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকের মধ্যেই দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। কেউ বা হতাশ। এর শেষ কোথায়, পরিণতি কী–এ প্রশ্ন উঠছে।
সর্বোত্তম ব্যবস্থা না হলেও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের চেয়ে ভালো ব্যবস্থার হদিস পাওয়া যায়নি। সামরিক-বেসামরিক স্বৈরশাসনের চেয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই অধিক গ্রহণযোগ্য। নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি বড় উপাদান। নির্বাচনের মাধ্যমেই মানুষ তার পছন্দের ব্যক্তিদের বেছে নেন। সংখ্যাগরিষ্ঠরা সরকার গঠন করেন এবং সংখ্যায় যারা কম, তারা বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকেন। আমাদের দেশে এমন অবস্থা হয়েছে, সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে শক্তির ভারসাম্য নেই।

সম্প্রতি কিছু কিছু দেশে নির্বাচনি গণতন্ত্রকে আর প্রথাগতভাবে কাজ করতে দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচন ব্যবস্থায় নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশেও নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের সংকট দেখা যাচ্ছে। মানুষ তার পছন্দের প্রার্থীকে প্রভাব-প্রলোভনমুক্ত থেকে ভোট দিতে পারার সুযোগ পাচ্ছেন না। কোন ব্যবস্থায় মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যাবে, তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চললেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয়–এটা মনে হয় এখন অনেকেই মেনে নেবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায়ও হয়তো শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোই বেশি বিতর্কিত হয়েছে।

এবার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে আর মনে হয় না, ভবিষ্যতে দলীয় সরকারের অধীনে কোনও দল নির্বাচনে অংশ নেবে। পরপর দুইবার আওয়ামী লীগ কৌশলের খেলায় জিতে গেলেও পরের বার আর এই কৌশল কাজ দেবে কিনা, সে প্রশ্নও সামনে আসছে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ সংবিধানে নেই। সংবিধানে যা নেই, আওয়ামী লীগ তা মানবে না। তাহলে কী হবে? সংবিধান সংশোধন করার পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হবে?
নির্বাচনের প্রশ্নটি যদিও এখনই সামনে নেই, তবু মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতি ঘুরপাক খাবে এই নির্বাচনি রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই। ‘কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নয়ন’–এই কথা বলে বেশিদিন মানুষকে ভোটের অধিকার বঞ্চিত করে রাখা যাবে বলে অনেকেই মনে করেন না। দেশে যদি কোনও অনিয়ম-দুর্নীতি না থাকে, সুশাসন নিশ্চিত হয়, উন্নয়নের সুফল যদি মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে জমা না হয়, আয় বৈষম্য, ধন বৈষম্য যদি প্রকট না হয়, তাহলে হয়তো ভোট-গণতন্ত্র নিয়ে মানুষ বেশি মাথা ঘামাবে না। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কি এটা বলা যায়, এই সমস্যাগুলো থাকবে না?

আমরা জানি, যা চোখে দেখা যায় তাই সব নয়, তাই শেষ নয়। চোখের আওতার বাইরেও আরো অনেক কিছু থাকে। এখন রাজনীতিতে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সবকিছুতে আওয়ামী লীগের যে একক প্রাধান্য বা আধিপত্য দেখা যাচ্ছে, তাই যে বছরের পর বছর স্থায়ী হবে, তা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যায় না। রাজনীতিতে কখন কোন ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাবে তার পূর্বাভাস দেওয়ার মতো রাজনৈতিক আবহাওয়াবিদ কিংবা জ্যোতিষী আমাদের দেশে আছে বলে মনে হয় না। সময়ের প্রয়োজনেই রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটবে। কারো হুকুম বা নির্দেশে যেমন সেটা হবে না, তেমনি সেটা কার হাত ধরে হবে তা-ও আগাম বলা যাবে না।

লেখক: কলামিস্ট

এই বিভাগের আরো সংবাদ