আজকের শিরোনাম :

রবীন্দ্রসৃষ্টির নেপথ্যে গ্রামবাংলার প্রভাব : আহমদ রফিক

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ মে ২০১৮, ১৪:৫৬

ঢাকা, ০৮ মে, এবিনিউজ : একসময় অর্থাৎ যুক্তবঙ্গের আমলে ‘পূর্ববঙ্গ’ বলতে মধ্যবঙ্গ-উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গসহ বঙ্গের পূর্বাঞ্চলকে বোঝাত, যার নাম এখন বাংলাদেশ। বিভাগপূর্ব সময়কার পূর্ববঙ্গ তাই গোটা পূর্বাঞ্চল নিয়ে। এখানকার গ্রামবাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আসা-যাওয়া ও অনিয়মিত বসবাস শুধু তাঁর ব্যক্তিজীবনেই নয়, বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় সৃষ্টি করেছে।

অনেকেই কথাটি বলে থাকেন, যেমন বলেছেন প্রমথনাথ বিশী যে এই গ্রামবাংলায় না এলে নতুন এক কবি, ছোটগল্পকার ও ভিন্নমাত্রার এক সংগীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের দেখা মিলত না। বিশীমশাই অবশ্য এক পা এগিয়ে মন্তব্য করেছেন যে পূর্ববঙ্গের প্রকৃতি ও জীবন-জনপদ রবীন্দ্রনাথকে ‘মহাকবির মর্যাদা দিয়েছে’। সেটাই শেষ কথা নয়, বরং বলা যায় শুরুর কথা, আর ‘ছিন্নপত্রাবলী’র পাতায় পাতায় তেমন প্রমাণ ধরা রয়েছে।

এতে নাগরিক রবীন্দ্রনাথের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্রচরিত্র লক্ষ করা যায়। প্রথমত রবীন্দ্রনাথ গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ-অভিভূত একজন মননশীল রোমান্টিক কবি, যাঁর চোখে শিলাইদহের পদ্মাপ্রকৃতিই এক ভিন্ন পৃথিবী। এখানকার রূপময়তা তাঁর চোখে যেন পৃথিবীর সৌন্দর্য। ১৮৮৯ খিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর (? ২৯ নভেম্বর)। পদ্মার বিশাল এক ধু ধু চরের সামনে রবীন্দ্রনাথের পদ্মাবোট। চারপাশের দৃশ্য দেখে অভিভূত রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে লিখছেন :

‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কী আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই যে ছোটো নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে, এবং অনন্ত ধূসর নির্জন নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতিরাত্রে শতসহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।’

লক্ষ করার বিষয় যে শিলাইদহ ও পদ্মাপ্রকৃতি এ পর্যায়ে নাগরিক কবির পৃথিবী, এমন এক পৃথিবী যে এর বাইরে অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। তাই একের পর এক বিশেষণ ব্যবহার। অথচ এই রবীন্দ্রনাথই একসময় বলেছেন, সাহিত্যে ‘সুমিতা অমিতা’র (পরিমিতি অপরিমিতি) কথা, যা উত্কৃষ্ট সৃষ্টির অন্যতম পূর্বশর্ত।

কিন্তু প্রকৃত সৌন্দর্যের রূপময়তায় মুগ্ধ কবি সেসব নান্দনিক তত্ত্বকথা ভুলে লিখে চলেছেন—‘আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে’, যেন শব্দের বিন্যাসে ছবি এঁকে চলেছেন :

‘সূর্য আস্তে আস্তে ভোরের বেলা পূর্বদিক থেকে কী এক প্রকাণ্ড গ্রন্থের পাতা খুলে দিচ্ছে এবং সন্ধ্যা পশ্চিম থেকে ধীরে ধীরে আকাশের উপরে যে-এক প্রকাণ্ড পাতা উল্টে দিচ্ছে সেই বা কী আশ্চর্য লিখন—আর, এই ক্ষীণপরিসর নদী আর এই দিগন্ত বিস্তৃত চর আর ওই ছবির মতন পরপার—ধরণীর এই উপেক্ষিত একটি প্রান্তভাগ—এই বা কী বৃহৎ নিস্তব্ধ নিভৃত পাঠশালা।’

শহর কলকাতার কিছুটা দূরবর্তী প্রকৃতির এই পাঠশালায় এসে কবি রবীন্দ্রনাথ সূর্যোদয় সূর্যাস্তের মতো গতানুগতিক ঘটনাকে নতুন চোখে, নতুন উপলব্ধিতে দেখছেন, আর মনে নিত্যনতুন ভাবাবেগ তৈরি হচ্ছে। সেই টানে শুধু চিঠিই নয়, লেখা হচ্ছে ভিন্ন এক চেতনাধৃত কবিতা, গান, ছোটগল্প। বাংলা সাহিত্যে যুক্ত হচ্ছে নব্য উপলব্ধির কবিতা—যেমন ভাববাদী তেমনি বাস্তবতাবাদী ধারায়।

আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি, নদী, মাটি, ফসলভরা নানা রং শস্যক্ষেত, নদীতে চলমান নৌকা, কখনো ধানেভরা, কখনো শূন্য, বর্ষণসিক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি সিক্ত নগ্নদেহ কৃষক, নির্দয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ ইত্যাদি নিয়েই এ পর্বের কবিতা—সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালিতে। কখনো সহজ পাঠশালা-বইয়ের পাতা, কখনো জটিল দর্শন চিন্তার প্রকাশ ভিন্ন চরিত্রের পাতায়।

আর ছোটগল্প? এই গ্রামীণ জীবন-জনপদ তার বিচিত্র চরিত্র নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আধুনিক ছোটগল্পের সৃষ্টি। এ সত্য অস্বীকারের উপায় নেই যে কবির অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি ছোটগল্পে রূপ নিয়েছে গভীর ভাবনায় ও সহজ-সরল চরিত্র চিত্রণে। সেখানে প্রকৃতি যেমন মুখ্য বিষয়, তেমনি সত্য জীবনবাস্তবতা, যা প্রায়শ ট্র্যাজেডি, ক্বচিৎ কমেডির বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরস্ফুিট। রবীন্দ্রনাথের পদ্মাপর্বের ছোটগল্পগুলো এই দুই ধারাকে আশ্চর্য এক নান্দনিক চমৎকারিত্বে তুলে ধরেছে। রবীন্দ্রনাথকে এই গ্রামবাংলা দিয়েছে বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্রকৃত আধুনিক ছোটগল্পকারের মর্যাদা।

অন্যদিকে গান। শিলাইদহে এসে গগন হরকরার বাউল গান—‘আমি কোথায় পাবো তারে/আমার মনের মানুষ যেরে’ রবীন্দ্রনাথকে কথা ও সুরে এতটা অভিভূত করে যে তাঁর বাকি জীবনের একাংশ কেটে গেল বাউলসংগীত রচনা ও বাউল সাধনায়। একের পর এক গানের অঙ্গে বাউল সুর—হোক তার বিষয় মরমি চিন্তাধারার বা হোক তা প্রতিবাদী স্বদেশচেতনার। কোথায় বসে সেসব গান লিখেছেন সেটা প্রধান বিচার্য বিষয় নয়। বিষয় কখন কোথায় কিভাবে মস্তিষ্ক কোষে উপলব্ধি-অনুভূতির সঞ্চয় করেছেন। এর প্রকাশ যখন যেখানে যেভাবে হোক।

আমরা জানি, বর্ষার আকাশনদীর শ্রাবণচিত্র শিলাইদহে কবিচিত্তে যে অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল তার প্রকাশ ঘটে ফাল্গুনে ‘সোনার তরী’ নামের বিখ্যাত কবিতায়। আর তা নিয়ে কত বিতর্ক, বিশেষ করে বিরূপ সমালোচনা রবীন্দ্র-বিদূষক খ্যাতিমান কবি-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের। বাস্তব সত্য না বুঝতে পারলে এমনটিই ঘটে। জলিধান, ধান পাকা, ধান কাটা নিয়েও একই জনের সমালোচনা। অথচ স্থানিক বাস্তব সত্য রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই কথা বলে।

বাউল গান রবীন্দ্রনাথকে এতটা প্রভাবিত করেছিল যে বৈষ্ণব পদাবলির রসে সিক্ত তাঁর চেতনা ওই বাউল চরিত্রকে বাকি জীবনের সঙ্গী করে তুলেছিল। যেমন ব্যবহার করেছেন তাঁর নাটকের গানে, তেমনি করেছেন বঙ্গভঙ্গবিরোধী স্বদেশি গানের সৃষ্টিতে। ‘আমার সোনার বাংলা’ থেকে বেশির ভাগ স্বদেশি গান বাউলাঙ্গের সুরে রচিত ও গীত। এগুলোর অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা শিলাইদহের অখ্যাত ডাকপিয়ন গগন হরকরাকে মনে করিয়ে দেয়।

অন্যদিকে অনুরূপ মরমি ভক্তিবাদী-জীবনবাদী রহস্যময়তার গান লালন ফকিরের, যা একইভাবে রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করে। কুষ্টিয়ার লালন শাহ হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের গান ও সাহিত্যের ভিন্ন এক উৎস। ‘খাঁচার পাখি’ নিয়ে কী বিচিত্র ব্যঞ্জনাগর্ভ তাৎপর্যে লেখা কবিতা ও গান। ‘গোরা’র মতো তাত্ত্বিক উপন্যাসও এ প্রভাবের বাইরে থাকে না। গগন হরকরার ‘মনের মানুষ’, যা গ্রামবাংলার মরমি গানের সাধনায় বহুলদৃষ্ট এবং লালনের ‘অচিন পাখি’ রবি বাউলের একতারাকে এতটা আবেগে অধিকার করেছিল যে রবীন্দ্রনাথ এ অঞ্চল থেকে লেখা এক বার্তায় নিজেকে ‘রবি বাউল’রূপে আখ্যায়িত করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের পূজাপর্বের গানে এই মরমি ভাবনার প্রকাশ এতটা ব্যাপক যে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয় না। তবু একটি বহু পরিচিত গানের উদ্ধৃতি রবীন্দ্রনাথের প্রাণের গভীরে এ উপলব্ধির গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করবে। এটি গীতবিতানে পূজাপর্বের, ৫৪৬ সংখ্যক গান :

‘আমি কান পেতে রই আমার আপন হৃদয়গহন দ্বারে কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে’ বস্তুত পুরো গানটিই রবীন্দ্রচিত্তের মরমি ভাবনা উপলব্ধির জন্য উল্লেখযোগ্য।

দুই.

এ অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞতার উপলব্ধি দার্শনিকতার ভাবনারূপে প্রকাশ পেয়েছে মূলত তাঁর গানে, অংশত কবিতায়। সেসবের বাস্তব রূপচিত্রণ ছোটগল্পে যেখানে ছায়াপত, তা কবির মনোগহনে ধৃত পদ্মাপ্রকৃতির—‘শাস্তি’ কিংবা ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন বা ‘মেঘ ও রৌদ্র’ প্রভৃতি গল্পে তা প্রত্যক্ষভাবে পরস্ফুট।

এবং একইভাবে পরস্ফুট পদ্মাবিষয়ক কবিতায় এবং ছিন্নপত্রাবলীর পাতায় পাতায়। সেখানে তাঁর ‘সুখদুঃখের দিনরাত্রিগুলো’ আশ্চর্য সজীবতায়, জীবনের ঐশ্বর্যে প্রতিফলিত। তা সে জীবন যত সাদামাটা বা আটপৌরে হোক। প্রমত্ত পদ্মার মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়ো প্রকৃতির পরিবেশ প্রকৃতি প্রেমের অনুষঙ্গে ফুটে উঠেছে তাঁর বিখ্যাত, অতি আধুনিক বিষয়-প্রকরণ-সিদ্ধ গল্প ‘অতিথি’তে।

অবশ্য তিনি লিখেছেন, শাজাদপুরের দুপুরবেলা তাঁর গল্পের দুপুরবেলা। প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর সত্তার গভীর একাত্মতায় এসব গল্পে যেমন প্রধান হয়ে উঠেছে প্রাকৃত অনুষঙ্গ, তেমনি পরস্ফুিট সাদামাটা জীবনের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা বা জীবনযন্ত্রণার বাস্তবরূপ। কখনো সেখানে দার্শনিক চিন্তার উদয়, জীবনকে ‘অনিত্য’ জ্ঞান করে, মানব সম্পর্কগুলোকে একইভাবে মূল্যায়ন করে। যেমন প্রকাশ পেয়েছে বিখ্যাত ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটিতে। কিংবা ভিন্ন ধারার চেতনার প্রকাশ ‘ছুটি’ বা ‘সমাপ্তি’র মতো গল্পগুলোতে।

এগুলোর ধারাবাহিকতায় লেখা পরবর্তী পর্বের গল্প মধ্যবিত্ত বা এলিট শ্রেণির জীবনসত্য নিয়ে—সব মিলিয়ে বাঙালির উপভোগ্য ও উপলব্ধির এক আশ্চর্য গল্পভুবন তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ, যা শিল্পমূল্যে ও জীবনবাস্তবতায় অসাধারণ। আর সে কারণে বিশ্বগল্প সাহিত্যের দুই ‘গ্রেটমাস্টার’ মপসাঁ ও চেকভের সঙ্গে তুলনীয় সূচানলগ্নে বাংলা ছোটগল্পের গ্রেটমাস্টার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

তিন.

এই রবীন্দ্রমানসের শিল্পসাহিত্য প্রকৃতি গঠনে গ্রামবাংলার অবদান, বিশেষ করে শিলাইদহ-শাজাদপুর-পতিসরের জীবন-জনপদ ও প্রাকৃত রূপের প্রভাবে, তা অবশ্যই সাহিত্যশিল্পী রবীন্দ্রনাথ ও সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়নে ও বিশ্লেষণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর জীবনসত্যের দার্শনিকতা অনেকাংশে এই গ্রামীণ রূপকল্পের প্রভাবে সৃষ্ট। এ ক্ষেত্রে ভাববাদ ও বাস্তবতার এক অবিশ্বাস্য, অদ্ভুত মিশ্রণ। সরসকৌতুকে, কখনো গভীর দার্শনিকতায় তাঁর এই গভীর ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে ছিন্নপত্রাবলীতে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। বুঝেশুনে, ভেবেচিন্তেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গ্রামীণ প্রবাসীজীবনের অনুভূতিগুলোকে ভিন্নমাত্রায় চিহ্নিত করেছেন, ভিন্ন সুরের তারে বেঁধেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর বোধের গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলাতে, না চাওয়ার নিরাবেশ নিরাসক্তি। তাই গানের কলিতে এমন সুরে শোনাতে পেরেছেন তাৎপর্যপূর্ণ : ‘কী পাইনি তারি হিসাবে মিলতে মন মোর নহে রাজি’ কথাগুলো। কয়জন পারেন জীবনের হিসাব মেলাতে, না চাওয়ার নিরাসক্তি প্রকাশ করতে? কিন্তু পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ। এখানেও কি এ অঞ্চল থেকে আহরিত বাউলচেতনার প্রভাব প্রধান হয়ে থেকেছে?

‘ছিন্নপত্রাবলী’তে ধৃত এ অঞ্চল থেকে লেখা চিঠিগুলোতে অধিকমাত্রায় প্রাকৃত আবেগ পরস্ফুিট, যার পেছনে রয়েছে প্রকৃতির বিচিত্র রূপের প্রকাশ। যেমন—ঝড়-বৃষ্টির তুমুল উদ্দামতায়, তেমন শরতের স্বচ্ছ নীল আকাশ ও অনুরূপ তরল রোদের রোমান্টিকতা ভিন্নমাত্রায় পরস্ফুিট বসন্তের দখিন হাওয়ার মনমাতানো গানে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, রবীন্দ্রমানসে বর্ষা ও বসন্ত ঋতুর প্রভাব সর্বাধিক, এর পরই শারদপ্রকৃতি। গানে গানে এ উপলব্ধির প্রকাশ সর্বাধিক।

আরো একটি সত্য রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যেই প্রকাশ পেয়েছে যে তাঁর ‘সুখ-দুঃখের দিনরাত্রিগুলি’ এখানকার মতো অন্য কোনো স্থানের লেখায় এতটা প্রকাশ পায়নি। ‘ছিন্নপত্রাবলী’ তাই রবি-জীবনের বিশেষ এক অধ্যায়ের বাস্তবিক গীতিকাব্য, যদিও চিঠিগুলো সাদামাটা গদ্যেই লেখা। এখানে বসে ঝুমবৃষ্টিতে তাঁর মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, চিঠিগুলো গদ্যে নয়, কবিতায় লেখেন। চঞ্চলা জলস্রোত ও নিবিড় তুমুল বৃষ্টি তাঁর চেতনায় আলোড়ন তুলেছে, মনে হয়েছে, ‘কী জানি পরান কী যে চায়’ যার প্রভাবে লেখা হয়েছে বর্ষার একাধিক গান; যেমন—‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে’ কিংবা ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’র মতো গান।

কথা আর না বাড়িয়ে বলা চলে, এ বঙ্গের গ্রামবাংলার জীবনজনপদ-প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের শিল্পী মানসগঠনে যে দ্বিমাত্রিক প্রভাব রেখেছিল, রবীন্দ্রনাথ সে প্রভাব থেকে আমৃত্যু মুক্তি পাননি। তাই রাঢ়বঙ্গে বসে শীর্ণ জলস্রোতের ‘কোপাই’কে নিয়ে কবিতায় মনে মনে দেখেছেন প্রমত্তা পদ্মাকে, যে চঞ্চলা পদ্মা একদা তার প্রিয় সঙ্গিনী।

রবীন্দ্রজীবনের গ্রামবাংলা পর্ব তাই তাঁর তাত্ক্ষণিক রচনাতেই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠেনি, বাস্তব সত্য হলো, এই প্রভাব তাঁর গোটা শৈল্পিকজীবনকে ভিন্ন তারে বেঁধে দিয়েছে। আর এ কথাও সত্য যে এখানে বসেই যুবক কবি তাঁর স্বদেশ ও প্রকৃতিকে চিনেছেন তা-ই নয়, বিশ্বপ্রকৃতি ও মানববিশ্বকে তাঁর মতো করে চেতনায় ধারণ করেছেন। তাঁর সে বিশ্ব নিঃসন্দেহে মানবিক বিশ্ব, বিজ্ঞানের বিশ্ব; কিন্তু বিজ্ঞানীর একমাত্রিক বিশ্ব নয়। (কালের কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত)

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

এই বিভাগের আরো সংবাদ