আজকের শিরোনাম :

রফতানিতেও মুনাফা, আমদানিতেও মুনাফা

  সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

১৬ জুন ২০১৯, ১০:৫৬ | অনলাইন সংস্করণ

দেশ স্বাধীন হওয়াতে কৃষকের যে ভাগ্য খুলেছে তা কিন্তু মোটেই নয়। হ্যাঁ, ধনী কৃষকের সুবিধা হয়েছে, তারা নিঃস্ব হয়ে-যাওয়া গরিব কৃষকের জমি অল্প দামে কিনে নিয়েছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে কৃষিতে, যন্ত্রপাতি কিনেছে এবং সেগুলো ভাড়াও দিতে পেরেছে মধ্য ও গরিব কৃষকের কাছে। টিকতে না পেরে গরিব কৃষক তার জমি বিক্রি করে দিয়েছে। বেচে দিয়ে ক্ষেতমজুর হয়েছে। হয়তো নিয়োগ পেয়েছে তার নিজের জমিতেই, নতুন মালিকের অধীনে। নয়তো চলে গেছে শহরে। চালক হয়েছে রিকশার। কিশোরী মেয়েটিকে পাঠিয়েছে সে গার্মেন্টে। গ্রামে থাকতে গরিব কৃষকের বুক কাঁপত, কবে না জানি মেয়েটি অপহৃত হয়, ভাবত বিয়ে দিতে পারলে বাঁচবে। নাকি আত্মহত্যাই করল সে বেচারা? না, এখনও করেনি; তবে আগামীতে যে করবে না এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ বাংলাদেশ তো উন্নতি করছে। শোনা যাচ্ছে, উন্নতির গতিতে অচিরেই সে ভারতকেও ছাড়িয়ে যাবে আর উন্নতি তো হবে ভারতের ওই পুঁজিবাদী ধারাতেই, যার বোঝা বহন করতে ব্যর্থ হয়ে সেখানে অনেক কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে।

ধানের ভালো ফলন হলে গরিব কৃষকের যে সর্বনাশ ঘটে, সেটা তো উন্মোচিত সত্য। এই সত্যের চরম উন্মোচন ঘটেছে এ বছর। প্রচুর ফলন এবং সঙ্গে সঙ্গে দরপতন! হিসাব বলছে, মুনাফা তো দূরের কথা, খরচই উঠছে না, মণপ্রতি আড়াইশ' থেকে তিনশ' টাকা লোকসান হচ্ছে। যত বিক্রি তত লোকসান। ধান নিয়ে কৃষক এখন কী করবে? অঝোরে কাঁদবে? কাঁদছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কেউ কেউ যা করেছে তেমনটা এ দেশের ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি। কৃষক তার পাকা ধানে আগুন দিয়েছে। একশ' বছর আগে গফুর যেভাবে এবং যে কারণে তার প্রিয় ষাঁড়টিকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল, এ ঘটনাও ঠিক সেই রকমের। এর আগে আমরা টমেটো, আনারস, আলু ইত্যাদি কৃষিপণ্য সড়কে এনে ফেলার ঘটনার কথা শুনেছি। দুধ কিংবা ডিমও রাস্তায় ফেলে দেওয়ার নজির আছে। কিন্তু প্রাণপ্রিয় ধানকে, সোনার বাংলার আসল সোনাকে নিজের হাতে পুড়িয়ে ছারখার করার কথা শুনিনি। 

সরকার বলছে, দামের ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই। এটা বাজারের ব্যাপার এবং বাজার মুক্ত, সেখানে চাহিদা ও সরবরাহের ঘাত-প্রতিঘাত। তা বুঝলাম এবং বাজার যে কী জিনিস, তা আমরা জানিও। সবচেয়ে বেশি জানে শেয়ারবাজারে যারা টাকা খাটায় তারা। ওই বাজারে দাম যখন ওঠে, তখনই বোঝা যায় পড়বে, যত ওপরে ওঠা তত ভয়াবহ পতন এবং যা করার ম্যানিপুলেটররাই করে। সরকার দেখে। সরকারের সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আছে, তারা ঠুঁটো জগন্নাথ। সাবেক এক অর্থমন্ত্রী যিনি অবিস্মরণীয় সব উক্তি করে খুব বিখ্যাত হয়েছেন তিনি বলতেন, শেয়ার মার্কেটে জুয়াড়িরা যায়। তা যায় বটে। কিন্তু যারা জুয়াড়ি নয়, তারাও তো যায়। ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীরা যায়, বিনিয়োগের জায়গা পায় না বলেই যায় এবং গিয়ে প্রায়শ সর্বস্বান্ত হয়। ক্ষুদ্র সঞ্চয়ীদের পক্ষে শেয়ারবাজারে যাওয়াটা হয়তো বাধ্যতামূলক নয়; কিন্তু কৃষকের কি ধানের বাজারে না গিয়ে কোনো উপায় আছে? বিক্রি করবে কোথায়? আর ধানের ওই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কারা? করছে মিল মালিকরা। তাদের দালালরা আছে, ওই দামে দালালরা ধান কিনে নেয়। কৃষক তো অসহায়। সরকার ইচ্ছা করলেই হস্তক্ষেপ করতে পারে। বলতে পারে সরকার নির্ধারিত দরেই কিনতে হবে। সরকারের অতি শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন ও র‌্যাব এত কিছু পারে আর এটুকু পারে না? পারে; তবে করে না। করে না এই জন্য যে, যাকে সিন্ডিকেট বলা হয়, মালিকদের সেই সিন্ডিকেট সরকারের ভেতরেই বসে আছে। মিল মালিকদের স্বার্থ এবং সরকারের স্বার্থ অনেক ব্যাপারেই এক ও অভিন্ন বটে। ধানের দাম ঠিক করার ব্যাপারেও। 

স্মরণীয় যে, কৃষি কিন্তু ইতিমধ্যেই শিল্পে পরিণত হয়ে গেছে। সেখানে পুঁজি ও প্রযুক্তি খাটছে। লাঙল ও গরুতে আর কুলায় না। ধান যে ঢেঁকিতে পা দিয়ে ঘরের বউ-ঝিরা ভানবে, সে উপায় নেই। খোরাকির ধান ভিন্ন কথা; কিন্তু অন্য ধান তো বিক্রি হয় বাজারে। গরিব কৃষক অতি দ্রুতগতিতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কেননা ঘরে তার নগদ টাকা নেই, বউ-ঝির শাড়ি কাপড় থেকে শুরু করে চিকিৎসার ব্যয়, ঋণ শোধের দায়, সবকিছুই অপেক্ষমাণ থাকে ধান বিক্রির জন্য। মিলের মালিকরা পুঁজিপতি। ধান তাদের জন্য কাঁচামাল। সেই কাঁচামাল থেকে নানা রকমের ধান বের হয়। খুদ-কুঁড়া-ভুসি কোনো কিছু ফেলনা নয়, সবকিছু থেকেই বাণিজ্য পণ্যের উৎপাদন ঘটে। কৃষিতে এখন জমিদার-জোতদার নেই, আছে পুঁজির মালিক। পুঁজিবাদ কোনো ফাঁক রাখছে না। কৃষকের সর্বনাশ ঘটিয়ে পৌষ মাস সম্ভব করছে মিল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীদের জন্য। মিলের মালিক ও গরিব কৃষকের ভেতর আজ যে সম্পর্কটি প্রকট হয়ে উঠেছে, সেই সম্পর্কটিই কিন্তু পুনরুৎপাদিত হচ্ছে সমাজের সর্বক্ষেত্রে। আমাদের মনোজগতেও ওই সম্পর্কের স্থায়ী অধিষ্ঠান। নানা রূপে, রঙ ও ভঙ্গিতে। 

কৃষকের গুরুত্ব কেবল সংখ্যা দিয়ে নিরূপণ করা যাবে না, যদিও সংখ্যায় তারা অনেক, তারাই সর্বাধিক; মানতে হবে এই সত্য যে, কৃষক না থাকলে কৃষিও নেই এবং কৃষি না থাকলে বাংলাদেশও নেই। সোনার বাংলা আর সোনার বাংলা থাকবে না, দোজখ হয়ে যাবে। সরকারের প্রধান কর্তব্য হবে কৃষককে ভর্তুকি দেওয়া। বহু ক্ষেত্রেই ভর্তুকি দেওয়া হয়। পোশাক খাত হরদম ভর্তুকি চাচ্ছে ও পাচ্ছে। এই লেখাটি লিখতে লিখতেই দেখছি পোশাক কারখানার মালিকরা ৬০ হাজার কোটি টাকার নতুন ভর্তুকি চেয়েছেন (বণিক বার্তা, ২৮ মে) এবং সেটা হয়তো তারা পাবেনও। গত দশ বছরে ঋণখেলাপিদের সুদ মওকুফ হয়েছে দশ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছরে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। এসব চলছে। চলুক। তবে সবচেয়ে জরুরি যে খাত, কৃষি খাত, সেখানে অবশ্যই ভর্তুকি দিতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। ভর্তুকি দিয়ে ডিজেল, সেচ, সার, বীজ, কীটনাশক, ধান কাটা, মাড়াই এক কথায় উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু যাতে দরিদ্র কৃষকের কাছে স্বল্পমূল্যে সহজলভ্য হয়, সেটা দেখা চাই। উৎপাদন খরচ কমানো চাই। সরকারের দ্বিতীয় কর্তব্য বেশি করে ও সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা। সরকার ধান কেনা ক্রমাগত কমিয়ে এনেছে, করা দরকার কিন্তু ঠিক উল্টোটা। এ বছর সরকার কিনেছে উৎপাদনের শতকরা মাত্র এক ভাগ (ডেইলি স্টার, ২৮ মে)। এই ক্রয়ের মধ্যে শুধু ধান নয়, চালও ছিল। ধানই কেনা দরকার, চাল নয়। সরকার চাল কেনে মিল মালিকদের কাছ থেকে, তাতে কৃষকের কোনো সুবিধা হয় না, সব সুবিধাই যায় মিল মালিকদের পকেটে। জানা গেছে, মিল মালিকরা যে শুধু নিজেদের মিলের জন্য ধান কেনে তা নয়, সস্তায় ধান কিনে সরকারের কাছে সরকার নির্ধারিত দরে বিক্রিও করে। ধান কেনাতে লাভ, ধান বিক্রিতে লাভ, আবার ধান থেকে চাল ও অন্যান্য পণ্য উৎপাদন করেও লাভ। ত্রিফলা। ওই যে গান আছে- 'ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাঘডাশে।' এ সত্যের এ বড় সঠিক প্রমাণ। 

শুনলাম কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ে রাজনৈতিক বাধা রয়েছে। এটা হচ্ছে সারকথা, লাখ কথার এক কথা। রাজনৈতিক বাধা মানে দলীয় বাধা, আর দল মানেই সরকারি দল। ধান কিনতে হয় মধ্যবর্তী ফড়িয়া-দালালদের মারফত, যাদের ভেতর সবাই হচ্ছে সরকারি দলের নেতা কিংবা কর্মী। কোনো কিছু না করে, মাঝখানে দাঁড়িয়ে গিয়ে এরা কৃষকের প্রাপ্য দু'হাতে হাতিয়ে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। কৃষকের হায় হায়টা বাড়ছে। ওদিকে শুনলাম খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন অন্য কথা। সেটি চমৎকার। তিনি বলেছেন, আমরা অর্থাৎ সরকারের লোকেরা পাশে না থাকলে উৎপাদন এত বাড়ল কী করে? তাই তো। হ্যাঁ তারা পাশে না থাকলে উৎপাদন বাড়ল কী করে? মন্ত্রী মহোদয় নিজেকে নিশ্চয়ই জনপ্রতিনিধি মনে করেন; কিন্তু তিনি অনেক কিছুই জানেন; তবে এটুকু জানেন না যে, উৎপাদন যে বেড়েছে সেটা সরকারি লোকের উপস্থিতির কারণে নয়। কৃষক সরকারি লোকদের, তা তারা দলীয় মাস্তানই হোক কি সরকারি আমলা কিংবা সরকারের বিবিধ বাহিনীর লোকজনই হোক, কাছে এগিয়ে আসছে দেখলেই ভয়ে কাঁপতে থাকে। সরকারি লোকেরা মূলত যা উৎপাদন করে তা ভীতি; অন্য জিনিস উৎপাদনে তারা মোটেই দক্ষ নয়, বিশ্বাসীও নয়। ভীতির মধ্যেই এবং ভীতি সত্ত্বেও উৎপাদন ভালো হয়েছে। প্রকৃতি তেমন বিরূপ ছিল না। তার চেয়েও বড় কথা, চাষিরা শ্রমে কোনো কসুর করেনি। 

বলা হচ্ছে, সরকারি গুদাম পর্যাপ্ত নয়। পর্যাপ্ত না হলে পর্যাপ্ত করা দরকার ছিল। এটি অবশ্যই জরুরি। পর্যাপ্ত করতে হবে। অনুৎপাদন খাতে ব্যয় করার সময় তো সরকারের অর্থ ও উদ্যোগ কোনোটারই সামান্যতম অভাব দেখা যায় না; তাহলে অত্যাবশ্যকীয় এই দায়িত্ব পালনে অনীহা কেন? এমনও ব্যবস্থা নেওয়া যায়, যাতে ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি চলে যাবে সরকারি গুদামে এবং মিল মালিকরা ধান কিনবে সেখান থেকেই এবং কিনবে সরকারি দরে। ধান দ্রুত আসবে সরকারি গুদামে এবং সেখান থেকে দ্রুত চলে যাবে ধানের কলে। বাইরের কায়কারবার সব বন্ধ। 

বলা হচ্ছে, চাল রফতানি করা হবে। পাশাপাশি আমদানিও কিন্তু চলছে এবং এমন সরকারি বক্তব্য শোনা গিয়েছিল যে, আমদানি চালু থাকবে। একই সরকারের এমন দুটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান বর্তমান বিশ্বে বিরল হতে পারে; কিন্তু আমাদের দেশে তা মোটেই নয়। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বিশ্বদৃষ্টান্ত বৈকি। এক হাতে চাল বিদেশে পাঠানো, অন্য হাতে বিদেশ থেকে চাল আনা- এ নিয়ে খবরের কাগজে যে কোনো কার্টুন ছাপা হয়েছে, তাও দেখিনি। তবে পত্রিকায়ই দেখলাম আপাতত চাল রফতানি হচ্ছে না। শুনেছি ফেসবুকে কটুকাটব্য চলে; কিন্তু সে কাজও যে মোটেই নিরাপদ নয়, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। 

এক হাতে রফতানি, অন্য হাতে আমদানি- ওই দ্বৈতনীতির পরস্পরবিরোধিতাটা কিন্তু আপাত মাত্র। ভেতরের বস্তু অভিন্ন, সেটা হলো মুনাফা। রফতানিতেও মুনাফা, আমদানিতেও মুনাফা। কেবল যে বাণিজ্যিক মুনাফা তা নয়; কারসাজি করে, কাগজে-কলমে এক ক্ষেত্রে দাম কম, অন্য ক্ষেত্রে দাম বেশি দেখিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করা চলে। সমানে চলছে। টাকা পাচারের এ এক ভালো রাস্তা। আবার আমদানি-রফতানির ক্রীড়াকৌতুকে বাণিজ্যিকভাবে যে মুনাফাটা আসছে, সেটাও যে দেশে থাকবে, শিল্পকারখানা গড়তে খরচ হবে, এটাও নিতান্তই দুরাশা। মুনাফার একটা বড় অংশের নিশ্চিত গন্তব্য ওই বিদেশই। পুঁজিবাদী দুনিয়ার এটি আরেক বৈশিষ্ট্য। যে চীন মহাদেশ একসময় বিপ্লবী ছিল, সে যে এখন পুঁজিবাদী হয়ে গেছে, তার অনেক নিশ্চিত প্রমাণের একটি হলো- সেখানে ধনীরা অতিদ্রুত ধনী হচ্ছে এবং অধিক ধনীরা বিদেশে চলে যাচ্ছে। গত বছরেই নাকি দেশ ছেড়েছে দশ হাজার ধনাঢ্য ব্যক্তি। নিশ্চয়ই তারা খালি হাতে যায়নি, বোঁচকা-বাচকি সঙ্গে নিয়েই গেছে। শুনছি বাংলাদেশে ধনীদের ধনবান হওয়ার গতি চীনের ধনীদের গতিকেও হার মানিয়েছে এবং এই মহামান্য ধনীদের কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বিদেশে চলে গেছেন, অন্যরা যাওয়ার এন্তেজাম করছেন। ওই যে রক্তচোষা মুনাফা, ওটিই সারবস্তু। প্রত্যক্ষে-অপ্রত্যক্ষে সব সরকারি নীতিরই মূল কথাটা এখন মুনাফা। আর সে মুনাফা জনপ্রিয়তার নয় তবে অর্থবিত্তের বটে। সমষ্টিগত নয়, ব্যক্তিগত।

শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ