আজকের শিরোনাম :

মাদক বিরোধী অভিযান চাহিদার দিক বিবেচনায় আনা হোক

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০১৮, ১২:২৮

ড. নারায়ন বৈদ্য, ০৮ জুন, এবিনিউজ : অর্থনীতির জনক এডাম স্মিথ অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ের উপর এত জটিল ব্যাখ্যা করেন যে, সাধারণ জনগণ তার কিছুই বুঝতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে এডাম স্মিথের উদ্দেশ্য ছিল রাজার ইচ্ছায় যাতে অর্থনীতি পরিচালিত না হয়। একটি নির্দিষ্ট নিয়মে অর্থনীতি পরিচালিত হবে। তখনকার সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ছিল রাজা শাসিত। রাজার বা তাঁর উত্তরাধিকারের অর্থনীতির উপর কোন জ্ঞান ছিল না। অথচ রাজার ইচ্ছাই আইন। এরূপ অরাজকতা থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করার জন্য তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি ওয়েলথ অব ন্যাশনস’–এ লিখেন, অর্থনীতিতে রাজা কোন হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু তাঁর এরূপ ব্যাখ্যায় কেউ সন্তুষ্ট হতে পারল না। এ কারণে একদিন সাংবাদিকেরা তাঁকে জিজ্ঞাস করেন যে, রাজা যদি অর্থনীতিতে হস্তক্ষেপ না করে তবে অর্থনীতি চালাবে কে? এর উত্তরে তিনি বলেন– ‘অদৃশ্য হস্ত’ এ শব্দটিও কেউ বুঝতে পারেনি। আসলে তিনি বুঝাতে চেয়েছেন ‘অদৃশ্য হস্ত’ হচ্ছে মার্কেট ম্যাকানিজম বা দাম প্রক্রিয়া। দাম প্রক্রিয়া হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে কোন পণ্যের বা সেবার দাম নির্ধারিত হবে উক্ত পণ্যের চাহিদা ও যোগানের ভিতর দিয়ে। নির্দিষ্ট সময়ে অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে কোন পণ্যের দামের সাথে চাহিদার সম্পর্ক হয় ঋণাত্মক, আবার দামের সাথে যোগানের সম্পর্ক হয় ধনাত্মক। কাজেই ঋণাত্মক চাহিদা রেখা ধনাত্মক যোগান রেখাকে যে বিন্দুতে ছেদ করে সেই বিন্দুতে ভারসাম্য দাম ও পরিমাণ নির্ধারিত হয়। এভাবে কোন পণ্যের দাম ও পরিমাণ নির্ধারিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে দাম প্রক্রিয়া বলে। উক্ত দাম প্রক্রিয়া থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট। সেটা হচ্ছে যে কোন পণ্যের চাহিদার একটি দিক আছে এবং যোগানেরও একটি দিক আছে। ভারসাম্য অবস্থা পাওয়ার জন্য ঐ দুইটি বিষয়কে বিবেচনা করতে হবে। ‘মাদক’ নামক বস্তুটার ক্ষেত্রে তা বিবেচনা করা হচ্ছে না।

প্রিয় পাঠক, সম্প্রতি মাদক বিরোধী অভিযান জোরদার হয়েছে। আসলে মাদক কি? কেনই বা এটি ব্যবহার করে। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা মাদক কি ব্যবহার করত না? যারা শরৎ বাবুর উপন্যাস পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই অনেক জায়গায় পেয়েছেন– ‘আফিম’ নামক মাদক খেয়ে ঝিমানোর কথা। শ্রীকান্ত উপন্যাসে ‘গাঁজা’ খাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। কাজেই বাঙালির পূর্বপুরুষেরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মদ, গাঁজা, আফিম ব্যবহার করতো। আরো পরে এ দেশে রাজা শাসকদের অন্দরমহলে ‘বাঈজী’ নামক নর্তকীকে নিয়ে যে মদের আসর বসতো তা কমবেশি সকলের জানা। সুতরাং এ সিদ্ধান্তে আসা যায়– মদ, গাঁজা, ভাং, আফিম অনেক আগে থেকে এ দেশের অন্ধকার জগতে প্রচলিত ছিল। তবে এখন কেন এ অভিযান?

সুপ্রিয় পাঠক, আগে এসব মাদক ব্যবহার করতো মধ্যবয়সী গুটিকয়েক শ্রেণির লোক। এখন ব্যবহার করে যুবক, কিশোর–কিশোরীরা। আবার যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মাদকের শ্রেণিগত পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে মাদক দ্রব্য হিসেবে হেরোইন, মারিজুয়ানা, এলএসডি, প্যাথেড্রিন, কোকেন, মরফিন, পপি, হাশিস, ক্যানবিস ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি বাংলাদেশে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের মরণ নেশা। যে কোন ধরনের মাদক দ্রব্য, যা নেশার সৃষ্টি করে তা সুস্থ মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটায়, হিতাহিত জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি লোপ করে দেয়। নেশাদ্রব্য গ্রহণের ফলে ধীরে ধীরে মানুষের হজম শক্তি বিনষ্ট হয়। খাদ্যস্পৃহা কমে যায়, চেহারা বিকৃত হয়ে পড়ে, স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায়, শারীরিক ক্ষমতা লোপ পায়, কিডনি বিকল করে দেয়, মস্তিষ্কের সেলগুলোকে ধ্বংস করে, লিভার সিরোসিস রোগের সৃষ্টি করে। মদের নেশায় বিভোর ব্যক্তি এমনসব কাণ্ডকীর্তি করে বসে, যা পারস্পরিক ক্রোধ প্রতিহিংসাকে জাগ্রত করে। মাদকতার মাধ্যমে সমাজে অশ্লীলতা বেড়ে যায়। নেশাগ্রস্ত মানুষগুলো অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠে। অনেক সময় দেখা যায়, নেশার কারণে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সুস্থ মানুষ একান্তই কাম্য। মাদক মানুষের বিবেক বুদ্ধিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র তথা সমগ্র জাতির ক্ষতি সাধিত হয়। মাদকের এ ক্ষতিকর দিকগুলো লক্ষ্য করে এর প্রতিকারের জন্য বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি দেশ এগিয়ে এসেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ১৫টি দেশে রয়েছে মাদকের উপর নিষেধাজ্ঞা। এ দেশগুলোর অধিকাংশ হয় মুসলিম দেশ। এ দেশগুলো হয়– ইরান, ব্রুনাই, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আরব আমিরাত, সোমালিয়া, সুদান, সৌদিআরব, মৌরিতানিয়া, মালদ্বীপ, কুয়েত, লিবিয়া, ইয়েমেন ও পাকিস্তান (শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য)। তাছাড়া ১৯২০–১৯৩৩ সময়ের জন্য আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ ছিল। রাশিয়ায় নিষিদ্ধ ছিল ১৯১৪ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত। কানাডায় নিষিদ্ধ ছিল ১৯১৮–১৯২০ সাল পর্যন্ত। এ ছাড়া একটা সময় পর্যন্ত মদ নিষিদ্ধ ছিল তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্গত হাঙ্গেরিতেও। অথচ আজ এ মাদকের ভয়ংকর থাবায় বিশ্বব্যাপী বিপন্ন হচ্ছে মানব সভ্যতা। এর সর্বনাশা মরণছোবলে এ দেশে ভেঙ্গে পড়েছে অসংখ্য পরিবার। বাংলাদেশে বিঘ্নিত হচ্ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। ব্যাহত হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বৃদ্ধি পাচ্ছে চোরাচালান সহ মানবতা বিধ্বংসী অসংখ্য অপরাধ। মাদকাসক্তির কারণে এ দেশের সুদূর গ্রাম্য জনপদ থেকে শহরাঞ্চলের অভিজাত এলাকা এমনকি বস্তি এলাকা পর্যন্ত সবখানে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস বেড়ে গিয়ে সাধারণ নাগরিক থেকে বিত্তশালী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনগণ কেউ রেহাই পাচ্ছে না। সব শ্রেণি মানুষের জানমাল ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সমাজের বেশিরভাগ অপরাধের জন্য দায়ী এ মাদক। কোনভাবেই মাদকের উৎসকে বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদকের প্রসারতা বন্ধ করার জন্য ইহাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কারণ এ মাদকের কারণে এদেশের এক একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাই এ মাদক বিরোধী অভিযান।

প্রিয় পাঠক, মাদকের বাজারেও দুইটি দিক আছে। এদের একটি হয় চাহিদার দিক আর অপরটি হয় যোগানের দিক। ঐ যে, এডাম স্মিথের ভাষায় দাম প্রক্রিয়া এখানেও বিদ্যমান। মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। ইহার অর্থ হল যে, যোগানের দিকটাকে সরকার বিবেচনা করছে। মাদকের যোগান তথা উৎস বন্ধ করার জন্য মাদক যোগানদারদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। তা কিন্তু যথেষ্ট নয়। কারণ চাহিদার দিকটি যদি অপরিবর্তিত থেকে যায় তবে মাদকের যোগান হ্রাসের সাথে সাথে মাদকের দাম বৃদ্ধি পাবে। ফলে অতিরিক্ত মুনাফার আশায় জীবন বাজি রেখে কিছু লোক শত বাধা সত্ত্বেও অতি গোপনে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাবে। যেমন করে মাদক পাচারের পন্থা হিসেবে চট্টগ্রামের চোরা কারবারীরা লক্ষীপুরের একজন জেলেকে ২ দিনে ১০ হাজার টাকা চুক্তিতে তাকে অজ্ঞান করে পায়ু পথে তার পেটের মধ্যে প্রায় এক হাজার ইয়াবা ঢুকিয়ে দেয়। তাকে লক্ষীপুর থেকে নৌপথে বরিশাল নিয়ে যাওয়া হয়। বরিশাল শহরের একটি বাসা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। শের–ই–বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উক্ত ব্যক্তির পেট অপারেশন করে ইয়াবাগুলো উদ্ধার করা হয়।

প্রিয় পাঠক, এবার দেখুন! এ এক অদ্ভুত পন্থা। জীবন যেখানে সংকটাপন্ন, আয় যেখানে শূন্য, দারিদ্র্য যেখানে দরজার গোড়ায় এসে হাজির হয় সেখানে মানুষের জীবনের দাম মাত্র ১০ হাজার টাকা। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব। কাজেই সরকারকে মাদকের চাহিদার দিকটি অবশ্যই দেখতে হবে। যারা মাদক গ্রহণ করে তাদের গ্রেপ্তার করে সংশোধনের ব্যবস্থা করা হোক। প্রয়োজনবোধে আইনের আওতায় এনে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হোক। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য টিভিতে প্রজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করা হোক। শহরের ব্যস্তমত এলাকায় জনস্বার্থে বিশাল বিশাল সাইনবোর্ড টাঙ্গানো হোক। সর্বোপরি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। তবেই এ অভিযান সফল হবে।

লেখক : প্রফেসর, ফ্যাকাল্টি অব বিজ্‌নেস এড্‌মিনিস্ট্রেশন, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।
(সংগৃহীত)

এই বিভাগের আরো সংবাদ