আজকের শিরোনাম :

জনকল্যাণমুখী বাজেট চাই

  সালেহউদ্দিন আহমেদ

৩১ মে ২০১৯, ১১:৩৩ | অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশ উন্নয়নের যে অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে, বাজেট তাতে বিশেষ একটা ভূমিকা রাখে। কাজেই জনচাহিদা ও উন্নয়নের ধারাকে সচল রাখতে এবং এগিয়ে নিতে বাজেটের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী কয়েক দিন পর, ১৩ জুন সংসদে বাজেটের পুরো বিবরণ পেশ করবেন। বাজেটের নানা দিক ও কার্যক্রম আছে। সহজ করে বলতে গেলে বাজেটটা হচ্ছে সরকারি আয় ও ব্যয়ের বার্ষিক হিসাব। একই সঙ্গে এটা উন্নয়ন ব্যয় ও অনুন্নয়ন ব্যয়ের হিসাব। সরকারি বাজেট হলেও এটা সার্বিকভাবে দেশের আপামর জনসাধারণ এবং সব ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। কারণ বাজেটে নানা রকম কর আরোপ করা হয় এবং ব্যবসায়ে নানা ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হয়। পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতেও বাজেটের একটা ভূমিকা থাকে। সে কারণে বাজেটের প্রভাবটা কমবেশি সবার ওপরেই পড়ে। এ কারণে বাজেট নিয়ে আমরা এত আলাপ-আলোচনা করি।

প্রতিবছরই বিশাল আকারের বাজেট দেওয়া হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। এবারে শুনছি, গতবারের চেয়ে আরো বড় আকারের বাজেট দেওয়া হবে। পাঁচ লাখ কোটি টাকারও বেশি বাজেট দেওয়া হবে। সেটা এক হিসেবে বেশি নয়। বিরাট বাজেট হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা মনে করি, বাজেটটা যেন বাস্তবমুখী হয়। এটা না হলে বাজেটের সাফল্যটা সেই অর্থে পাওয়া যাবে না।

একটা বিষয়ে জোর দিতে হবে, বাজেট থেকে আপামর জনসাধারণ যেন উপকৃত হয়। এ জন্য আমরা চাই একটা কল্যাণমুখী এবং গণবাজেট যেন দেওয়া হয়। যাতে সার্বিকভাবে মানুষ বাজেট থেকে উপকার লাভ করে। বিশেষ গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রণোদনা দেওয়া হবে, তা হোক; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নতুন বাজেটের ফলে সাধারণ মানুষ যেন উপকৃত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ছোট-বড়-মাঝারি, বড় শিল্প ও ছোট শিল্প, ভোক্তা, দরিদ্র, অতিদরিদ্র, উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত—সবার ওপরেই যেন একটা প্রভাব ফেলে। সেই সঙ্গে যেন বাজেটের সুফলটা সবাই পায়।

এবারে বাজেট নিয়ে একটা প্রত্যাশা, বাজেটটা যেন কল্যাণমুখী হয়। কল্যাণমুখী এ জন্য বলছি—বাংলাদেশকে আমি দেখতে চাই একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধি হতে থাকবে, এমন নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলে আরো কিছু বিষয় সামনে আসবে—রপ্তানি বাড়বে, রেমিট্যান্স বাড়বে; কিন্তু এগুলো কিছু সুযোগ মাত্র। জীবনযাত্রার মানও তো বাড়তে হবে। মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকার; অধিকার বলতে মানুষের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যবোধ, কথা বলার অধিকার, কাজের সুযোগ—এ সব মিলিয়েই কিন্তু মানুষ। সুতরাং বাজেটে সে জন্য কল্যাণমুখী শব্দটির ওপরে জোর দিতে চাই। সোজা কথায়, মানুষের কল্যাণের জন্য যে বাজেট, আমরা সেটার কথাই বলছি।

এখানে আরেকটি ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ। বিরাট বাজেট দিয়ে সেটা ভালোভাবে বাস্তবায়ন করা গেল না। অনেক সময় বাজেটে একটি বিশাল ঘাটতি থাকে, আয় ও ব্যয়ের মধ্যে অনেক ফারাক থাকে। বিশাল খাটতি হলে সরকার বিশাল ট্যাক্স, ফি ইত্যাদির লক্ষ্য নির্ধারণ করে। সরকারের রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্য থাকে, সেটা পূরণ হয় না। মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। বাজেটের ঘাটতি এড়ানোর জন্য এনবিআর নানা ধরনের চাপ তৈরি করে। কর, ট্যাক্স এবং নানা ধরনের ফি আরোপ করে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরো বাড়ে। মানুষ বিরক্ত হয়। ব্যবসায়ীরা তো ভুক্তভোগী হয়ই, সাধারণ মানুষও এই ভোগান্তি থেকে রেহাই পায় না। অতএব বাজেটটা দেওয়ার সময় আয়ের উৎস ও কাঠামো ঠিক রাখতে হবে, তখন ব্যয়টাও যুক্তিসংগত ও ফলপ্রসূ হবে। বেশি আয় করতে গেলে যেটা হয়, ব্যাপক ঘাটতি থেকে যায়; তখন ব্যয়ের ব্যাপারে লাগামছাড়া হয়।

কেমন বাজেট চাই-বলতে বলা হলে আমি বলব যে বাজেটটা অবশ্যই কল্যাণমুখী হতে হবে। আরেকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে—কর্মসংস্থান তৈরিতে জোর দিতে হবে। বাজেটের প্রধান কিছু দিক থাকবে, তার মধ্যে আমি মনে করি এটা অন্যতম একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর উন্নয়নটা যেন কেন্দ্রমুখী না হয়। উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি প্রচুর পরিমাণে হচ্ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু লক্ষ রাখতে হবে যে উন্নয়নটা যেন শুধু ঢাকা এবং কিছু বড় শহরকেন্দ্রিক না হয়। সব ধরনের উন্নয়নের সুবিধা ও সুফল যেন সারা দেশের মানুষ উপভোগ করতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে। কেন্দ্র থেকে বিকেন্দ্রীকরণ করে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বাজেটের বিষয়গুলো মাথায় রেখে বলতে পারি, গত বাজেটগুলোতে যেগুলো দেখেছি, বাজেটের বিরাট ঘাটতি থেকে গেছে। রেভিনিউ টার্গেট পালন করা হয় না। ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্র থেকে কিছু পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া নানা ধরনের উেসর ওপর নির্ভর করতে হয়। এখন নানা ধরনের কাজ হচ্ছে। বড় ও মেগা প্রজেক্ট হচ্ছে। যথাসময়ে কাজ শেষ হচ্ছে না। ফলে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। মেগা প্রজেক্টের অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু লাগামহীন খরচ করে যাবে, সময় বেড়ে যাবে—এটা নিয়ে ভাবতে হবে। মেগা প্রজেক্টের ফলটা তো তাত্ক্ষণিক আসে না। সময় লাগে। কাজ শেষ হতেও সময় লাগে, ফলটাও দেরিতে পাওয়া যায়। গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রকল্প অর্থ বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হতে পারে। মূল্যস্ফীতি দেখা দিতে পারে, এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।

এবারের বাজেটে শিল্পোন্নয়নের দিকে জোর দেওয়া উচিত। শিল্প বলতে শুধু রপ্তানি শিল্প নয়। দেশের ভেতরে যে ছোট-বড় ও মাঝারি শিল্প আছে, সেগুলোর উন্নতি করতে হবে। আমাদের এখানে সেবা খাত থেকে ভালো আয় আসছে। বাণিজ্যসেবায় তাই গুরুত্ব দেওয়া হয়। এতে কর্মসংস্থান সেভাবে হচ্ছে না। আমাদের এখন দরকার শিল্পোন্নয়নে জোর দেওয়া। ছোট-বড় ও মাঝারি শিল্পে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, প্রণোদনা যেটা দেওয়া হয় সেটা কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এবং নির্বাচিত কিছু প্রতিষ্ঠানকে। ভর্তুকি যারা পায়, তারাই পেয়ে যায়। এতে হয় কী—প্রণোদনার প্রভাবটা সেভাবে কাজে লাগছে না। অন্যান্য রপ্তানি খাত কিছু আছে, যেমন—চামড়া, ফার্মাসিউটিক্যাল, সিরামিক, বিভিন্ন ট্রেনিং এবং পাট খাত—এগুলোর প্রতি সেভাবে গুরুত্ব নেই। অতএব প্রণোদনার ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। সুনির্দিষ্ট খাতে এটা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। ট্যাক্সের আওতা বাড়াতে হবে। প্রতিবছর যাঁরা ট্যাক্স দিচ্ছেন, তাঁদের ওপরেই শুধু চড়াও হলে হবে না। এটা তো ঠিক না। এর আওতাটা বাড়াতে হবে। ঢাকার বাইরেও অনেক ব্যবসায়ী আছেন, তাঁদের কাছে পৌঁছানোর প্রয়োজন আছে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, তাদের কাছে আমরা পৌঁছাতে পারছি না। নতুন সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে হবে। বহু লোকের টিন নম্বর আছে, কিন্তু তাঁরা ট্যাক্স দিচ্ছেন না। বহু বছর ধরে এনবিআর বলছে, সার্ভে করবে। তারা কিন্তু এটা সম্পন্ন করেনি। এ ছাড়া ঢাকা শহরেও অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা ট্যাক্সের আওতায় নেই। আর ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকের অনেক আয় আছে। তাদের শনাক্ত করে তাদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করতে হবে।

আবার করপোরেট ট্যাক্স যেগুলো আছে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের, তাদের ওপরই ক্রমাগত চাপ বাড়ছে। অন্য বড় ব্যবসায়ী বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান এমনকি মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আওতায় আনতে হবে। এখানে যে দুটি বিষয় নিয়ে বললাম, প্রণোদনা ও ট্যাক্স—এই দুটির আওতাটা বাড়াতে হবে বলে আমি মনে করি। ক্যাপিটাল মার্কেটের কার্যকরিতা বাড়াতে হবে। এখানে নানা ধরনের সমস্যা আছে। সেগুলো চিহ্নিত করে এই খাতকে উন্নত করতে হবে।

পুঁজিবাজারে যাঁরা ছোট বিনিয়োগকারী তাঁরা সময়মতো ঋণ পান না। সুযোগ-সুবিধাও হয়তো তাঁরা তেমন পাচ্ছেন না। তাঁদের দিকে একটু নজর দিতে হবে। তবে টাকা দিয়ে কিন্তু সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না। টাকাটা কাকে দেওয়া হবে, কে পাবে বা পাবে না—এ ধরনের কিছু জটিলতা আছে। এর চেয়ে ভালো হয় ছোট বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্সটা যদি কমানো সম্ভব হয়, তাহলে বরং ভালো হতে পারে।

আমাদের এখানে পরোক্ষ করের (বিশেষ করে মূল্য সংযোজন কর) ওপর সরকার বেশি নির্ভরশীল। প্রত্যক্ষ করের (যেমন আয়কর) ওপর বেশি জোর দিতে হবে। সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানের পারফরম্যান্স ভালো নয়, লস করে চলেছে বছরের পর বছর, সেগুলো ঢেলে সাজাতে হবে। আর শিক্ষার প্রতি নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে আরো মনোযোগ দিতে হবে। প্রশিক্ষণ ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে এবং মানবসম্পদ তৈরি করার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আয়ের বৈষম্য কমাতে হবে। বয়স্কভাতা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। 

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরো সংবাদ