আজকের শিরোনাম :

বিএনপির একমাত্র পুঁজি কি ভারত বিরোধিতা?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০১৮, ১৪:১৫

আবদুল মান্নান, ০৬ জুন, এবিনিউজ : সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ সফর শেষে দেশে ফেরার পর বিএনপি ও তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী ঢাকাকেন্দ্রিক সুশীল সমাজ এই বলে মাতম শুরু করেছেন যে শেখ হাসিনা ভারতকে সবকিছু দিয়ে এসেছেন, তার বদলে তিস্তার এক বালতি পানিও আনতে পারেননি। পূর্বের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা ভারত হতে ফিরে দুদিন পর সংবাদ সম্মেলন করলেন। সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বললেন, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন তা তারা সারা জীবন মনে রাখবেন। তার প্রতিদানে তিনি কিছু প্রত্যাশা করেন না। সঙ্গে সঙ্গে রিজভী আহমেদ হতে শুরু করে ড. খোন্দকার মোশাররফ হোসেন চিৎকার শুরু করে দিলেন কী দিয়ে এসেছেন জানান। এই হইচইয়ে শামিল হলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আর ব্যারিস্টার মওদুদ । বিএনপি’র এই গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনার সফর এবং তিনি কী দিয়ে এসেছেন এবং কী নিয়ে এসেছেন তা যে জানেন না সেটি সত্য নয়। কারণ, এরা সকলে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠ ছিলেন। জিয়া হতে শুরু করে বেগম জিয়া তাদের শাসনকালে অনেকবার বিদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছেন। এই নেতারাও তাদের সফরসঙ্গী হয়েছেন। সুতরাং একটি রাষ্ট্রীয় সফর হোক বা না হোক, একটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান অন্য দেশে কী দিতে পারেন আর কী পারেন না তা তারা ভালো জানেন। আর শেখ হাসিনার পশ্চিমবঙ্গ সফরটি সঠিক অর্থে রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। একটি রাষ্ট্রীয় সফরের পূর্বে দু’দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে উভয় দেশে একাধিক বৈঠক করেন, দুই দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানদের মধ্যে আলোচনার বিষয়বস্তু যৌথভাবে নির্ধারণ করেন। সফরের সময় অনেক ক্ষেত্রে আলোচ্যসূচির বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়ের আলোচনাও হতে পারে। শেখ হাসিনার এই সফরটি ছিল মূলত দুটি উদ্দেশ্যে। প্রথমটি শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মিত ‘বাংলাদেশ ভবন’ ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ যৌথভাবে উদ্বোধন আর দ্বিতীয়টি ছিল আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান আসানসোলে অবস্থিত কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে তাঁকে দেওয়া সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি গ্রহণ করা। শেখ হাসিনা এর আগে বিশ্বের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমন সম্মানসূচক ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় হতে এই ডিগ্রি গ্রহণ না করলে তাঁর কোনও লোকসান হতো না। তিনি সেই সম্মানসূচক ডি-লিট গ্রহণ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জাতীয় কবির নামে। স্থাপিত হয়েছে ২০১২ সালে। ১৯৯৯ সালে যখন শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বিশ্বভারতী তাদের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ‘দেশিকোত্তম’ ডিগ্রি দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানিত করেন এবং তিনি তা গ্রহণ করার পর জাতীয় কবির জন্মস্থান আসানসোলের চুরুলিয়া সফর করেন। তাঁর আগমন উপলক্ষে সেবার আসানসোল এবং চুরুলিয়া সাজ সাজ রব উঠেছিল। রাতারাতি সেখানে কিছু রাস্তাঘাট হলো। তিনি তখন যত না বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার চাইতেও বেশি বঙ্গবন্ধু কন্যা। বর্তমানে তো শেখ হাসিনা বিশ্বের কাছে শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী নন, একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক।

আসলে বিএনপি এবং তাদের সুশীল সমাজের শেখ হাসিনার সফর নিয়ে এত যে হৈচৈ তার একমাত্র কারণ হচ্ছে বিএনপির বর্তমান একমাত্র পুঁজি যে ভারত বিরোধিতা তা জাহির করা। আগে ভারত বিরোধিতার সঙ্গে ছিল পাকিস্তানের সাথে সখ্য। বর্তমানে পাকিস্তানের সঙ্গে সখ্য থাকলেও তা তারা প্রকাশ্যে বলতে পারে না। কারণ, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি এখন সম্পূর্ণভাবে একটি পতিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বিএনপি বুঝতে পারে না এখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে আর ভারত বিরোধিতার ট্যাবলেট সহজে গেলানো যায় না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের দেড় লক্ষ মানুষ কলকাতায় ঈদের বাজার করছে। সন্ধ্যা হলেই বাড়িতে বাড়িতে মহিলারা ভারতের টিভি সিরিয়াল দেখতে বসে যান। বিএনপি’র একাধিক সিনিয়র নেতাকে দেখেছি ভারতে চিকিৎসা নিতে নিয়মিত চেন্নাই, কলকাতা আর ভেলোর যাতায়াত করতে। বিএনপির বুঝতে হবে এখন শুধু ভারত বিরোধিতা দিয়ে এই দেশের রাজনীতিতে খুব বেশিদূর যাওয়া যাবে না। তারা শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু তাদের গণআন্দোলন কী ভয়াবহ হতে পারে তা দেশের মানুষ ২০১৩ ও ২০১৪ সালে দেখেছেন।  রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে বিএনপিকে তাদের রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে।

বিএনপির মূল প্রশ্ন ‘শেখ হাসিনা ভারতকে কী কী দিয়ে এসেছেন তা জাতিকে জানাতে হবে’। রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ভারত গেলেন তিস্তা নিয়ে কোনও কথা হলো না, এক বালতি পানিও আনতে পারলেন না। শেখ হাসিনা ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে নিরাপত্তা ও শান্তি দিয়েছেন। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে সেই পাকিস্তান আমল হতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো সশস্ত্র সন্ত্রাসে লিপ্ত ছিল। এদের মধ্যে প্রধান ছিল মিজোরামের ‘মিজো ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের নেতা পিউ লাল ডেঙ্গাকে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য পাকিস্তান সরকার ঢাকার মতিঝিলে অফিস খুলে দিয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মিজো বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাবর্ত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সক্রিয় দোসর হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর লালডেঙ্গা তার বাহিনী নিয়ে নাগাল্যান্ডে চলে যান এবং পরবর্তীকালে স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরে আসেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফাসহ আরো একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ঘাঁটি গাড়ে। উলফার শীর্ষ নেতা অনুপচেটিয়া ও অরবিন্দ রাজখোওয়া অনেকটা স্থায়ীভাবে ঢাকাতেই অবস্থান করে এখান হতে ভারতে অন্তর্ঘাতমূলক  কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বিদেশ হতে তারা পাকিস্তানের আইএসআই-এর সহায়তায় নিয়মিত অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান পেতে থাকে। বাংলাদেশ হয়ে ওঠে ভারতে অবৈধ অস্ত্র চালানের নিরাপদ রুট। বেগম জিয়ার শাসনামলে চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও ২০০৩ সালে বগুরার কাহালুতে কয়েক হাজার রাউন্ড গুলি উদ্ধার নিয়ে চারদিকে তোলপাড় শুরু হয়। সংসদে দাঁড়িয়ে বেগম জিয়ার মন্ত্রী সভার সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যে স্বাধীনতার আন্দোলন করছে তাতে বাংলাদেশের নৈতিক সমর্থন দেওয়া উচিত।

১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতের সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়। উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া ও অরবিন্দ রাজখোওয়াকে ঢাকায় গ্রেফতার করে ভারতের হাতে তুলে দেয়। পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে শান্তি ফিরে আসে। শেখ হাসিনা ভারতের জনগণকে শান্তি দিয়েছে। একটি দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় শান্তির চাইতে মূল্যবান আর কী হতে পারে। এটাই শেখ হাসিনা ভারতকে দিয়েছে এবং এর চাইতে বড় কিছু পাওনা তো ভারতের থাকতে পারে না। শেখ হাসিনা ভারতে গেলেই তিস্তার কথা ওঠা স্বাভাবিক।  কারণ, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের অধিকার। শুধু তিস্তা নয়, বাংলাদেশের একাধিক নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমস্যা ছিল এবং আছে। এরমধ্যে গঙ্গার পানিবণ্টন অন্যতম যার সূত্রপাত পাকিস্তান আমলে যখন ভারত উজানে ফারাক্কা বাঁধ দেওয়া শুরু করে। তখন পাকিস্তান এই বাঁধ নিয়ে টুঁ-শব্দটি করেনি। প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে গঙ্গার পানিবণ্টন সমস্যা নিয়ে ভারতের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে স্থাপিত হয় যৌথ নদী কমিশন এবং বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে দিল্লিতে পঁয়তাল্লিশ হাজার কিউসেক পানি শুকনা মৌসুমে বাংলাদেশ পাবে মর্মে  একটি অন্তর্র্বতীকালীন চুক্তি সম্পাদিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সেনা শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে ভারত সেই চুক্তি বাতিল করে দেয়। ১৯৭৭ সালে যৌথ নদী কমিশনের এক বৈঠকে গঙ্গার পানি হিস্যা পঁয়তাল্লিশ হাজার কিউসেক হতে কমিয়ে কুড়ি হাজার কিউসেক করা হয়। জেনারেল জিয়ার পানিসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা বিএম আব্বাস এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৯৮০ সালের ২১ জানুয়ারি জেনারেল জিয়া ইউনিডোর সম্মেলনে যোগ দিতে গেলে ভারতের দৈনিক হিন্দু পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ফারাক্কা বাঁধ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের কিছু বলার নেই’। ১৯৯৩ সালে বেগম জিয়া ভারত সফর শেষে দেশে ফিরলে তাঁর কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিস্তা বা অন্যান্য নদীর পানিবণ্টন সম্পর্কে কোনও আলোচনা করেছেন কিনা? উত্তরে বেগম জিয়া বলেন, ‘প্রসঙ্গটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম’। রিজভী গং এসব বিষয় সম্পর্কে কী ওয়াকিবহাল ? টিপাইমুখে বাঁধ হবে এই পরিকল্পনা তো ১৯৭৮ সালে জিয়া এবং ১৯৯১ সালে বেগম জিয়ার সরকার সমর্থন করেন। এসব বিষয় তো রিজভী, খোন্দকার মোশাররফ হোসেনের অজানা থাকার কথা নয়। ঘটনা আরো আছে। সব কথা একসঙ্গে বলা বা লেখা সম্ভব নয়। গঙ্গার পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান করতে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পরপরই তিনি দিল্লি সফর করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেবি গৌড়ার সঙ্গে শুকনা মৌসুমে বাংলাদেশ পঁয়ত্রিশ হাজার হতে পঁয়তাল্লিশ হাজার কিউসেক পানি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা আদায় করে পঁয়ত্রিশ বছর মেয়াদি চুক্তি করেন। এবারের সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শেখ হাসিনা পৃথক পৃথকভাবে রুদ্ধদার বৈঠক করেন। সেই বৈঠক নিশ্চয় খোশগল্পের জন্য ছিল না। সংবাদমাধ্যম খবর দিচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দুই দেশের মধ্যে তিনবছর মেয়াদি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির সম্ভাবনা আগের যেকোনও সময়ের চাইতে উজ্জ্বল। ভারত ঠিকই জানে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কোনও দল ক্ষমতায় থাকলে তাদের সুবিধা। যেকোনও দেশ তাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। বিএনপি’র সমস্যা হচ্ছে ক্ষমতায় থাকতে তাদের মতো ভারতের বশংবদ সরকার আর নেই, আর না থাকলে বাংলাদেশ ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত হয়েছে বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। পরবর্তী কোনও সরকারই এই সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিএনপিতে নিশ্চয় বেশ কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে মুহূর্তে তারা এই দলটিতে যোগ দেন তাদের বিচার বুদ্ধি, সুস্থ চিন্তাশক্তি সবকিছুর অবসান ঘটে। তারা বাস্তব হতে অনেক দূরে সরে যান। সম্ভবত এটিই দলটির সংস্কৃতি। এমনটা চলতে থাকলে বিএনপির মুসলিম লীগ হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। (সংগৃহীত)

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

এই বিভাগের আরো সংবাদ