আজকের শিরোনাম :

বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও কিছু কথা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০১৮, ১৮:৩১

সঞ্জয় চৌধুরী, ০৫ জুন, এবিনিউজ : আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই আমাদের পরিবেশ। আর এই পরিবেশের প্রধান উপাদান বায়ু, পানি ও মাটি ইত্যাদির পরশে আমরা বেঁচে থাকি। প্রতিনিয়তই আমরা প্রকৃতির কাছ থেকেই শিখি আর প্রকৃতির পরিবেশেই বেড়ে উঠি। কিন্তু প্রাকৃতিক সম্পদের উপকারের প্রতিদানে অপকার করি। এই প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম সৌন্দর্য্য তার বনরাজি, সবুজ গাছ আর তরলতা যা থেকে প্রাপ্ত অক্সিজেন আমাদের জীবন বাঁচিয়ে রেখেছে। পৃথিবীর সব প্রাণী শ্বাস প্রশ্বাসের সময় অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। অপরদিকে বৃক্ষরাজি কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ ও অক্সিজেন ত্যাগ করে। বৃক্ষ যেখানে আমাদের পরম বন্ধু সেখানে শত্রুর মত বৃক্ষনিধনে মেতে উঠি। আমরা এই বৃক্ষকে সমূলে উৎপাটিত করে তার ভালবাসাকে মূল্যহীন করে দিই। এ যেন নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মারার মত। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত কারণে বায়ুমন্ডলে কার্বনডাইঅক্সাইডের পরিমাণ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একদিকে নির্বিচারে সবুজ বৃক্ষ নিধন করার ফলে অবশিষ্ট বৃক্ষরাজি সমূহ বায়ুমণ্ডলের এই অতিরিক্ত কার্বনডাইঅক্সাইড শোষণ করতে পাচ্ছে না বিধায় বায়ুমণ্ডল ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের বিজয় গৌরবে অন্ধমানুষ প্রতিনিয়তই পৃথিবীর পরিবেশকে বিষাক্ত করছে। এই বিষাক্ত পরিবেশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং সমস্ত জীবজগতের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার প্রভাব যে কতখানি ভয়াবহ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই গ্রিন হাউস কথাটির অর্থ হল “সবুজ ঘর” কিন্তু বর্তমানে “কাচঘর” হিসেবে এর ব্যাপক প্রয়োগ চলছে। এটি এমন একটি ঘর যার দেয়াল ও ছাদ কাচের দ্বারা তৈরী। এখানে সহজে আলো প্রবেশ করতে পারে কিন্তু বের হতে পারে না। ফলে কাঁচের ঘরটির তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যায় বাইরের উষ্ণতাকেও। এই অস্বাভাবিক অবস্থাটির নামই গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া। বেশী সময় ধরে সূর্যের তাপ ধরে রাখার কারণে শীতপ্রধান দেশে এই কাচ ঘরে সবুজ শাকসবজির চাষ করা হয়। পৃথিবীর এরকম কাচঘরের মতো বায়ুণ্ডলে আছে ভূ–পৃষ্ঠ থেকে ৩০ কি:মি পর্যন্ত ওজন স্তর, যার জন্য সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মিগুলো আমাদের এই পৃথিবীতে আসতে পারে না। এই স্তরের ঘনত্ব সর্বত্র একরকম নয়। ২৩ কি:মি এর ঊর্ধ্বে ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত কম। এই স্তরে রয়েছে কার্বন ডাই অক্সাইড ও আরো কয়েকটি গ্যাসের আস্তরণ। এই গ্যাসগুলোই গ্রিন হাউস গ্যাস নামে পরিচিত। কাঁচঘরের দেয়াল যেভাবে তার ভেতরের তাপমাত্রাকে বিকিরিত হতে না দিয়ে ধরে রাখে, ঠিক একইভাবে এই গ্যাসের বেষ্টনী বা পর্দা ভূপৃষ্ঠের শোষিত তাপের বিকিরণ ঘটাতে বাধা দেয়। ফলে ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা স্বাভাবিক থাকে। এই গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়ার কারণ হিসেবে মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অপরিকল্পিত কর্মকান্ডকে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রবল জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে পরিকল্পনাহীন নগরায়ন চলছে, যত্রতত্র স্থাপিত হচ্ছে কলকারখানা, যাতায়াতের জন্য বেড়ে চলেছে বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিন চালিত যানবাহন। এতে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে বায়ুমণ্ডলে তৈরি হচ্ছে ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন নামক অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি গ্যাস যা ওজোন স্তরের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে। এছাড়া শিল্পোন্নত দেশগুলোর অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারনে “বৈশ্বিক উষ্ণায়নের” মত ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এই বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে মেরু অঞ্চলের জমাট বাঁধা বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে ঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এবার আমরা একটু ফিরে দেখি পানি ও মাটি দূষণের দিকে। পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো সাধারণত জলাশয়ের সাথে যুক্ত থাকার কারণে শহর, হাটবাজার, বাসাবাড়ির ময়লা আবর্জনা, বিভিন্ন প্রাণীর মলমূত্র খালবিল ও নদীতে গিয়ে পানিকে দূষিত করছে। ফসলের জমিতে মাত্রাতিরিক্ত বালাইনাশক রাসায়নিক পদার্থ, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বর্জ্য, লঞ্চ ও স্টিমারের তেল নিঃসরণ ইত্যাদি কারণেও পানি দূষিত হচ্ছে। আর এই দূষিত পানি পান করে কলেরা, টাইফয়েড ও ডায়রিয়া রোগের মত মারাত্মক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। মানুষ আবার অন্যদিকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় প্রথম যে মাটিতে পা রাখে এবং যে মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পরবর্তীতে মাটির সাথে মিশে যায় সে মাটিও আজ বিভিন্ন কারণে দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হল পলিথিনের ব্যবহার। এই পলিথিন পচে না বিধায় মাটির সাথে মিশে না গিয়ে স্তূপ তৈরি করে। ড্রেনে এটি পতিত হয়ে পানি নিষ্কাশনের বাধা সৃষ্টি করে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে মাটিকে প্রতিনিয়ত দূষিত করছে। এটি জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট করে ফসল ফলনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। পলিথিন যুক্ত মাটির ওপর গাছের চারা রোপণ করলে শিকড় স্বাভাবিকভাবে বাড়তে না পেরে তা পুষ্টিহীনতায় ভোগে। আজ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি এদেশের সাধারণ জনগণকেও পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। উপরে যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে আলোকপাত করলাম তার জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলিই দায়ী। তাই ক্ষতিপূরণ হিসেবে এদেশগুলোর ওপর কার্বন ট্যাক্স কার্যকর করে একটি অর্থ তহবিলের মাধ্যমে বিশ্ব পরিবেশ উন্নয়নে ওই অর্থ উন্নয়নশীল দেশসমূহে সহায়তা দিলে পরিবেশ বাঁচবে বলে আশা রাখি। সরকারীভাবে অবাধে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করে পরিকল্পিতভাবে শিল্প কারখানা স্থাপন করে এগুলোর বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। দেশে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের আইন প্রণয়ন করা হলেও তার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে এটির ব্যবহার চিরতরে বন্ধ করে পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে সবাই অংশীদার হতে হবে।

যানবাহনের কালো ধোঁয়া রোধের ব্যবস্থাকল্পে ফিট্‌নেসবিহীন গাড়িগুলোর রাস্তায় চলার অনুমতি বাতিল করে যদি সমস্ত গাড়িগুলো সিএনজির আওতায় আনা যায় তবে জনগণের বসবাস উপযোগী একটি পরিবেশবান্ধব ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে যা এদেশের জনগনের সুস্থজীবন যাপনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। ডাস্টবিনের ময়লা আবর্জনা ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত জৈব বর্জ্যগুলোকে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের মাধ্যমে বায়োগ্যাস ও জৈবসার উৎপন্ন করে বিপন্ন পরিবেশকে রক্ষা করা সম্ভব। আবার যে কোন একটি পরিবেশের জড় এবং জীব সম্প্রদায়ের মধ্যে আদান–প্রদান, ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া ও সহযোগিতার মাধ্যমে গড়ে উঠে পরিবেশ তন্ত্র বা ইকো সিস্টেম। এই ইকো সিস্টেমের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় থাকে। এটিকে টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও আবাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি। অন্যদিকে যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত শব্দকে নিয়ন্ত্রণে রেখে শব্দদূষণ অনেকাংশে রোধ করে পরিবেশের সার্বিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো যায়। এছাড়া জাতীয় পরিবেশ নীতির সফল বাস্তবায়ন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি, পরিকল্পিত নগরায়ন, ব্যাপকহারে বৃক্ষরোপন ও সংরক্ষণ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথাযথ ব্যবহার, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার হ্রাস, উপকূলীয় বনভূমির সম্প্রসারণ, বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজের সমন্বয় সাধন ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা ভগ্ন একটি পরিবেশ থেকে সুস্থ ও সুন্দর একটি পরিবেশ ফিরে পেতে পারি। পরিশেষে, আজকের এই বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমি সকলকে অন্ততপক্ষে একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে তার যথাযথ পরিচর্যার মাধ্যমে নির্মল পরিবেশ রচনায় এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাব।  (সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ