নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা : আবদুল মান্নান
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০১৮, ১৩:৫৭
ঢাকা, ০৪ জুন, এবিনিউজ : প্রধানমন্ত্রী কেমন কাজপাগল মানুষ, তা টের পাওয়া যায় তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে কোথাও গেলে। প্রয়োজনে তিনি কতটুকু ডিপ্লোমেটিক হতে পারেন, তারও একটা ধারণা মিলতে পারে। অবশ্য তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের কথা আলাদা। ব্যক্তিগতভাবে আমার দুইবার সুযোগ হয়েছে তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার। ২০১৫ সালে জাপানে আর সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। জাপান সফরের সময় তাঁকে যে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, তা অভূতপূর্ব। সাধারণত কোনো সরকার অথবা রাষ্ট্রপ্রধান জাপান সফরে গেলে তিনি কোনো একটি পাঁচতারা হোটেলে অবস্থান করেন। সেবার শেখ হাসিনা অবস্থান করেছিলেন আকাসাকা রাজপ্রাসাদে। তিনি হচ্ছেন তৃতীয় সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি এই প্রাসাদে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর আগে করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড আর বারাক ওবামা। প্রাসাদে শেখ হাসিনা পেয়েছিলেন একটি দৃষ্টিনন্দন গার্ড অব অনার, যেখানে তাঁর কয়েকজন সফরসঙ্গীর সঙ্গে আমারও উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেবার জাপান জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দক্ষিণ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অস্থায়ী সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা করবে। বাংলাদেশেরও করার কথা। বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে জাপানের জেতার সম্ভাবনা কমে যায়। রাতের রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশের সমর্থন চাইলেন। শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় স্পষ্ট কিছু না বলে জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালেন এবং বললেন, বন্ধু দেশ জাপান যদি আমাদের কাছে কিছু চায়, তাহলে তা নিশ্চয়ই আমরা ভেবে দেখব। পরিচয় পর্বের সময় আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে অনেকটা চুপি চুপি বলি, নিরাপত্তা পরিষদে জাপানকে কী বাংলাদেশের সমর্থনের কথা এখানে জানাবেন? তিনি আমাকে চটজলদি উত্তরে জানালেন—‘এখানে ঘোষণা করলে আবে বাংলাদেশে না-ও আসতে পারেন।’ ঠিক আড়াই মাসের মাথায় আবে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং যথারীতি শেখ হাসিনা ঘোষণা করলেন, বাংলাদেশ জাপানকে নিরাপত্তা পরিষদের নির্বাচনে সমর্থন জানিয়ে বাংলাদেশের মনোনয়ন প্রত্যাহার করবে। এর আগে বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য ছিল। বাংলাদেশ-জাপানের বন্ধুত্ব আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল।
এবারের ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ সফর সঠিক অর্থে কোনো রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। এটি ছিল শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাংলাদেশের অর্থায়নে নবনির্মিত ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন আর আসানসোলে অবস্থিত কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি গ্রহণ করা। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০ জন সদস্য ২৪ মে কলকাতা পৌঁছে যান। সফরসঙ্গীদের বেশির ভাগই শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের ব্যক্তি। সবার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কলকাতার দুটি তারকাখচিত হোটেলে। প্রধানমন্ত্রী পরদিন আর তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছেন। সেখানে তিনি সেনাবাহিনীর বিশেষ হেলিকপ্টারে সরাসরি বিশ্বভারতীতে পৌঁছবেন। অন্য হেলিকপ্টারে যাবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। আমরা ২৫ তারিখে কাকডাকা ভোরেই প্রায় কুড়িটি গাড়িযোগে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশে যাত্রা করি। কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব সড়কপথে প্রায় ১৬৩ কিলোমিটার। সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। সকাল ১০টা নাগাদ যখন বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে পৌঁছি, তখন তাপমাত্রা প্রায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ক্যাম্পাসে তখন আনন্দঘন পরিবেশে কয়েক হাজার স্নাতক ঘোরাফেরা করছে। আজ তাদের সমাবর্তন। সভাপতিত্ব করবেন বিশ্বভারতীর আচার্য নরেন্দ্র মোদি। মঞ্চে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল আর বিশ্বভারতীর উপাচার্য ড. সবুজ কলি সেন।
সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ সমাবর্তনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। মূল বক্তা আচার্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর বক্তৃতার মাঝখানে বাংলাদেশ থেকে আসা অতিথিদের গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো ‘বাংলাদেশ ভবনে’। দূর থেকেই চোখে পড়ল দৃষ্টিনন্দন ভবনটি। বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসে আরো দুটি ভবন আছে। ‘চীনা ভবন’ আর ‘নিপ্পন ভবন’ (জাপান ভবন)। এই দুটি ভবন তাদের দেশের সাহিত্য, সংস্কৃৃতি, কৃষ্টি, ইতিহাস সম্পর্কে গবেষকদের সহায়তা করার জন্য ওই সব দেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। চীনা ভবন ইউনেসকো কর্তৃক ঐতিহ্য (হেরিটেজ) হিসেবে স্বীকৃত। ‘বাংলাদেশ ভবন’ নতুন হওয়ায় নির্মাণশৈলী একদিকে আধুনিক, আবার বিশ্বভারতীর অন্য ভবনগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্মিত। স্থপতি বাংলাদেশের রবিউল হুসাইন ও এহসান। ‘বাংলাদেশ ভবন’-এর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এই ভবন নির্মাণের জন্য উপকরণ ছাড়া সব কিছু বাংলাদেশ থেকে এসেছে। বাথরুম ফিটিংস থেকে শুরু করে ক্যাফেটেরিয়ায় ব্যবহৃত সামগ্রী, ৪৫০ আসনের অডিটরিয়ামের সব আসন, স্টেজের ব্যাকস্ক্রিন, পাঠাগারের বুকশেলফ—কোনো কিছুই বাদ যায়নি। প্রবেশমুখের বিশাল দেয়ালের দুই পাশে দুটি ফ্রেসকো। একটির স্রষ্টা বাংলাদেশের শিল্পী রফিকুন নবী, অন্যটির বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী বিশ্বভারতীর শিল্পী যোগেন চৌধুরী। পিতলের উদ্বোধনী ফলকটিও তৈরি করেছেন শিল্পী রফিকুন নবী। এক কথায় ভবনের যেখানেই স্পর্শ করা হোক, সেখানেই বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যাবে। নির্মাণে ব্যয় হয়েছে বাংলাদেশি টাকায় ২৫ কোটি। প্রাথমিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশ্বভারতীকে দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা। আর এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ সরকার ১০ কোটি টাকার একটি তহবিল বিশ্বভারতীকে দেবে এবং সেই তহবিল থেকে প্রাপ্ত মানাফা থেকে ১০ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে পিএইচডি ও মাস্টার্সে পড়াশোনা করার জন্য বৃত্তি দেওয়া হবে। দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ শেখ হাসিনা আর নরেন্দ্র মোদি উদ্বোধনস্থলে এসে পৌঁছলেন। সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর রাজ্যপাল কেশরীনাথ। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি তুমুল করতালির মধ্যে নামফলক উন্মোচন করার পর শুরু হয় ফটোসেশন। মমতা মোদির একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শেখ হাসিনা তাঁকে অনেকটা হাত ধরে টেনে এনে তাঁর পাশে দাঁড় করালেন। মমতার মুখে হাসির ঝিলিক। বোঝা যাচ্ছিল, তিনি মোদির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলেন। অডিটরিয়ামের ভেতর ঢুকেই চোখ জুড়িয়ে গেল। মূল অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন বাংলাদেশের শহীদকন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী ও বিশ্বভারতীর একজন অধ্যাপক। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে দুই দেশের জাতীয় সংগীত গাইলেন বিশ্বভারতীতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশ ও ভারতের শিক্ষার্থীরা। শুরুর বক্তা মমতা। নরেন্দ্র মোদি আর রাজ্যপালকে সম্বোধন করে শেখ হাসিনাকে সম্বোধন করলেন ‘আমার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে’। সংক্ষিপ্ত ছয় মিনিটের বক্তৃতা। বললেন, বাঙালির মাঝখানে হয়তো একটি রাজনৈতিক সীমারেখা তাদের আলাদা করে রেখেছে; কিন্তু ভাগ হয়নি তার সাহিত্য, ভাষা, ইতিহাস আর ঐতিহ্য। দুই দেশের মানুষের মধ্যে যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়েছে, যত সমস্যাই থাকুক, তা আরো নিবিড় হবে। যখন তিনি বললেন, ‘দুই দেশের মধ্যে জল অনেক গড়িয়েছে, জল আরো গড়াবে’—তখন সবাই ধরে নিলেন, তিনি হয়তো তিস্তার দিকে ইঙ্গিত করছেন। মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে তাঁর এই বক্তব্যকে সবাই স্বাগত জানালেন।
শেখ হাসিনা যখন তাঁর বক্তৃতা শুরু করলেন, তখন চারদিকে সুনসান নীরবতা। বলতে দ্বিধা নেই, এদিন তিনি ছিলেন পুরো অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। শুরুতেই তিনি বিশ্বভারতীকে ধন্যবাদ জানালেন ‘বাংলাদেশ ভবন’ নির্মাণে সহায়তা করার জন্য। ফিরে গেলেন ১৯৯৯ সালে, যখন তাঁকে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ডিগ্রি ‘দেশিকোত্তম’ দেওয়া হয়েছিল। জানালেন, যদিও তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত এই অসাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি, তার পরও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই সম্মান পাওয়ার পর নিজেকে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মনে করেন। বললেন, ১৯৭১ সালে দুই দেশের মধ্যে যে বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো নিবিড় হয়েছে। দেশভাগের পর দুই দেশের অনেক কিছুই হয়তো ভাগ হয়েছে; কিন্তু ভাগ হয়নি রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। বললেন, তাঁর পিতার জেলজীবনের সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সব সময় গুনগুন করে গাইতেন—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। বাংলা ভাষা, যে ভাষায় উভয় বাংলার মানুষ কথা বলে, তার জন্য ১৯৫২ সালে বাংলাদেশের তরুণরা রক্ত দিয়েছে। শোনালেন তাঁর সরকারের নেতৃত্বে সব অবিস্মরণীয় অর্জনের কথা। বাদ গেল না বঙ্গবন্ধু উপগ্রহের তরতাজা কাহিনি। ধন্যবাদ জানালেন নরেন্দ্র মোদি সরকারের সময় ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি ভারতের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে অনুমোদনের জন্য, যেখানে অভূতপূর্বভাবে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়ে তা অনুমোদন করেছিল। ভারতের পার্লামেন্টে এটি একটি বিরল ঘটনা। দুই দেশের মধ্যে সমস্যা থাকবে—এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু সেই সব সমস্যার সমাধান যে আলোচনার মধ্য দিয়ে সম্ভব, তা বাংলাদেশ-ভারত দেখিয়েছে। আগের মতো বাংলাদেশের মাটি ভারতের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আর ব্যবহার করতে পারে না। বঙ্গবন্ধুকন্যা আবেগাপ্লুত হয়ে শোনালেন—পঁচাত্তরের পর কিভাবে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁদের দুই বোনকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছিলেন।
মোদি তাঁর বক্তৃতায় মনে করিয়ে দিলেন, দুই দেশের মধ্যে এখন বন্ধুত্বের সোনালি অধ্যায় চলছে। এই অধ্যায় আরো দীর্ঘায়িত হবে। বললেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ সীমান্তের ওপারে হয়েছে; কিন্তু তার নির্মমতা আর ব্যথা এপারেও অনুভূত হয়েছে। মনে করিয়ে দিলেন, গত বছর যখন শেখ হাসিনা দিল্লিতে এসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ১৬০০ ভারতীয় সৈনিককে সম্মাননা জানিয়েছেন, তখন তিনি সারা ভারতবাসীর সম্মান ও ভালোবাসা অর্জন করেছেন। জানালেন, বঙ্গবন্ধুকে শুধু বাংলাদেশের মানুষ সম্মান করে না, ভারতের মানুষের কাছেও তিনি সমানভাবে সম্মানিত, যেমনভাবে সম্মানিত রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলতে ভোলেননি, কিভাবে পূর্ব বাংলার গগন হরকরা আর লালন ফকির রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিলেন। জানালেন, একসময় দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান অনেক সমস্যা মীমাংসিত হবে না বলে মনে করা হতো, তা দুই দেশের নেতৃত্ব ভুল প্রমাণ করেছেন। তিনি বাকি সমস্যাগুলোও সমাধনে আশাবাদী। অনুষ্ঠান শেষে সব দর্শক-শ্রোতা দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে দুই নেতাকে অভিবাদন জানায়।
অবাক কাণ্ড হচ্ছে, ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধনের আগে থেকেই কিছু মানুষ বুক চাপড়াতে শুরু করেছিলেন যে বাংলাদেশে সংরক্ষিত রবীন্দ্রনাথের সব নিদর্শন ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এটি মূলত যাঁরা শেখ হাসিনা ফোবিয়ায় ভোগেন, তাঁদের আর্তনাদ। বাংলাদেশ ভবনে যা প্রদর্শিত হচ্ছে, তার সবই অনুকৃত (রেপ্লিকা)। শুধু কবির চারটি ব্যক্তিগত জিনিস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল ইরান থেকে কবিকে দেওয়া একটি লণ্ঠন আর তিনটি পাথর। এসব এরই মধ্যে দেশে ফেরতও এসেছে। কিছু প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে, যা দীর্ঘমেয়াদি ধার হিসেবে এখানে রাখা হয়েছে। প্রদর্শনী গ্যালারি একবার ঘুরে দেখলে বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি ধারণা মিলবে। ফিরে যাওয়া যাবে একাত্তরের সেই আগুনঝরা দিনে। পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজনে ছিল বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এই ভবন যেন শান্তিনিকেতনে একখণ্ড বাংলাদেশ।
পরদিন কলকাতার উত্তরে আসানসোলে অবস্থিত কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু ২০১২ সালে। সড়কপথে কলকাতা থেকে আসানসোল ২০০ কিলোমিটারের বেশি। তবে স্বস্তির বিষয়, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীরা তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ বিমানে আসানসোলের ৩৭ কিলোমিটার দূরে দুর্গাপুর পর্যন্ত যাবেন। এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নজরুলের চিন্তাচেতনা ধারণ করে নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ আর দেশ পরিচালনায় তাঁর অসামান্য নেতৃত্বের জন্য একটি বিশেষ সমাবর্তনের মাধ্যমে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি দেবে। দুর্গাপুর মূলত একটি শিল্প শহর। এখানে আছে ইস্পাত কারখানা, কয়লাখনি, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আর ড্রাই ডক। দুর্গাপুরের আন্দোলে একটি ছোট বিমানবন্দর আছে। সম্প্রতি নামকরণ করা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের নামে। দিল্লি থেকে একটি মাত্র বিমান সপ্তাহে তিন দিন দুর্গাপুর আসে। শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানের ফ্লাইটটি প্রথম বিদেশি বিমান। চারদিকে সাজসাজ রব। সকাল ১১টায় কলকাতা থেকে উড়াল দিয়ে কুড়ি মিনিটে দুর্গাপুর পৌঁছা গেল। চারদিকে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার আর ফেস্টুন। প্রায় ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে একনজর দেখার জন্য শত শত মানুষ অপেক্ষা করছে। একই দৃশ্য কলকাতায়ও দেখা গেছে। বিশ্বভারতীর সমাবর্তনটি কিছুটা অগোছালো ছিল বলে সবার মনে একটা প্রশ্ন ছিল—এই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়টির এই সমাবর্তন না জানি কেমন হয়। বিমানবন্দর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগল। ক্যাম্পাসে ঢুকতেই অসাধারণ প্রস্তুতি দেখে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বোঝা গেল, এই সমাবর্তন সফল করে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সাধন চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন। বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. মোনালিসার কথা বলতেই হয়। ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রীকে হাতে হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ আয়োজনে তাঁর নিখুঁত তদারকি স্পষ্ট।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষামন্ত্রী ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বললেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনামলে এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সম্মান জানিয়ে নিজেরাই সম্মানিত হয়েছে। শেখ হাসিনা ডিগ্রি গ্রহণের পর তাঁর বক্তৃতায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁর এই প্রাপ্তি বাংলাদেশের জনগণের জন্য উৎসর্গ করেন। তিনি বলেন, নজরুলের জন্ম আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে হলেও তিনি তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মানুষের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নজরুলের লেখনী মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর গান ‘চল চল চল...’ বাংলাদেশের রণসংগীত। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হলে কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে যান এবং তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। মনে করিয়ে দেন, ১৯৯৯ সালে তিনি কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চুরুলিয়া গিয়েছিলেন। বলেন, কবির প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ বাংলাদেশে তাঁর নামে স্থাপিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট আর গবেষণা সেন্টার। এক কথায় এই দিনের সব আয়োজন ছিল নিখুঁত এবং তাতে আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল দেখার মতো। দুই দিনের আয়োজন আর বঙ্গবন্ধুকন্যার উপস্থিতি আর তাঁর অসাধারণ বক্তৃতা ওই অঞ্চলের তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখবে। বিশ্বভারতী আর কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা আর অভিনন্দন। আয়োজকদের ধন্যবাদ। (কালের কণ্ঠ থেকে নেয়া)
লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক
এই বিভাগের আরো সংবাদ