নব আনন্দে জাগৃতির দিন

  গোলাম কবির

১৪ এপ্রিল ২০১৯, ১৩:৫৭ | অনলাইন সংস্করণ

মধ্যযুগের বাংলা মঙ্গলকাব্যে এমনকি রোমান্টিক কাহিনি কাব্যেও বিরহিনীর প্রগাঢ় শূন্যতার পরিচয় দিতে গিয়ে কবিগণ কাব্যে বারোমাস্যা নামের একটি পর্ব সংযোজন করতেন। (গত শতকেও দেখা গেছে বাগচী কবি অন্ধ বধূর অবহেলার কথা বর্ষপ্রক্রিয়ায় স্মরণ করেছেন।) এতে প্রতিটি মাসের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হতো। খরতাপদগ্ধ বোশেখকে কবিরা ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতেন। এর পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের চৈত্রসংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনের সংস্কৃতি। ইঞ্জিনিয়ার সহিদ আহমেদ তাঁর ‘বঙ্গাব্দের ইতিহাস’ নামের গবেষণামূলক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘মেষ মাসের নাক্ষত্রিক নাম বৈশাখ। এই সৌর বৈশাখ সৌরবর্ষের মুখ। তাই পহেলা বৈশাখে নববর্ষ।’ (পৃষ্ঠা ৬৯) বিষয়টি বেগবান হয়েছিল সম্রাট আকবরের পহেলা বৈশাখকে নববর্ষের প্রথম দিন ঘোষণাকে সামনে রেখে। সংস্কৃতির বিকাশ সাধারণভাবে তৃণমূল থেকেই হয়ে থাকে। তবে তাতে যদি রাজানুকূল্যের পরশ লাগে, তবে তার প্রসার বহুগুণে বেড়ে যায়।

সুবে বাংলায় পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ ঘোষণা সম্রাট আকবরের দিল্লির মসনদে অধিষ্ঠিত থাকার সময় থেকে। আগেই বলা হয়েছে, চৈত্রসংক্রান্তি এবং পহেলা বৈশাখ বাংলার মানুষের পুরনো সংস্কৃতি। সম্রাট আকবর রাজকোষ পূর্ণ করার অভিপ্রায়ের অনুষঙ্গ হিসেবে ফসল তোলার একটি পর্বের প্রাকৃতিক এই সময়কে নির্ধারণ করায় পহেলা বৈশাখ রাজকীয় বেশে অভিষিক্ত হয়। তখনকার গ্রাম-গঞ্জকেন্দ্রিক এই বাংলার সাধারণ মানুষের নির্মল বিনোদনের দিন হিসেবে দিনটি গণ্য হতে থাকে। উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত ওই দিনের বৈচিত্র্যময়তা ইতিহাস ধরে রাখতে পারেনি। এই শতকের প্রথম থেকে সমাজসচেতন লেখক, সংবাদসেবী ব্যক্তিবর্গ সমকালীন সমাজজীবনের চিত্র আমাদের গোচরে আনেন।

‘শক-হুন-মোগল-পাঠান’, আর্য-অনার্য বাংলা তথা ভারতবর্ষে দীর্ঘ সময় বসবাস করেছে। তাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক জীবন ও উৎসব লক্ষ করা যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, পারস্যের নওরোজ উৎসব রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির যুগ থেকে প্রচলিত হয়ে দিল্লির দরবার পর্যন্ত মুখর করে রেখেছিল। তখন দিল্লি ও পারস্যে আমলাকেন্দ্রিক অবস্থানগুলোতেও দিবসটি উদ্যাপিত হতো। কবি সত্যেন্দ্র নাথ দত্ত তাঁর ‘কবর-ই-নূরজাহান’ কবিতায় শাহজাদা সেলিম ও মেহেরুন্নিসার প্রণয় সম্পর্ক সূচনার সূতিকাগার উল্লেখ করতে গিয়ে নওরোজের প্রসঙ্গ এনেছেন: ‘বাদশাজাদা দেখলো তোমায় দেখলো প্রথম নওরোজে/খুশিদিলের খোশরোজে তার জীবন মরণ দুই যোঝে।’ সেই দিল্লির ফরমানে প্রবর্তিত পহেলা বৈশাখ সুবে বাংলায় আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করত জমিদারের দরবার আর ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানে। কৃষিপ্রধান বাংলার কৃষককূল দিবসটি উদ্‌যাপন করতেন সারা বছরের কল্যাণ কামনা এবং সাংসারিক ও কৃষি সরঞ্জাম ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত মেলায়। পরক্ষণে যেখানে বাংলার মানুষ একঘেয়ে জীবনে বিনোদনের সাক্ষাৎ পেত।

ইংরেজ আগ্রাসনের পর খ্রিস্টীয় নববর্ষ গঠমান নগর কলকাতায় খ্রিস্ট সমাজে প্রচলন শুরু হয়। এ দেশের সুযোগসন্ধানী কিছু মানুষ তাদের উৎসবে যুক্ত হতে পেরে নিজেদের কৃতার্থ ভাবতে থাকে।

একসময়ের খ্রিস্টীয় সংস্কৃতির পোষমানা দুরন্ত ইয়ংবেঙ্গলদের অধস্তন প্রতিভূ কালের বিবর্তনে ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে হিন্দুমেলা প্রবর্তকদের সহযাত্রী রাজনারায়ণ বসু প্রবল বাঙালিয়ানা প্রচলনের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেন। তিনি মেদিনিপুর স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় শহরকেন্দ্রিক বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন করে যে নাগরিক বাঙালির বর্ষবরণের সূচনা করলেন, তা আর থেমে থাকেনি।

রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে ঋতুপর্যায়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালার অনুষঙ্গ ছিল পহেলা বৈশাখ। এ নিয়ে প্রচুর গান ও কবিতা রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনের এই সংস্কৃতি বাংলার শহরগুলোতে বিস্তৃত হতে থাকে। বাঙালির দুর্ভাগ্য, বাংলা ভাগ হয়ে গেল। মধ্য এশিয়া ও ব্রিটিশের পরে আমাদের খবরদারির ভার নিল পাকিস্তানিরা। ভাগ্যিস এদের সাংস্কৃতিক তেমন ঐতিহ্য ছিল না। তা না হলে আমাদের ওপর তা চাপিয়ে দেওয়া হতো এবং দালালরা সেটি লুফে নিয়ে প্রচলনের পাঁয়তারা করত। যেমন—তাহজিব তমুদ্দুনের নামে অজ্ঞাত সংস্কৃতিতে ভরে দিতে চেয়েছে কিছু স্বকীয়তাহীন দালাল।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পহেলা বৈশাখ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য হারায়। দেশ ভাগের আগে এবং অব্যবহিত পরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আমপাতার ঝালর আর আতপ চালের গুঁড়ার আলপনা দিয়ে যে শ্যামল-শুভ্র শুচিময় পরিবেশ সৃষ্টি হতো, তা অপসৃত হতে থাকে। বাংলার মানুষের কাছে বিনোদন সংস্কৃতির অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয়। ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন প্রমুখের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দালালদের শ্যেনদৃষ্টি অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনের সময় থেকে ছায়ানট প্রবর্তনায় রমনার বটমূলে যে পহেলা বৈশাখ শুরু হলো, তা আজ গ্রামবাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। দিবসটি শুধু রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যই পায়নি, প্রজাতন্ত্রের কাজে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ উৎসব ভাতা পেয়ে উজ্জীবিত হচ্ছে। প্রসঙ্গত একটা কথা বলা যায়, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিকট-অতীতকে ছাড়িয়ে গেলেও এখনো অনেক হতদরিদ্র মানুষ আছে, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। তাদের জন্য নববর্ষের উৎসবে কিছু উপহারের ব্যবস্থা করতে পারে সরকার ও ভাগ্যবানরা। কারণ দেশের মানুষ অন্য জাতীয় দিবসগুলোর চেয়ে পহেলা বৈশাখকে কম মূল্য দেয় না। আমরা এখনো মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে পারিনি। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, নৃগোষ্ঠী প্রভৃতিতে আমাদের পরিচয় সীমিত। তবে নববর্ষের দিনটিকে মানুষের উৎসবের দিন নিজেদের মানুষ হিসেবে চেনার পথে এগিয়ে চলেছি। ইরান তাদের প্রাচীন ধর্মের খোলস পরিবর্তন করেছে; কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতি বহন করে চলেছে কালান্তর ধরে। আমরা নববর্ষের আনন্দকে নতুন করে ধারণ করব এবং সমন্বয়ে গেয়ে উঠব:

নব আনন্দে জাগো আজি নব রবি কিরণে

শুভ সুন্দর প্রীতি-উজ্জ্বল নির্মল জীবনে

রবীন্দ্রনাথ গীতবিতানে পূজাপর্বের ৩২৭ সংখ্যক এই গানটি যে উদ্দেশেই রচনা করুণ না কেন, আমরা বৈশাখের প্রথম প্রভাতে ‘অমৃতপুষ্পগন্ধ বহ শান্তিপবনে’ দেহে-মনে নির্ভেজাল আনন্দ উপভোগ করব সে বিশ্বাস রাখলে ক্ষতি কী!

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ