আজকের শিরোনাম :

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন

  প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া

৩১ মার্চ ২০১৯, ১২:৪৮ | অনলাইন সংস্করণ

এটা নিঃসন্দেহে সত্যি যে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি নন তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, দেশ ও জাতি তাঁকে নিয়ে যতটুকু গবেষণা হবার প্রয়োজন ততটুকু হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। অবশ্য আমার এ অনুমান সত্যিই নাও হতে পারে। ব্যক্তি যখন প্রতিষ্ঠানে, দেশে ও জাতি পরিণত হয় তখন গবেষণা আরো স্বাভাবিকভাবে বিস্তৃত হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন সংগ্রামের জীবন। জন্ম তাঁর ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া গ্রামে। তাঁর মহাপ্রয়াণ হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। নির্মম নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হন তিনি ও তাঁর পরিবার। ইতিহাসের পাতায় নির্মম হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু না থাকলেও এক মুজিব থেকে আজ কোটি মুজিবের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের মতো কোটি কোটি মুজিব সেনা বঙ্গবন্ধুকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখ্বো। আমরা বঙ্গবন্ধুর মহান ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর।
যে কোন রাজনৈতিক নেতার দর্শন থাকে। রাজনৈতিক দর্শন ব্যতীত কোন নেতার নেতৃত্ব ফুটে উঠ্তে পারে না। বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারি। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির হাতেখড়ি শুরু হয় তিনি যখন ম্যাট্রিক পাস করে কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজে আই.এ. পড়তে যান। সেই সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসেন এবং ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে কিশোর বয়সে গ্রামীণ পরিবেশ ও ছাত্র জীবনে কোলকাতায় অবস্থানকালে রাজনীতির পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাক্তে হবে।
বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান উচ্চ শিক্ষা লাভ করুক। তখন কোলকাতা ছিল আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কোলকাতা ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী এবং প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। কোলকাতার পরিবেশ শেখ মুজিবকে প্রভূতভাবে প্রভাবিত করে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে আলোকপাত করতে হলে কিশোর বয়সের স্কুল জীবনের কিছু কিছু ঘটনাবলীর উপর আমাদেরকে সুনিপুনভাবে অবলোকন করতে হবে। শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিব ডানপিটে ও একরোখা স্বভাবের ছিলেন বলে তাঁর ভয়-ভীতি আদৌ ছিল না। ডাকসাইটে, রাশভারী ও গম্ভীর প্রকৃতির প্রধান শিক্ষক গিরিশ বাবু শেখ মুজিবের সাহসিকতা, স্পষ্টবাদিতা ও দৃঢ়-বলিষ্ঠতার জন্যই তাঁকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, সত্য ও উচিত কথা বলার জন্য শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ‘মুজিব ভাই’ বলে জনপ্রিয় হয়ে হয়ে উঠেন। স্কুলে পড়া অবস্থায় তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে থাকে। দুঃস্থদের, গরীবদের, আর্তদের সেবা করার মধ্য দিয়ে যে মহানুভবতা, মানবতার আদর্শ ছাত্র জীবনে ফুটে উঠেছিল তা শেখ মুজিবের রাজনীতির জীবনে আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করেছি। সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দরদ, বিপদে-আপদে অকুণ্ঠভাবে সাহায্য-সহযোগিতা, উদার শেখ মুজিবের জীবনের অনুপম বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সাল এই পাঁচ বছরে ব্রিটিশ ভারতে রাজনীতির সঙ্গে শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা, বিশ্বযুদ্ধের দামামা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হাঙ্গামা, নিজের লেখাপড়া, ছাত্র হিসেবে সোহ্রাওয়ার্দীর সান্নিধ্যে আসা ইত্যাদি মুজিব মনে প্রচুর প্রভাব ফেলেছিল। অপরদিকে মধুমতী তীরে জন্ম জনপদ টুঙ্গীপাড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ, সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা, ছাত্র জীবনে খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ, দরিদ্র জনসাধারণের আর্থিক অবস্থা স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা, রাজনীতিবিদদের ফরিদপুর জেলায় আনাগোনা ইত্যাদি মুজিব মনকে আন্দোলিত করতো। ইসলামিয়া কলেজে থাকাকালীন সময়ে ছাত্র রাজনীতির জনপ্রিয় নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিভাত করার মধ্য দিয়ে রাজনীতির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া, পাকিস্তান আন্দোলনে সোহ্রাওয়ার্দীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গোপালগঞ্জের আনাচে-কানাচে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দর্শনের একটি ভিত্তি তৈরি হয় মুজিব মনে। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তাঁর নিষ্ঠা, ত্যাগ, আন্তরিকতা, নিয়ে বলা হয় ÒIn all these exercises he was greatly assisted by the formidable Sheikh Mujibur Rahman who according to Suhrawardy was his star organizerÓ. শেখ মুজিব যে অসাধারণ ত্যাগদীপ্ত নেতা ছিলেন তার প্রমাণ তো আমরা সকলেই তাঁর জীবন থেকে প্রত্যক্ষ করেছি।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন আলোচনা করতে গিয়ে আমরা এটুকু অনুমান করতে পারি তিনি যখন রাজনীতির দ্বার উন্মোচন করে সেই রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন সেই সময় যেসব নেতার আদর্শ তাঁকে প্রভাবান্বিত করেছিলেন তাঁরা হলেন- বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, মহাত্মা গান্ধী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও আরো অনেক ব্রিটিশ ভারতের নেতৃবৃন্দ। এক সময় তিনি অনুশীলন সমিতির সভাতে নিয়মিত যেতেন। তাঁর মধ্যে সংগ্রামী চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। এখানে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই থেকে উদ্ধৃতি দিতে চাই (পৃষ্ঠা-৯) “ চোখের চিকিৎসার পর মাদারীপুর ফিরে এলাম, কোন কাজ নেই। লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকেলে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজদের আতঙ্ক। স্বদেশী আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে। আমার মনে হত মাদারীপুরে নেতাজী সুভাষ বসুর দলই শক্তিশালী ছিল। পনের-ষোল বছরের ছেলেদের স্বদেশীর দলে ভেড়াত। আমাকে রোজ সন্ধ্যায় বসে থাকতে দেখে আমার উপর কিছু যুবকের নজর পড়ল। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও আমার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হল। ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নাই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বসুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া আসা করতাম। আর স্বদেশী আন্দোলনের লোকদের সাথেই মেলামেশা করতাম। গোপালগঞ্জের সেই সময়ের এস.ডি.ও আমার দাদা খান সাহেবকে একদিন হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন, এ গল্প আমি পড়ে শুনেছি”।
বিশিষ্ট কলামিস্ট লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দৈনিক জনকণ্ঠে (২৭শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯) প্রকাশিত “ভাষা আন্দোলনে হক সাহেব ও শেখ সাহেব” নামক প্রকাশিত নিবন্ধে লিখেছেন, “শেখ সাহেব যদিও ছিলেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর রাজনৈতিক শিষ্য হিসেবে। কিন্তু আমার ধারণা, তাঁর রাজনৈতিক চরিত্র গড়ে উঠেছিল হক সাহেব, আবুল হাশেম, সুভাষ বসু ও মাওলানা ভাসানীর রাজনীতির প্রভাব বলয়ে। হক সাহেবের প্রথম রাজনীতিই ছিল অসাম্প্রদায়িক।” মূলত শেখ মুজিব এই সব নেতাদের আদর্শ রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে “অসাম্প্রদায়িকতা” কে গ্রহণ করেছিলেন। শেখ মুজিবের জনগণের প্রতি ভালোবাসার মধ্যেই অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ প্রতিনিয়ত নিহিত ছিল। আমার মনে হয় শুধুমাত্র ঐসব নেতাদের নয় গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতির প্রভাব বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চরিত্র বা দর্শনকে প্রভাবিত করেছিল। এ প্রসঙ্গে আমাদেরকে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি তথা লোকদর্শন সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম হাতিয়ার ছিল গণমানুষের প্রতি ভালোবাসা লোকদর্শনের অন্যতম ভিত্তি হলো মানুষকে ভালোবাসা।
একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনার দোষ কোথায়?” জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার সবচেয়ে বড় ও একমাত্র দোষ হলো আমি আমার জনগণকে বেশি ভালোবাসি।” বঙ্গবন্ধুর মতো মানবতাবাদী নেতা আমাদের বাঙালি লোকসংস্কৃতিরই একটি বিরাট ফসল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন লোকধর্মসিক্ত লোকদর্শনের জীবনমুখী চিন্তা-আদর্শের প্রতীক। বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদার মানবতায় উজ্জ্বীবিত এক মহান নেতা। তিনি ছিলেন মহৎ প্রাণের অধিকারী। বঙ্গবন্ধু গ্রামের মাটি থেকে বেড়ে উঠেছিলেন। গ্রামের সেই খোকা বিশ্বের তৃণমূল মানুষের অবিসংবাদিত নেতার আসনে সমাসীন হয়ে বাঙালি জাতিকে করেছে ধন্য। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার এই ফসল। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বাঙালি লোকদর্শনের সঙ্গে কতটুকু সম্পৃক্ত তা বর্ণনা করতে গিয়ে গবেষক ড. আবদুল ওয়াহাব তার গবেষণামূলক বই “ফোকলোর মানবতাবাদ ও বঙ্গবন্ধু” (পৃঃ ৪০-৪১) তে লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধু ও বাংলার লোকদর্শন পঞ্চদ্বয়ের একটি অপরের পরিপূরক। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাল্য- কৈশোরকালে বাংলার শত সমস্যা ক্লিষ্ট কৃষক, খাজনাদায়যুক্ত কৃষক, দুঃখজর্জর আধপেটা শ্রমিক, একদিন-দু’দিন না খেয়ে থাকা অনাহারক্লিষ্ট হতদরিদ্র মানুষের তিনি দেখেছেন নিজ চোখে, এটা দেখে তাঁর অন্তরে বেঁধেছে তাদের মুক্তির প্রেরণা। ঐ বাল্য-কৈশোরেই দেখেছেন, মানুষের প্রতি উদারপন্থী বাউল-ভাটিয়ারি-জারি-সারি গানের মধুর সুর-বাণী-এটা তাঁর প্রাণ-মনকে আবেগ-আপ্লুত করেছে। আর তাঁর ছিল উদারতান্ত্রিক পারিবারিক আবহ-এই আবহ মানুষের দুঃখী-দুর্দশা চিত্র মনের বাসা তৈরি করতে তাঁকে প্রণোদনা দিয়েছে। তাই বাংলার কৃষক মানে তাঁর ভাই, নিরন্ন দুঃখ-ক্লিষ্ট সব মানুষ তাঁর ভাই। সব মানুষকেই তিনি ভালোবাসতে শিখেছেন সেই বাল্য-কৈশোরেই। বঙ্গবন্ধুর প্রধান গুণ ছিল সাহস-সারল্যতা ও কোমলতা। বিশেষ করে মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। আর এ কারণেই বাংলার মানুষের কাছে সর্বজনমান্য, সর্বজনগণ্য-সর্বজনশ্রদ্ধেয়-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মুক্তি, স্বাধীনতার অধিকার তাঁর মনের মধ্যে সর্বদাই গাঁথা ছিল। এসব ক্ষেত্রে নিজের জীবনের প্রতি মায়া ছিল তাঁর কাছে তুচ্ছ ব্যাপার। জীবনকে তিনি বাজি রেখে কর্তব্যকর্মে অগ্রসর হতে কোন প্রকার দ্বিধা তিনি করতেন না।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অসীম সাহসিকতা। জীবনকে পরোয়া না করা। ২৭-২৮ মাস বিনা বিচারে কারাবাসের শেষ পর্যায়ে যখন অনশনের সিদ্ধান্ত নিলেন তখন বলেছিলেন “হয় জেলের বাইরে যাব জ্যান্ত অবস্থায়, না হয় মৃত অবস্থায় যাব ÒEither I will go out of the jail or my dead body will go outÓ. বঙ্গবন্ধুর জীবন ইতিহাস পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবে তিনি এতই সাহসী ছিলেন যে তিনি জেল জুলুমকে কোনদিন ভয় করেননি। জেলখানা ছিল তাঁর আরেকটি গৃহ বা বাসভবন। সমগ্র রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হবে তাঁর গণমানুষের উপর গভীর আস্থা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ এবং মানুষের প্রতি বিশ্বাস রাখার দৃঢ় সংকল্প তিনি ব্যক্ত করেছিলেন।” তেমনিভাবে বাঙালির প্রতি শেখ মুজিবের প্রতি প্রত্যয়টি ছিল ততোধিক দৃঢ়।
রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানো ছিল বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বৈশিষ্ট্য। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ কয়টি বছর রাজনীতির হাতেখড়িকে গড়ে তুলতে গিয়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বের বিকাশকে হৃদয়ঙ্গম করার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতেন। পাকিস্তান আন্দোলনে সেই ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। ব্যক্তিত্বের বিকাশ এতদূর ঘটেছিল যে বঙ্গবন্ধু বিশ্বনেতা হয়েছিলেন ঐ ব্যক্তিত্বের বিকাশের কারণে। কিউবার শোষিত বঞ্চিতদের মহান নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতে বলেছিলেন, ÒI have not seen the Himalayas. But I have seen Sheikh Mujib. In personality and courage, The man is the Himalayas. I have these had the experience of witnessing the Himalayas.Ó বঙ্গবন্ধু হিমালয়ের মতো মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি ছিলেন অকুতোভয় সাহসের বীর প্রতীক।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো আপাদমস্তক বাঙালি হওয়া। বাঙালি হবার দর্শন হচ্ছে হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসের দর্শনের অনন্য রূপ। হাজার বছর শুধু নয় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি (বিবিসির জরিপ মতে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরিল দুন লিখেছেন- ÒIn the Thousand year history of Bengal, Sheikh Mujib is her only leader who has, in terms of blood, race, language, culture and birth, been a fall blooded Bengali. His physical stature was immense worked magic on people. the courage and charm that flooded from him made him a unique superman in these times.Ó
আগস্ট ১৯৭১ সালে Time Magayine-এর উদ্ধৃতি: ÒA man of vitality and vehemence Mujib became the political Gandhi of the Bengalis, Symbolize their hopes and voices their grievances. Not even Pakistan’s founder, M.A Jinnah, drew the million-strong throngs that Mujib has attracted in Dhaka.Ó
রাজনৈতিক দর্শনে প্লেটো, মেকিয়াভেলি, কার্ল মার্কস, সক্রেটিস, এরিস্টোটোল ও আরো অনেক দার্শনিকের রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী আলোচিত বিষয়। অনেকের মতে রাজনৈতিক দর্শনে বঙ্গবন্ধু মেকিয়াভেলির দর্শনের অনুগত ছিলেন। তবে তা অর্ধেকাংশে সত্য, সর্বাংশে সত্য নয়। বঙ্গবন্ধুর দেশপ্রেম ও বাঙালির প্রতি ভালোবাসার অমর স্বাক্ষর তিনি স্বীয় প্রাণ বিসর্জন দিয়ে রেখে গেছেন। এ ক্ষেত্রে মেকিয়াভেলির দর্শনের কথা স্মরণ করতে পারি যে “নেতাকে হতে হবে সিংহের মত বলবান ও শৃগালের মত ধূর্ত”। বঙ্গবন্ধু সিংহের মতো বলবান ছিলেন সত্যিই, কিন্তু কোন প্রকার ধূর্ততা, শঠতার আশ্রয় তিনি নেননি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাস্তববাদী এবং আত্মবিশ্বাসী মহান নেতা। তিনি পিতার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন, ÒSincerity of purpose and honesty of purposeÓ। বঙ্গবন্ধুর মতো আত্মবিশ্বাসী নেতা পৃথিবীতে বিরল। ঘাতকরা যখন বুলেট উঁচিয়ে হত্যায় উদ্যত তখনো বঙ্গবন্ধু আত্মবিশ্বাসের সাথে উচ্চারণ করেছিলেন “তোরা কি চাস”?। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের এই মহান দিক “আত্মবিশ্বাস” যেই আত্মবিশ্বাসে তিনি বলেছিলেন, “বাঙালিরা আমাকে হত্যা করতে পারে না”।
এখানে বলা রাখা প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন বা চরিত্র সম্পর্কে বুঝতে হলে বাঙালির ইতিহাস ও বাঙালির দর্শন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকবে হবে। না হলে বিষয়টি পরিপূর্ণ রূপ পাবে না। বাঙালির ইতিহাস ও দর্শনের সুদীর্ঘকালীন ইতিহাস আছে। প্রায় তিন থেকে পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে দেখা যায় এর মধ্যে অস্ট্রিক-ভোটচীনা, মঙ্গোল, নর্ডিক-শক-হুন-আরব-পাঠান-পর্তুগীজ-ওলন্দাজ-ফরাসী-ইংরেজ জাতি এসেছে, এসেছে বহুমত, বহুপথের সংস্কৃতি। বাঙালি সব কিছুকে আত্মস্থ করে একটি মিশ্র সংস্কৃতির আবর্তকে গ্রহণ করেছে। এই মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যেই বাঙালির ইতিহাস ও দর্শন উদ্ভাসিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির দর্শনের মধ্যে বাঙালির দর্শন নিঃসন্দেহে কোন না ভাবে প্রভাবিত করেছে। বাঙালির এই দর্শনের মধ্যে উদারপন্থী লোকদর্শন বাঙালীকে সমৃদ্ধ করেছে। এই দর্শন অনেক লোকনায়কের জন্ম নিয়েছে। তন্মধ্যে বঙ্গবন্ধু একজন। এই দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবতাবাদ। বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত্র্যে ছাত্র জীবন থেকেই এই মানবতার আদর্শ ফুটে উঠেছে। দরিদ্রদের সহায়তা করা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনে নিরলস প্রচেষ্টা ইত্যাদিতে বঙ্গবন্ধুর মানবতার আদর্শ ফুটে উঠেছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট থেকে শুরু করে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর মৃত্যু পর্যন্ত দেখা যায় সোহ্রাওয়ার্দীর নেতৃত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ও আস্থা রেখে তিনি কাজ করেছেন। তবে আমার মনে হয় এই সময়ে তিনি একেবারে নিজের স্বাধীন চিন্তা চেতনা দিয়ে কাজ করতে পারেননি। কারণ সকল দলকে সমন্বয় করে কাজ করতে গেলে কিছু সীমাবদ্ধতা অবশ্যই থাক্বে। একক নেতৃত্বের বিকাশ শুরু হয়েছিল তখন সোহ্রাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর যখন আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তার আরো কয়েক বছর পরে তিনি যখন আওয়ামী লীগের সভাপতি হন তখন পরিপূর্ণ স্বাধীনভাবে তাঁর সুপ্ত চিন্তাকে বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সুপ্ত চিন্তা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন। এর জন্য ধাপে ধাপে জনগণকে সুসংগঠিত করা, ৬ দফা ঘোষণার পর সারাদেশব্যাপী বিচরণ, সভা সমাবেশ করে সাড়ে সাতকোটি বাঙালির মনোমানসকে তৈরী করার কাজ বঙ্গবন্ধু দক্ষতার সাথে করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন শুরু হয় সেদিনই যেদিন মাতৃভাষা বাংলার উপর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর মলিন হস্ত প্রসারিত হয় এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে।
বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘকালীন রাজনৈতিক দূরদর্শী দর্শনের বাস্তব রূপ পরিগ্রহ হয়েছিল ৭ই মার্চের ভাষণে। এই সেই ভাষণ যেটি কোটি কোটি বাঙালিকে সুসংগঠিত করেছিল, ঐক্যবদ্ধ করেছিল। বাঙালি জাতি অপেক্ষা করছিল ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে লাখো লাখো জনতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। অন্যদিকে বলা যায় পরোক্ষভাবে তিনি স্বাধীনতার ডাক দিলেন। তাই বাংলার জনগণের প্রত্যাশা যেমন সরাসরি পূর্ণ হয়নি তেমনি জনগণকে তিনি হতাশও করেননি। দু’য়ের মাঝামাঝি পথে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় “ত্ত-/সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের”। রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, “স্বাধীনতার ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু সতর্ক ছিলেন”। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের অনন্য দিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শীতা আজ সর্বত্র প্রশংসিত বলেই ইউনেসকো বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
মূলত ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাত্রি পর্যন্ত বাংলার জনগণকে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে সার্বিকভাবে প্রস্তুত করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি মহান জননেতা। তিনিই স্বাধীনতার মহান স্থপতি। তিনিই বঙ্গবন্ধু, তিনিই জাতির পিতা। তিনিই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনিই বাঙালির একক অদ্বিতীয় অবিসংবাদিত মহান নেতা।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া)

লেখক : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদ, বৃহত্তর চট্টগ্রাম

এই বিভাগের আরো সংবাদ