জীবন ও মৃত্যু, মাঝখানে সামান্য ভুল !
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ৩১ মে ২০১৮, ১৬:৩৭
কামরুল হাসান বাদল, ৩১ মে, এবিনিউজ : কক্সবাজার জেলার টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর একরামুল হকের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পরিবারের সদস্য ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মীর ধারণা, নাম বিভ্রাটের সুযোগ নিয়ে একরামুলকে খুন করিয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। ২৬ মে দিবাগত রাতে র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন দুই কন্যা সন্তানের জনক, উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুল হক। তাঁর মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার পর থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক মহল ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তুমুল সমালোচনা চলছে। এদের দাবি একরামুল হক ইয়াবা ব্যবসায়ী ছিলেন না। ভুল তথ্য দিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র একরাম নিহত হওয়ার পর এর সুবিচার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর বরাবর একটি খোলাচিঠি দিয়েছেন। স্থানীয় সাংসদ একরামুলের জানাজায় অংশ নিতে গিয়ে তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন একরাম ইয়াবা কারবারি ছিলেন না। টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিক মিয়া বলেন, একরামুল হককে তিনি চেনেন অন্তত ২০ বছর থেকে। একরাম উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১২ বছর। কখনোই তাঁকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে দেখতে পাননি। তিনি ভুল টার্গেটের শিকার হয়েছেন। পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, টেকনাফ সদর ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্যের নাম এনামুল হক। তিনি ইয়াবা ব্যবসাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। এনামুলের বাবার নাম মৃত মোজাহের মিঞা। এনামুল মেম্বার ভেবে একরামুলকে হত্যা করা হতে পারে (সূত্র প্রথম আলো ৩০ মে) একরামুলের বড় ভাই নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেছেন, এলাকায় তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ রয়েছে। তারাই তাঁদের কয়েক ভাইয়ের নাম ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকা দিয়েছে। আর নাম বিভ্রাটের সুযোগ নিয়ে একরামুলকে খুন করিয়েছে তারা।
র্যাবের দাবি তাদের কোনো ভুল হয়নি। র্যাব–৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন গত ২৯ মে একটি জাতীয় দৈনিকে বলেছেন, একরামুল তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকায় তাঁর কয়েক ভাইয়ের নামও আছে। তাহলে র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একরামুলের বাবার নাম ও বাড়ির ঠিকানায় ভুল ছিল কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে রুহুল আমিন বলেন, এটা র্যাবের ভুল নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তালিকায় এভাবেই লিপিবদ্ধ ছিল। একরামের নিহত হওয়ার বিষয়ে র্যাব গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠায় ২৭ মে। তাতে পিতার নাম মোজাহের মিয়া, ওরফে আবদুস সাত্তার, বাড়ি টেকনাফের নাজিরপাড়া। আর নিহত একরামের বাবার নাম মৃত আবদুস সাত্তার। বাড়ি টেকনাফ পৌরসভার কায়ুকখালী পাড়ায়।
একরামের জানাজায় লোক সমাগম এবং তার বাড়ির দৃশ্য দেখে কারো মনে হয়নি তিনি একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী ছিলেন। নিহত হওয়ার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখে বোঝা যায় একরাম আর্থিকভাবে খুব সচ্ছল ছিলেন না।
গত অন্তত ২০ বছরে টেকনাফসহ বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে টেকনাফ উখিয়ার মানুষের জীবনে পরিবর্তন ঘটে গেছে। ইয়াবা ব্যবসা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যাওয়ায় এখানকার সামাজিক চিত্রও পাল্টে গেছে। এসব এলাকার প্রতি তিনজনের ২ জন কোনো না কোনোভাবে ইয়াবা পাচার ও ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। অনেকে ছোটোখাটো ব্যবসা বা চাষাবাদ ছেড়ে দিয়ে জড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা পাচারের সাথে। এসব এলাকায় মাদক ব্যবসা খুবই রমরমা। ফলে গত কয়েক বছরে অনেকে কোটিপতিতে পরিণত হয়েছে। সৎ, সজ্জন ও মাদকবিরোধীরা সেখানে এখন সংখ্যালঘু ও অনেকটা কোণঠাসা। এই এলাকায় ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান খুব শক্ত। সামাজিক অবস্থানও খুব রক্ষণশীল। অথচ এই এলাকাতে মাদক ব্যবসায় জড়িত লোকের সংখ্যা বেশি।
বাংলাদেশে এখন মাদক হিসেবে ইয়াবা খুব জনপ্রিয়। এর আগে ছিল ফেন্সিডিল। ফেন্সিডিল বিক্রি ও পরিবহন ইয়াবার চেয়ে বেশি ঝুঁকি ও ঝামেলাপূর্ণ বলে ক্রমে ক্রমে তার অনেকটা স্থান দখল করেছে ইয়াবা। ইয়াবা পরিবহন করতে সুবিধা। ফেন্সিডিল আসে ভারত থেকে আর ইয়াবা আসে মিয়ানমার থেকে। ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে এই মাদক দেশে আসে এবং যে কারণে এই দুই সীমান্তবর্তী এলাকায় লোকজন কোনো না কোনোভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিত্র যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে চমকে যাওয়ার মতো একটি তথ্য পাবো। তাহলো বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা বা নির্বাচনী এলাকাগুলোতে সাম্প্রদায়িক, ধর্মভিত্তিক যেমন জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোর শক্ত ঘাঁটি ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। টেকনাফ–উখিয়ার মতো মিয়ানমারের সাথে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো আওয়ামী লীগ বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর বড় ঘাঁটি। অনেক আগে থেকে এসব এলাকায় পাকিস্তান ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থাগুলো বেশ তৎপর। মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাশেম আলীর বড় এনজিও প্রতিষ্ঠান অনেক আগে থেকে এখানে সক্রিয়। ভারতের সাথে আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকা, যা দিয়ে বাংলাদেশে ফেন্সিডিল প্রবেশ করে সেসব এলাকায়ও জামায়াতে ইসলামী বা মৌলবাদী দলগুলোর শক্তি ঘাঁটি রয়েছে। এইসব সীমান্ত দিয়ে শুধু ফেন্সিডিল আসে তা নয়। ভারত থেকে যেমন অনেক কিছু আসে তেমনি বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু পণ্য পাচার হয় ভারতে। সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অনেকেই চোরাচালানির সাথে জড়িত। যাদের অধিকাংশই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমর্থক। পরিষ্কার করে বললে সেখানে জামায়াতে ইসলামীর খুব শক্ত অবস্থান। ২০১৩ সালে সাঈদীর বিচারের রায় ঘোষণার পর যেসব জায়গায় বেশি সন্ত্রাস ও তাণ্ডব সংঘটিত হয়েছে তার অধিকাংশই সীমান্তবর্তী এলাকা, যেখানে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি আছে। সাতক্ষীরা, রাজশাহী, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী। এই সমস্ত সীমান্তবর্তী এলাকায় চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। তারাই সেখানে রাজনৈতিকভাবেও বেশ শক্তিশালী। এ সমস্ত এলাকায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থান খুব শক্ত নয়। বিগত কয়েকটি নির্বাচন এবং ১৩.১৪ ও ১৫ সালের রাজনৈতিক সহিংসতার খতিয়ান দেখলে তার সত্যতা মিলবে। এরা মুখে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বললেও জড়িত আছে চোরাচালান ও মাদক পাচারের মতো জঘন্য ও মানববিরোধী কাজে। চোরাচালানপ্রবণ সীমান্তবর্তী এইসব এলাকার অর্থনীতি ও রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক জামায়াতে ইসলামী। ফলে এই এলাকাগুলোয় কোনো বামপন্থি রাজনৈতিক দল, তাদের ছাত্র সংগঠনতো দূরের কথা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করাও অনেক কঠিন। টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের ১২ বছরের সভাপতি, তিনবারের নির্বাচিত কাউন্সিলর একরামুল হক সে রাজনৈতিক শক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ এমন ভুল কাজ এই মাদকবিরোধী অভিযানকে বিতর্কিত করবে, প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
মাদকবিরোধী তালিকায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর তারেক সোলায়মান সেলিমের নাম প্রকাশ পাওয়ায় এলাকাসহ চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করছে। ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করে অনেকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তারেক সোলায়মান সেলিম চট্টগ্রাম নগরে একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। ছোটবেলা থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন। তাদের পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। পাশাপাশি তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত। জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘর মহানগরের অন্যতম সংগঠক তিনি। এলাকায় তাঁর মাদক ও বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডবিরোধী অবস্থানও দীর্ঘদিনের। একজন ভালো ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে তিনি সবার কাছে সমাদৃত। মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁর নাম দেখে অনেকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি এটি ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা। তাঁর জামায়াত বিরোধী শক্ত অবস্থানের কারণেই তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার।
জনগণের দাবির মুখে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের মঙ্গলের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ৪ মে থেকে পুলিশ র্যাব মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করে। অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০৯ জনের নিহত হওয়ার খবর ছেপেছে পত্রিকা। তবে অভিযানে এই পর্যন্ত বড় বা মাঝারি ধরনের মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়েনি, মারাও পড়েনি। এই ধরনের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তবে লক্ষ্যণীয় যে, মাদকের ব্যাপকতায় ভুক্তভোগী ও সাধারণ মানুষ কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে অভিযান শুরু হওয়ায়। তবে তারা মনে করে মাদকবিরোধী অভিযান যেন ভুলভাবে পরিচালিত না হয়। নিরপরাধ ব্যক্তিরা যেন শাস্তি না পায়। ইয়াবার মতো মাদক অনেক পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। অনেক পিতা–মাতার স্বপ্নকে ভেঙে দিয়েছে। সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে। ফলে দেশের মানুষ মাদক থেকে মুক্তি চায়। ভুক্তভোগীরা যে কোনো কিছুর বিনিময়ে মাদক ব্যবহার বন্ধ করতে চায়। কাজেই সরকারকে সে বিষয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে সরকারের এই সদিচ্ছা ব্যর্থ করে দিতে নানা প্রকার ষড়যন্ত্রও অব্যাহত আছে। অভিযানকে বিতর্কিত করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টাও আছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খুব সতর্কভাবে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামের এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও বর্তমানে আইনজীবী সহকারী সমর চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ তিনি অস্ত্র ও ইয়াবা কারবারি। তাঁকে গ্রেফতারের একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, বৃদ্ধ সমর চৌধুরীর হাতে একটি অস্ত্র আর তাঁর দু’পাশে দু’জন পুলিশ। সমর চৌধুরীর পকেটে একটি কলম। এই বৃদ্ধ মানুষটির চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে লোকটি ভদ্র এবং সজ্জন। জানা গেছে পরে, জায়গা–জমি সংক্রান্ত জটিলতায় লোকটিকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
পুলিশ তথা আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর ভাবমূর্তি এমনিতেই সংকটে। দেশে এখন এমন অবস্থা সাধারণ মানুষ একজন অপরাধীর কথা যতটা বিশ্বাস করে পুলিশকে ততটা করে না। যে বাহিনীর হাতে বর্তমানে মাদকবিরোধী অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তাদেরকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে সে বাহিনীর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, গ্রহণযোগ্যতা ও সততা যাচাইয়ের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুবা এই বাহিনী বর্তমান সরকারেরই গ্রহণযোগ্যতার বারোটা বাজাবে। মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। সে জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে একটি সামান্য ভুল অনেক বড় বিপর্যয় ঘটাতে পারে। সে কথা খুব মনে রাখা দরকার।
[email protected]
(সংগৃহীত)
(সংগৃহীত)
এই বিভাগের আরো সংবাদ