খেলাপি ঋণ সমস্যাকে কার্পেটের নিচে লুকানো চরম অনৈতিক
ড. মঈনুল ইসলাম
১০ মার্চ ২০১৯, ১১:৫১ | অনলাইন সংস্করণ
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) ‘ব্যাংকিংয়ে নৈতিকতা’ (এথিকস্ ইন ব্যাংকিং) শীর্ষক ১৮তম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এবারের ১৮তম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতাটি উপস্থাপন করেছেন ভারতে বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বাংলাদেশের সন্তান ড. কামাল জুনায়েদ আহমাদ। ঐদিন সন্ধ্যার টেলিভিশন খবরে এবং পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখের পত্র-পত্রিকায় ড. কামাল জুনায়েদের নিচের মন্তব্যটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে,‘সাংসদেরা ব্যাংক খাতে জড়িয়ে পড়েছেন এবং ব্যাংক খাতে নৈতিকতাকে উপেক্ষা করছেন। গিভ মি এন এথিক্যাল পার্লামেন্ট, আই উইল গিভ ইউ এন এথিক্যাল ব্যাংকিং সিস্টেম (আমাকে একটি নৈতিক পার্লামেন্ট দিন, আমি আপনাকে একটি নৈতিক ব্যাংকিং খাত দেবো)’। তিনি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন, খেলাপি ঋণ সমস্যা একটি পলিটিক্যাল ইকনমি সমস্যা, এটি টেকনিক্যাল সমস্যা নয়। ২০১০ সালে প্রকাশিত খেলাপি ঋণের উপর আমার ও মহিউদ্দিন সিদ্দিকীর গবেষণা-পুস্তক এ প্রোফাইল অব ব্যাংক লোন ডিফল্ট ইন দ্য প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ এর মূল বক্তব্যও এটাই: দেশের অনৈতিক রাজনীতির কারণেই খেলাপি ঋণ সমস্যা সংকটে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের ঐকান্তিক সদিচ্ছা ব্যতিরেকে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের কেশাগ্রও স্পর্শ করা যাবে না।
১৯৯৮-২০০১ সাল এই তিন বছরের ডেপুটেশনে আমি বিআইবিএম এর মহাপরিচালক থাকার সময় ১৯৯৮ সালে প্রথম নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানটির আয়োজন শুরু হয়েছিল, এবং প্রথম বক্তৃতাটি উপস্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশের তদানীন্তন মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। ঐ বক্তৃতায় তিনিই প্রথম দেশের খেলাপি ঋণ সমস্যাটিকে ‘অনৈতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির শিকার’ চিহ্নিত করে বিচার ব্যবস্থার অকার্যকারিতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে বড় বড় ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদেরকে’ শাস্তি প্রদানের ব্যর্থতা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ দশজন ঋণখেলাপির দ্রুত বিচার ও শাস্তিপ্রদানের জন্যে ‘ঋণখেলাপি ট্রাইব্যুনাল’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতির ট্রাইব্যুনাল গঠনের ঐ আহ্বানটি সহ স্মারক বক্তৃতাটির বিস্তৃত বিবরণ দেশের সকল পত্র-পত্রিকায় পরদিন প্রথম হেডলাইন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল এবং জনগণের মধ্যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পরের বছর ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় নুরুল মতিন স্মারক বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন দেশের আরেকজন প্রধান বিচারপতি ও ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সর্বজনশ্রদ্ধেয় জ্ঞানতাপস বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনিও তাঁর বক্তৃতায় ঋণখেলাপি ট্রাইব্যুনাল গঠনের আহ্বানটির পুনরুক্তি করেছিলেন। কিন্তু, দেশের একজন রাষ্ট্রপতি এবং দু’দুজন প্রধান বিচারপতির ঐ আহ্বানটি তদানীন্তন সরকারের কিংবা পরবর্তী ১৯ বছর ধরে ক্ষমতাসীন কোন সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। ফলে, এখনো দেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা রয়ে গেছে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের কাছে আটকে থাকা বিপুল খেলাপি ঋণ। এই ঋণখেলাপিদের প্রায় সবাই ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’, মানে যাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে তাঁরা তাঁদের ঋণ ফেরত দেবেন না। কারণ, তাঁদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এবং আর্থিক প্রতাপ দিয়ে তাঁরা শুধু ব্যাংকিং খাত নয় দেশের সংসদকেও দখল করে ফেলেছেন। (গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের ৬১.৭ শতাংশই ব্যবসায়ী। তাঁদের সিংহভাগই ব্যাংকের মালিক/পরিচালক।) অতএব, এই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের যথোপযুক্ত বিচার যদি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা না যায়, এবং অর্থঋণ আদালতে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায় যদি উচ্চতর আদালতে আপিল করে বছরের পর বছর আপিল মামলাকে অর্থশক্তি ও রাজনৈতিক শক্তির জোরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যায় তাহলে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদেরকে বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে শায়েস্তা করে খেলাপি ঋণ আদায় অসম্ভব থেকে যাবে। অনেক ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণ ২০০২ সালে ‘রাইট-অফ’ করা চালু হওয়ার পর গত ১৬ বছরেও আদায় করা যায়নি। শত শত কোটি টাকা মন্দঋণ অনাদায়ী রেখে বেশ কয়েকজন ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’ মারাও গেছেন, অন্যরা হয়তো বিদেশে ভেগে গেছেন। তবে, তাঁদের অধিকাংশই উচ্চ আদালতের মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রেখে বহাল তবিয়তে দেশের ব্যবসাক্ষেত্রে এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে দাবড়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের অনেকেই ব্যাংকের মালিক বনে গেছেন, পরিচালক হিসেবে বছরের পর বছর দোর্দন্ড প্রতাপে ব্যাংকিং খাতকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমার জানামতে, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের পিতা/পরিবারের সদস্য এই ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’দের কাতারে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এফবিসিসিআই এর বেশ কয়েকজন সভাপতিও এই ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, এদেশের রাজনীতি ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি কালচারকে’ সযতনে লালন করে চলেছে। অতএব, সংশোধনও শুরু করতে হবে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেই। আর, এজন্যে জরুরি প্রয়োজন হলো তিন বছরের জন্যে একটি খেলাপিঋণ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ দশজন ঋণখেলাপিকে চূড়ান্ত বিচারে দ্রুত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ব্যবস্থা হয় রদ করতে হবে নয়তো আপিলের ক্ষেত্রে রায়ে উল্লিখিত ঋণের অর্থের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ব্যাংককে ফেরত দিলে আপিলের সুযোগ দেওয়া যাবে মর্মে শর্ত আরোপ করতে হবে।
৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের নির্বাচন পরবর্তী নতুন মন্ত্রীসভা দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা কিন্তু খেলাপি ঋণের পরিমাণ লুকানোর প্রয়াস জোরদার করার নানা কসরত দেখলেও এখনো ঋণখেলাপিদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কোন প্রতিফলন দেখলাম না। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখের একইদিনের দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত আরেকটি খবর অনুযায়ী ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩,৯১১ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৯৯,৩৭০ কোটি টাকার তুলনায় ৫,৪৫৯ কোটি টাকা কমে গেছে বলে ধারণা জন্মাতে পারে। কিন্তু, এই ধারণা সঠিক অবস্থানের প্রতিফলন নয়। এই খবরেই বলা হয়েছে,‘ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ডিসেম্বরের চূড়ান্ত হিসাব তৈরির আগে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের বিভিন্ন নিয়মে ছাড় দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেও অনেকে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে’। জাতীয় নির্বাচনের আগে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা বড় ঋণখেলাপিদের পুরানো অভ্যাস, যা প্রধানত নব্বই দশকের শেষে শুরু হয়েছিল। তাই এর ফলে যদি সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদে খেলাপি ঋণ কমে যায় সেটাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। তবে, এর মধ্যে খুশি হওয়ার কোন যুক্তি নেই। এটা সমস্যার প্রধান লক্ষণকেই তুলে ধরছে, যেটাকে বলা হয় ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ সমস্যা। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যেসব রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি দীর্ঘদিন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ফেরত দেন না, সেসব জ্ঞানপাপী রাজনীতিক-ব্যবসায়ীরা এই মহাজনী পন্থাটি অপব্যবহার করে প্রতিবারই নির্বাচনে শামিল হয়ে সংসদের আসনে আসীন হয়ে চলেছেন। এ ব্যাপারে দেশের প্রধান দুই জোটের শীর্ষ নেতৃত্বের কোন মাথাব্যথা নেই। বলতে গেলে প্রধানত এই কারণেই ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ কালচারটা ক্রমেই ক্যানসারে রূপান্তরিত হয়ে গেছে এদেশে। আবার এই রাজনীতিক-ব্যবসায়ীরা তাঁদের খেলাপি ঋণের সিংহভাগ যে দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছেন সেটাও ক্ষমতাসীন মহলের অজানা নয়। আর, ঐ পাচার হওয়া অর্থ যে কস্মিনকালেও ব্যাংকে ফেরত আসবে না তা-ও সরকার এবং উচ্চপদে সমাসীন ব্যাংকাররা না জানার কোন কারণ নেই। আসলে এটাকে ব্যাংকঋণ নিয়ে একটা ‘পাতানো খেলা’ বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। সমস্যার প্রকৃত রূপটি সরকার, ব্যাংকার এবং ঋণখেলাপি সবারই জানা আছে। সমস্যার সমাধানের উপায় সম্পর্কেও এই তিন পক্ষের সবার স্পষ্ট ধারণা আছে। কিন্তু, জেনেশুনেই সরকার সমাধানের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করছে না এই ঋণখেলাপিরা ক্ষমতাসীন মহলের ‘আপনজন’ হওয়ায়। বর্তমান অর্থমন্ত্রী নিজেই দেশের একজন নেতৃস্থানীয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। অতএব, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের হাঁড়ির খবর তাঁর নখদর্পণে থাকার কথা। কিন্তু, তাঁর গত দু’মাসের এতদ্সম্পর্কিত কথাবার্তা ও কার্যকলাপের ফলে অনেকের ধারণা জন্মাতে পারে যে তিনি তাঁর ‘চার্টার্ড একাউন্টেন্টের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান’ ব্যবহার করে খেলাপি ঋণ সমস্যাটিকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলতেই বেশি আগ্রহী, ঋণ আদায়ের জন্যে তাঁর একাগ্রতার অভাব দৃশ্যমান হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিকটুভাবে। সন্দেহটা ভুল হলে আমি খুবই খুশি হবো, কিন্তু লুকানোর অভিযোগটি কেন উত্থাপন করছি সেটাই ব্যাখ্যা করছি।
নূতন মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণের মাত্র কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পরই হঠাৎ মাননীয় অর্থমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন, ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। এর কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ বা অবলোপন করার নিয়মনীতি অনেকখানি শিথিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করল: আগের নিয়মে যেখানে পাঁচ বছরের খেলাপি মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ করার যোগ্য বিবেচিত হত সেক্ষেত্রে নতুন নিয়মে দুই বা তিন বছরের মন্দঋণও কোন ব্যাংক চাইলে ‘রাইট-অফ’ করায় কোন বাধা থাকবে না। পাঠকদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, মন্দঋণ ‘রাইট-অফ’ বা অবলোপন করার মানে হলো ঐ অবলোপনকৃত মন্দঋণের হিসাবটা ব্যাংকের মূল ব্যালেন্স শিট থেকে অপসারণ করে আরেকটি লেজারে হিসাবটা সংরক্ষণ করা। ‘রাইট-অফ’ করার মূল দুটো শর্ত হলো: ১) ঐ ঋণ সুদাসলে আদায়ের জন্যে ব্যাংক মামলা দায়ের করবে, ২) যে পরিমাণ ঋণ ‘রাইট-অফ’ করা হয় তার সম-পরিমাণ অর্থ ‘প্রভিশনিং’ বা ‘সঞ্চিতি’ করতেই হবে। প্রভিশনিং মানে হলো, ঐ পরিমাণ অর্থ ব্যাংক কর্তৃক অন্য কাউকে ঋণ দেওয়া যাবে না। রাইট অফ করার ফলে ব্যাংকের শ্রেণীকরণকৃত (বা ক্লাসিফাইড) নন-পারফর্মিং লোনের (খেলাপি ঋণের) পরিমাণ ঠিক অতটুকু কম দেখানো যাবে। অতএব, এই নতুন নিয়ম চালু হওয়ার পর ক্লাসিফাইড লোনের যে ক্রমবর্ধমান (পঁসঁষধঃরাব) পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর প্রকাশ করে সে পরিমাণটা কমানোর হাতিয়ার ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হলো। আর একটা সুবিধে, মামলা করার বাধ্যবাধকতার জন্যে আগে যে সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর) ছিল ওটাকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেওয়া হলো। এই নতুন নিয়মগুলোর আসল মরতবা হলো, অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়িত করার বেশ কয়েকটি অস্ত্র ব্যাংকগুলোকে প্রদান করা হলো। কিন্তু, এর ফলে কি ‘রাইট অফ’ করা মন্দঋণ আদায় করার ব্যবস্থাটা শক্তিশালী হলো? বলা হচ্ছে, ২০০২ সালে পাঁচ বছরের বেশি সময়ের অনাদায়ী মন্দঋণের ‘রাইট-অফ’ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৪৯,৭৪৫ কোটি টাকা মন্দঋণ ‘রাইট-অফ’ করা হয়েছে এবং ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঐ ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণের ১১,৮৭৯ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। যে ১১,৮৭৯ কোটি টাকা ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণ আদায় হয়েছে ওগুলো ‘সুদাসলে আদায়কৃত মন্দঋণ’। অতএব, ঐ অংকটিকে ৪৯,৭৪৫ দিয়ে ভাগ করে যদি কেউ খুশি হয়ে যান যে প্রায় ২৩.৮৮ শতাংশ ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণ আদায় করে ব্যাংকগুলো বেশ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে তাহলে তাঁরা মারাত্মক ভুল করবেন। আসলে, এই দুটো অংক মোটেও অনুপাত নির্ধারণের জন্যে উপযোগী নয়। গত ১৬ বছর ধরে মোট ৪৯,৭৪৫ কোটি টাকা মন্দঋণ হিসেবে ক্রমাগতভাবে ‘রাইট-অফ’ করার পর ঐ মন্দঋণের উপর নিয়মিতভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ ধার্য হয়ে চলেছে, কিন্তু যখন ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশ করা হয় তখন যে সুদ ধার্য হচ্ছে তার পরিমাণ যোগ করে ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণ ৪৯,৭৪৫ কোটি টাকা সর্বশেষ হিসেব প্রকাশের সময় সুদাসলে কত দাঁড়িয়েছে তা বাংলাদেশ ব্যাংক জনগণকে জানাচ্ছে না। ২৭ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোর সংবাদটির প্রতিবেদক আদায়কৃত ১১,৮৭৯ কোটি টাকা ৪৯,৭৪৫ কোটি টাকা থেকে বিয়োগ করে অবলোপনকৃত ঋণের স্থিতি ৩৭,৮৬৬ কোটি টাকা হয়েছে বলে যে হিসেব দিয়েছেন সেটাও ভুল তথ্য। প্রতিবেদকের এই ভুলের ফলে ১,৩১,৭৭৭ কোটি টাকা মোট খেলাপি ঋণের হিসেবটাও ভুল হয়ে গেছে। আসল খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি হবে।
আমার মূল বক্তব্য হলো, খেলাপি ঋণের সমস্যাটাকে নানা কসরত করে গৌণ করে দেখানো কিংবা ওটাকে কার্পেটের তলায় লুকানোর জন্যে নিয়ম-নীতি শিথিল করা আমার দৃষ্টিতে চরম অনৈতিক। এখন সময়ের দাবি হলো খেলাপিঋণ আদায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সত্যিকার সদিচ্ছার এবং ঋণখেলাপিদের প্রতি তাঁর ‘জিরো টলারেন্স’। ব্যাংকিং কমিশনের পরিবর্তে কমিটি গঠন সদিচ্ছার পরিচায়ক নয়। রচনাকাল : ৯ মার্চ ২০১৯ (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া)
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের নির্বাচন পরবর্তী নতুন মন্ত্রীসভা দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা কিন্তু খেলাপি ঋণের পরিমাণ লুকানোর প্রয়াস জোরদার করার নানা কসরত দেখলেও এখনো ঋণখেলাপিদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কোন প্রতিফলন দেখলাম না। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখের একইদিনের দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত আরেকটি খবর অনুযায়ী ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩,৯১১ কোটি টাকা, যা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৯৯,৩৭০ কোটি টাকার তুলনায় ৫,৪৫৯ কোটি টাকা কমে গেছে বলে ধারণা জন্মাতে পারে। কিন্তু, এই ধারণা সঠিক অবস্থানের প্রতিফলন নয়। এই খবরেই বলা হয়েছে,‘ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ডিসেম্বরের চূড়ান্ত হিসাব তৈরির আগে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের বিভিন্ন নিয়মে ছাড় দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেও অনেকে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে’। জাতীয় নির্বাচনের আগে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা বড় ঋণখেলাপিদের পুরানো অভ্যাস, যা প্রধানত নব্বই দশকের শেষে শুরু হয়েছিল। তাই এর ফলে যদি সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদে খেলাপি ঋণ কমে যায় সেটাকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না। তবে, এর মধ্যে খুশি হওয়ার কোন যুক্তি নেই। এটা সমস্যার প্রধান লক্ষণকেই তুলে ধরছে, যেটাকে বলা হয় ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ সমস্যা। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যেসব রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি দীর্ঘদিন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ফেরত দেন না, সেসব জ্ঞানপাপী রাজনীতিক-ব্যবসায়ীরা এই মহাজনী পন্থাটি অপব্যবহার করে প্রতিবারই নির্বাচনে শামিল হয়ে সংসদের আসনে আসীন হয়ে চলেছেন। এ ব্যাপারে দেশের প্রধান দুই জোটের শীর্ষ নেতৃত্বের কোন মাথাব্যথা নেই। বলতে গেলে প্রধানত এই কারণেই ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ কালচারটা ক্রমেই ক্যানসারে রূপান্তরিত হয়ে গেছে এদেশে। আবার এই রাজনীতিক-ব্যবসায়ীরা তাঁদের খেলাপি ঋণের সিংহভাগ যে দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছেন সেটাও ক্ষমতাসীন মহলের অজানা নয়। আর, ঐ পাচার হওয়া অর্থ যে কস্মিনকালেও ব্যাংকে ফেরত আসবে না তা-ও সরকার এবং উচ্চপদে সমাসীন ব্যাংকাররা না জানার কোন কারণ নেই। আসলে এটাকে ব্যাংকঋণ নিয়ে একটা ‘পাতানো খেলা’ বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। সমস্যার প্রকৃত রূপটি সরকার, ব্যাংকার এবং ঋণখেলাপি সবারই জানা আছে। সমস্যার সমাধানের উপায় সম্পর্কেও এই তিন পক্ষের সবার স্পষ্ট ধারণা আছে। কিন্তু, জেনেশুনেই সরকার সমাধানের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করছে না এই ঋণখেলাপিরা ক্ষমতাসীন মহলের ‘আপনজন’ হওয়ায়। বর্তমান অর্থমন্ত্রী নিজেই দেশের একজন নেতৃস্থানীয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। অতএব, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের হাঁড়ির খবর তাঁর নখদর্পণে থাকার কথা। কিন্তু, তাঁর গত দু’মাসের এতদ্সম্পর্কিত কথাবার্তা ও কার্যকলাপের ফলে অনেকের ধারণা জন্মাতে পারে যে তিনি তাঁর ‘চার্টার্ড একাউন্টেন্টের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান’ ব্যবহার করে খেলাপি ঋণ সমস্যাটিকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলতেই বেশি আগ্রহী, ঋণ আদায়ের জন্যে তাঁর একাগ্রতার অভাব দৃশ্যমান হয়ে যাচ্ছে দৃষ্টিকটুভাবে। সন্দেহটা ভুল হলে আমি খুবই খুশি হবো, কিন্তু লুকানোর অভিযোগটি কেন উত্থাপন করছি সেটাই ব্যাখ্যা করছি।
নূতন মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণের মাত্র কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পরই হঠাৎ মাননীয় অর্থমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন, ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। এর কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ বা অবলোপন করার নিয়মনীতি অনেকখানি শিথিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করল: আগের নিয়মে যেখানে পাঁচ বছরের খেলাপি মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ করার যোগ্য বিবেচিত হত সেক্ষেত্রে নতুন নিয়মে দুই বা তিন বছরের মন্দঋণও কোন ব্যাংক চাইলে ‘রাইট-অফ’ করায় কোন বাধা থাকবে না। পাঠকদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, মন্দঋণ ‘রাইট-অফ’ বা অবলোপন করার মানে হলো ঐ অবলোপনকৃত মন্দঋণের হিসাবটা ব্যাংকের মূল ব্যালেন্স শিট থেকে অপসারণ করে আরেকটি লেজারে হিসাবটা সংরক্ষণ করা। ‘রাইট-অফ’ করার মূল দুটো শর্ত হলো: ১) ঐ ঋণ সুদাসলে আদায়ের জন্যে ব্যাংক মামলা দায়ের করবে, ২) যে পরিমাণ ঋণ ‘রাইট-অফ’ করা হয় তার সম-পরিমাণ অর্থ ‘প্রভিশনিং’ বা ‘সঞ্চিতি’ করতেই হবে। প্রভিশনিং মানে হলো, ঐ পরিমাণ অর্থ ব্যাংক কর্তৃক অন্য কাউকে ঋণ দেওয়া যাবে না। রাইট অফ করার ফলে ব্যাংকের শ্রেণীকরণকৃত (বা ক্লাসিফাইড) নন-পারফর্মিং লোনের (খেলাপি ঋণের) পরিমাণ ঠিক অতটুকু কম দেখানো যাবে। অতএব, এই নতুন নিয়ম চালু হওয়ার পর ক্লাসিফাইড লোনের যে ক্রমবর্ধমান (পঁসঁষধঃরাব) পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর প্রকাশ করে সে পরিমাণটা কমানোর হাতিয়ার ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হলো। আর একটা সুবিধে, মামলা করার বাধ্যবাধকতার জন্যে আগে যে সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর) ছিল ওটাকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেওয়া হলো। এই নতুন নিয়মগুলোর আসল মরতবা হলো, অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়িত করার বেশ কয়েকটি অস্ত্র ব্যাংকগুলোকে প্রদান করা হলো। কিন্তু, এর ফলে কি ‘রাইট অফ’ করা মন্দঋণ আদায় করার ব্যবস্থাটা শক্তিশালী হলো? বলা হচ্ছে, ২০০২ সালে পাঁচ বছরের বেশি সময়ের অনাদায়ী মন্দঋণের ‘রাইট-অফ’ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৪৯,৭৪৫ কোটি টাকা মন্দঋণ ‘রাইট-অফ’ করা হয়েছে এবং ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঐ ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণের ১১,৮৭৯ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। যে ১১,৮৭৯ কোটি টাকা ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণ আদায় হয়েছে ওগুলো ‘সুদাসলে আদায়কৃত মন্দঋণ’। অতএব, ঐ অংকটিকে ৪৯,৭৪৫ দিয়ে ভাগ করে যদি কেউ খুশি হয়ে যান যে প্রায় ২৩.৮৮ শতাংশ ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণ আদায় করে ব্যাংকগুলো বেশ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে তাহলে তাঁরা মারাত্মক ভুল করবেন। আসলে, এই দুটো অংক মোটেও অনুপাত নির্ধারণের জন্যে উপযোগী নয়। গত ১৬ বছর ধরে মোট ৪৯,৭৪৫ কোটি টাকা মন্দঋণ হিসেবে ক্রমাগতভাবে ‘রাইট-অফ’ করার পর ঐ মন্দঋণের উপর নিয়মিতভাবে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ ধার্য হয়ে চলেছে, কিন্তু যখন ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশ করা হয় তখন যে সুদ ধার্য হচ্ছে তার পরিমাণ যোগ করে ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণ ৪৯,৭৪৫ কোটি টাকা সর্বশেষ হিসেব প্রকাশের সময় সুদাসলে কত দাঁড়িয়েছে তা বাংলাদেশ ব্যাংক জনগণকে জানাচ্ছে না। ২৭ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোর সংবাদটির প্রতিবেদক আদায়কৃত ১১,৮৭৯ কোটি টাকা ৪৯,৭৪৫ কোটি টাকা থেকে বিয়োগ করে অবলোপনকৃত ঋণের স্থিতি ৩৭,৮৬৬ কোটি টাকা হয়েছে বলে যে হিসেব দিয়েছেন সেটাও ভুল তথ্য। প্রতিবেদকের এই ভুলের ফলে ১,৩১,৭৭৭ কোটি টাকা মোট খেলাপি ঋণের হিসেবটাও ভুল হয়ে গেছে। আসল খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি হবে।
আমার মূল বক্তব্য হলো, খেলাপি ঋণের সমস্যাটাকে নানা কসরত করে গৌণ করে দেখানো কিংবা ওটাকে কার্পেটের তলায় লুকানোর জন্যে নিয়ম-নীতি শিথিল করা আমার দৃষ্টিতে চরম অনৈতিক। এখন সময়ের দাবি হলো খেলাপিঋণ আদায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সত্যিকার সদিচ্ছার এবং ঋণখেলাপিদের প্রতি তাঁর ‘জিরো টলারেন্স’। ব্যাংকিং কমিশনের পরিবর্তে কমিটি গঠন সদিচ্ছার পরিচায়ক নয়। রচনাকাল : ৯ মার্চ ২০১৯ (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া)
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এই বিভাগের আরো সংবাদ