আজকের শিরোনাম :

দরকার কার্যকর সাঁড়াশি অভিযান : আহমদ রফিক

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ মে ২০১৮, ১২:২৪

ঢাকা, ৩১ মে, এবিনিউজ : ‘দেশটা মাদকে ভরে গেছে’, ‘ছাত্র-ছাত্রীরা পর্যন্ত মাদকে আসক্ত’, ‘মাদক যে কী সর্বনাশা জিনিস’ ইত্যাদি মন্তব্য হরহামেশা শুনতে পাওয়া যায়। অথচ কারো মনে হয় না ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করি, মাদক নির্মূলের জন্য আহ্বান জানাই। শুধু মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে দেখা যায় মাদকসংক্রান্ত খবর : ‘ইয়াবা বড়ি জব্দ’ বা অনুরূপ কোনো ঘটনা।

সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে। পুলিশ-র‌্যাব তথা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সম্মিলিতভাবে এ অভিযান শুরু করেছে। আর এ পরিপ্রেক্ষিতে খবরাখবর নিয়ে সংবাদপত্র মহলে তুমুল সংবাদ পরিবেশন ও প্রতিবেদন-লেখালেখি চলছে।

তাই সংবাদপত্রের পাতায় মোটা মোটা হরফে শিরোনাম এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। যেমন—গত ২৫ মে তারিখের একটি সংবাদ শিরোনাম : ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত অর্ধশত ছাড়াল’, ‘মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান’-এ গত ১০ দিনে বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৫২ ছাড়াল। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ঘটনার এ তালিকা।

হঠাৎ করে সূচিত এ অভিযান সমাজে অনেকটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সংবাদ শিরোনামগুলোয় তার প্রকাশ। যেমন—‘মাদকের পৃষ্ঠপোষকরা এখনো অধরা’ (২৫ মে ২০১৮)। এ প্রসঙ্গে পত্রিকাটির মন্তব্য হচ্ছে : “বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি সংস্থার তদন্তে যেসব ‘গডফাদার’ বা ‘পৃষ্ঠপোষকের’ নাম এসেছে তাদের আইনের আওতায় আনা না গেলে মাদকের মূলোত্পাটন সম্ভব নয়। মাদকের তালিকায় থাকা বর্তমান ও সাবেক ২৫ সংসদ সদস্যসহ সাড়ে ৪০০ জনপ্রতিনিধি এখনো থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।”

এ সমস্যা বিরাট এক প্রশ্ন। দেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যাঁদের হাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেশ শাসন এবং আইন প্রণয়নের ভার, তাঁরাই যদি এমন সর্বনাশা সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়েন তাহলে এ দেশের বিশেষত সমাজের পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাঁদের বিচারই বা করবে কে?

দুই.

প্রশ্ন এখানে শেষ নয়, যা উঠছে তা আরো মারাত্মক, আরো ভয়াবহ এবং তা জননিরাপত্তাসহ দেশের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্নের সম্মুখীন। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতায় এমন দু-চারটি বড় ও প্রকাশিত ছোটখাটো ঘটনা সরকারের বিশেষ বাহিনীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। যেমন—নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় স্থানীয় র‌্যাবপ্রধানের সংশ্লিষ্টতা। সে মামলার শেষ পরিণতি এখনো দেখা যায়নি।

এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে : ‘এমনকি মাদক সিন্ডিকেটে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক সদস্য জড়িত থাকার বিষয়েও অভিযোগ উঠেছে।’ এ ঘটনা সত্য হলে সরকারের মাদকবিরোধী অভিযানের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যাবে। মাদক ব্যবসার মূল হোতারা আড়ালে থেকে গেলে অভিযান বন্ধ হলেই পুরনো অবস্থা ফিরে আসবে।

তাহলে এ রক্তক্ষয়ী অভিযানের পরিণাম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এখন তো দেখছি এ অভিযান নিয়ে সাধারণ মানুষ খুশি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছে না। মাদকের সর্বনাশা প্রভাব সমাজে লক্ষ করে তারা এতটাই নির্মম মনোভাব পোষণ করেছে। একই রকম প্রতিক্রিয়া অনেক শিক্ষিতজনের।

জঙ্গি দমনে বিশেষ বাহিনীর অভিযানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডেও তাদের সমর্থন দেখা গেছে। তাদের যুক্তি—এ বিষাক্ত আগাছা নির্মূল করা না গেলে সমাজ সুস্থ নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে না। বিচারের ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধীরা বেরিয়ে যাবে। এমন যুক্তি এই অভিযানের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যাচ্ছে। অর্থাৎ একটি সুস্থ সমাজের প্রত্যাশা দেশের মানুষের।

অবশ্য মানবাধিকার সংস্থার সদস্য ও অনুরূপ নীতি-নৈতিকতায় বিশ্বাসীরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের বক্তব্য : প্রয়োজনে কঠোর আইন প্রণয়ন করে বিশেষ আদালতে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে অপরাধের শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তবু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নয়, আইনি বিচারের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন থাকুক সমাজে।

পূর্বোক্ত অভিযানের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে রাজনৈতিক মহলে আরো উদ্বেগ যে এ অভিযান প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে। তাই আইনি ব্যবস্থায় সব সমস্যার সমাধান ঘটানো হোক। তাঁদের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন রয়েছে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্রী মহলের।

সে জন্যই বলছিলাম এ অভিযান সদিচ্ছা সত্ত্বেও বেশ কিছু অনভিপ্রেত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন- মাদকের সর্বনাশা ছোবল তো সমাজের সর্বস্তরে বিস্তার লাভ করেছে গত কয়েক দশক ধরে। শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এর বিস্তার। সর্বোচ্চ শিক্ষায়তনের ছাত্র-ছাত্রী থেকে বস্তিবাসী তরুণ-তরুণী এ ভয়াবহ নেশায় আসক্ত। এককথায় সমাজের একটি বড় অংশ এ বিষয়ের প্রভাবে নিশ্চল। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কোনো শ্রেণির পরিবারের সদস্য এ বিষাক্ত নেশা থেকে মুক্ত নয়। তাহলে এত দিন পরে এ অভিযান কেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে?

এসব প্রশ্ন আমাদেরও বিব্রত করছে। আমরাও চাই সমাজ থেকে এ সর্বনাশা নেশার যেন অবসান ঘটে। সে জন্য দরকার দেশজুড়ে চুলচেরা অভিযান। সে ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা যেন কোনো প্রভাব না রাখে। যদি রাখে, তাহলে এ অভিযানের মূল উদ্দেশ্যই বরবাদ হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে কী করণীয় সমাজে সুস্থ অবস্থা ফিরিয়ে আনতে।

তিন.

প্রথম কথা, এ অভিযান যেন একমুখী না হয়, রাজনীতির দলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। যে কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তা যেন যথাযথভাবে পালিত হয়। অর্থাৎ দলীয় বিবেচনা যেন বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। অপরাধ দল বিবেচনাবহির্ভূত বিষয়। দ্বিতীয়ত, অভিযান কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যেন কোনো প্রকার স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা প্রভাবিত না হন।

ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে মাদক ব্যবসায়ে লিপ্ত প্রত্যেক ব্যক্তি যেন বিচারের আওতায় আসে, সঠিক তদন্ত প্রতিবেদনে বিচারের সম্মুখীন হয়। যেন নেপথ্যের পৃষ্ঠপোষক বা সিন্ডিকেট সদস্য যেন মুক্ত না থাকে, তাদের অপরাধের জন্য যথাযথ শাস্তি ভোগ করে।

কিন্তু অভিযান শুরু থেকে এত দিন পার হওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে, এতগুলো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পরও সংবাদপত্রের ভাষ্যমতে আমাদের আশঙ্কাই সত্য হয়ে থাকছে। এমনকি অভিযানের মধ্যেই কোথাও কোথাও পূর্বাবস্থা বিরাজ করছে। যেমন—একটি সংবাদ শিরোনাম চট্টগ্রামের বরিশাল কলোনি নিয়ে : ‘অভিযান শেষ হতে না হতেই পুনরায় বসে সে মাদকের হাট’। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় মাদকের আখড়ায় কেমন করে এ অঘটন সম্ভব হলো। একই দিনের অর্থাৎ ২৬  মের আরেকটি খবর অন্য একটি দৈনিকে : ‘আড়াইহাজারে হাত বাড়ালেই মাদক’। কেমন করে সম্ভব হচ্ছে এসব ঘটনা অভিযান চলাকালে?

বাস্তব ঘটনা হলো দেশজুড়ে, গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত মাদক বিক্রির জমজমাট ব্যবসা চলছে। শুরুতে এ ব্যবসা রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরে গড়ে উঠলেও এখন তা বাংলাদেশের অণু-পরমাণুতে বিরাজমান। যেমন—ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের অদূরে আড়াইহাজারের মতো এলাকায়ও গড়ে উঠেছে মাদক সিন্ডিকেট। নিশ্চয়ই এর পেছনে আশীর্বাদ রয়েছে কেন্দ্রীয় বড় সিন্ডিকেটের! কিংবা মাদকের আপন মাহাত্ম্যেই তা গড়ে উঠেছে টাকার অবিশ্বাস্য লেনদেন!

এ জন্যই এর আগে আমরা বলেছি, অনেক অনেক দেরিতে শুরু হয়েছে মাদকবিরোধী অভিযান, বিশেষ করে যখন দেশটির সর্বাঙ্গে মাদকের ক্ষত। এখন এ সর্বনাশা পরিণাম থেকে দেশকে, সমাজকে মুক্ত করতে হলে দীর্ঘদিন ধরে লাগাতার অভিযান চালিয়ে যেতে হবে, শুধু শহরে-বন্দরে নয়, সুদূর গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত। গোয়েন্দা বিভাগকে আরো তৎপর হতে হবে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরিতে। হানা দিতে হবে প্রতিটি মাদক ব্যবসার আখড়ায়।

সত্যি বলতে কি মাদক ব্যবসা ও সমাজে মাদকাসক্তি যে হারে বেড়েছে এবং বাড়ছে, বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে, তাতে এটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশেও চলছে এ বিষয়ে সমালোচনা। তাই এ অভিযান শুধু নির্ধারিত ও তালিকাভুক্ত মাদক আখড়ায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না।

আঘাত হানতে হবে এর উৎসমুখে, এর মূল হোতাদের ওপর। সর্বোপরি বন্ধ করতে হবে মাদক অনুপ্রবেশের গতিপথ, যাতে মাদক ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয় অন্য রুট বেছে নিতে। একমাত্র তখনই বাংলাদেশ মাদকমুক্ত হতে পারবে।

তাই মাদকবিরোধী অভিযান বা আক্রমণ হতে হবে দ্বিমুখী—যেমন ধ্বংস করতে হবে মাদকের ব্যবসাকেন্দ্রগুলো, তেমনি বন্ধ করতে হবে দেশে মাদক প্রবেশের পথগুলো। সীমান্তবর্তী পথগুলোয় কড়া নজরদারি দরকার এবং তা যেন হয় সরষের মধ্যকার ভূতমুক্ত। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে সাগরপথগুলোকে বন্ধ করতে হবে, নিয়মিত নজরদারিতে।

পরিসংখ্যানের সাহায্য নিলে দেখা যাবে গত কয়েক বছরে মাদকের অনুপ্রবেশ বেড়েছে বহু গুণ। এর পেছনে রয়েছে সমাজবিরোধী চোরাচালানি কুচক্রী তথা সিন্ডিকেট। ব্যবসা যেখানে শতকোটি, হাজার কোটি টাকার, সেখানে বৃহৎ অপশক্তির আবির্ভাব ঘটবেই। এদের শক্ত হাতে নিষ্ক্রিয় করতে হলে মাদকবিরোধী অভিযানের জন্য আরো অনেক স্কোয়াড গঠন করতে হবে—সেখানে থাকবে সৎ, নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক কর্মী। তাঁদের সৎ কর্মতৎপরতা দেশকে, সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে।

আরো একটি কথা। অভিযানের পাশাপাশি দরকার হবে ব্যাপক মাদকবিরোধী প্রচারের। সমাজকে এ ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে এর সর্বনাশা পরিণাম সম্পর্কে। যাতে সমাজের মধ্যে ব্যাপক মাদকবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এ ব্যবস্থা হবে দেশকে মাদকমুক্ত করার পরোক্ষ কিন্তু কার্যকর একটি উপায়।

এ বিষয়ে শেষ কথা হলো, মাদক প্রবেশে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে যেমন উদ্বুদ্ধ করতে হবে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, তেমনি একে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে, সরষের মধ্যে যেন ভূত অর্থাৎ রাজনৈতিক ভূত বাসা বাঁধতে না পারে। কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি বা শক্তি যাতে মাদক চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত হতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে না পারলে বর্তমান অভিযান সফল হবে না। অর্থাৎ দরকার সফল মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান। (কালের কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত)

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

এই বিভাগের আরো সংবাদ