আজকের শিরোনাম :

মতিয়া চৌধুরীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি মহল ঘোঁট পাকাচ্ছে কেন?

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০১৮, ১৭:০৪

ড. মইনুল ইসলাম, ৩০ মে, এবিনিউজ : গত ১৯ মে ২০১৮ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত খবরে অবাক হয়ে জানলাম, শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের একটি সভায় কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীকে সংসদ থেকে প্রত্যাহার করার জন্য একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে বাস্তবায়নের জন্য পাঠানো হয়েছে। আমাদের দেশের রাজনীতি সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তারা বুঝতে পারবেন যে এই প্রস্তাবের পেছনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কোন প্রভাবশালী নেতার বা নেতাদের গোপন আশ্‌কারা না থাকলে জেলা পর্যায়ের নেতাদের এতবড় দুঃসাহস দেখানোর প্রশ্নই উঠতো না। অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার সাথে বেগম মতিয়া চৌধুরীর যে শ্রদ্ধা এবং আস্থার সম্পর্ক রয়েছে তা বিনষ্ট করার জন্য আওয়ামী লীগের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন দক্ষিণপন্থী নেতা নানান কিসিমের ফন্দি–ফিকিরের আশ্রয় নিতে কসুর করেননি। আওয়ামী লীগে যারা মার্কিনপন্থী লবির সমর্থক হিসেবে পরিচিত তাঁরাই এই মতিয়া–বিরোধী কোটারীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই মতিয়া–বিরোধী চক্রান্তকারীদের মধ্যে শেখ হাসিনার আত্মীয় হিসেবে প্রভাবশালী কারো কারো নামও শোনা গেছে। বলা বাহুল্য, তাঁদের এহেন অপপ্রয়াস প্রতিবারই ভন্ডুল হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভার মধ্যে সাধারণ জনগণের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর ওপর প্রধানমন্ত্রীর অগাধ আস্থাকে এসব ষড়যন্ত্রকারী তেমন একটা টলাতে সক্ষম হননি গত নয় বছর ধরে। কিন্তু, সাম্প্রতিক কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদেরকে তিরস্কার করার সময় বেগম মতিয়া চৌধুরী ‘রাজাকারের বাচ্চা’ শব্দটি উচ্চারণ করে বেশ খানিকটা সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ঐ শব্দগুচ্ছকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ অপব্যবহার করে ‘আমরা সবাই রাজাকার’ োগান ও ব্যানার তৈরী করে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে আন্দোলনের পক্ষে খেপিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। একইসাথে, বিএনপি এবং জামায়াত–শিবিরের সক্রিয় উস্কানিতে কোটাবিরোধী মিটিং–মিছিলগুলোতে দেশের সব জায়গায় মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত অবমাননাকর বক্তব্য প্রদানের একটা সুচতুর প্রোপাগান্ডা–ক্যাম্পেইন চালানো হয়েছে। এর ফলে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে বেশ কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল বলা চলে। তবে, আন্দোলন পরিচালনায় তারেক জিয়ার অডিও–বার্তা ফাঁস হওয়ায় বিএনপি–জামায়াতের এই খেলাটা ধরা পড়তে দেরী হয়নি। যাহোক্‌, বেগম মতিয়া চৌধুরীর আবেগঘন বক্তব্যে তিনি যে এই ইস্যুটাকে রাজনৈতিকীকরণের জন্যে জামায়াত–শিবির এবং বিএনপি’র অপপ্রয়াসকেই তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন সেটা এদ্দিনে নিশ্চয়ই খোলাসা হয়ে গেছে! তবুও বলবো, তাঁর বক্তব্যকে ‘বেফাঁস মন্তব্য’ অভিহিত করে অনেকেই যে এরপর থেকে মতিয়া চৌধুরীকে প্রতি–আক্রমণের প্রধান টার্গেট বানিয়ে ফেলেছেন সেটা বুঝতে কারো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। (যেমন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন এরকম বক্তব্যের জন্যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে নাকি মতিয়া চৌধুরীকে বরখাস্ত করে ঘরে পাঠিয়ে দিতেন। কাদের সিদ্দিকী বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে যেসব কেলেংকারির জন্ম দিয়েছেন এরপর তাঁর মুখে এধরনের কড়া কথা কি আদৌ শোভা পায়। জনগণের শ্রদ্ধার আসনটা তিনি বহু আগেই হারিয়েছেন। ভাগ্যিস তিনি প্রধানমন্ত্রী হননি!) এরই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছেন আওয়ামী লীগের এই দক্ষিণপন্থী নেতাদের কোটারী। শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক প্রস্তাবের সাথে এসব নেতাদের ঘনিষ্ঠ যোগসাজশ রয়েছে বলে আমার ধারণা।

বেগম মতিয়া চৌধুরী বাংলাদেশে একটি কৃষি বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল কৃষিমন্ত্রী তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। ১৯৯৬–২০০১ মেয়াদেও শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভায় সবচেয়ে সফল মন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। কিন্তু, ২০০১ সালের নির্বাচনে শেরপুর জেলার নেতাকর্মীদের একাংশের অসহযোগিতা এবং সাবোটাজ কর্মকান্ডের শিকার হয়ে তিনি নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। ওসব নেতা–কর্মীর অভিযোগ হলো মতিয়া চৌধুরী তাদের বিভিন্ন অনৈতিক লবিয়িং এবং ঠিকাদারী সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে সুপারিশ করেননি এবং মদদ দেননি। রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এসব অন্যায় সুযোগ–সুবিধা পাওয়াকে তারা ‘অধিকার’ বিবেচনা করে। জনশ্রুতি রয়েছে যে সুপারিশের জন্য কেউ মতিয়া চৌধুরীর দ্বারস্থ হলে তিনি নাকি ‘নিয়ম মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হলো’ লিখে দিতেন, যাতে প্রায়ই সুফল মিলত না। যেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী রাজনৈতিক তৎপরতাকে হালুয়া–রুটি এবং সার্বক্ষণিক আয়–রোজগার ও ধনসম্পদ আহরণের ধান্দা হিসেবে ব্যবহার করে তারা যে এহেন নিয়মনিষ্ঠা ও সততাকে ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখবে তাতে তো অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই মতিয়া চৌধুরীর সীমাবদ্ধতা হয়ে গেছে বাংলাদেশে। ১৯৯৬–২০০১ মেয়াদে পাঁচ বছর এবং ২০০৯–২০১৮ মেয়াদে নয় বছর মন্ত্রীত্ব—মোট ১৪ বছর মন্ত্রীত্ব করার পরও বেগম মতিয়া চৌধুরীর আর্থিক সততা ও কর্তব্যপালনে কর্মনিষ্ঠা এসিড টেস্টে উত্তীর্ণ একটি পরীক্ষিত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর এই অনন্য সততা একেবারেই ব্যতিক্রমী নজির হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আমার জানামতে পাঁচ বছর মন্ত্রীত্ব করার পর ২০০১ সালে তাঁর নির্বাচনী পোস্টার ছাপানোর খরচ মেটানোর সামর্থ্যও ছিল না তাঁর, কিছু বন্ধুবান্ধব স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাঁকে এ–ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন বলে জানা গেছে। মন্ত্রী হিসেবে তিনি যে বেতন–ভাতা পান তার বড় অংশটাই তিনি তাঁর এলাকার গরীব–দুঃখীদের সহায়তায় ব্যয় করে ফেলেন। চৌদ্দ বছরের মন্ত্রীত্বকালে তাঁর জীবনযাত্রা–বসন–ভূষণে কোন জৌলুস পরিদৃষ্ট হয়নি। নিরলস জনগণের সেবায় নিবেদিত এই জননেত্রীকে তাই এদেশের শ্রমজীবী কৃষক–শ্রমিকের একান্ত আপনজন হিসেবেই আমরা ভালবাসি এবং শ্রদ্ধা করি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা–কর্মী যদি তাঁর আদর্শকে কিছুটা হলেও অনুসরণ করতেন তাহলে বাংলাদেশ সত্যিসত্যিই বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলায়’ পরিণত হওয়ার পথে অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতো।

আবার, আমরা এখনো ভুলিনি যে ২০০৭–৮ সালে সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের ‘মাইনাস টু’ কৌশলের প্রধান টার্গেট হয়ে শেখ হাসিনা যখন মহা বিপদে পড়েছিলেন তখন আওয়ামী লীগের যে দুজন নেতা–নেত্রী অটল হিমালয়ের মত তাঁর পক্ষে অবস্থান নিয়ে সমরপ্রভুদের সকল চাণক্য–নীতি ভন্ডুল করে দিয়েছিলেন তাঁরা দুজন ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান এবং বেগম মতিয়া চৌধুরী। ঐ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় চারজন নেতা সামরিক এস্টাবলিশমেন্টের টোপ গিলে সামরিক শাসকদের কথিত রাজনৈতিক সংস্কারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়, কিন্তু ঐ চারজনের খায়েশ পূর্ণ হওয়ার পথে অটল হিমাদ্রির মত পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলেন প্রয়াত জিল্লুর রহমান ও মতিয়া চৌধুরী। কেন্দ্র থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের সিংহভাগ নেতা–কর্মী যখন এই দুজনার সাথে একাত্ম হয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তখন ঐ চার নেতা নিজেদের অস্তিত্বের খাতিরে পিছুটান দিয়ে মূলধারায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে, ঐ সংকটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ঐক্য আরো মজবুত হওয়ায় বাধ্য হয়ে সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর, এভাবেই বানচাল হয়ে গিয়েছিল ‘মাইনাস টু ফরমুলা’। শেখ হাসিনার এসব কাহিনী ঠিকই জানা আছে। তাই, ঘোরতর বিপদের এই বন্ধুকে তিনি অনন্য মর্যাদায় হৃদয়ের মনিকোঠায় স্থান দেওয়াই স্বাভাবিক। পরবর্তী অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় শেখ হাসিনা মতিয়া চৌধুরীর পরামর্শকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন বলে জানা যায়, যেটা আওয়ামী লীগের উল্লিখিত মহলের কাছে অসহনীয় মনে হতেও পারে। এর সাথে যখন কৃষিমন্ত্রী হিসেবে মতিয়া চৌধুরীর ঈর্ষনীয় সাফল্য যোগ হয়ে গেছে তখন তাঁর পতন চাওয়া এসব নেতার জন্যে মোটেই অস্বাভাবিক নয়। অতএব, মতিয়া চৌধুরীর সাথে শেখ হাসিনার ভুল–বোঝাবুঝি সৃষ্টির মরিয়া প্রয়াস থাকতেই পারে এসব নেতার পক্ষ থেকে। কোটা আন্দোলনের সময় মতিয়া চৌধুরীর আবেগাপ্লুত বক্তব্য এখন হয়তো আরেকটি সুযোগ এনে দিয়েছে মতিয়া–বিরোধীদের কাছে!

কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে একাত্তর টেলিভিশনের একটি টক–শোতে আমাকেও এ–ব্যাপারে মতামত প্রদানের জন্যে অনুরোধ করা হয়েছিল। আমার অভিমত ছিল, কোটা ব্যবস্থার সময়োপযোগী সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। অতএব, ৫৬ শতাংশ কোটা যথাযথ বিচার–বিবেচনার পর অনেকখানি কমিয়ে আনা হোক্‌। কিন্তু, আমার প্রস্তাব ছিল পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার দায়িত্বটি একটি ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন বা কমিটির’ কাছে অর্পণ করাই সমীচীন। কারণ, এহেন সংস্কারের পূর্বে বিদ্যমান কোটাগুলোর সময়োপযোগিতা বিচার–বিবেচনা করার জন্য বিশেষজ্ঞদের গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। আমি উদাহরণ দিয়েছিলাম, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশে বহাল রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের পুত্র–কন্যাদের এক জেনারেশান পর্যন্ত যৌক্তিক হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি–নাতনীদের জন্যেও যদি ৩০ শতাংশ কোটা অব্যাহত রাখা হয় সেটাকে যৌক্তিক বলা যাবে না। তেমনিভাবে অন্যান্য কোটাগুলোরও সময়োপযোগিতা পরিবর্তনশীল হওয়াই স্বাভাবিক। পরবর্তীতে আন্দোলন তীব্র হওয়ার সুযোগ নিয়ে বিএনপি এবং জামায়াত–শিবির সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা কোটাকেই আক্রমণের মূল টার্গেট বানিয়ে ফেলেছিল তাদের রাজনীতির কারণে। তাদের এহেন হীন রাজনৈতিক এজেন্ডা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মহলকে আহত করাই স্বাভাবিক। আমি এখনো মনে করি, সরকারি চাকুরিতে কোটা একেবারে বাতিল করার সময় এখনো আসেনি। কোটা ব্যবস্থার সংকার করে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনাই এর যৌক্তিক সমাধান। এজন্যেই আমার দাবি, বেগম মতিয়া চৌধুরীর আবেগপূর্ণ বক্তব্যের জন্যে তাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত অহেতুক চরিত্রহননের অপপ্রয়াস অচিরেই বন্ধ হোক। এই জাতির জন্যে তিনি যা করে চলেছেন তার জন্যে আমরা তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকতেই হবে। ২৭ মে ২০১৮

লেখক: অর্থনীতিবিদ; ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
(সংগৃহীত)

এই বিভাগের আরো সংবাদ