আজকের শিরোনাম :

দিল্লির চিঠি

বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক

  জয়ন্ত ঘোষাল

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৯:২০ | অনলাইন সংস্করণ

খালেদা জিয়া তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। সে সময় একদিন খবর পেলাম, ঢাকায় পাকিস্তানের এক সেনা অফিসার তাঁদের এক গোপন ডেরায় বেশ কিছু উলফা জঙ্গি নেতার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নানা রাজ্যের নানা বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাও সেই বৈঠকে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ভারতবিরোধী এই সংগঠনগুলোকে এক ছাতার তলে নিয়ে আসা। আমি তখন কলকাতার বর্তমান খবরের কাগজের দিল্লি প্রতিনিধি। এই সংবাদ বর্তমান খবরের কাগজের প্রথম পাতায় লিড স্টোরি হলো। ব্যস, পরদিন সাউথ ব্লকের বিদেশ মন্ত্রক থেকে ফোন।

‘আপনি জয়ন্ত ঘোষাল?’

‘হ্যাঁ, স্যার।’

‘আপনি বাংলাদেশের বিষয়ে আজ যে খবরটি লিখেছেন, সেটি নিয়ে আপনার সঙ্গে একটু আলোচনা করতে চাই। যদি দয়া করে আপনি একবার সাউথ ব্লকে আসতে পারেন?’

আমি বললাম, আমার আসতে বা কথা বলতে কোনো অসুবিধা নেই।

সাউথ ব্লকের বাংলাদেশ ডেস্কের ওই অফিসার তখন খুবই উত্তেজিত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই খবরের সূত্রটি কী? আপনি কি ভারতের হোম মিনিস্ট্রি থেকে খবরটা পেয়েছেন? নাকি গোয়েন্দারা দিয়েছে?’

আমি বললাম, ‘দেখুন, আমরা সাংবাদিক। খবরের উৎস জানাতে কোনোভাবেই বাধ্য নই। তাহলে আমি কেন এ কথা আপনাকে বলব?’

সেই প্রধান কূটনীতিক সেদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘আসলে জানেন তো, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বড় সংবেদনশীল। একটা শালিক পাখিও যদি ১৫৬০ মাইল সীমান্তের কোনো এক প্রান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে, তাহলেও বড় বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। তার ওপর আবার পাকিস্তান। আরো সমস্যা, বুঝলেন মহাশয়!’

এটা সম্ভবত ২০০১ সালের ঘটনা। আজ এত বছর পর এখন ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরে জইশ-ই-মোহাম্মদ যে ভয়ংকর সন্ত্রাসকাণ্ড করল, তা উরি অথবা অতীতের পাঠানকোটের সন্ত্রাসের চেয়ে আরো অনেক বেশি ভয়াবহ। কাশ্মীরের পুলবামাতে পাকিস্তানের মদদপুষ্ট জইশ-ই-মোহাম্মদ সুইসাইডাল স্কোয়াড আর আরডিএক্স পাঠিয়ে এক ভয়ংকর সন্ত্রাসের কাণ্ড করেছে। এ অবস্থায় ভারত কী করবে? নরেন্দ্র মোদি মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাবিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির বৈঠক ডেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে কিছুদিনের মধ্যেই ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানে আক্রমণাত্মক ব্যবস্থা নেবে। সে আক্রমণাত্মক ব্যবস্থা যে কী হবে, সে তো সামরিক গোপনীয়তা; কিন্তু এটা খুব স্পষ্ট যে ভারত এখন চেষ্টা করছে, যাতে কূটনৈতিক দিক থেকে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, এমনকি চীনের সামনেও পাকিস্তানের কাজকর্ম সম্পর্কে সবিস্তার তথ্য পেশ করা; আর অন্যদিকে ভারত তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকেও বোঝাতে চাইছে, পাকিস্তান ঠিক কী করছে। এত বড় একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আজকের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ হঠাৎই ভারতের কাছে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। আয়তনে বাংলাদেশ ছোট হতে পারে; কিন্তু তার জিও-স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান আজ ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে ঘটনা থেকে আজকের লেখা শুরু করেছিলাম। ভারত আজও মনে করে, খালেদা জিয়ার জমানায় পাকিস্তান বাংলাদেশের জমি ব্যবহার করে ভারতবিরোধী সন্ত্রাসের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করতে সক্রিয় ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার জমানায় এ কথা মানতেই হবে, তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্বার্থহীনভাবে সোচ্চার হয়েছেন। ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। সার্ক অথবা জাতিসংঘে গিয়ে শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, সন্ত্রাসের জন্য বাংলাদেশও ভিকটিম। এ অবস্থায় সব দেশ মিলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমবেতভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। হাসিনা সরকার বারবার বলেছে, বাংলাদেশের জমিকে ভারতবিরোধী সরকারের জমি হতে দেব না। সত্যি কথা বলতে কি, উলফা জঙ্গিদের ভারতে প্রত্যাবর্তনই হোক না কেন, পাক সন্ত্রাস রুখতে হাসিনা সরকার যে সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে, তার জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকারও কৃতজ্ঞ।

চীন অবশ্য পাকিস্তানের পাশে আছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সামনে যখন মাসুদ আজাহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব পেশ হলো, তখন চীন কিন্তু সে প্রস্তাবে ‘ভেটো’ দিয়ে তাদের পাকপ্রীতি আবারও দুনিয়ার সামনে তুলে ধরল। মিয়ানমার, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী চীন। আর্থিক সাহায্য এবং পরিকাঠামো নির্মাণ—এসবই চীনের স্ট্র্যাটেজি। শেখ হাসিনা চীন সফরে যান। চীন সরকার তাঁকে শুধু আমন্ত্রণ জানানো নয়, বিশেষ গুরুত্বও দিয়েছে। তবু হাসিনা সরকার চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষা করেও ভারতবিরোধী কার্যকলাপে অংশীদার হয়নি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভারত-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিশ্চয়ই উন্নত করতে চাইবে; কিন্তু তাই বলে খামাকা ঢাকা ভারতবিরোধী অবস্থান নেবে কেন?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জয়ের চার বছর যেতে না যেতেই জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল। এ হত্যা একজন মানুষকে হত্যা করা নয়, হত্যা করা হলো বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির স্বপ্নকে। বৈষম্যহীন এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন রচনা করতে চায় পাকিস্তানের আমজনতা।

বাংলাদেশের জন্ম মানুষের একটা মৌলিক আকাঙ্ক্ষা ছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভুল এবং স্বার্থপর নীতির জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ অতি দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পায় এবং তা অতি দ্রুত এক রাজনৈতিক সংঘাতে পরিণত হয়। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব যদি কার্যকর করা হতো, তাহলে হয়তো এক হাজার মাইলের দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও একক দেশ হিসেবে পাকিস্তান টিকে থাকতে পারত। শেষ পর্যন্ত কী হলো, তা ১৯৭১ সালে আমরা দেখেছি। এ অবস্থায় বলতেই হবে, পাকিস্তান এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে প্রথম থেকেই। তিন তিনবার যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানকে পরাস্ত করেছে। কারগিল যুদ্ধেও ভারত পাকিস্তানকে বিপাকে ফেলেছে।

তবে বাংলাদেশের সমর্থন আজ ভারতের প্রয়োজন বিশেষভাবে। ভারত এখনো জানে না, পাকিস্তানবিরোধী আক্রমণ সীমিত যুদ্ধেই থাকবে নাকি এটি বড় যুদ্ধ হয়ে যাবে। দেখুন, ভোটের দুই মাস আগে নরেন্দ্র মোদি জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন যে ভারতের সেনাবাহিনীকে তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সবুজ সংকেত দিয়েছেন। সেনাবাহিনীকে অনুমতি দিয়েছে মন্ত্রিসভার নিরাপত্তাবিষয়ক কমিটি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমনই যে নয়াদিল্লির জন্য তা তাৎপর্যপূর্ণ।

তবে বাংলাদেশ সম্পর্কে এটাও ভাবার কারণ নেই যে ভারত যা করবে, যা বলবে—সবটাই বাংলাদেশ চোখ বুজে মেনে নেবে। এটা ঠিক যে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কখনোই সহজ নয়। ১৯৭৪ সালে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ঢাকা সফরে যান; কিন্তু সে সফর সফল হয়নি। শেখ মুজিবুর রহমান কতটা উদারতা দেখান, তিনি ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি ভুট্টোকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানান। ২৭-২৯ জুন ভুট্টো ঢাকায় আসেন ১০০ জন প্রতিনিধি নিয়ে। কিন্তু ভুট্টো অসংবেদনশীল হয়ে পড়েন, যখন তাঁকে শহীদ স্মারক সফরে যেতে বলা হয়।

সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে গেলে কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যেতে পারত। যা হোক, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কও কিন্তু একরৈখিক নয়। ভারতীয় কিছু কূটনীতিকের সমস্যা আছে। তাঁরা বাংলাদেশের সম্পর্কে একটা টেকেন ফর গ্র্যান্টেড মানসিকতা নেন। দেখুন, ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের রৌদ্র-ছায়া আছে। ঢাকার একাডেমিক প্রেস অ্যান্ড পাবলিশার্স লাইব্রেরি প্রকাশিত Bangladesh Foreign Policy ‘Realities, Priorities, and Challenges’ বইটি লিখেছেন হারুন-উর-রশিদ। হারুন রশিদ অতিরিক্ত বিদেশসচিবও হন ঢাকার। বইটি পড়তে গিয়ে বুঝলাম, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জটিলতা বহু ক্ষেত্রে। তা পানিই হোক বা বাণিজ্য। একটা কথা মনে রাখতেই হবে, বাংলাদেশ একমাত্র মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যা অমুসলিম রাষ্ট্রের মাধ্যমে ঘেরা। বাংলাদেশে আসলে শুধুই ইসলাম নয়, বাংলা ভাষার সংস্কৃতিও বিশেষভাবে যুক্ত। এটি ভারতীয় সংস্কৃতির বহুত্ববাদের জন্য খুবই ইতিবাচক।

বইটিতে হারুন রশিদ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মধুর; কিন্তু এই দুই দেশের মধ্যে নানা বিষয়ে সংঘাতও অনস্বীকার্য। আবার পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যতই স্বাভাবিকভাবে বৈরিতামূলক হোক না কেন, আজকের আধুনিক কূটনীতিতে পাক-বাংলাদেশ বাণিজ্য ও অন্যান্য আর্থিক সম্পর্কের ভবিষ্যেক শক্তিশালী করার পক্ষেও জনমত আছে। মজার ব্যাপার দেখুন, বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তান আয়তনে পাঁচ গুণ বড়, তবু এখন পাকিস্তান বাংলাদেশকে ম্যানেজ করতে ব্যস্ত। যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য পাকিস্তানের কাছে ১০০০, ১৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চাওয়া হয়েছে। পাকিস্তান কিন্তু এ ব্যাপারে আজও নীরব।

তাহলে? তাহলে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক পুনরুদ্ধার কি সম্ভব?

আমার মনে হয়, এটা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের নয়া অধ্যায়—এটা একটু বেশি অতিকথন। সত্য থেকে অনেকটাই দূরে। কিন্তু আবার অন্যদিকে আমার মনে হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের যে ঐক্যগুলো আজও বিদ্যমান, যার মধ্যে তিস্তার পানিও আছে, এগুলোর সমাধান বিশেষ জরুরি। তা না হলে ভারত যখন পাকিস্তানবিরোধী আক্রমণাত্মক ভূমিকায় যেতে চাইছে, তখন বাংলাদেশের সক্রিয় সমর্থন আজ প্রয়োজন। তার জন্য স্বপ্ন বিক্রি নয়। হাসিনা সরকারের সঙ্গে প্রয়োজন কিছু প্রকাশ্য দায়বদ্ধতা।

লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক

এই বিভাগের আরো সংবাদ