অধিকাংশ ব্যাংকের অবস্থা ভালো নয় : ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করুন
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক মন্দ ঋণ ‘রাইট-অফ’ করার নীতি অনেকখানি শিথিল করেছে। এই পরিবর্তনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের আগামীবারের ক্লাসিফাইড লোনের পরিমাণ ঘোষণার আগে মন্দঋণের ঐ পরিমাণ কম দেখানোর ব্যবস্থা করা। নতুন অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন, তিনি আর খেলাপিঋণ এক টাকাও বাড়তে দেবেন না। অতএব, একজন চার্টার্ড একাউন্টেন্টের দক্ষ চাল প্রয়োগ করে তিনি মন্দঋণ রাইট-অফ করার পদ্ধতি সহজ করে দিয়েছেন, যাতে ক্লাসিফাইড লোনের আগামী স্টেটমেন্টের আগেই এই শিথিল পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিভিন্ন ব্যাংক ‘মন্দঋণ রাইট-অফ করা’ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। রাইট-অফ করা মন্দঋণ বাড়ার মানেই হলো এর ফলে মোট ক্লাসিফাইড লোন ঐ পরিমাণ কম দেখানো যাবে। কিন্তু, এ-ধরনের পরিবর্তন সমস্যাটিকে আড়াল করার পন্থা হলেও মন্দঋণ আদায় করার কোন নিষ্ঠাবান প্রয়াস এর মাধ্যমে জোরদার করার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করেছিল, ২০০২ সালে মন্দ ঋণ রাইট-অফ সিস্টেম চালু হওয়ার পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো কর্তৃক মোট ৪৯,৭৪৫ কোটি টাকা ‘রাইট-অফ’ করা হয়েছে এবং ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঐ ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণের ১১,৮৭৯ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। যারা রাইট-অফ করার ব্যাপারটি ভাল করে বুঝেন না তাঁরা এই দুটো অংকের শতাংশ বের করে খুশি হয়ে যেতে পারেন যে ব্যাংকগুলো ২৩.৮৮ শতাংশ মন্দঋণ আদায় করতে সমর্থ হয়েছে। বেশ কয়েকটি পত্রিকার সাংবাদিক এই খবরে বিভ্রান্ত হয়ে তাঁদের নিউজ-আইটেমে সিদ্ধান্ত টেনে ফেলেছেন যে বর্তমানে এর ফলে অনাদায়ী রাইট-অফ করা মন্দঋণের ব্যালেন্স দাঁড়িয়েছে ৩৭,৮৬৬ কোটি টাকা। ভুল, সবটাই ভুল! গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক সমকাল, দৈনিক বণিক বার্তা এবং দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত আমার এতদ্সংক্রান্ত কলামে আমি এই বিভ্রান্তিকর সংবাদটি প্রকাশের পেছনের উদ্দেশ্যটি পাঠকদের কাছে ব্যাখ্যা করেছি। সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, প্রকৃত খেলাপিঋণের পরিমাণ লুকানোর এসব অপপ্রয়াস বন্ধ করুন। কারণ, সময়ের দাবি হলো খেলাপিঋণ আদায়ে সরকারের সত্যিকার সদিচ্ছার, ঋণখেলাপিদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’। এজন্যে পথ দেখানোর প্রয়োজনে অবিলম্বে একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করার আহ্বান জানাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে।
সংসদ নির্বাচন সমাপ্ত হওয়ার পর নূতন সরকার ক্ষমতাগ্রহণ করেছে। বিগত সরকারের সময় ব্যাংকিং খাতের অবস্থা সংকটজনক থাকলেও কোন রহস্যজনক কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠনের ইস্যুটাকে বারবার এড়িয়ে গেছেন। ব্যাংকারদের সাথে আলোচনায় বারবার যে আশংকাটি ব্যক্ত হচ্ছে তাহলো, বেশিরভাগ ব্যাংকের অবস্থা ভাল নয়। আওয়ামী লীগের পাঁড় সমর্থক ও শেখ হাসিনার অন্ধভক্ত নেতা-কর্মী ব্যতিরেকে দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ একবাক্যে স্বীকার করবেন যে দেশে এখন প্রয়োজনাতিরিক্ত সংখ্যক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, এবং যে সব বিবেচনায় ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দফায় দফায় ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে তাতে অর্থনীতির স্বার্থ কিংবা জনগণের আর্থিক লেনদেনের যুক্তিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকের সেবা পৌঁছে দেয়ার জন্যে নূতন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার চাইতে বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর শাখা বিস্তারকে উৎসাহিত করা হলে অনেক কম ব্যয়ে ঐ সুবিধা অর্জন করা যেতো, আসলে প্রয়োজনাতিরিক্ত জেনেও নূতন নূতন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বজনপ্রীতির তাগিদে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তিকে বারবার অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এমনকি, সদ্য-প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রকাশ্য আপত্তিকেও পাত্তা দেয়া হয়নি।
ব্যাংকের মালিকানার লাইসেন্স অনেক ভাগ্যবানের জন্যে কোটিপতি হওয়ার সহজ পথ করে দিয়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে তিন বছর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর মহাপরিচালক থাকার সময় থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং বিষয়ে আমার গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। সেজন্যেই প্রাইভেট ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের হাঁড়ির খবর আমার জানা আছে। পাঠকদের অনেকেই হয়তো খেয়াল করেন না যে এদেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপিঋণ সংকট যত গুরুতরই হোক্, দেশের প্রায় প্রতিটি প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংক প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ মুনাফা করে যাচ্ছে। অতএব, ব্যাংকের লাইসেন্স যাঁরা বাগাতে পেরেছেন তাঁরা এদেশে অতি সহজেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান ঐ মুনাফার ভাগ পাওয়ার কারণে। সেজন্যেই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ক্লাসিক নজির হলো ব্যাংকের মালিকানা বন্টনের এই রাজনৈতিক দুর্নীতি। আর, এই ব্যাংক-উদ্যোক্তাদের অনেকেই তাঁদের রাজনৈতিক কানেকশনের জোরে বা প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়তার পরিচয়ে কিংবা তাঁর প্রিয়পাত্র হওয়ায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স পেয়ে বিনা মূলধনে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের অর্থে তাঁদের ব্যাংকের উদ্যোক্তা-পরিচালক বনে গেছেন। মানে, তাঁর শেয়ারের জন্যে বিনিয়োজিত পুঁজিও হয়তো ব্যাংকের অন্যান্য পরিচালকরা পরিশোধ করে দিয়েছেন। এই পরিচালকদের সিংহভাগ আবার দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, যাঁরা ব্যাংকের মালিকানা পেয়ে এদেশের ব্যাংক-ঋণের ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করে ফেলেছেন। ব্যাংক কোম্পানী আইনে নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে তাঁদের ওপর নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলেও একে অপরের ব্যাংক থেকে দেদারসে ঋণ গ্রহণের সংস্কৃতি (লোন সোয়াপ) এদেশে ভয়াবহ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গেছে। দেশের কয়েকজন রাঘব বোয়াল ব্যবসায়ী বিভিন্ন পন্থায় এসব রাজনৈতিক কানেকশনওয়ালা ব্যাংক-লাইসেন্সধারীর কাছ থেকে নানা নামে একাধিক ব্যাংকের বিপুল শেয়ার কিনে নেয়ার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নিজেদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে নিয়ে যাচ্ছেন । চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী নাকি এখন সাতটি ব্যাংকের উপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন! ব্যাংকগুলোর ঋণ নিয়ে ঐ ব্যবসায়ী নয়ছয় করছেন বলে ব্যাংকারদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, বেনামী ঋণে নাকি সয়লাব হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। একজন ব্যক্তিকে এতগুলো ব্যাংকের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দিয়ে পুরো ব্যাংকিং খাতকে বড়সড় ঝুঁকিতে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের অভিমত। দেশের ‘কমপিটিশান এক্ট’ তো এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কথা! ব্যাংকের মালিকানায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এত সহজ সুযোগ অন্য কোন দেশে চালু আছে কিনা আমার জানা নেই। এ-ব্যক্তির খামখেয়ালিপনায় আর্থিক খাতে ভব্ষ্িযতে ধস নামলে কিংবা ব্যাংকিং খাত কোন মহলের ব্ল্যাকমেইলের শিকার হলে অবাক হবো না আমি।
প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যাংকের এসব মালিকদের অভিহিত করা উচিত ‘কথিত মালিক’, কারণ ব্যাংকের আসল মালিক আমানতকারীরা। ব্যাংকের উদ্যোক্তারা কিংবা পরিচালকরা এমনকি শেয়ার হোল্ডাররা ব্যাংকের ‘প্রকৃত মালিক’ নন, কারণ একেকটি ব্যাংক যে হাজার হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে ঋণপ্রদানের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তার তুলনায় সম্মিলিতভাবে উপর্যুক্ত তিন ধরনের মালিকদের বিনিয়োজিত পুঁজি (
paid-up capital) দশ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একটি আধুনিক অর্থনীতির সুস্বাস্থ্যের জন্যে সুস্থ ও সবল (
robust) ব্যাংকিং সিস্টেম যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেটা ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার পর এখন বিশ্ববাসীর জানা হয়ে গেছে। বিশেষত, আমাদের দেশে পুঁজিবাজার যেহেতু একেবারেই অনুন্নত এবং গুরুত্বহীন রয়ে গেছে তাই ব্যাংকিংকে এদেশে এখনো স্বল্পমেয়াদী ঋণের পাশাপাশি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণের প্রধান যোগানদাতার ভূমিকাও পালন করে যেতে হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির যে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে সেটাকে বেগবান করতে হলে জাতীয় সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়াকে আরো জোরদার করতেই হবে। আর, এজন্যে প্রয়োজন সবল ও স্বচ্ছ ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আরো বেশি শৃঙ্খলাধীন ও সুনিয়ন্ত্রিত করার প্রক্রিয়াকে জোরদার করা। নূতন নূতন ব্যাংক চালু হওয়ায় এখন আমানত নিয়ে যে অসুস্থ কাড়াকাড়ি পরিদৃষ্ট হচ্ছে তার ফলে ব্যাংকাররা মরিয়া হয়ে নানা ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নিচ্ছেন, যা ব্যাংকিং খাতের পরিবেশ দূষিত করে চলেছে। আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতার ফলে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ব্যাংক আমানতের উপর নয় শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়ে যাচ্ছে বলে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখের পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোর জন্যে পুরো ব্যাংকিং খাতে আবার প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ঋণের উপর ‘সিঙ্গল ডিজিট’ সুদের হার কি তাহলে শুধুই ‘নির্বাচনী স্টান্ট’ ছিল? এভাবে ঋণের সুদ বাড়তে থাকলে বিনিয়োগে ভাটার টান লাগতে দেরি হবে না। অনেকগুলো প্রাইভেট কমার্শিয়াল ব্যাংক সম্প্রতি কঠিন তারল্য সংকটে নিপতিত হয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এহেন তারল্য সংকট যদি পুরো ব্যাংকিং খাতে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে আর্থিক খাত চরম সংকটের সম্মুখীন হতে পারে।
দীর্ঘদিন যাবত ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সমস্যা নিঃসন্দেহে খেলাপিঋণ। খেলাপিঋণ আদায়ের জন্যে বিদ্যমান বিচার প্রক্রিয়া বাংলাদেশে এতই অকার্যকর ও দীর্ঘসূত্রতার শিকার রয়ে গেছে যে ২০০২ সালে রাইট-অফ সিস্টেম চালু হওয়ার পর অনেক ‘রাইট-অফ’ করা মন্দঋণ গত ১৬ বছরেও আদায় করা যায়নি। এটা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে এদেশের রাজনীতি ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি কালচারকে’ লালন করে চলেছে। অতএব, সংশোধনও শুরু করতে হবে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেই। আর, এজন্যে জরুরি প্রয়োজন হলো তিন বছরের জন্যে একটি খেলাপিঋণ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যেক ব্যাংকের শীর্ষ দশজন ঋণখেলাপিকে চূড়ান্ত বিচারে দ্রুত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ব্যবস্থা হয় রদ করতে হবে নয়তো আপিলের ক্ষেত্রে রায়ে উল্লিখিত ঋণের অর্থের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ব্যাংককে ফেরত দিলে আপিলের সুযোগ দেওয়া যাবে মর্মে শর্ত আরোপ করতে হবে। অর্থঋণ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল দায়ের করে বিচার প্রক্রিয়াকে বছরের পর বছর ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাচ্ছে বলেই খেলাপি ঋণ সমস্যার কোন সুরাহা হচ্ছে না, এটা আমি চ্যালেঞ্জ দিয়েই বলতে চাই। আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয় নিজেই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাই, অসাধু ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তিনি কতখানি কঠোর হতে পারেন সেটা তাঁর নিজের জন্যেও ‘এসিড টেস্ট’। সমস্যাটিকে লুকানোর চেষ্টা না করে তিনি যদি সত্যিসত্যিই খেলাপিঋণ আদায়ে সফল উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যান তাহলে তিনি জনগণের দিয়ে স্থায়ী আসন করে নেবেন।
আরো বোঝা যাচ্ছে, প্রয়োজনাতিরিক্ত সংখ্যক ব্যাংক চালু করে যেসব নেতিবাচক অভিঘাত ডেকে আনা হয়েছে সেগুলো নিরসনের একটা পথ খুলে দিতে পারে অদূর ভবিষ্যতে বেশ কিছু দুর্বল ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী কয়েকটি ব্যাংকের সাথে একীভূত করার আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ-ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপটি হতে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের কয়েকটি ব্যাংককে ‘মার্জারের’ মাধ্যমে বড় ব্যাংকগুলোর সাথে একীভূত করার ব্যবস্থা করা। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক এবং অগ্রণী ব্যাংকের সাথে অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে একীভূত করলে তেমন কোন নেতিবাচক অভিঘাতের সৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। এমনকি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকেরও আলাদা অস্তিত্বের প্রয়োজন এখন আছে কিনা ভেবে দেখা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে একীভূত করে একটি ব্যাংকে পরিণত করলেও তেমন ক্ষতির আশংকা নেই। অন্যদিকে, দেশে এতগুলো ‘ইসলামী ব্যাংকের’ আবশ্যকতা নেই। ফারমার্স ব্যাংককে পদ্মা ব্যাংক করলে কি আমানতকারীদের আস্থা ফিরে আসবে?
আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, বড় বড় উদ্যোক্তাদেরকে উৎসাহী করতে হবে পুঁজির জন্যে শেয়ারবাজারে যেতে। পুঁজিবাজারের দুর্বলতার জন্যে এদ্দিন যাবত দীর্ঘমেয়াদী বড়সড় ঋণের জন্যে যেভাবে ব্যাংকিং খাতকে বিকল্প পুঁজির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তা থেকে আমাদেরকে সরে আসতেই হবে। নইলে খেলাপিঋণের সমস্যা থেকে দেশ পরিত্রাণ পাবে না। ব্যাংকিং খাত থেকে খুব বড় ঋণ এবং দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দেয়া ক্রমশ বন্ধ করে দিতে হবে। এমনকি, ব্যাংক ঋণের পরিমাণের উপর ‘সর্বোচ্চ সিলিং’ আরোপের চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে মনে করি। আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা পুঁজির জন্যে এখনো পুঁজিবাজারে যেতে বড়ই অনাগ্রহী রয়ে গেছে। একই কারণে, এদেশের ৯৫ শতাংশ শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান পারিবারিক গণ্ডিতে গড়ে ওঠা ‘প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি’ থাকতেই বেশি পছন্দ করে, ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ হলে যে নিয়ম-নীতির আওতায় আসতে হবে সেগুলো এড়াতে চায় বেশিরভাগ শিল্পপতি-ব্যবসায়ী। কিন্তু, ব্যাংকিং খাতকে যদ্দিন আমরা দীর্ঘমেয়াদী ঋণ দিতে বাধ্য করব, তদ্দিন ব্যাংকগুলো খেলাপিঋণ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে না।
অতএব, এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে আমাদেরকে। উপরে যেসব সংস্কারের কথা উল্লিখিত হলো, সেগুলোর জন্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেহেতু কঠিন তাই এর জন্যে প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সুপারিশ করার জন্যে অবিলম্বে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করা হোক। দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া)
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর
অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়