আজকের শিরোনাম :

দিল্লির চিঠি

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর ও রোহিঙ্গা ইস্যু

  জয়ন্ত ঘোষাল

১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:৩৮ | অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সাম্প্রতিক ভারত সফরের পর সাউথ ব্লকে দেখা এক ভারতীয় কর্মকর্তার সঙ্গে। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের কূটনীতিক। সাংবাদিকতার ন্যূনতম নৈতিকতা। নামটা বলতে পারছি না। বাংলাদেশের পাঠকরা সবাই জানেন কি না, জানি না। এখানে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র একমাত্র কথা বলতে পারেন সংবাদমাধ্যমে। বাকি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত অভিমত জানানোর কোনো অধিকার নেই। একমাত্র মুখপাত্র কথা বলেন। তা তিনি কখনোই নিজের কথা বলেন না, তিনি ভারত সরকারের যা অফিশিয়াল বা সরকারি লাইন, সেটাই ব্যক্ত করেন। যা হোক, যে কথা বলছিলাম, সাউথ ব্লকের সেই ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস অফিসার দিল্লির তীব্র শীতে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘জানেন জয়ন্তবাবু, একটা সত্যি কথা বলব, রোহিঙ্গার বিষয়ে আমাদের ভারতের বিদেশনীতিতে কিছু ভুল হয়ে গেছে। সে সময়ে সমন্বয়ের অভাব হয়েছিল বিদেশ মন্ত্রক আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মধ্যে। সুষমা স্বরাজ বিদেশমন্ত্রী; কিন্তু তখন তিনি অসুস্থ। কিডনি প্রতিস্থাপনের অপারেশন নিয়ে খুব ব্যস্ত। নরেন্দ্র মোদি প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে ছিলেন। তিনি যখন মিয়ানমারে যান তখন তিনি মিয়ানমার এবং সেখানকার আরেক তথাকথিত বিপ্লবী নেত্রী সু চিকে খুশি রাখতে চেয়েছিলেন। কারণ মিয়ানমারও তো ভারতের আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্র। মিয়ানমারে আবার সম্প্রতি চীন সম্পর্ক স্থাপনে বিশেষ সক্রিয় হয়েছে। চীন মিয়ানমারকে বারবার বলছে যে সে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে চীন পরিকাঠামো গঠনে বিপুল অর্থ ব্যয় করবে। আচ্ছা বলুন, আপনি যদি সাউথ ব্লকে বসে ভারত নামক এক দেশের এক বিশিষ্ট নীতিনির্ধারক হতেন, তাহলে মনে হতো, না না মিয়ানমারকে কোনোভাবে চটানোই অনুচিত হবে। যদি চীন মিয়ানমারকে বিপুল অর্থ সাহায্য করে, যা এরই মধ্যে তারা শুরু করেছে, তার ওপর মিয়ানমারে সেনাবাহিনীতেও চীনের প্রভাব আছে জেনে ভারতের ভ্রুকুটি কি অস্বাভাবিক?’

মনমোহন সিং তখন প্রধানমন্ত্রী। শিবশঙ্কর মেনন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। তিনি নিজে এখন অবসরপ্রাপ্ত। অনেকেই বলেন, মেনন চীন নামক রাষ্ট্রের বিশেষ ঘনিষ্ঠ। তিনি ভারত-চীন সুসম্পর্কের পক্ষে। কিন্তু মনে আছে, মনমোহন সিংয়ের সময়ও এই গেল গেল রব উঠেছিল যে চীন মিয়ানমার সীমান্তে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে পরিকাঠামো নির্মাণ করছে। তাহলে? তাহলে চীন উন্নয়নের নামে মিয়ানমারের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে। কী হবে তাহলে? ভারতের নিরাপত্তার অভাববোধ তীব্র হয়ে উঠল। এই সময় শিবশঙ্কর মেননের অভিমত ছিল, চীনের উন্নয়নমূলক সহায়তার জন্য ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে যদি ভারতও একইভাবে মিয়ানমারকে জানায় যে দিল্লিও এই পরিকাঠামোগত কাজের জন্য অর্থ সাহায্য দিতে প্রস্তুত, তাহলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। রাস্তা তৈরি করার কাজ তো কোনো খারাপ কাজ নয়। মিয়ানমার তো বলেনি ভারত সাহায্য করলেও তা তারা নেবে না, চীন থেকেই নেবে?

আসলে এখানে একটা মস্ত বড় সমস্যা ছিল। সে কথাও মেনন বুঝতে পারছিলেন। সীমান্তে হলেও সড়ক ও সেতু নির্মাণের আর্থিক বরাদ্দ কে করবে? ভারতের পূর্ত মন্ত্রক, যাকে বলা হয় সিপিডাব্লিউডি দপ্তর। মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী তখনো ক্যাবিনেটে এই বিতর্ক হয়েছিল যে ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পাকা রাস্তা নেই, সেতু নেই, সেসব রাজ্যে আগে রাস্তা বানানো বেশি প্রয়োজন। ভারতের রাজকোষে এত টাকা কোথায়? অতএব নিজেদের গ্রামে রাস্তা না বানিয়ে আমরা মিয়ানমারে কেন রাস্তা বানাতে যাব?

সেই ট্র্যাডিশন কিন্তু এখনো চলছে। এখন মোদি সরকার। মিয়ানমারে রাস্তা নির্মাণ নিয়ে ভারত সরকারের প্রশাসনের ভেতর সেই বিতর্ক কিন্তু এখনো অব্যাহত। প্রধানমন্ত্রী যখন মিয়ানমারে যান তখনো তিনি রোহিঙ্গা নিয়ে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেননি। সেভাবে মিয়ানমারকে চেপে ধরেননি। শেখ হাসিনা এ ঘটনায় খুশি হতে পারেন না। উল্টো বাংলাদেশে কর্মরত এক কূটনীতিক বলেন, মোদি দুই ক্ষমতাসীন নারী সু চি ও হাসিনার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছেন। আসলে তিনি যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠানোর পক্ষে, তা নয়। কিন্তু মোদি সে সময়ে কোনোভাবেই মিয়ানমারকেও চাপে ফেলতে চাননি।

হাসিনা সরকার এ ঘটনায় খুশি হয়নি। তবে ঢাকার কৌশল ছিল ভোটের সময় এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মোদিবিরোধিতা না করে ভেতরে ভেতরে চাপ সৃষ্টি করা। এই পরিণতমনস্ক পররাষ্ট্রনীতি কিন্তু বাংলাদেশকে ডিভিডেন্ড দিয়েছে বেশি। বিশেষত এবার ভোটে বিপুলভাবে জেতার পর রোহিঙ্গার বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় শেখ হাসিনা। নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর প্রথম সফরে ভারতকে যথেষ্ট বড় ভাইয়ের কূটনৈতিক মর্যাদা দিলেও ভেতরে ভেতরে চাপ সৃষ্টি করেছেন নরেন্দ্র মোদির ওপর।

সত্য তো নাগরিকত্ব বিল অসমের মতো রাজ্যে এনে তথাকথিত সংখ্যালঘুদেরও রাজ্যছাড়া করছেন (যাদের অহমিয়া বলে মানা হবে না)। নাগরিকত্ব বিল এনে অসমে বাঙালি বিতাড়ন শুরু, অনুপ্রবেশ নিয়েও বিজেপি সরব, তাহলে রোহিঙ্গা নিয়ে ভিন্ন অভিমতই বা কেন? তারা বাংলাদেশের নয়, মিয়ানমার থেকে আগত মুসলমান সমাজ বলে?

এবার ঢাকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর সম্পর্কে ধারণা ছিল এটা নেহাতই রুটিন। কিন্তু এমন লো-প্রফাইল বিদেশ সফরের পরতে পরতেও যে বাংলাদেশের আক্রমণাত্মক বিদেশনীতি লুক্কায়িত ছিল, তা বোঝা যায়নি প্রথমে।

তবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কর্তারা একান্তে স্বীকার করছেন যে ভারতের সর্বোচ্চ কর্তারা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছেন রোহিঙ্গার বিষয় নিয়ে এখন আর নিষ্ক্রিয় থাকা যাবে না। তাই ভারত এবার শুধু মিয়ানমার নয়, যুক্তরাষ্ট্রকেও জানিয়েছে যাতে তারা মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

দেখুন, আমি ভারতীয় সাংবাদিক; কিন্তু ভারতীয় সরকারের প্রতিনিধি। আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ভারত সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রথম অধ্যায়ে ভুল করেছে। এখন নরেন্দ্র মোদি নিজেই ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের আগে বুঝতে পেরেছেন, মিয়ানমার যা-ই ভাবুক, এ বিষয়ে বাংলাদেশের পাশে থাকা অনেক বেশি জরুরি।

ইংরেজি প্রবচন—বেটার লেট দ্যান নেভার।

মিয়ানমারকে নরেন্দ্র মোদি চটাতে চাননি কেন? সোজা উত্তর—চীনের জন্য। বিশেষত পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর্থিক করিডর নির্মাণ, সেটা ভারতের জন্য বড় আতঙ্ক। কিন্তু আমি বলব, বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের কূটনৈতিক সাফল্য—তারা ভারতকে এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকেও বোঝাতে পেরেছে কেন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন প্রয়োজন।

ভারতে সাধারণ নির্বাচন এসে গেছে। ভারতেও রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। আবার অসম থেকে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে রোহিঙ্গারা ঢুকছে! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, প্রয়োজনে তাদের থাকার ব্যবস্থা করবেন রাজ্যে। বিজেপি বলছে, সংখ্যালঘু ভোটের জন্য মমতা এ কাজ করছেন। এটা ঠিক নয়। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে!

এ অবস্থায় হাসিনা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করতেও যান আবার তিনি জাতিসংঘের ওপরও চাপ সৃষ্টি করেছেন।

ভালো কথা। মোদি সরকার দেরিতে হলেও বুঝেছে, এ ব্যাপারে আজ বাংলাদেশের পাশে থাকা বেশি জরুরি! জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমরা দুই দেশের ভেতরে সব সমস্যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করে সমাধান করব!’

আমার আশা, আজ এত বছর পর আওয়ামী লীগ আর বিএনপি, কংগ্রেস আর বিজেপি—যে দলই হোক, আমরা আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হব!

লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক

এই বিভাগের আরো সংবাদ