আজকের শিরোনাম :

জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র : অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ মে ২০১৮, ১২:৫৪

ঢাকা, ২৯ মে, এবিনিউজ : যে কোনো সংগঠন প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাষ্ট্রের উন্নয়নের মূল ভিত্তি হলো স্থিতিশীলতা। সেই স্থিতিশীলতা আসে জনগণের মৌলিক শিক্ষা, দেশপ্রেম, জরুরি চিকিৎসাসেবা ও ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যমে।

বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় একজন বহুমাত্রিক দার্শনিকের ত্যাগ-তিতিক্ষা, চিন্তাচেতনা, ঈস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ইচ্ছা ও দৃঢ়প্রত্যয়, যা শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মাঝেই ছিল এবং যার ফলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের শুধু জনক তিনি হননি, ইতিহাসের বিচারে আন্তর্জাতিক পরিসংখানের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং বাংলাদেশের জাতির জনক।

অস্থিতিশীলতা, একটা জাতিকে কতটুকু পিছিয়ে দিতে পারে তা হলো ’৭৫-এর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং আর ৪৫ বছরের জন্য পিছিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে আসা। যে বাংলাদেশ চারটি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যে দর্শন শুধু জাতির জনকের উদ্ভাবন। সেই দর্শনের গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গেল ১৫ আগস্টের ভোররাত্রিতে। গণতন্ত্র হয়ে গেল সামরিক গণতন্ত্র। সামরিক শাসন একা চলতে পারে। যখনই তার সঙ্গে প্রহসনের নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়, তখন তা এতই বিপজ্জনক হয়, যে একটা রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার একটা প্রচ- সৌহার্দ্যতা ছিল, তাও সামরিক গণতন্ত্রে বিলুপ্ত হয়ে গেল। সংবিধান লাঞ্ছিত হলো, তার মূল স্তম্ভের একটি স্তম্ভ অপসারিত হলো। বঙ্গবন্ধুর দর্শন, সমাজচিন্তা এবং কৃষি ও বিজ্ঞানের ওপর গবেষণার যে উদ্যোগ, তা শুধু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর চিন্তাচেতনার সঙ্গে মিল ছিল না, বরং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের চিন্তা বৈজ্ঞানিকভাবে শ্রেষ্ঠতর ছিল।

জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাও সমাজতন্ত্র ছাড়া গুরুত্ব দিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার মতো আর কিছুই বাকি থাকে না রাষ্ট্র বিনির্মাণে। মানুষের মৌলিক অধিকারের সুষম বণ্টনের জন্য সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার কোনো বিকল্প ছিল না। তা ছাড়া উনার স্বপ্ন ছিল তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য। বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন অসাম্য ও স্তর বিভাজনকে প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে অথবা দেশের ঐক্য ও অস্বাভাবিক শান্তি অর্জনের চেষ্টায় এই চারটি স্তম্ভ খুব বেশি জরুরি এবং কার্যকর।

‘সামাজিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে ভারতের খতিয়ানটি ভয়ঙ্কর। জাতি-বর্ণব্যবস্থা এই বীভৎসতার একটি প্রতিফলন মাত্র। সবার আগে এটিকে যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমি জগৎ প্রবৃত্তিগতভাবেই সমভাবাপন্ন এবং ভারতবর্ষ স্থায়ীরূপে স্তরবিভক্ত এবং এ দুটি ধারণার মধ্যে ব্যবধানের চরিত্রটি মৌলিক- এমন একটি অতিসরলীকৃত সাধারণীকরণকে গ্রহণ করার প্রলোভনকে যদি আমরা ঠেকিয়েও রাখি, তা হলেও আমাদের এই বীভৎসতাকে স্বীকার করতে হবে।’

যদি ’৭৫-এর পরবর্তী অবৈধ সরকার, বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাকে যথাযথভাবে Recognition দিত, তা হলে অতিকষ্টের মহান ত্যাগের এই সদ্যজাত রাষ্ট্রটি বিপন্ন হতো না। ইংরেজি এই Recognition শব্দটি সম্পর্কে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের এক মহান উক্তি “বস্তুতপক্ষে ইংরেজি Recognition নামক অতিব্যবহৃত অভিব্যক্তিটি অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করতে পারে। তাই এটিকে আঁকড়ে না ধরে আমি সংস্কৃত ‘স্বীকৃতি’ শব্দটি ব্যবহার করছি। এই স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে গ্রহণ, বিশেষ করে এটা মেনে নেওয়া যে, সংশ্লিষ্ট মানুষদের নিজের নিজের মতো জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। তবে স্বীকৃতি কথাটি যে একটি ‘গৃহীত’ গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য একটি গোষ্ঠীর অবস্থানগত সাম্যের সদর্থক অনুমোদন হবেই, এমন কোনো কথা নেই।”

“সুতরাং স্বীকৃতির প্রশ্নটি স্বতঃই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু স্বীকৃতিকে যদি অন্যান্য উদ্দেশ্য বা অগ্রাধিকারের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হয়, তা হলে সামাজিক সাম্য বা বণ্টনগত ন্যায়বিচারকে সুনিশ্চিত করার বা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দিক দিয়ে এটি তেমন কিছু করতে পারে না। এই ক্ষেত্রগুলোয় ভারতের খতিয়ান সত্যিই খুব মর্মপীড়াদায়ক। স্বাধীনতার পর ৪৭ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে, দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুশীলন হয়েছে, কিন্তু এই খতিয়ানের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। Recognition বা স্বীকৃতি কোনোভাবেই শ্রেণি, জাতি, বর্ণ ও লিঙ্গগত অসাম্যগুলোকে খর্ব করতে পারেনি, ব্যাধিগুলো এখনো প্রবলভাবে বিদ্যমান। সমসাময়িক সমাজের মাপকাঠিতে ‘গ্রহণ’ ও অংশ নেওয়ার প্রথাসিদ্ধ মান স্বাভাবিকভাবে গণতন্ত্রের এক প্রশস্ত কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক সুষমতার দিকে নিয়ে যেতে পারে (এই রূপান্তর আদৌ শক্ত নয়); কিন্তু তা হলেই যে সেই সুষমতা আপনা থেকেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্যের বিকাশের দিকে সম্প্রসারিত হবে এমনটা নয়।” -অমর্ত্য সেন।

গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতাকে শুধু ধ্বংস করেই ক্ষ্যান্ত হননি তারা। যে জাতি বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে মাধ্যমে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে, মিত্রবাহিনীর স্বল্পদিনের সহায়তায় দেশটিকে স্বাধীন করেছিল, সেই জাতিকেও দ্বিধাবিভক্ত করে দিল। সৃষ্টি করা কত কঠিন তা একাত্তরের পূর্বপ্রজন্মই শুধু জানে, ধ্বংস শুধু নিমিষের ব্যাপার, যা ঘটিয়েছিলেন মোস্তাক-জিয়া চক্র। ওই চক্র বেঁচে থাকলে, জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের কারণেও তাদের বিচার হতো এবং ফাঁসি হতো। শুধু বিভক্তি নয়, স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী গোষ্ঠীকে নিয়ে তিনি পাকিস্তানপন্থি একটা গোষ্ঠীর জন্ম দিলেন, যারা বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি। সেই বিভক্তি পরবর্তী সময়ে বিষবৃক্ষের রূপ ধারণ করে আজও বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে। ডা. অমর্ত্য সেনের ভারতের ঐক্য সম্পর্কে যে বক্তব্য তার লেখনীতে তুলে ধরেছেন তা বাংলাদেশের জন্যও প্রণিধানযোগ্য : “এটি হচ্ছে ভারতের ঐক্য। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে আকবর আগ্রা শহরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যেসব আলোচনাসভার আয়োজন করেছিলেন আমরা তাদের দুটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারি। প্রথম বৈশিষ্ট্যটি ছিল ‘বহুত্বকে মান্যতা দান’, বহু ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের নিয়মিত উপস্থিতিকে সাগ্রহে গ্রহণ। দ্বিতীয়টি ছিল, একটি ‘সংলাপমূলক দায়বদ্ধতা’ হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস ও প্রত্যয়সম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে কথোপকথন ও আদান-প্রদানের ওপর আকবর কর্তৃক দৃষ্টান্তসুলভ গুরুত্ব আরোপ। এ দুটি হচ্ছে এক বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ সম্পর্কে সমৃদ্ধ সুসংহত বোধের পরস্পর সংযুক্ত বৈশিষ্ট্য।”

“অনুরূপভাবে, আকবর যে কেবল ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়ানো বিভিন্নতাগুলোকেই লক্ষ করেছিলেন তাই নয়। সেই সঙ্গে তিনি সেগুলোর সাধারণীকরণেরও একটি গভীর চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ভারতের জন্য ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ নামে এক সংহত দিনপঞ্জিকা তৈরি করার জন্য তার নিষ্ফল প্রচেষ্টা, এবং ভারতে ভিন্ন ভিন্ন পরিচিত ধর্মের সমাহারে ‘দীন-ই-ইলাহি’ নামে একটি সমন্বয়বাদী ধর্ম তৈরি করার জন্য তার ব্যর্থ প্রয়াস- এ দুটিই প্রকৃতপক্ষে এক সর্বব্যাপী ঐক্যের জন্য গঠনমূলক অনুসন্ধান ও সেই সঙ্গে বহুত্বের এক দৃঢ় স্বীকৃতিকে প্রতিফলিত করেছিল। এসব বৈচিত্র্যপূর্ণ সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্যে ভারতের সীমিত সংহতির যে ধারণাটি বেরিয়ে আসে, তার সঙ্গে অসমসত্ত্বতার স্বীকৃতির অনেকটা যোগ রয়েছে। লর্ড ক্লাইভ ব্রিটিশ রাজের ভিত তৈরির কাজ আরম্ভ করার অনেক আগেই এক বহুত্ববাদী ভারতের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। একীভূত ভারতের এক সমসত্ত্ব ভাবনা কিংবা সমগ্রকে বাদ দিয়ে কেবল বিচ্ছিন্ন অংশগুলোকে দেখা দুইয়ের কোনোটাই এই বহুত্ববাদী ভারতের ধারণার জায়গা নিতে পারেনি।” জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ তারিখ-ই-ইলাহি এর মতো পঞ্জিকা এবং দীন-ই-ইলাহির মতো ধর্মীয় অনুভূতির চেষ্টা করেছিলেন।

খরমযঃ ড়ভ ওহফরধ বইতে অকটাভিও পাজ এই উপমহাদেশকে অতি চমৎকারভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এ গ্রন্থে তিনি যা রচনা করেছিলেন তার মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশা করার মতো অনেক কিছুই আছে :

‘ঘটনা ভবিষ্যতে কী মোড় নেবে তা আগে থেকে বোঝা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। প্রাচীনরা যাকে নিয়তি বলে অভিহিত করতেন সেই অজানা শক্তি রাজনীতিতে ও ইতিহাসে, হয়তো সব কিছুতেই, সব সময় ক্রিয়াশীল। এ কথা মনে রেখেই আমি বলছি যে ব্যক্তিজীবনে যেমন, তেমনই রাজনীতিতেও, যতই ধীরগতিতে হোক না কেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সবচেয়ে নিশ্চিতভাবে সংঘাতের নিরসন করা সম্ভব।’

কিন্তু বাংলাদেশে এই আলোচনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়, যতক্ষণ না একটি গোষ্ঠী পাকিস্তানি চিন্তাচেতনাকে বিসর্জন দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করবে। (সৌজন্যে : দৈনিক আমাদের সময়)

লেখক : ভাইস চ্যান্সেলর (সাবেক) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরো সংবাদ