আজকের শিরোনাম :

নৌকরি নেহি মিলেগা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০১৮, ১৬:১৩

ফজলুল হক, ২৮ মে, এবিনিউজ :

(এক)

ছোটকালে হুজুর ও পলিটিশিয়ানদের শ্রদ্ধা করতাম। উনাদের কথা শুনতাম। ওয়াজ মাহফিল ও জনসভায় যেতাম। কিন্তু এখন হুজুরদের শ্রদ্ধা করি, মন্ত্রী ও নেতা মহোদয়দের ভয় করি। হুজুররা ধর্মোপদেশ দেন। আমাদের দেখলে কাছে টেনে নেন। কয়েকদিন আগে রেষ্টুরেন্টে এক সাবেক মন্ত্রীর সাবেক এপিএস– এর দেখা পাই। সে আমাকে খুবই ভক্তি শ্রদ্ধা দেখায়। এই ঘটনার কথা মনে না পড়লে আমি তার ভক্তিতে গলে যেতাম। ঘটনাটা শুনুন। আমি একদিন ঢাকায় এক মন্ত্রী সাহেবের বাস ভবনে যাই। গেটে এপিএসকে পাই। সে আমাকে ড্রয়িং রুমে বসায়। চা নিয়ে আসে। সে আমাকে আশ্বস্ত করে যে, আমার আসার কথা মন্ত্রীকে বলেছে। কেউ কেউ ভেতরে যাচ্ছে। কাজ সেরে চলেও যাচ্ছে। আমি অনেকক্ষণ বসে থাকি। তারপর দেখি মন্ত্রী বের হয়ে যাচ্ছেন। গাড়িতে উঠবেন। আমার অবাক লাগে। মাত্র কয়েক মাস আগে নির্বাচন হয়েছে। ভোটের ক্যাম্পেইনের সময় উনি দুবার আমার ঘরে এসেছেন। আমি জোর কদমে উনার গাড়ির কাছে যাই। উনাকে বলি, আপনি আমাকে বসিয়ে রেখে চলে যাচ্ছেন কেন? (আমার এই কথা শুনে আমার এক ছাত্র বলে, স্যার মন্ত্রী বড়? না অধ্যক্ষ বড়?) আমাকে ছাত্ররা বলে, শিক্ষক বড়। আমি বলি অধ্যক্ষ এখন ছোট, সে কথা বাদ দাও, আমি দর্শনার্থী। ভিজিটর ছোট? দর্শনার্থী যদি ছোট হয়, তাহলে উনারা আমাদের কাছে ভোটের জন্য যান কেন?

চাটগাঁইয়াদের বেলায় বলা যায়, সবার উপরে “মন্ত্রী” সত্য তাহার উপরে নাই। আরেক সরকারের আমলে আমাদের এলাকার আরেক মন্ত্রীর বিষয় বলি। উনি সদ্য মন্ত্রী হয়েছেন। বাড়িতে বড় মেজবান। কয়েকটি প্যান্ডেল। উঠানে একটি টেবিলে নামকরা লোকজন। আমি একটি খালি চেয়ারে বসি। এক মেয়ে পুলিশ অফিসার আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়, বলে, উঠেন। কেন উঠব? তর্কের এক পর্যায়ে মন্ত্রী এসে যান, উনি আরেকটি চেয়ার আনিয়ে আমাকে সেটাতে বসতে দেন। এই চেয়ারে উনি বসেন। হেসে বলেন, “বদ্দা, কিছু মনত নোয়াইন্নন।” ডোন্ট মাইন্ড। ওই টেবিলে কিছু সরকারি অফিসার বসেছিলেন। উনারা মন্ত্রীকে কিছু বলতে এসেছেন। বক্তব্য শুনে মন্ত্রী বলেন, আপনারা সরকারি কর্মচারী। সরকারের অংশ। কিন্তু আপনারা সরকার নন। আমরা সরকার। সেটা বুঝে, যা বলার বলবেন। পাড়ার কিছু লোক এই প্যান্ডেলে এসেছিলেন। তাদের পাশের প্যান্ডেলে পাঠিয়ে দেন। একেক সময় আমরা একেক সরকার দেখেছি। অগণতান্ত্রিক সরকার, স্বৈর সরকার, অনির্বাচিত সরকার, নির্বাচিত গন মানুষের সরকার। তো, মন্ত্রী মহোদয়গন আমাদের মাথার তাজ। উনারা আমাদের অবজ্ঞা করতে পারবেন। আমরা দায়ের তলার মাছ। আমি জানতাম “গভ:- বাই দ্যা পিপল, ফর দ্যা পিপল এন্ড অফ দ্যা পিপল।সরকার বানায় জনগন। তবুও মন্ত্রী যা বলেন, আমরা উনাদের কথার বাইরে যেতে পারবোনা। যাই ও না। বাঘকে ভয় করি। সিংহকে ভয় করি। মন্ত্রীকে ভয় করি। আমরা এমন মন্ত্রী সম্পর্কেও জানি, যারা জনগনের জন্য অপশক্তির সাথে লড়াই করেন। ভাল মন্ত্রী আছেন। হামবড়া মন্ত্রীও আছেন। ভাল হুজুর আছেন। আবার ধর্ম ব্যবসায়ী হুজুর ও আছেন। হামবড়া মন্ত্রী ও ধর্ম ব্যবসায়ী হুজুর থেকে আল্লাহ রক্ষা করুন।

(দুই)

নীচের বক্তব্য শুরু করার আগে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি বঙ্গবন্ধুকে, যিনি যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী ছিলেন। আবুল মনসুর আহমদ একজন রাজনৈতিক নেতা, আওয়ামী লীগ নেতা, তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। পুর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারে শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য মন্ত্রী ছিলেন। “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর,

”End of a betrayal” এই বই দুটি আমার বাসা থেকে একজন নিয়া গেছে আর দিচ্ছেনা। “ফুড কনফারেন্স”, “আয়না,” “জনসেবা ইউনিভার্সিটি” ও গায়েব। বই কেনা সহজ। বই রাখা কঠিন। বই মেরে দেয়া পাপ নয়। যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন, তারা বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” পড়বেন। “কারাগারের রোজনামচা” পড়বেন। অনেক কিছু জানতে পারবেন। “মন্ত্রী”– কত ক্ষমতাধর এটা বোঝার জন্য আমি কিছুদিন লেখাপড়া করি। “প্রথমা,” আবুল মনসুর আহমদের, “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” নতুন প্রিন্ট দিয়েছে। এটি এবং আতাউর রহমান খানের “ওজারতির দুই বছর” কেনার জন্য বাতিঘওে যাই। সাতশত টাকা দিয়ে “আমার দেখা—” কিনি। মন্ত্রী কত পাওয়ারফুল? সরকার কে? সরকার বলতে কি বুঝব, সরকার মানে কি, কেবল মন্ত্রী? আসুন, দেখি– বিভিন্ন সুত্র থেকে আমরা কি জানতে পারি। আপনারা অনেকে জানেন,আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দিয়ে স্বায়ত্বশাসন– এর দাবি উর্দ্ধে তুলে ধরেছিলেন। কিংবা তার আগে গেলে, অনেকে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করবেন। কিন্তু স্বায়ত্বশাসন ও পুর্ব পাকিস্তানের বাঙালির চাকরি বাকরি, ব্যবসা, শিল্পে ন্যায্য অধিকারের জন্য আওয়ামী লীগ অনেক কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী থাকা অবস্থায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে বাঙালির স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য অনেক কাজ করেছেন। করাচীতে পিআইএ– এর এক অফিসার (শাকিল) এর সাথে আমার বন্ধুত্ব ছিল। সে “তোম্‌ বাঙালা আদমী জমহুরিয়ত চাহতা আউর নৌক্‌রি ভি মাংতা। ইয়ে চাহাত মে গলতি হ্যায়। জমহুরিয়াত তোমকে মিল স্যাকতা। আউর তোম ছিন্‌ ভি লে স্যাকতা। মাগার ইয়ে গলতি কভি নেহি করনা, নৌকরি নেহি মাংনা।” তোমরা বাঙালিরা আয়ূব খানের কাছে গণতন্ত্র চাও, তা ঠিক আছে। তার নিজস্ব মডেলের পাক– জমহুরিয়াত(গণতন্ত্র) তুমি না মানতে পার। (বেসিক– ডেমোক্রেসি আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি।) তোমরা গণতন্ত্র ছিনিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু পুর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ভাইদের জন্য চাকরি চেয়োনা। দিবেনা। মারবে। পিষে ফেলবে। কিন্তু চাকরি বাঙাল পাবেনা। এমনকি পাকিস্তান ভেঙে গেলে, ভেঙে যাবে। মাগার নৌকরি তোমকো নেহি মিলেগা। “ফজলু, রাইট ইট ডাউন। এন্ড ওয়েট ফর টাইম। শাকিল ইজ নো লে ম্যান।” ফজলু, লিখে নাও, শাকিল যা তা লোক নয়। কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলবে। জিয়া, এরশাদ— পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। আরো অনেক আর্মি ও সিভিল অফিসার আমলা পাকিস্তান সরকারে ছিলেন। তারা পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছেন। আর্মি অফিসাররাও এসেছেন।পাকিস্তান সরকারের বাঙালি আমলারা ও গুঢ় রহস্য জানতেন।তারা বাঙালির স্বার্থের কথা বলেননি। কিন্তু জীবন বাজী রেখে বঙ্গবন্ধুই ডিস্‌ প্যারিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছেন। ডিস প্যারিটির কথা সবাই জানত। পাকিস্তান বাঙালিকে চাকরি দেবেনা। শির দেঙ্গা– আমামা নেহি। কেবল পাকিস্তান কুত্তা না, যারা পাকিস্তানের পায়রাবি করে, তারাও কুত্তা। আমিও আমার বন্ধুরা কেবল ৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা নই, আমরা ৬০ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা, আমরাই মুক্তিযুদ্ধের ধারনা তৈরি করেছি। আমরা জন্মেছি মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট নিয়ে। আমরা জন্মেছি পাকিস্তানে– পাকিস্তানকে তার অন্যায়ের শাস্তি দেয়ার জন্য। আমরা কখনো “বখশিস” চাইনি। হিসাবের পাওনাটাও পাইনি। আমরা “বাইচান্স” মুক্তিযোদ্ধা নই। করাচীতে বসে, শাকিল বলেছিল, দেখবা, কোন এক মাসের “ছয় তারিখ” পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে। অবাক কান্ড দেখুন, আমাদের বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতা দিবস দুটিতে ৬ আছে (১৬ ডিসেম্বর এবং ২৬ মার্চ)। আমরা বখশিস নিইনা। পাকিস্তানিদের মেরে হিসাবের পাওনা আদায় করেছি। কোথায় “সিয়াসত” কোথায় তোদের “সদরে রিয়াসত?” তোদের নাই– মান সম্মান, ইজ্জত। তোদের খাসলত, কুত্তার খাসলত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল বলে, আমরা পাঞ্জাবীদের কাছে মাথা নত করিনি। আজ আমার মনে পড়ে যায়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী– হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। তিনি আমার বাবার প্রিয় নেতা ছিলেন।

(তিন)

এবার শুনুন, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ (আওয়ামী লীগ নেতা) এর বয়ান ঃণ্ড

তিনি বলেন, মন্ত্রী হিসাবে আমার উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা সরকারি/বেসরকারি চাকুরীতে পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবি যথাসম্ভব পূরনের চেষ্টা করা। চাকুরীতে প্যারিটির (সাম্যের) পক্ষে আমি যত বক্তৃতা করেছি, তা আর কেউ করে নাই। কিছু দিনের মধ্যেই আমি বুঝেছিলাম, স্বাভাবিক অবস্থায় প্যারিটি দাবি করা অবাস্তব। পাকিস্তানের কাছে চাকুরী আশা করা পাগলামি। এই কথা আমাকে সমঝাইয়াছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চ পদাধিধারী একজন রাষ্ট্র নেতা। তিনি আমাকে অত্যন্ত সরলভাবে বলিয়াছিলেন, মনে রাখিও মুসলমানেরা ভারতে সরকারি চাকুরীতে অংশ দাবি করায় হিন্দুরা তাদের ভারত মাতাকে দ্বিখন্ডিত করতে রাজী হইয়াছে। তবুও চাকুরীতে অংশ বসাইতে দেয় নাই। অতঃপর প্যারিটি লাভের আশা মনে মনে পরিত্যাগ করিলাম। (প্যারিটি আনতে হলে বৈষম্য দূর করতে হবে। ৬দফা প্যারিটির দাবি। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শক্তি সামর্থ্য পুর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আদায়ে প্রয়োগ করেছিলেন। এখানে বঙ্গবন্ধু অনন্য।) আবুল মনসুর আহমদ বলেন, আমার অধীনস্থ দুইটি দফতরে কোন ভ্যাকেন্সি হইলেই পূর্ব পাকিস্তানী নেওয়ার প্রস্তাব দিতাম। আমার অভিপ্রায় ব্যাহত করিবার জন্য কতযে প্রথা, রীতি, আইন কানুন, রুল ও রেগুলেশন দেখাইতেন, তাতে আমার মত অনভিজ্ঞ ও অল্প বুদ্ধির লোক ভ্যাবাচ্যাকা খাইতে বাধ্য হইত।(দেখুন, আওয়ামী লীগের পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের এই মন্ত্রী কি বলতেছেন। (চাটগাঁইয়া বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রীরা এই লেখা দয়া করে পড়বেন। চাটগাঁইয়ারা যেন সরকারি চাকুরীতে তাদের অংশ পায়।)

আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন, আমার কথামত একজন পূর্ব পাকিস্তানীকে তারা একবার চাকুরী দিলেন। আমার সন্দেহ হওয়ায় কাগজপত্র তলব করিলাম। একজন লোক মাত্র দুই বছর আগে মাদ্রাজ হইতে পাকিস্তানে আসিয়াছেন। তার কোন আত্মীয় কোয়েটায় চাকুরী করেন। সেখানেই তিনি দুই বছর যাবৎ আছেন। পূর্ব পাকিস্তানীর কোটায় এই চাকুরীটি খালি হওয়ার পর ঐ যুবক পূর্ব পাকিস্তানী হিসাবে দরখাস্ত করিয়াছেন। দফতর হইতে তাহার নাম পাবলিক সার্ভিস কমিশনের বিবেচনার জন্য পাঠানো হইয়াছে। কমিশন যথারীতি কর্তব্য করার পর তার নিয়োগ সুপারিশ করিয়াছেন। তিনি চাকুরীতে বহাল হইয়াছেন। কোয়েটাবাসী মাদ্রাজী যুবক পূর্ব পাকিস্তানী হইলেন কি করে? (এই বাংলাদেশে আমি নিজে প্রতিবাদ করেছি, চাটগাঁর কোটায় চাকুরী পাচ্ছে– ভোলার, বাগেরহাটের বাসিন্দা। তিনি চট্টগ্রামের বাসিন্দা বলে, ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিস–সনদ দিয়েছে। চাটগাঁর লোক নিয়োগের ব্যাপারে অনমনীয় কথা বলতে গিয়ে যে কর্মকর্তা আমাকে বদলী করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে, তিনি এমন বলবেন, সেটা আমার অবিশ্বাস্য লেগেছে।) চাটগাঁইয়াদের চাকুরী পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য আমাকে কষ্ট দেয়। চাটগাঁইয়াদের ভিটা জমি উন্নয়নের স্বার্থে হুকুম দখল করে নেয়া হয়েছে। তারা কি বাস্তুহারা হয়ে ভেসে বেড়াবে? অন্য জেলার লোক চাকুরী পাওয়ার বেলায়, চাটগাঁইয়া বনে যায়।

মাদ্রাজী– পূর্ব পাকিস্তানী বনে গেলো কি ভাবে? ঢাকা জিলা কর্তৃপক্ষ সার্টিফিকেট দিয়েছেন, উক্ত যুবক এক বৎসরের অধিককাল পূর্ব পাকিস্তানের ডমিসাইল। আমার তালু–জিহ্বায় লাগিয়া গেল। আমি তোলপাড় শুরু করিলাম। কমিশন জানাইলেন সরকারি ডমিসাইল সার্টিফিকেট পাওয়ার পর এ বিষয়ে তাদের কিছু করার নেই। আমাকে শান্ত করিবার জন্য বিভিন্ন দিক হইতে, অফিস ফাইলে এমন “নোট” আসিল যে একজন পাকিস্তানীর চাকুরী যেভাবে হোক, হইয়া গিয়াছে, এখন এটা নিয়া হৈ চৈ করা ঠিক হইবে না। আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে যে ভারত হইতে আগত মোহাজেরদেরও আমাদের চাকুরীবাকরীতে একটা দাবি আছে। সব নোটের শেষে আমি লিখিতে বাধ্য হইলাম– “কিন্তু একথাও আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে যে, পাকিস্তানের দুটি মাত্র উইং। ভারতে ইহার কোন দ্বিতীয় উইং নাই। মোহাজের নামধারী বিহারীরা চট্টগ্রামে বন্দর ও রেলের সকল চাকুরী কব্জা করেছিল॥ হালিশহরের “কলিজা” হুকুম দখল করে “হাউজিং এস্টেট” বানিয়ে বিহারীদের আবাস করা হয়েছিল। বিহারী কুত্তারা একাত্তরে আমাদের মেরেছিল। পাকিস্তান টিকে থাকলে, চাটগাঁর অর্ধেক চলে যেত বিহারীদের দখলে।

পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন অফিসের বিদেশে ট্রেনিং নেয়ার জন্য ৯ জন অফিসার পাঠাইতে হইবে। আমার কাছে অভিযোগ আসিল সিলেকশনে একজন পূর্ব পাকিস্তানীও নেওয়া হয় নাই। আমি তখন পাকিস্তানের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। কাজেই সংশ্লিষ্ট দফতরের সেক্রেটারীকে ডাকিয়া পাঠাইলাম। তিনি একা আসিলেন না, সংগে আনিলেন, জয়েন্ট সেক্রেটারীকে। আমি তাদের কাছে আমার উদ্দেশ্য বলিলাম। তারা পূর্ব পাকিস্তানী এক আধ জন পাঠানো নিতান্ত উচিৎ ছিল স্বীকার করিয়াও পরিতাপের সাথে বলিলেন, বড় দেরী হইয়া গিয়াছে স্যার। নামগুলো বিদেশে পাঠানো হইয়া গিয়াছে। তারা সেই জন্য বড়ই দুঃখিত। আয়েন্দাতে তারা এর ক্ষতি পূরণ করিয়া দিবেন। আমি তাদের আশ্বাসে আশ্বস্ত হইলাম না। বলিলাম, ওটা ফিরান যায় না? তারা বলিলেন, অসম্ভব। কারণ ওটা এতদিনে গন্তব্যস্থলে যদি পৌঁছিয়া নাও থাকে, তবে পথিমধ্যে আছে। পাকিস্তানের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে নিশ্চয়। ততক্ষণে আমার জিদ বাড়িয়া গিয়াছে। বলিলাম, এক্ষুণি এই মর্মে উক্ত সরকারের কাছে ক্যাবল করিয়া দেন, যে ঐ নামগুলো বাতিল করা হইল। নতুন নামের তালিকা অনতিবিলম্বে পাঠানো হইতেছে। (পাঠক, দেখুন– আমলার কাছে মন্ত্রী কত অসহায়। তবে কিছু মন্ত্রী আমলাকে ট্যাকল করতে পারেন।)

পাঠক, এবার আমলার ক্ষমতা ও কূট কৌশল বোঝার চেষ্টা করুন। মন্ত্রীদের সাফল্য নির্ভর করে উনি আমলাকে ট্যাকল করতে পারেন কিনা– তার উপর। এমন মন্ত্রী আছেন, যিনি আমলাকে সমীহ করেন, জনগণকে ভয় দেখান। এমন মন্ত্রীও আছেন, যিনি জনগণকে সমীহ করেন, আদর কদর করেন, কিন্তু আমলাকে তার আওতার বাইরে যেতে দেন না। পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও গণবিরোধী, এমনকি বাঙালি বিরোধী মন মানসিকতার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। তারা, পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাও আমলা– তারাই পাকিস্তান ভেঙে দিয়েছে, কিন্তু চাকুরীতে আমাদের অংশ দেয় নাই। বঙ্গবন্ধু না হলে– আমাদের কি হতো– বুঝে দেখুন। কিন্তু সেই সামরিক, বেসামরিক পাক আমলাকে আমরা স্বাধীনতা পরবর্তী আমাদের প্রশাসনে এনেছি। যিনি ১৪, ১৫ ডিসেম্বর ডিসি,এসপি, তিনিই ১৭ ডিসেম্বর ডিসি, এসপি, আমরা কখনো চক্রান্ত থেকে মুক্তি পাই নাই। ওই সাবেক পাক আমলারা আমাদের “আপদ” হিসেবে থেকেই গেছে। শুরুতেই দুই মন্ত্রীর কথা বলেছি। উনাদের মন্ত্রীত্ব দেখেছি। খালি জনগণের উপর চোটপাট করে। আমরা জনগণ, যাকে ভোট দিয়ে মন্ত্রী বানাই– তিনি “সম্রাট” বনে যান। মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা পতাকা বদল করেছি, রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতাদের চরিত্র বদল করতে পারিনি। আমলারা অপ্রতিরোধ্য হয়েছেন। আরো দুইবার মুক্তিযুদ্ধ করেও রাজনীতিবিদ এবং আমলার চরিত্র বদল করতে পারবো না। তাই মানুষ মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদদের ভয় পায়। হুজুরকে ভালবাসে। তবে পলিটিক্যাল হুজুরদের নয়। ধর্ম ব্যবসায়ী হুজুরদের নয়। আপনারা মনোনয়ন বাণিজ্য করবেন, ছাত্রনেতারা টেন্ডারবাজী করবে, মন্ত্রীরা স্বেচ্ছাচারিতা করবেন, পরিণতি হবে একটা– হুজুররা মিষ্টি বুলি দিয়ে মানুষের মন ভোলাবে। পলিটিক্যাল হুজুরদের কাছ থেকে সাবধান থাকুন। আপনারা, মন্ত্রীরা জনগণের চাকুরী বাকুরীর দিকে মনোযোগ দিন। আপনি তো চিরদিন মন্ত্রী থাকবেন না। একদিন না একদিন পাড়া গ্রামে এসে চায়ের দোকানে বসতে হবে। জনগণের কাছেই আসতে হবে। তারাই “খাটিয়া” বা “কফিন” কাঁধে নিবে।

পাকিস্তানী বন্ধুদের কথা এখনো কানে বাজে : বাঙাল কো নৌক্‌রি নেহি মিলেগা।

লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
(সংগৃহীত)

এই বিভাগের আরো সংবাদ