আজকের শিরোনাম :

একটি পতাকা কি তাঁরা পেতে পারেন না

  ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

২৮ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:৫১ | অনলাইন সংস্করণ

আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে সাতচল্লিশ বছর আগে। এ স্বাধীনতা অর্জনে হাজার বছর চড়াই উৎরাই পথ চলতে হয়েছে এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিসর্জন ঘটেছে নিজ দেশে। আরও প্রায় দশ লাখ প্রাণ আতœাহুতি দিয়েছে ভারতের শরনার্থী শিবিরে। অনেক রক্তে কেনা আমাদের এ স্বাধীনতা। বিসর্জনের এ রক্ত সাগরের বিস্তৃত জলরাশির ব্যাপকতার চেয়েও বিস্তৃত । মেরুঅঞ্চলের জমাটবেধে থাকা বিশাল বিস্তৃত বরফ খন্ডের চেয়েও ব্যাপক ।এ রক্ত বৈশাখি আকাশে কালো মেঘের ঘনত্বের চেয়েও ঘন। এ রক্ত পতাকার লাল রং এর চেয়েও লাল। ত্রিশ লাখ শহীদের দীর্ঘশ্বাস মহাপ্রলয়ের চেয়েও প্রলয়ংকরী। এদেশের পবিত্র মাটির সাথে মিশে আছে হাজারো মুক্তিযোদ্ধার তাজাপ্রাণ, দীর্ঘশ্বাস, তাজা রক্ত। হাড়, কংকাল, রক্ত-মাংস।আরও আছে প্রায় দ’ুলাখ মা-বোন, বধূ-কন্যা, জায়া-জননীর সম্ভ্রম লুণ্ঠনের নজিরবিহীন হিংস্রতা ও বর্বরতার জীবন্ত বিভীষিকা । মানবতার চরম লঙ্ঘনের ইতিহাস। পরম পশুত্ব আর আদিমতা। দু’শত ছেষট্টি দিনের দুনিয়া কাঁপানো যুদ্ধ। অত:পর প্রতীক্ষার স্বাধীনতা। হাজার বছরের অধরা স্বপ্নের স্বরূপ প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের রক্তগঙ্গা মানচিত্র। লাল সবুজের অনিরুদ্ধ-অদম্য পতাকা। মুক্ত আকাশ। মুক্ত বাতাস। মুক্ত সংস্কৃতি। মুক্ত স্বকীয়তা। মুক্ত স্বদেশ-স্বাধীনতা। রক্ত সাগর পাড়ি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত মুক্তির মন্দিরে পৌঁছার অদম্য অভিযাত্রী,অকুতোভয় সৈনিক বাংলাদেশের ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষ,শিক্ষক-রাজনীতিক-আইনজীবী সর্বস্তরের জনতা। জনযুদ্ধের আপামর জনতা, গণযুদ্ধের গণজনসাধারণ। মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয় এ দেশের প্রায় সোয়া লাখ মানুষ। মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিবাহিনী। মুক্তিফৌজ। এরা এফএফ; এরা বিএলএফ; এরা গেরিলা; এরা সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, ইপিআর ইবিআরের সদস্য। প্রায় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমেরিকা চীনের সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।
স্বাধীনতা একটি জাতির স্বপ্নপূরণের শেষ ধাপ। সর্বোচ্চ ত্যাগ ও রক্ত দিয়ে এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়। পৃথিবীতে হাতে গোনা যে কয়টি দেশ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। মানুষ যখন মরতে শিখে, মানুষ যখন বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিতে অকুণ্ঠ হয়, তখন তাদের দেশাতœবোধের স্বপ্নগুলো অধরা,অজেয় আর থাকেনা। জাতিরজনক মুজিব যথার্থই বলেছিলেন, ”আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবেনা।” বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর বাংলাদেশই তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। অন্তত কাগজে লেখা, অক্ষরের ভাষা তাই বলে। পৃথিবীর অপরাপর কয়েকটি দেশের মতো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়নি কোন প্রক্রিয়াতেই। তাঁদের যুদ্ধে যাওয়া ছিল অন্তরের তাগিদের, মননের মুক্তির আকাঙ্খার, চেতনা ও সত্তার স্বকীয়তার প্রয়োজনে। সামাজিক, রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক বৈষম্য-বঞ্চনা-বিভেদে দাহিত সত্তার বিস্ফোরণে। হাজার বছরের সেরা বাঙালি,স্বাধীনতার মহান কারিগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে। নয় মাসের যুদ্ধে মাতৃভূমি পাকিস্থানি হানাদার কবল থেকে মুক্ত হবার পর মহান নেতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আবারো অন্যরকম মুক্তির স্বাদ এনে দেয় বাঙালি জাতিকে। ইতিহাসের এই জায়গাগুলোই আমাদের প্রেরণার উৎস।
ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই তিন বছর সাত মাসের মাথায় আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসাবে দেশীয় বর্বর খুনিচক্র বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে কাপুরুষোচিত ভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব পাকিস্তানি জিম্মাদারিত্বে চলে যায়। দীর্ঘ অনাকাঙ্ক্ষিত পথ পরিক্রমায় আমরা বিভ্রান্ত, বিস্মৃত, চেতনার বিকলাঙ্গে পরিণত হয়ে পড়ি। ইতিহাসের পথ ছেড়ে আমরা ভিন্ন পথে চলি, ভিন্ন কথা বলি। দেশের মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজ, নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতার স্বপ্নকে দু:স্বপ্ন হিসাবে অন্তর ও মননে পোষণ করে করে বিভ্রান্তির বিহ্বলতায় হাবুডুবু খেতে থাকে। দীর্ঘ প্রায় পঁচিশ বছর এভাবেই।
ইতিমধ্যেই দেশমাতার মুক্তির অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা অবিচারে, অনাদরে,অনাচারে,অবহেলায়, অভাবে, অনটনে, অচিকিৎসা, অপচিকিৎসায় বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায়। ডাষ্টবিনের খাবার, লাঞ্চনার আচার, প্রবঞ্চনার বিচার বয়স হারানো মুক্তিযোদ্ধাদের নৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক ভিতকে প্রায় নি:শেষ করে দেয়। অনেক পরে রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রতিকী সম্মানি ভাতার ব্যবস্থা করে। মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে মৃতদেহকে লাল সবুজের পতাকায় আবৃত করে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের প্রথা চালু করা হয়।
অভুক্ত, অনাহারক্লিষ্ট, সামাজিক অবহেলা, অনাচার, অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত মুক্তিযোদ্ধারা সব ভুলে তা সাদরে গ্রহণ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য ফসল আমাদের সংবিধান। মুক্তিকামী জনতার জীবনের মুল্যে এ পবিত্র দলিল। আমাদের পবিত্র সংবিধানের কোথাও মুক্তিযোদ্ধা শব্দটির আক্ষরিক উল্লেখ না থাকলেও, তাঁদের জন্য বরাদ্দকৃত সম্মানি ভাতার উৎস সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দরিদ্রফান্ড হলেও – রাষ্ট্রসম্মানে তাঁদের উচ্চাসের সীমা ছিলনা। দীর্ঘকাল পরিক্রমায় তাঁদের আমরা চিনতেই চাইনি। বিশেষ করে প্রশাসনিকভাবে। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের এক পেকেট খাবার অথবা একটা টি শার্ট বা টুপি তাঁদের সীমাহীন ভাবে আপ্লুত করে। এ প্রশাসনিক রাজনীতি বহুদিনের। এই অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা এখন যখন দেখে, দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার। অবাধে জয়বাংলা স্লোগান দেয়া যায়। বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করা যায়। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা যায়। দ’ুবেলা পেট ভরে খাওয়া যায়। অভাবি মানুষকে কম দেখা যায়। তখন স্বপ্নে লালিত সোনার বাংলার চেতনার কথা মনে করে তাঁরা আপ্লুত হন। ফিরে যান একাত্তরে। অতীতের অবহেলা, অপ্রাপ্তি তাঁরা ভুলে যান নিমেষে। সম্মানির সীমিত অর্থও তাঁদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্নগুলোকে সংঘবদ্ধ করে। স্বপ্ন পূরণের সাধ হাতছানি দেয়। বেঁচে থাকার সাধ বর্ণিল হয়।
এমন সারল্যকে পুঁজি করে আমরা তাঁদের সাথে কপটতার খেলা খেলি। মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স হয়েছে। যথার্থ ভাবে তাঁরা সবাই ষাটোর্ধ। তাঁদের মৃত্যুতে প্রচলিত অসঙ্গতি মেনে নেয়া কষ্টকর। একজন মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা,পুলিশ প্রশাসনের উধ্বর্তন কর্মকর্তা একদল চৌকস পুলিশ নিয়ে উপস্থিত হন। রাজসিক, রাজকীয় সম্মাননা প্রদানের জন্য, প্রদর্শনের জন্য। এ কর্মে জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং উপজেলা পর্যায়ে সেখানকার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার থাকার বিধান প্রচলিত। একজন জনপ্রশাসন কর্মকর্তা এতে নিজেও সম্মানিত হবেন, সম্মান বোধ করবেন। যা তার জীবনের একটি পরম প্রাপ্তি হয়ে থাকবে। কেননা আর দশ,পনের, বিশ বছর পরের কর্মকর্তারা এ সুযোগ চাইলেও পাবেননা। তখন হয়তো কোন মুক্তিযোদ্ধা আর বেঁচে থাকবেনা। কিন্তু গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা যায়, বিগত কয়েক বছরে জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক প্রধানকে এ কর্মে দেখা যায়নি। তারা অন্য গুরুত্বপুর্ণ (?র্) রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় সর্ব কনিষ্ঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানের এ মহতি কাজে পাঠিয়ে থাকেন। পুলিশ প্রশাসনও একই ঘটনা ঘটায় । এটিই এখনকার প্রচলিত বিধানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রদত্ত এ বিরল সম্মানকে অন্তরে এবং পেশাদারিত্বে ধারন করার সংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পৃক্ত। এখানে ঘাটতি থাকলে বিধি দিয়ে তার কার্যকারিতা আদায় করা যাবেনা। স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর অতিক্রম করেও আমরা এ ক্ষেত্রে পেশাদার হতে পারিনি। একজন প্রশাসকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায়, ”এসপি, ডিসি,কমিশনার এমনকি এমপি, মন্ত্র্রী হওয়া যায়, কিন্তু চাইলেই একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়না।” কোন ভাবেই না। আমরা আশাকরি আগামী দিনে দায়িত্বশীলরা এদিকে মনোযোগ দেবে।
আরও একটি বিষয় গভীর ভাবে লক্ষ্য করা যায়- জেলা অথবা উপজেলা প্রশাসন উল্লেখিত রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের একটি পতাকা নিয়ে আসে। যা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহকে ঢেকে দেয়া হয়। অতীব সম্মানের বিষয় এটি। গার্ড অব অনার প্রদর্শন শেষে মৃতদেহ সৎকারের বা সমাহিত করার অনেক আগেই পতাকাটি খুলে নিয়ে ফেরত আসে উক্ত টিম। তখন প্রকৃত অর্থেই বিষয়টি খুব বেমানান হয়ে যায়। বিষয়টির কৃত্তিমতার সুবাস জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায়। দেশে জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা মনে করে ঐ পতাকাটি ফেরত না এনে সেই মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে চিরদিনের জন্য প্রদান করা যেতে পারে। রাষ্ট্রের বদান্যতাস্বরূপ। তাঁদের বিশ্বাস, ঐ পরিবার পতাকাটিকে অতিযতেœ সংরক্ষণ করে প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধ এবং তার চেতনাকেই সযতেœ লালন করবে জন্মজন্মান্তরে। সেনাবাহিনীর একজন সদস্য মৃত্যুর পরে যখন রাষ্ট্র সম্মান পায়, তখন তার নান্দনিকতায় ঘাটতি আমরা দেখিনা। রাষ্ট্র একটিই। দেশের জন্য ত্যাগের সম্মান ভিন্ন হওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি প্রদর্শিত রাষ্ট্রীয় সম্মান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালিত, চেতনা উৎসারিত। এ চেতনার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বিসর্জনের সামগ্রিকতা জড়িত। এ সামগ্রিকতার সাথে ত্রিশ লাখ প্রাণে সর্বোচ্চ ত্যাগ নিবিড়ভাবে জড়িত। সুতরাং আমাদের কৃত কর্মে ঘাটতির সুযোগ কোথায়।বিজয়ের মহান এ মাসে আমাদের কৃতজ্ঞতা সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি। স্বাধীনতার মহান যোদ্ধাদের প্রতি প্রদর্শিত যথাযথ সম্মানজনক কর্মই প্রজন্মের চেতনাকে দেশপ্রেমে আরও শাণিত করতে পারে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালিত প্রজন্মই আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করতে পারে। গড়তে পারে সমৃদ্ধ, সুখী, অদম্য বাংলাদেশ। (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া)

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক

এই বিভাগের আরো সংবাদ