আজকের শিরোনাম :

মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

  এ কে এম শহীদুল হক

২১ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:৪৯ | অনলাইন সংস্করণ

মাদক এক ধরনের ওষুধ বা রাসায়নিক বস্তু, যা মানুষ খেলে অথবা ইঞ্জেকশন বা ধূমপানের মাধ্যমে দেহে গ্রহণ করলে দেহের মধ্যে এক জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, যা মাদকগ্রহণকারীকে সাময়িকভাবে সুখানুভূতি বা তথাকথিত প্রশান্তি দেয়। এই অস্বাভাবিক সুখানুভূতি বা প্রশান্তির কারণে সে বারবার মাদক গ্রহণ করতে চায় এবং চরমভাবে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

মাদক একটি জীবন ধ্বংসকারী ড্রাগ। বিচিত্র ধরনের মাদক পাওয়া যায়। একেক ধরনের মাদক একেক ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বেশির ভাগ মাদকই  Psychoactive বা চিত্ত প্রভাবকারী ড্রাগ। এসব মাদক মনস্তাত্ত্বিক এক বা একাধিক উপাদানকে প্রভাবিত করে। দেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাব বিস্তার করে দেহে বহুবিধ উপসর্গ সৃষ্টি করে। এসব প্রতিক্রিয়ার ফলে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির দৈহিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আচরণে অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। মাদক নেওয়ার তাড়না উঠলে মাদক নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে, মানবিক বোধ হারিয়ে ফেলে এবং যেকোনো মূল্যে মাদক নিতে দ্বিধা করে না। সংসারে সুখ-শান্তি বিনষ্ট করে নিজেকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয়।

মাদকের ছোবল থেকে মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য যুগে যুগে, দেশে দেশে মাদকবিরোধী আইন হয়েছে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেক দেশে মাদকবিরোধী আইনে মৃত্যুর ব্যবস্থা আছে। আমাদের দেশেও মাদকবিরোধী কঠিন আইন আছে। বিভিন্ন দেশে মাদক প্রতিরোধ ও মাদকাসক্তের চিকিৎসার জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তার পরও এই মারণাস্ত্র মাদক থেমে নেই। তার কালো থাবা ও পাখা বিস্তার করেই চলেছে।

১৯৬০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ড্রাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ  শুরু হয়। War on drugs স্লোগানটি প্রথম ব্যবহার করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৭১ সালের ১৮ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন যে মাদকের অপব্যবহার জনগণের এক নম্বর শত্রু (Drug abuse is public enemy number one)। রিচার্ড নিক্সন ফেডারেল সরকারকে মাদকের উৎপাদন, পরিবহন ও অপব্যবহার বন্ধ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক দমনের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে।

যুদ্ধের দীর্ঘ ৩০ বছর পর Drug Enforcement Administration-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আমেরিকা বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে মাদক নির্মূলের জন্য। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অবৈধ মাদকের ১০ শতাংশ জব্দ করতে পারে। বাকি ৯০ শতাংশ ড্রাগ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে মাদকসেবীদের কাছে চলে যায়। তবে ১০ শতাংশ মাদকের জন্য কেন এত ব্যয়?  মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান করে অসংখ্য লোককে  গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেলে তাদের রাখতে জেল  কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে দিন দিন মাদকসেবীর ভিড় বেড়েই চলছে। কিন্তু মাদক নির্মূল করা যায়নি, বরং বেড়েই চলেছে। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটি বলা যায় যে War on Drugs  প্রত্যাশিত সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এ অভিযান নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৮ সালের ২ অক্টোবর প্রকাশিত এক জরিপে দেখা যায়, চারজন আমেরিকানের মধ্যে তিনজনই মনে করে War on Drugs ব্যর্থ হয়েছে। ২০১২ সালে গুয়াতেমালায় এক সভায় গুয়াতেমালা, মেক্সিকো ও কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্টরা এ মর্মে মতামত দেন যে War on Drugs অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। তাঁরা বিকল্প নিয়ে আলোচনা করেন।

বাংলাদেশের মাদকের বিস্তার দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদকাসক্তের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে কঠোর আইন আছে। পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিন বহু মাদকদ্রব্য উদ্ধার করছেন, গ্রেপ্তার করছেন এবং মামলা নিচ্ছেন। কিন্তু মাদকের বিস্তার ও আসক্তি রোধ করা যাচ্ছে না। পুুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মামলা করেছে এক লাখ ১২ হাজার ৫৫২টি এবং গ্রেপ্তার করেছে এক লাখ ৪৭ হাজার ৮০৩ জনকে। উদ্ধার হওয়া মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ৪১৭ কেজি হেরোইন, ৪৯ হাজার ১২ কেজি গাঁজা, দুই হাজার ৫০৭টি ইঞ্জেকশন, তিন লাখ ৩৯ হাজার ৮২৮ বোতল ফেনসিডিল এবং তিন কোটি ৬৯ লাখ ৪৭ হাজার ৮২২ পিস ইয়াবা। (সূত্র : বাংলাদেশ পুলিশ)

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিলে পুলিশ ও র‌্যাব ১৭ মে ২০১৮ থেকে বিশেষ অভিযান শুরু করে। এ অভিযানে বহু মাদক কারবারি গ্রেপ্তার হয়, বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মাদক কারবারি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে এনকাউন্টারে নিহত হয়। এ অভিযানে মাদকের সরবরাহ কিছুটা হ্রাস পেলেও পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

আমাদের দেশেও মাদকের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণিত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন :

মাদকের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানকে অব্যাহত রাখতে হবে। মাদক কারবারের সঙ্গে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা গডফাদার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব সদস্যকে শতভাগ সততা নিয়ে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁদের মাদক কারবারিদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দেওয়াসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। এ লক্ষ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে মাদকের কুফল সম্পর্কে  জ্ঞান দান করতে হবে। কোনোক্রমেই যাতে তারা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে সে জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

প্রতিটি পরিবারকে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে। এ ব্যাপারে মা-বাবা ও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাঁদের সন্তানদের মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করতে হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে মাদকের ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কে শিক্ষামূলক তথ্যাবলি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মাদকের বিরুদ্ধে জ্ঞান দান করবেন এবং তাদের দিকে খেয়াল রাখবেন, যাতে কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক ব্যবহার না করে।

মাদকাসক্তদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য। কোনো পরিবারে কেউ মাদকাসক্ত হলে তা গোপন রাখা হয়। কিন্তু এটি গোপন রাখার বিষয় না। মাদকাসক্ত ব্যক্তি তো অসুস্থ। পরিবার, আত্মীয়স্বজন সবাই মিলেই তার পাশে দাঁড়াতে হবে। তাকে সুস্থ করার জন্য ভূমিকা নিতে হবে।

আমাদের দেশে উন্নত মানের মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের অভাব আছে। সরকারি পর্যায়ে খুবই অপ্রতুল। বেশির ভাগ বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্র মানসম্মত নয়। সরকারি উদ্যোগে সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরে প্রয়োজনীয়সংখ্যক উন্নত মানের নিরাময়কেন্দ্র নির্মাণ করা অপরিহার্য। ওই সব নিরাময়কেন্দ্র অবশ্যই দক্ষ ও আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও সাইকোথেরাপিস্ট দ্বারা পরিচালিত হতে হবে।

শুধু সরবরাহ বন্ধের চেষ্টা করেই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। সমাজে মাদকের চাহিদা থাকলে যেকোনো প্রকারেই মাদকের সরবরাহ আসবে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে নতুন করে মাদকাসক্তির প্রবণতা কমাতে পারলে সমাজে মাদকের চাহিদা কমে যাবে।

মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করা শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করে বসে থাকলে হবে না। অভিযানের পাশাপাশি Proactive, Preventive, Treatment and Rehabilitation-এর সার্বিক কার্যক্রম সমান তালে চালাতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থাকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সব পেশা ও মতের লোকদের ঐক্যবদ্ধভাবে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

পুলিশ কর্মকর্তারা কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজ নিজ এখতিয়ারভুক্ত এলাকার সব শ্রেণির লোকদের উদ্বুদ্ধ করে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনকে বেগবান করতে পারেন। তাঁরা নিজেরাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ফোরামে গিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণমূলক বক্তব্য দিতে পারেন। আলেম-উলামাদেরও মাদকের বিরুদ্ধে মসজিদ, ওয়াজ মাহফিল বা কোনো সমাবেশে কোরআন-হাদিসের আলোকে বক্তব্য দিতে হবে।

লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ

এই বিভাগের আরো সংবাদ