আজকের শিরোনাম :

বিএনপির জামায়াত বাধ্যবাধকতা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:৫৩

রাজনীতি সরলরেখায় চলে না। কিন্তু কোন কোন দল কোন কোন ইস্যুতে সরলরেখায় চলে, যেমন জামায়াত প্রশ্নে বিএনপি। এই একটি জায়গায় কোন বক্র পথে নাই বিএনপি, যত সমালোচনা হোক, যত প্রশ্নের মুখেই পড়ুক তার রাজনীতি- জামায়াতকে তার লাগবেই। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবার, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া মানুষ, এদেশের উদারপন্থী সাধারণ মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের কোন মূল্য নেই বিএনপির কাছে, যদি সেই রক্তক্ষরণের কারণ হয় জামায়াত।

কিন্তু এই প্রসঙ্গটি বারবার আসবে এবং সাম্প্রতিক সময়ে আরও বড় প্রাসঙ্গিক হয়েছে কারণ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন স্বয়ং এই প্রসঙ্গ তুলেছেন। সরকারের চাপ, জালিয়াতি ইত্যাদি নানা অভিযোগ আসছে নির্বাচন নিয়ে। শুধু এমন অভিযোগ নাকি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলকে একটি ভিন্নভাবে পড়বেন বিএনপি নেতারা?

২০০১-এ ক্ষমতায় এসে যা যা করেছিল, ধর্ষণের উৎসব থেকে বড় বড় দুর্নীতি এবং গ্রেনেডের উৎসব, সব ক্ষেত্রেই দলটি এক সংকট হতে পরবর্তী সংকটে যাত্রা করেছে কেবল। সমাজের সর্বস্তরে বিপুল সমালোচনা শুনতে হয়েছে দুটো বিষয়ে। এক তারেক রহমানের রাজনীতি আর দ্বিতীয় হলো জামায়াতের সাথে দলের সখ্য।

তবে আমরা যাই বলিনা কেন, বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া বা তার ছেলে তারেক রহমানের জামায়াত কেন্দ্রিক মনোবল নিশ্চয়ই অন্যরকম। ড. কামাল হোসেনরা নির্বাচনের পর যে ভঙ্গিতে জামায়াত-কে ছেঁটে ফেলার কথা বলছেন তা যে সম্ভব নয় তা বিএনপি ও তার ২০ দলের প্রতিক্রিয়া থেকেই বোঝা যায়। বরং ২০ দল এখন কি করে ঐক্যফ্রন্টকে ছুঁড়ে মারে সেটা দেখার অপেক্ষায়।

জামায়াত সব নির্বাচনেই একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের ভোট পায়। তাকে সাথে না রাখলে ভোটগুলো কোথায় যায় সেই প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া কঠিন। জামায়াতকে ছেড়ে ফেলার পথে এই ভাবনাই বৃহত্তম বাধা। বিএনপি সেই বাধার হিসাব করছে সবসময়।


নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরামসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে জোট গড়তে দেরি করে মূলত জামায়াতের কারণে। একপর্যায়ে ২০ দলীয় জোটের বাইরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গড়া হলেও জামায়াত নেতাদের ধানের শীষ প্রতীক দিয়ে আসন ছাড় দেওয়ায় নির্বাচনের পর অসন্তোষ পকাশ করেছেন ড. কামাল হোসেন।

জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে বিএনপির ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন বলেও গত শনিবার জানিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের এই শীর্ষ নেতা। বিএনপির মধ্যম সারির অনেক নেতাও এখন মনে করছেন, জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকায় বিএনপি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মতে, জামায়াতকে জোট থেকে বের করে দেওয়া উচিত। তবে জামায়াতকে দূরে ঠেলে দিতে চাইছে না বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।

নির্বাচনের পরে ড. কামাল একথা বলছেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে প্রায় সব রাজনৈতিক বিশ্লষণে বলা হয়েছিল জামায়াতকে সাথে রেখে, ধানের শীষ প্রতীক দিয়ে প্রকারান্তরে গণফোরামসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলগুলোকে পরাজিত করেছে বিএনপি। তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এখন বলছেন, ‘জামায়াতকে নিয়ে আমরা রাজনীতি কখনো করিনি, কোনো দিন রাজনীতি করার কথা চিন্তাও করিনি। যেটা বলা হয়েছে যে করেছি, সেটা আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছি, এটা তো আমাদের বলা হয়নি, তারা (জামায়াত) থাকবে এটার মধ্যে।

ভবিষ্যতে এ ব্যাপারটি একদম পরিষ্কার। জামায়াতকে নিয়ে আমরা রাজনীতি করব না।’ তিনি আরো বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে অতীতে যেটা হয়েছে, সেটা অনিচ্ছাকৃত ভুল। তারা যে ধানের শীষে জামায়াতের ২২ জনকে মনোনয়ন দেবে, সেটা আমরা জানতাম না।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতৃত্ব কি ভাবছে সেটা সবার জানা। অর্থাৎ জামায়াতকে তাদের লাগবেই। কিন্তু আমাদের সাথে নানা স্থানে নানা স্তরের বিএনপি নেতৃত্বের দেখা হয়, তারা প্রায় সকলেই বলে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির আদর্শগত কোনো মিল নেই বলে যে কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, তার প্রমাণ দিতে হবে। আর আদর্শগত মিল না থাকলে সেই জোট নির্বাচনেও কোন প্রভাব রাখেনা। বরং এতে জামায়াতের লাভ হয় বেশি, কারণ জামায়াত বিএনপির মতো একটি বড় প্লাটফর্মকে ব্যবহার করার সুযোগ পায়। একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, স্বাধীনতাবিরোধী দলটিকে জোটে রাখতে চায় না বিএনপির বড় একটি অংশই।

বিএনপি বুদ্ধিজিবী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বহুবার বলেছেন, ‘জামায়াতের উচিত তাদের পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের জন্য জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া’। তিনি আরো বলেন, ‘একটি জিনিস প্রমাণিত, ভোটের বাজারে জামায়াতকে দিয়ে বিএনপি কোনো লাভবান হয়নি’।

বিএনপি হয়তো আরেকটি কাজ করবে। জামায়াত ছাড়বে না তবে ‘সাইড লাইনে’ বসিয়ে রেখে রাজনীতি করার চেষ্টা করবে। অর্থাৎ তারা ২০ দলীয় জোটেও থাকবে না আবার তাদের বাদও দেওয়া হবে না— এমন একটি পন্থা অবলম্বন করতে চাইবে বিএনপি।

বিএনপি নেতারা একটি কথা সবসময় বলেন, জামায়াতকে আওয়ামী লীগ কেন নিষিদ্ধ করেনা? এটি একটু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন। কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন উঠে – আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচার করবে, আওয়ামী লীগকেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে, বিএনপি শুধু জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে পারবে না?

জামায়াত প্রশ্নে কি সিদ্ধান্ত আসে সেটা জানতে সময় লাগবে। রাজনীতির বাধ্যবাধকতা থেকে কোন কাজটি বিএনপি করবে, কোন প্রশ্নগুলোকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়ে বিচার করলে নতুন পথের সন্ধান পাবে সেটা তারাই বিবেচনা করুক। শুধু এটুকু বলা যায় সর্বোচ্চ থেকে একেবারে নিচু তলা, দলের সব স্তরের স্বার্থ এক সরলরেখায় না পড়লে দল পরিচালনা করা কঠিন কাজ।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এই বিভাগের আরো সংবাদ