বিএনপি-ঐক্যজোটের পরাজয় ও একটি বিশ্লেষণ
মুহাম্মদ শামসুল হক
০৮ জানুয়ারি ২০১৯, ১৩:০৬ | অনলাইন সংস্করণ
ব্যাপক আলোচনা ও আশা-নিরাশার দোলাচল পেরিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বহুল প্রত্যাশিত অংশগ্রহণমূলক একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও কিছু সহিংস ঘটনার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন এ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। আর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করছে এটা বলাই বাহুল্য। ইতিমধ্যে সংসদ সদস্যরা শপথও নিয়েছেন। যদিও বিএনপির পাঁচ সদস্য শপথ গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছেন।
বিএনপির দাবি সরকার ও প্রশাসন যৌথভাবে ভোট কারচুপির মাধ্যমে তাঁদের প্রার্থীদের হারিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের আগে তারা দাবি করেছিল সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ২০-৩০টির বেশি আসনে জয়ী হতে পারবে না। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক মহল এবং প্রভাবশালী দেশগুলো এই নির্বাচনের ফলাফলকে ইতিবাচক হিসেবে অভিমত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
এই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত-ঐক্যফ্রন্ট কেন হারল এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট কেন আকাশ-পাতাল ব্যবধানে বিজয়ী হলো- এ নিয়ে গত কদিন ধরেই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে, আরও আলোচনা চলবে।
এসব আলোচনা ও বিশ্লেষণে বিএনপি-জামায়াত-ঐক্যফ্রন্ট জোটের পরাজয় এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জয়ের পেছনে যেসব কারণে চিহ্নিত করা হয়েছে মোটাদাগে তার সার সংক্ষেপ এরকম- যেমন বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব নিয়ে ধোঁয়াশা অর্থাৎ যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। জোটে জামায়াতের অবস্থান নিয়ে লুকোচুরি। নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে বিভ্রান্তি। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অদক্ষতা এবং প্রার্থী মনোনয়নে অদূরদর্শিতা।
অধিকাংশ বিশ্লেষকের মতে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শোচনীয় পরাজয়ের অন্যতম কারণ দলীয় বা জোটের নেতৃত্ব নিয়ে ধোঁয়াশা। দলের হাল ধরে সুশৃঙ্খলভাবে দল পরিচালনার মতো যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব বিএনপির মধ্যে অনেক দিন ধরে লক্ষ্যণীয়। দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হয়ে কারাভোগ করছেন। অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে প্রায় এক দশক ধরে লন্ডনে পলাতক হিসেবে অবস্থান করছেন। দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন তিনি। ওই হামলায় শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও ৪ শতাধিক নারী পুরুষ আহত হন। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপির মূল নেতৃত্বের সাথে অন্য নেতাদের সরাসরি যোগাযোগ নেই বললে চলে। বলা যায় সভাপতির পরিবর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো নেতা বর্তমানে বিএনপির নেই। দলের ভাইস চেয়ারম্যান কিংবা স্থায়ী কমিটির যেসব নেতা রয়েছেন তাঁরা কিংবা তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের আগেও ছিল না এখনো নেই। ফলে বিভিন্ন সময় আন্দোলন পরিচালনা, দলের সাংগঠনিক কাঠামো বিন্যাস, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রার্থী মনোনয়ন থেকে শুরু করে নির্বাচন পরিচালনার কৌশল নির্ধারণ- সবকিছুই চলেছে অগোছালো ও সমন্বয়হীনভাবে। জয়ী হলে খালেদা জিয়া বা তারেকবিহীন বিএনপির নেতা কে হবেন এ প্রশ্নের উত্তর বিএনপি নেতাদের ছিল না। এ অবস্থায় গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ২০ দলীয় জোটের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন মির্জা ফখরুলসহ দলের কোনো কোনো নেতা। ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে পরিচিত হলেও রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি যে ঢাল-তলোয়ারবিহীন সর্দার তার প্রমাণ মিলেছে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের নামে প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া চলাকালে। দুর্বল ডালে সত্তয়ার হলে ডাল ভেঙে সওয়ারী কীভাবে আছড়ে পড়ে কোমড় ভাঙে, তার প্রমাণ এ নির্বাচনে সংগঠনহীন গণফোরাম বা ঐক্যফ্রন্টের কাঁধে চড়ে বিএনপি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
বিএনপি জোটের ভরাডুবির আর এক কারণ জামায়াতকে নিয়ে লুকোচুরি। স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য দলটি দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাদের অনেক নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়েছেন। দলটি ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও হারিয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে আসার সম্ভাবনা দেখে অনেকে ভেবেছিলেন এবং পরামর্শও দিয়েছিলেন, দলটি যেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ে। তখন মির্জা ফখরুল ইসলামসহ দলের নেতারা এমন ভাব দেখিয়েছিলেন, তারা আন্দোলনের কৌশলগত সঙ্গী হিসেবে জামায়াতকে দেখলেও তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোট হবে না। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট জামায়াতকে সঙ্গে না রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ড. কামাল হোসেনও প্রথম দিকে জামায়াত সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে বলেছিলেন তাঁদের সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধীদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৃশ্যত জামায়াত প্রশ্নে এবং ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধের জেরে যুক্তফ্রন্ট বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গ ছাড়ল। অন্যদিকে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় এলে বিএনপি রাখঢাক না করে জামায়াতের ২৫-২৬ জন নেতাকে ধানের শীষে মনোনয়ন দিল যাদের মধ্যে রয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ছেলে ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ও দণ্ডিত এক খুনি মেজর (অব.) খারুজ্জামানের মেয়ে রিটা রহমান। দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ পেশাজীবীদের একটা অংশ যারা রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত নন তারা মনে করেন জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গ ছাড়লে তরুণ প্রজন্মসহ সমাজের দল নিরপেক্ষ অনেক ভোটার যারা নানা কারণে আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন না তারা বিকল্প হিসেবে ঐক্যফ্রন্ট-বিএনপিকে বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বিএনপি তাদের লণ্ডনে অবস্থানরত দণ্ডিত নেতা তারেক রহমানের অদূরদর্শি আদেশের কাছে নতি স্বীকার করে জামায়াতসহ অবাঞ্ছিত লোকদের মনোনয়ন দিয়ে নুতন প্রজন্মসহ অনেক সাধারণ ভোটারের বিরাগভাজন হয়। ভোটের দুতিন দিন আগে ড. কামাল হোসেন ‘জামায়াত মনোনয়ন পাবে জানলে আমি ওদের সঙ্গে থাকতাম না’ বলে যে কথা বলেছেন, তার সঙ্গে একমত হয়ে দুদোল্যমান অনেকে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকেননি, যদিও কামাল হোসেন অদৃশ্য কারণে থেকে গেছেন।
বিএনপির নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকা-না থাকা নিয়েও ছিল ধোয়াশাচ্ছন্ন কথাবার্তা। মির্জা ফখরুল ড. কামাল হোসেন, আসম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নারা ভোটের ফল না গুনে ঘরে না ফেরা এবং কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার জন্য কর্মীসহ জনগণের প্রতি আহ্বান জানালেও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, বরকত উল্লাহ বুলুসহ অন্য কয়েকজনের কথাবার্তায় ছিল নির্বাচন বর্জনের সূর। ভোটের আগের দিন বা ভোটের দিন মধ্যরাতে অঘটন ঘটিয়ে যে কোনো অজুহাতে নির্বাচন বয়কট করে সরকারি দলকে শেষ মুহূর্তে বেকায়দায় ফেলা ছিল তাঁদের লক্ষ্য। ফলে মির্জা ফখরুল বা ড. কামাল হোসেনরা ভোট কেন্দ্র পাহারা দিয়ে ফল নিয়ে ফেরার জন্য কর্মীদের আহবান জানালেও নেতা-কর্মীদের বড় অংশ ভোট আদৌ হবে কী না-এনিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে ভোট হবে না মনে করে প্রচার-প্রচারণায় এমনকি ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারেও গা ছাড়া ভাব দেখায়। ভোটের দিন সকাল ৮-৯টা থেকে বিভিন্ন এলাকার প্রার্থীরা কেন্দ্রে ভোটার নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কর্মীদের উৎসাহিত করার চেষ্টা না করে ভোট বর্জনের দিকে পা বাড়ায়। ফলে বিএনপি সমর্থিত অনেক ভোটার ভোটকেন্দ্রের দিকে যাওয়া কিংবা ভোটে কারচুপির বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করার ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
যে কোনো আন্দোলন কিংবা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও সফলতা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত নেতার পাশাপাশি সাংগঠনিক শক্তি। কিন্তু বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল সাংঘাতিকভাবে হতাশাজনক। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটি দীর্ঘ সময় ধরে হরতাল অবরোধ ও জ্বালাও- পোড়াওসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে ব্যাপকভাবে শক্তিক্ষয় করেছে। দলের অন্যতম প্রাণশক্তি ছাত্রদল-যুবদলও হয়ে পড়ে ছত্রভঙ্গ অবস্থায়। পরবর্তী সময়েও পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। প্রতিবছর একাধিকবার দল গোছানো, এলাকাভিত্তিক কমিটি পুনর্গঠন এবং দল গুছিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে বলা হলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বিভিন্ন দাবিতে একের পর এক আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হলেও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে নেতা-কর্মীদের রাজপথে সক্রিয় তৎপরতা দেখা যায়নি।
বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট জোটের অপ্রত্যাশিত ভরাডুবির আর এক কারণ প্রার্থী মনোনয়নে অদূরদর্শিতা। আওয়ামী লীগ সেখানে ভোটের চার থেকে ছয় মাস আগে থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক করে মাঠের প্রস্তুতি শুরু করে সেখানে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে সময় ব্যয় করেছে। যদিও তারা শুরু থেকে জানত যে, সরকার তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের কোনো দাবি মানবে না। বিদ্যমান পদ্ধতিতে এ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যেতে হবে। বরং তারা ওই ইস্যুতে আন্দোলনের সময়টুকু বিভিন্ন জেলা উপজেলা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে যাছাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক করে মাঠ পর্যায়ে ভোটারদের সঙ্গে মেলামশায় মনোনিবেশ করলে ভাল করতো। তারা পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া শেষ মুহূর্তে এসে ভোটে লড়ার ঘোষণা দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, জনসম্পৃক্ততাহীন, এমনকি মাঠ-পর্যায়ে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে থাকা এবং নানা রকম মামলায় জড়ানো ব্যক্তিদেরই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনোনয়ন দিয়েছে। তাও আবার একেক আসনে ৩ থেকে ৫-৬ জন পর্যন্ত। ভোটের এক সপ্তাহ আগেও কোন আসনে কোন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে লড়বেন এ নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝেও অস্থিরতা ছিল। এভাবে অপরিকল্পিত ও হ য ব র ল মনোনয়নের কারণে চারদিকে বিক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছিল নেতা-কর্মীদের মধ্যে। ঐক্যফ্রন্ট ও জামায়াতের কাছে আসন ছাড়ার বিষয়টিও অনেকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে মাঠ পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মনে যে ক্ষোভ, হতাশা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয় তাতে তারা প্রতিপক্ষের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রচার-প্রচারণায় শক্ত অবস্থান নিতে চাননি।
বিএনপি বরাবর দাবি করেছে, তাদের নেতা-কর্মীদের মাঠে নামতে দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন। হামলা-মামলা দিয়ে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু প্রকৃত রাজনৈতিক নেতাদের জানা থাকার কথা যে, আমাদের দেশে রাজনীতিতে হামলা-মামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন নতুন কোনো বিষয় নয়। ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে না দেওয়ার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগের হাজারো নেতা-কর্মী সমর্থকের বিরুদ্ধে অজস্র মামলা-হামলা, জেল জুলুম ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি নির্বাচনেই বিরোধী দলকে হারানোর কৌশল ক্ষমতাবানরা যার যার সাধ্যানুযায়ী করেছে। এসব হামলা-মামলা-জেল-জুলুম মাথা পেতে নিয়ে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ সামনের দিকে এগিয়েছে। বিভিন্ন সরকারের নেয়া কৌশল ও পদক্ষেপ থেকে শিক্ষা নিয়েই নিজেদের কৌশল ঠিক করে দলকে তৃণমূল পর্যায়ে দাঁড় করিয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বিএনপির দৃশ্যত যথেষ্ট কর্মী-সমর্থক থাকা সত্ত্বেও তাদের সময়োপযোগী রাজনীতির ধারা থেকে দূরে থাকা এবং তৃণমূল পর্যায়ে দল গোছানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা অস্বীকার করার উপায় নেই। সর্বোপরি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী অভিজ্ঞ নেতাদের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছে বিএনপি ও তার স্বাধীনতা বিরোধী মিত্ররা। (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া) লেখক : সম্পাদক, ইতিহাসের খসড়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী।
বিএনপির দাবি সরকার ও প্রশাসন যৌথভাবে ভোট কারচুপির মাধ্যমে তাঁদের প্রার্থীদের হারিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের আগে তারা দাবি করেছিল সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ২০-৩০টির বেশি আসনে জয়ী হতে পারবে না। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক মহল এবং প্রভাবশালী দেশগুলো এই নির্বাচনের ফলাফলকে ইতিবাচক হিসেবে অভিমত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে।
এই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত-ঐক্যফ্রন্ট কেন হারল এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট কেন আকাশ-পাতাল ব্যবধানে বিজয়ী হলো- এ নিয়ে গত কদিন ধরেই প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে, আরও আলোচনা চলবে।
এসব আলোচনা ও বিশ্লেষণে বিএনপি-জামায়াত-ঐক্যফ্রন্ট জোটের পরাজয় এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জয়ের পেছনে যেসব কারণে চিহ্নিত করা হয়েছে মোটাদাগে তার সার সংক্ষেপ এরকম- যেমন বিএনপি বা ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব নিয়ে ধোঁয়াশা অর্থাৎ যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। জোটে জামায়াতের অবস্থান নিয়ে লুকোচুরি। নির্বাচনে থাকা না থাকা নিয়ে বিভ্রান্তি। সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অদক্ষতা এবং প্রার্থী মনোনয়নে অদূরদর্শিতা।
অধিকাংশ বিশ্লেষকের মতে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শোচনীয় পরাজয়ের অন্যতম কারণ দলীয় বা জোটের নেতৃত্ব নিয়ে ধোঁয়াশা। দলের হাল ধরে সুশৃঙ্খলভাবে দল পরিচালনার মতো যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব বিএনপির মধ্যে অনেক দিন ধরে লক্ষ্যণীয়। দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে দণ্ডিত হয়ে কারাভোগ করছেন। অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে প্রায় এক দশক ধরে লন্ডনে পলাতক হিসেবে অবস্থান করছেন। দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন তিনি। ওই হামলায় শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও ৪ শতাধিক নারী পুরুষ আহত হন। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপির মূল নেতৃত্বের সাথে অন্য নেতাদের সরাসরি যোগাযোগ নেই বললে চলে। বলা যায় সভাপতির পরিবর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো নেতা বর্তমানে বিএনপির নেই। দলের ভাইস চেয়ারম্যান কিংবা স্থায়ী কমিটির যেসব নেতা রয়েছেন তাঁরা কিংবা তাঁদের সঙ্গে আলাপ করে প্রয়োজনে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের আগেও ছিল না এখনো নেই। ফলে বিভিন্ন সময় আন্দোলন পরিচালনা, দলের সাংগঠনিক কাঠামো বিন্যাস, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রার্থী মনোনয়ন থেকে শুরু করে নির্বাচন পরিচালনার কৌশল নির্ধারণ- সবকিছুই চলেছে অগোছালো ও সমন্বয়হীনভাবে। জয়ী হলে খালেদা জিয়া বা তারেকবিহীন বিএনপির নেতা কে হবেন এ প্রশ্নের উত্তর বিএনপি নেতাদের ছিল না। এ অবস্থায় গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ২০ দলীয় জোটের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন মির্জা ফখরুলসহ দলের কোনো কোনো নেতা। ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে পরিচিত হলেও রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি যে ঢাল-তলোয়ারবিহীন সর্দার তার প্রমাণ মিলেছে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্টের নামে প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়া চলাকালে। দুর্বল ডালে সত্তয়ার হলে ডাল ভেঙে সওয়ারী কীভাবে আছড়ে পড়ে কোমড় ভাঙে, তার প্রমাণ এ নির্বাচনে সংগঠনহীন গণফোরাম বা ঐক্যফ্রন্টের কাঁধে চড়ে বিএনপি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
বিএনপি জোটের ভরাডুবির আর এক কারণ জামায়াতকে নিয়ে লুকোচুরি। স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য দলটি দেশে-বিদেশে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাদের অনেক নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়েছেন। দলটি ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও হারিয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপি নির্বাচনে আসার সম্ভাবনা দেখে অনেকে ভেবেছিলেন এবং পরামর্শও দিয়েছিলেন, দলটি যেন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ে। তখন মির্জা ফখরুল ইসলামসহ দলের নেতারা এমন ভাব দেখিয়েছিলেন, তারা আন্দোলনের কৌশলগত সঙ্গী হিসেবে জামায়াতকে দেখলেও তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোট হবে না। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট জামায়াতকে সঙ্গে না রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ড. কামাল হোসেনও প্রথম দিকে জামায়াত সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে বলেছিলেন তাঁদের সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধীদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৃশ্যত জামায়াত প্রশ্নে এবং ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে বিরোধের জেরে যুক্তফ্রন্ট বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গ ছাড়ল। অন্যদিকে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় এলে বিএনপি রাখঢাক না করে জামায়াতের ২৫-২৬ জন নেতাকে ধানের শীষে মনোনয়ন দিল যাদের মধ্যে রয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ছেলে ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ও দণ্ডিত এক খুনি মেজর (অব.) খারুজ্জামানের মেয়ে রিটা রহমান। দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ পেশাজীবীদের একটা অংশ যারা রাজনীতিতে সরাসরি জড়িত নন তারা মনে করেন জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গ ছাড়লে তরুণ প্রজন্মসহ সমাজের দল নিরপেক্ষ অনেক ভোটার যারা নানা কারণে আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন না তারা বিকল্প হিসেবে ঐক্যফ্রন্ট-বিএনপিকে বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বিএনপি তাদের লণ্ডনে অবস্থানরত দণ্ডিত নেতা তারেক রহমানের অদূরদর্শি আদেশের কাছে নতি স্বীকার করে জামায়াতসহ অবাঞ্ছিত লোকদের মনোনয়ন দিয়ে নুতন প্রজন্মসহ অনেক সাধারণ ভোটারের বিরাগভাজন হয়। ভোটের দুতিন দিন আগে ড. কামাল হোসেন ‘জামায়াত মনোনয়ন পাবে জানলে আমি ওদের সঙ্গে থাকতাম না’ বলে যে কথা বলেছেন, তার সঙ্গে একমত হয়ে দুদোল্যমান অনেকে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকেননি, যদিও কামাল হোসেন অদৃশ্য কারণে থেকে গেছেন।
বিএনপির নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকা-না থাকা নিয়েও ছিল ধোয়াশাচ্ছন্ন কথাবার্তা। মির্জা ফখরুল ড. কামাল হোসেন, আসম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নারা ভোটের ফল না গুনে ঘরে না ফেরা এবং কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার জন্য কর্মীসহ জনগণের প্রতি আহ্বান জানালেও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, বরকত উল্লাহ বুলুসহ অন্য কয়েকজনের কথাবার্তায় ছিল নির্বাচন বর্জনের সূর। ভোটের আগের দিন বা ভোটের দিন মধ্যরাতে অঘটন ঘটিয়ে যে কোনো অজুহাতে নির্বাচন বয়কট করে সরকারি দলকে শেষ মুহূর্তে বেকায়দায় ফেলা ছিল তাঁদের লক্ষ্য। ফলে মির্জা ফখরুল বা ড. কামাল হোসেনরা ভোট কেন্দ্র পাহারা দিয়ে ফল নিয়ে ফেরার জন্য কর্মীদের আহবান জানালেও নেতা-কর্মীদের বড় অংশ ভোট আদৌ হবে কী না-এনিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে ভোট হবে না মনে করে প্রচার-প্রচারণায় এমনকি ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারেও গা ছাড়া ভাব দেখায়। ভোটের দিন সকাল ৮-৯টা থেকে বিভিন্ন এলাকার প্রার্থীরা কেন্দ্রে ভোটার নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কর্মীদের উৎসাহিত করার চেষ্টা না করে ভোট বর্জনের দিকে পা বাড়ায়। ফলে বিএনপি সমর্থিত অনেক ভোটার ভোটকেন্দ্রের দিকে যাওয়া কিংবা ভোটে কারচুপির বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করার ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
যে কোনো আন্দোলন কিংবা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও সফলতা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত নেতার পাশাপাশি সাংগঠনিক শক্তি। কিন্তু বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল সাংঘাতিকভাবে হতাশাজনক। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলটি দীর্ঘ সময় ধরে হরতাল অবরোধ ও জ্বালাও- পোড়াওসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে ব্যাপকভাবে শক্তিক্ষয় করেছে। দলের অন্যতম প্রাণশক্তি ছাত্রদল-যুবদলও হয়ে পড়ে ছত্রভঙ্গ অবস্থায়। পরবর্তী সময়েও পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। প্রতিবছর একাধিকবার দল গোছানো, এলাকাভিত্তিক কমিটি পুনর্গঠন এবং দল গুছিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে বলা হলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বিভিন্ন দাবিতে একের পর এক আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হলেও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে নেতা-কর্মীদের রাজপথে সক্রিয় তৎপরতা দেখা যায়নি।
বিএনপি-ঐক্যফ্রন্ট জোটের অপ্রত্যাশিত ভরাডুবির আর এক কারণ প্রার্থী মনোনয়নে অদূরদর্শিতা। আওয়ামী লীগ সেখানে ভোটের চার থেকে ছয় মাস আগে থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক করে মাঠের প্রস্তুতি শুরু করে সেখানে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনে সময় ব্যয় করেছে। যদিও তারা শুরু থেকে জানত যে, সরকার তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের কোনো দাবি মানবে না। বিদ্যমান পদ্ধতিতে এ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যেতে হবে। বরং তারা ওই ইস্যুতে আন্দোলনের সময়টুকু বিভিন্ন জেলা উপজেলা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে যাছাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থী ঠিক করে মাঠ পর্যায়ে ভোটারদের সঙ্গে মেলামশায় মনোনিবেশ করলে ভাল করতো। তারা পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া শেষ মুহূর্তে এসে ভোটে লড়ার ঘোষণা দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, জনসম্পৃক্ততাহীন, এমনকি মাঠ-পর্যায়ে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে থাকা এবং নানা রকম মামলায় জড়ানো ব্যক্তিদেরই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনোনয়ন দিয়েছে। তাও আবার একেক আসনে ৩ থেকে ৫-৬ জন পর্যন্ত। ভোটের এক সপ্তাহ আগেও কোন আসনে কোন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে লড়বেন এ নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝেও অস্থিরতা ছিল। এভাবে অপরিকল্পিত ও হ য ব র ল মনোনয়নের কারণে চারদিকে বিক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছিল নেতা-কর্মীদের মধ্যে। ঐক্যফ্রন্ট ও জামায়াতের কাছে আসন ছাড়ার বিষয়টিও অনেকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে মাঠ পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মনে যে ক্ষোভ, হতাশা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয় তাতে তারা প্রতিপক্ষের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রচার-প্রচারণায় শক্ত অবস্থান নিতে চাননি।
বিএনপি বরাবর দাবি করেছে, তাদের নেতা-কর্মীদের মাঠে নামতে দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন। হামলা-মামলা দিয়ে নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু প্রকৃত রাজনৈতিক নেতাদের জানা থাকার কথা যে, আমাদের দেশে রাজনীতিতে হামলা-মামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন নতুন কোনো বিষয় নয়। ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে না দেওয়ার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগের হাজারো নেতা-কর্মী সমর্থকের বিরুদ্ধে অজস্র মামলা-হামলা, জেল জুলুম ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি নির্বাচনেই বিরোধী দলকে হারানোর কৌশল ক্ষমতাবানরা যার যার সাধ্যানুযায়ী করেছে। এসব হামলা-মামলা-জেল-জুলুম মাথা পেতে নিয়ে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে আওয়ামী লীগ সামনের দিকে এগিয়েছে। বিভিন্ন সরকারের নেয়া কৌশল ও পদক্ষেপ থেকে শিক্ষা নিয়েই নিজেদের কৌশল ঠিক করে দলকে তৃণমূল পর্যায়ে দাঁড় করিয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। বিএনপির দৃশ্যত যথেষ্ট কর্মী-সমর্থক থাকা সত্ত্বেও তাদের সময়োপযোগী রাজনীতির ধারা থেকে দূরে থাকা এবং তৃণমূল পর্যায়ে দল গোছানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা অস্বীকার করার উপায় নেই। সর্বোপরি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী অভিজ্ঞ নেতাদের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাজিত হয়েছে বিএনপি ও তার স্বাধীনতা বিরোধী মিত্ররা। (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া) লেখক : সম্পাদক, ইতিহাসের খসড়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী।
এই বিভাগের আরো সংবাদ