আজকের শিরোনাম :

নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমি কি অসৎ? আমি কি অহংকারী?

  ফজলুল হক

০৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১৫:৪২ | অনলাইন সংস্করণ

“সততা”- ছোটকালে পরিবারে মুরুব্বীদের কাছ থেকে শিখেছি। স্কুলে শিক্ষকদের কাছে শিখেছি। সে “শিক্ষা” জীবনে চলার পথে পাথেয় হয়েছে। আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন সহজ সরল। উনারা ছিলেন সৎ এবং সম্মানিত। আমার বাবা অসৎ পথে পা দিতে ভয় পেতেন। বলতেন, আল্লাহপাক, কিয়ামতের দিন র্জরা র্জরা হিসাব নিবেন। আমার এক ক্লাসমেট আছে, একটি ব্যবসায়িক সংস্থার অবসর প্রাপ্ত চিফ একাউন্টেন্ট। আমার ক্লাসমেট (২৭ ডিসেম্বর ১৮) আমাকে ফোন করে, সে বলে, ফজলুল হক, আমার বাসায় আসতে পারবে? তার সংস্থা হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে। আমার এক আত্মীয় ওই সংস্থায় তার অধীনে কাজ করত। ছোট চাকরি। তার চাকরি চলে গেছে। আমার সে আত্মীয় এখন শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক। বাড়ি গাড়ি করেছে। আমার ক্লাসমেট এতবড় চাকুরী থেকে অবসর নেয়ার পর একটি সাদামাটা ভাড়ার ঘরে দীনহীন পরিবেশে থাকে। সে একজন চাটার্ড একাউন্টেন্ট। তার বাবা পরহেজগার সৎ মানুষ ছিলেন। শ্বশুর ছিলেন বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এখন পর্যাপ্ত টাকার দরকার হয়। মানুষ হালাল হারাম দেখেনা। আমার ক্লাসমেট আমাকে বল্ল, “আমি তো অসৎ পথে যাইনি। আমি গরীব তাই আমি অবাঞ্চিত এবং অপাংক্তেয়।” তো, তুমি অসৎ পথে যাওনি কেন? হারামের টাকা ঘরে আননি কেন? যাওনি যখন, এখন আফসোস করছ কেন? আমরা পরিবারের কাছ থেকে “কোড অফ কন্ডাক্ট,” “কোড অফ এথিকস” পেয়েছি। আমাদের স্কুল আমাদের দিয়েছে “অনার কোড।” আমরা তার বাইরে যাইনি। আমার যত সম্পদ থাক, হুকুম হওয়ার সাথে সাথে আজরাইল পাকড়াও করবে। তাকে ম্যানেজ করা যায়না। সবাই মিলে আমাকে সাড়ে তিন হাত কবরে শুইয়ে দিয়ে আসবে। আমি অসৎ পথে হারাম সম্পদ উপার্জন করলে, তা ওয়ারিশগন ভাগ বন্টন করে নিবে। আমি যদি ৫০০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ উপার্জন করতাম, সে সম্পদ কি কবরে নিতে পারতাম? কবর বড় অন্ধকার। আমি কবরে সততার আলো নিয়ে যেতে চাই। ইবাদতের চাদর নিয়ে যেতে চাই, কবরে ঠান্ডা বেশী। টাকা সেখানে অচল। তুমি অবৈধ সম্পদ উপার্জন করনি, তাতে কি হয়েছে? আমি কোটি টাকার মালিক নই, তাতে কি হয়েছে? পরিবারের কেউ কেউ আমাদেরকে আন্ স্মার্ট মনে করে, দাদা বাড়ি মামা বাড়ী, শ্বশুর বাড়ীর কেউ কেউ এভয়েড করে, আনফিট মনে করে, তাতে কি হয়েছে? চিফ একাউন্টেন্টের পিয়ন- দুইটা ফ্ল্যাটের মালিক, আত্মীয় স্বজন অবাক হয়, কিরে বাবা, সোনার খনি থেকে বের হয়ে এলো, হাতে দুচার খন্ড স্বর্ণ দেখিনা- কেন? একাউন্টেন্ট সাহেবের দামী গাড়ি নাই কেন? দু চারটা প্লট নাই কেন? কে কি বলে, কে কি ভাবছে, তাতে আমার কোন মাথা ব্যথা নাই। আমি এসব পরোয়া করিনা। আমি আমার মত থাকব। কবরে পোকা মাকড় আছে, আমি আল্লাহ রাসুল (দ:) প্রেমের দ্যুতি নিয়ে যাব, পোকা মাকড়, সাপ বিচ্চু, কেঁচো আমার কাছে আসবেনা। অসৎ পথের সম্পদ কত বিপজ্জনক তা বুঝবে এখন নয়- সময় চলে গেলে।
আমি কারো কাছে দৈন্যতা প্রকাশ করিনা। আফসোস করিনা। আমার পাঠক পাঠিকা আমাকে সম্মান করে। আমার ছাত্রীরা আমাকে সম্মান করে। আমার ছাত্ররা আমাকে সম্মান করে। আমার সততার আলো, তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আমার কোন দুঃখবোধ নাই। দুশ্চিন্তা নাই। শুকরিয়া, আল্লাহ আমাকে কারো মোহতাজ বানান নাই। এথিকস আমাদের শক্তি। হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান। তুমি মোরে দানিয়ছ খ্রীস্টের সম্মান। এটা নয় যে, তুমি আমার অক্ষমতার প্রমাণ। আমি বিদ্রোহী রনক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত, যেদিন, ধনীর হস্ত গরীবেরে করিবেনা সর্বশান্ত। প্রমাণ আছে ভুরি ভুরি, ধনীর হস্ত করিতেছে গরীবের ধন চুরি। যে দিন চলে যাব শুন্য হাতে যাব। সে দিন আল্লাহর দেয়া সম্মান পাব। আমার আর কোন চাওয়া পাওয়া নাই।
যদি সম্মান চাও, অহংকার করোনা। অহংকার মানুষকে ছোট করে। সম্মানিত হতে চাইলে তুমি কি করবে? সম্মান অর্জন করতে হলে, বড় লোক হতে হবে তোমাকে? বড় লোক হলে মানুষকে আর্থিক ভাবে সাহায্য করা যায়। সাহায্যের বিনিময়ে সম্মান পাওয়া যায়। দান যার, মান তার। এসব ভাবছো?
আমি কাউকে গরীব হতে বলছিনা। গরীব হওয়া বাহাদুরি নয়। আমি সৎ হতে বলছি। সম্মানিত হতে চাইলে সৎ হতে হবে। সততার সাথে পথ চলতে হবে। সততাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সৎ হতে গিয়ে যদি ক্ষতিগ্রস্ত ও হতে হয়, তবুও তাই করতে হবে। এটা আমাদের দায়বদ্ধতা। তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছ কেন? অসৎ হওয়ার জন্য? শিক্ষকগণ জানেন, তারা মানুষকে সততা শেখান। সততা ও সম্মান- ভাই বোন। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ল্যাতিন শব্দ, “অনেস্টাস” এর দুইটি অর্থ হয়। সৎ এবং সম্মানিত। যিনি সৎ তিনি সম্মানিত। আল্লাহর কাছে এবং বান্দার কাছে। আখেরাতে এবং দুনিয়াতে। সৎ লোকের ইবাদত মুল্যবান।
সততার বিষয়ে একটা বক্তৃতার কথা এখানে উল্লেখ করি। এটি ইন্টারনেটে ভিডিওতে শুনেছি ২০১৮ সালের মে মাসে। বক্তা মাইকেল ব্লুমবার্গ। ইন্টারনেটে এরকম ভিডিও আপনি পাবেন। ব্লুমবার্গ মার্কিন রাজনৈতিক নেতা এবং বড় ব্যবসায়ী। রাজনীতিবিদ হলে তিনি অসৎ হবেন, বড় ব্যবসায়ী মাত্রেই অসৎ এমন কথা ভাববেন না। ব্যবসায়ী মানে ধান্দাবাজ নয়। উদ্যোক্তাদের অনেক কষ্ট করে এগুতে হয়। রাজনীতি একটি সেবা। সব রাজনীতিবিদ ক্ষমতার অপব্যবহার করেনা। রাজনৈতিক নেতা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে দেশ এগুবেনা। কেউ দেশের জন্য প্রান দেয়। কেউ দেশকে লুন্ঠন করে। একাত্তরে ত্রিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। দেশ জনগনের। জনগণের সম্পদ লুন্ঠনকারী বড় গলায় কথা বলে। দেশের সম্পদ লুন্ঠনকারী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মুখে আনলে, তার মুখ কেটে ফেলা দরকার।
মাইকেল ব্লুমবার্গ হচ্ছেন ব্লুমবার্গ এলপি নামক দৈত্যাকার আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৮ সালের ১২ মে যুক্তরাষ্ট্রের রাইস ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন বক্তা ছিলেন তিনি। ৯ ডিসেম্বর ২০১৮ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সাপ্লিমেন্টে ব্লুমবার্গের কনভোকেশন স্পীচ ছাপা হয়। আমরা আমেরিকার ইতিহাস কিছু কিছু জানি। জর্জ ওয়াশিংটন সম্পর্কে পড়েছি। উনার জীবনে একটা চেরী গাছের গল্প আছে, এটা সততার গল্প। খুব ছোট যখন ছিলেন, তখন জর্জ ওয়াশিংটন, একবার একটি চেরী গাছ কেটে ফেলেছিলেন। হয়ত ওটা ছিল উনাদের বাগানের চেরী গাছ। জর্জ ওয়াশিংটনের বাবা ভীষণ ভাবে রেগে গিয়েছিলেন। গাছটা কে কেটেছে? ছোট্ট ওয়াশিংটন বলেছিলেন, “আমি মিথ্যা কথা বলতে পারিনা। হ্যাঁ, আমিই গাছটা কেটেছি।” বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, “তোমার এই সততার দাম হাজারটা গাছের চাইতে বেশী।” এই গল্প আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করতে হচ্ছে। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র:) ছোটকালে কাফেলার সাথে যাচ্ছিলেন। ডাকাত কাফেলা লুট করছে। ছোট্ট শিশুটিকে ডাকাত তল্লাশী নেয়নি, বাচ্চার কাছে কি আর থাকবে? ছোট আবদুল কাদের জিলানী (র:) ডাকাতকে বল্লেন, আমার জামার সাথে দিরহাম সেলাই করা আছে। ডাকাত তার সর্দারকে ডেকে নিয়ে আসে। ডাকাত সর্দার বলে, বালক, তুমি আমাদেরকে না বললে, আমরা তোমার দিরহাম খুঁজে পেতামনা। আবদুল কাদের জিলানী (র:) বল্লেন, আমার মা আমাকে বলেছেন মিথ্যা না বলতে। মিথ্যা বলা পাপ। এই সত্য আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করে যাচ্ছি। আমাদের ধর্ম বলে, মিথ্যা বলা মহাপাপ।
রাইস ইউনিভার্সিটির কনভোকেশন স্পীচে ব্লুমবার্গ বলেছেন, আজই (১২ মে ১৮) আমি রাইস ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট লিব্রোনকে বলছিলাম, আমি রাইসের জন্য কিছু দান করতে চাই। শুনে লিব্রোনের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। তখন ব্লুমবার্গ বল্লেন, না আমি আর্থিক দানের কথা বলছিনা। আর্থিক দানের চাইতেও বড় দান আছে। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি গাছ দান করতে চাই। যে গাছের সামনে লেখা থাকবে “২০১৮ সালের ক্লাসের সম্মানে।” (আমরা হলে লিখতাম, ২০১৮ ব্যাচের সম্মানে) তোমরা প্রাক্তন ছাত্র হিসাবে যখন- ক্যাম্পাসে আসবে, এই গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে, আমি আশা করি, তোমাদের মনে পড়বে, কেন এই গাছটা লাগানো হয়েছে। আমাদের দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) জন্য এই গাছের কি মানে? জীবনভর যেখানে তুমি যখনই কোন চেরী গাছ কেটে ফেলবে, তুমি ভুল স্বীকার করবে। (যখনই কোন অন্যায় করবে, তা স্বীকার করে নেবে।) তাহলেই যারা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, যারা দেশ চালাচ্ছেন, তাদের কাছ থেকেও একই রকম সততা তোমরা দাবী করতে পারবে। (আচ্ছা, আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দুর্নীতি করে, এটা শুনতে কেমন লাগে? কেন তাকে ভোট দিলাম, এজন্য আমার নিজেকে জুতা পেটা করতে ইচ্ছা করে।)
আমাদের বাংলাদেশে যেটা জরুরি, সেটা হলো, সকলকে সৎ হতে হবে। বুঝতে হবে, দুর্নীতি মাদকের চাইতেও ভয়াবহ। দিলীপ কুমার পাক ভারত উপ মহাদেশে কিংবদন্তির অভিনেতা। আমি নিজে দিলীপ কুমার (ইউসুফ খান) এর ভক্ত। উনার এক একটি সিনেমা ২০/২৫ বার দেখেছি। (সিইউ ফ্রেন্ডস পেজ থেকে নেয়া, একটি গল্প, রাবেয়া বসরীর পোস্ট থেকে, উনি বলেছেন এটা সংগৃহীত)। উনার আত্মজীবনীতে দিলীপ কুমার বলেছেন, আমি প্লেনে অন্য শহরে যাচ্ছিলাম। শুটিং ছিল। তখন আমি ক্যারিয়ারের তুংগে। আমার পাশে যে যাত্রী বসেছিল, তার পরনে সাধারণ শার্ট প্যান্ট। অতি সাধারণ ভদ্রলোক বলে মনে হয়। শিক্ষিত মার্জিত মধ্যবিত্ত হয়ত হবে। আশে পাশে অন্য যাত্রীরা দিলীপ কুমারকে চিনতে পেরে, উৎসাহিত হয়ে অটোগ্রাফ নিচ্ছিল। কিন্তু পাশে বসা ভদ্রলোক এব্যাপারে নির্লিপ্ত, ভ্রূক্ষেপ নাই। উনি এক মনে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। কি যেন ভাবেন। ফ্লাইটে চা পরিবেশন করা হয়। তিনি এয়ার হোস্টেসকে বিনম্র ধন্যবাদ দিয়ে বিনয়ের সাথে চা নেন। দিলীপ কুমার লিখেছেন, আমার ব্যাপারে তার নির্মোহ ভাব আমাকে কৌতূহলী করে তুলল। তার সাথে কথা বলার জন্য আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তিনি সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বল্লেন, হ্যালো? সৌজন্যমূলক কথাবার্তা শুরু হলো। দিলীপ কুমার সিনেমার প্রসংগ তুললেন। দিলীপ কুমার বল্লেন, সিনেমা দেখেন? তিনি বল্লেন, কখনো সখনো। শেষ সিনেমা দেখেছি, এক বছরের বেশি হলো। দিলীপ বল্লেন, আমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করি। তিনি বল্লেন, সিনেমায় আপনি কি করেন? দিলীপ বল্লেন, আমি একজন অভিনেতা। তিনি বল্লেন, চমৎকার। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। প্লেন ল্যান্ড করলো। দিলীপ হাত বাড়িয়ে দিলেন, বল্লেন, আমি দিলীপ কুমার। উনি মাথা নত করে আমার হাত ঝাঁকিয়ে বল্লেন, আপনার সাথে পরিচয় হয়ে দারুণ ভাল লাগল। আমার নাম জে আর ডি টাটা। আমি চমকে উঠলাম। বিশ্বের সেরা শিল্পপতির পাশে এতক্ষণ বসেছিলাম আমি। সারা দুনিয়া টাটা শিল্প গ্রুপকে চেনে।
যদি অহংকার করি, কিছুই করতে পারবোনা। যদি সৎ না হই, সম্মান পাবো না। যদি সবাই দুর্নীতি করি দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। একজন অসৎ লোক কেবল দেশের ক্ষতিই করে। আয়নায় নিজের চেহারা দেখেন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, আমি কি অসৎ? অহংকারী? আমি ধান্দাবাজ? (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া)

লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ