আজকের শিরোনাম :

আওয়ামী লীগ জিতলো না বিএনপি হারলো?

  আমীন আল রশীদ

০১ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:০৪ | আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০১৯, ১৮:২৪ | অনলাইন সংস্করণ

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ভোটের ফলাফল কী হতো বা দেশের প্রধান দুটি দলের আসন ও ভোট প্রাপ্তির ব্যবধান কী হতো তা নিয়ে এখন আর আলোচনা করে লাভ নেই। কারণ ভোটের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে এবং বিএনপির মতো একটি বড় দল মাত্র ৫টি আসনে জিতেছে, এটিই বাস্তবতা। প্রশ্ন হলো এবারের নির্বাচনে বিএনপি ও তার জোটের ভয়াবহ ‘পরাজয়ের’ পেছনে কেবল আওয়ামী লীগের নির্বাচনি কৌশলই কি মূল ভূমিকা রেখেছে নাকি তার বিরোধীদের বিবিধ ‘ভুল’ এবং মানুষের উন্নয়নস্পৃহা বা উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখার প্রতি সমর্থনও এক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে?

 

নেতৃত্বের ধোঁয়াশা
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে বিএনপির নেতৃত্ব কে দেবেন বা কে দিচ্ছেন, তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত ধোঁয়াশাই ছিল। বিশেষ করে ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পরে এই ধোঁয়াশা আরও তীব্র হয়। কেননা, ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে ড. কামাল থাকলেও তার দল গণফোরামের কোনো গণভিত্তি নেই। বরং এই জোটের চারটি দলের (বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জেএসডি) মধ্যে একমাত্র বিএনপিই বড় দল এবং তাদের একাধিকবার ক্ষমতায় ও বিরোধী দলে থাকার অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু ড. কামালকে সামনে রেখে এগোনোর ফলে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যেও এ নিয়ে সংশয় ছিল যে, তাহলে বিএনপি কি এখন সাবেক আওয়ামী লীগ নেতার কথায় চলছে?

দ্বিতীয়ত, ঐকফ্রন্ট নির্বাচনে জিতলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন? সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর? যেহেতু ড. কামাল নির্বাচনে অংশ নেননি, তাহলে তিনি কি রাষ্ট্রপতি হবেন? বিএনপি ভোটে জিতলে নিশ্চয়ই দ্রুততম সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত এবং তারেক রহমান দেশে ফিরে আসতেন। তখন কি মির্জা ফখরুলকে সরিয়ে খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করা হতো? তারেক রহমানের অবস্থান কী হতো? আর এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে করতে যে মাস ছয়েক সময় লাগতো, সেই সময়ে দেশটা কীভাবে চলতো? এসব কিছু নিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই, বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যেও দোটানা ছিল। অর্থাৎ বিএনপি তার এই নেতৃত্বের ধোঁয়াশাই কাটাতে পারেনি।   

অনেকেই এটি মনে করেন যে, এবারও যদি ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, কাদের সিদ্দিকী বা আ স ম আব্দুর রবকে সাথে না নিয়ে এককভাবে মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে বিএনপি সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করত এবং নির্বাচনে অংশ নিতো, যদি বিতর্কিত জামায়াতের ইসলামির ২২ জনকে প্রার্থী না দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জামায়াত ত্যাগের ঘোষণা দিতে পারতো, তাহলে বিএনপি অন্তত ৫টি আসন পেত না। তারেক ও জামায়াত ইস্যু না থাকলে সরকারও হয়তো এত হার্ডলাইনে থাকত না।

তারেক রহমানের প্রতি মানুষের ওই অর্থে কোনো সহানুভূতি না থাকলেও ব্যক্তি খালেদা জিয়ার প্রতি অসংখ্য মানুষের সংবেদনশীলতা ও সহানুভূতি রয়েছে। ফলে জিয়া  পরিবারকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে এককভাবে মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে দল কতটুকু এগোতে পারবে, সেই আশঙ্কাও অনেকের মনে ছিল। কিন্তু তারপরও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বিএনপি যে বেশি দূর যেতে পারবে না, সেই শিক্ষাটা নিশ্চয়ই তাদের হয়েছে। কারণ বিএনপির মনে রাখা দরকার, এই সাবেক আওয়ামী লীগাররা আওয়ামী লীগে জায়গা পেলে বা আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেলে ভুলেও বিএনপিকে উদ্ধারের দায়িত্ব নিতে যেতেন না। অর্থাৎ তারা চেহারা বদলেছেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। এখানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যেসব কথাবার্তা তারা বলেছেন, সেগুলো যে রাজনৈতিক বুলি, তা এখন বিএনপি নিশ্চয়ই টের পাবে। বিএনপির মধ্যে এখন যদি কেউ এরকম সন্দেহ পোষণও করেন যে, তাহলে ড. কামালরা ভেতরে ভেতরে আওয়ামী লীগের হয়েই কাজ করেছেন কি না, তাও অমূলক হবে না।

 

কৌশল ও পাল্টা কৌশল
মনে রাখা দরকার, এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনের কৌশল ছিল খুব পরিস্কার যে, বিএনপিকে মাঠে দাঁড়াতে দেবে না। যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে এবং গত এক দশক ধরে প্রশাসনসহ সর্বস্তরে আওয়ামী লীগের একটা শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ফলে তার এই নির্বাচন কৌশল বাস্তবায়নে মাঠ প্রশাসন সহায়তা করবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই কৌশল ভেদ করে বিএনপি ও তার দুটি জোট এমন কোনো পাল্টা কৌশল নিতে পারেনি যাতে আওয়ামী লীগের পরাজয় নিশ্চিত হয়।

বিএনপির এবারের নির্বাচনি কৌশল অনেকটা খেলার আগেই হার স্বীকারের মতো। দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেই নির্বাচনি কৌশল নিয়ে যে বিভক্তি, তা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও বরকতউল্লাহ বুলুর একটি ফোনালাপে স্পষ্ট—যেখানে মওদুদ পরিস্কার বলছেন যে, তারা চেয়েছিলেন ৩০০ আসনের বিএনপি ও জোটের প্রার্থীরা ঢাকায় এসে অবস্থান নেবেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করবেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে প্রচার করলে সারা বিশ্বেই বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। ওই টেলিফোন আলাপে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলের প্রতি মওদুদের তীব্র ক্ষোভও স্পষ্ট। ভোটের দুদিন আগে বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিও ভোট বর্জনের আহ্বান জানান। তার মানে হলো, বিএনপি তাদের ভোটের কৌশলই ঠিক করতে পারেনি অথবা তাদের মধ্যে তীব্র সমন্বয়হীনতা আছে। আওয়ামী লীগের মতো একটা দলের সাথে এরকম বড় ভুল তো দূরে থাকে, যেকোনো সিলি মিসটেকও (সামান্য ভুল) পরাজয়ের কারণ হবার জন্য যথেষ্ট।

 

বিএনপির অতীতের দায়

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিজের কারণেই হেরেছিল এবং মাত্র ৩০টি আসনে জিতেছিল। কারণ ক্ষমতায় থাকার জন্য তারা যেভাবে বিচার বিভাগে রদবদল এবং নিজেদের লোক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিল, সেই কৌশল মেনে নেয়নি তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং স্বভাবতই তারা এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। মাঠের সেই আন্দোলনে বস্তুত আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। আর ভোটের আগে আন্দোলনের মাঠ যার দখলে থাকে, ভোটের ফলাফল তার অনুকূলেই যায়, এ কথা অতীতেও প্রমাণিত। ওই বছর বিএনপি যদি নিয়ম অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হবার পরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতো এবং সেই সরকারের ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করতো, তাহলে আর যাই হোক ৩০টি আসনের লজ্জা পেতে হত না। কারণ বিএনপি যে নবম সংসদ নির্বাচনে জিতবে না তা পরিস্কার ছিল। কারণ আগের ৫ বছরে তারা যেসব কাজ করেছে, তাতে স্বভাবতই জনমত তাদের বিরুদ্ধেই ছিল। কিন্তু ক্ষমতা ছাড়তে না চেয়ে তারা যেসব খেলা খেলেছে, তাতে রাজনীতিটা আর রাজনীতিবিদদের হাতে থাকেনি। মনে রাখা দরকার, রাজনীতি যখন রাজনীতিবিদদের হাতের বাইরে চলে যায়, তখন সেখানে এমন সব শক্তি ঢুকে পড়ে, যারা পরবর্তীতে রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে।

 

আন্দোলনের ব্যর্থতা

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জিততে আওয়ামী লীগ তার মতো ছক আঁকলেও বিএনপি সেই ছকে পা না দিয়ে ভোট বর্জন করে। এতে তারা কতটা লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তারা ওই সময়ে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও সেখানে পেট্রোলবোমার সহিংসতা এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে যে, জনমত তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। পক্ষান্তরে সরকারও সেই আন্দোলন দমন করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ আন্দোলনের মাঠে বিএনপি বস্তুত ব্যর্থ হয়। আর আন্দোলনে ব্যর্থ হলে ভোটে জয় হবে না, সেটিই রুলস অব গেম।

একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সামনে রেখেও বিএনপি ওই অর্থে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। তাদের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অহিংস হওয়ায় দেশের মানুষ খুশি হলেও আখেরে তারা তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে তাদের প্রধান দাবি নির্দলীয় সরকাররে অধীনে নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করতে ব্যর্থ হয়। কেননা এরজন্য প্রয়োজন সংবিধান সংশোধন। ১৯৯৬ সালের তীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপি একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হলেও সংক্ষিপ্ত সময়ের সংসদ গঠন করে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করতে বাধ্য হয়েছিল। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ১৯৯৬ সালে তারা যেমন আওয়ামী লীগের কাছে পরাজিত হয়েছে, দুই দশক পরে এসে সেই বিএনপিই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আওয়ামী লীগের কাছে ফের পরাজিত হয়। দেখা যাচ্ছে বিএনপির জনসমর্থন ও ভোট যতই থাকুক, তারা বারবারই আওয়ামী লীগের রাজনীতি, কৌশল ও শক্তিমত্তার কাছে হেরে যায়। হেরে গিয়ে ভোটেও পরাজিত হয় এবং সেই পরাজয়ের ব্যবধানটি ক্রমশ বাড়ছে।

 

অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটেও কি বিএনপি জিততো?

একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরোধী পক্ষের তরফে একটি কথা বেশ সফলভাবে প্রচার করা হয়েছিল যে, ৫০ শতাংশ সুষ্ঠু ভোট হলেও বিএপি বিপুল ভোটে জিতবে, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ হেরে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা কি আসলেই তেমন? মনে রাখা দরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলেও সেখানে আওয়ামী লীগের জয়ের জন্য বেশ কিছু ফ্যাক্টর কাজ করতো। যেমন—

 

ক. উন্নয়ন

ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি, অর্থপাচার, প্রশাসনে দলীয়করণ এবং বাকস্বাধীনতার ইস্যুতে আওয়ামী লীগ যথেষ্ট সমালোচনার মুখে থাকলেও গত এক দশকে বাংলাদেশ যে একটা উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে গেছে, দেশ থেকে দারিদ্র যে আশাব্যঞ্জক হারে দূর হয়েছে (বর্তমানে অতি দারিদ্র্যের হার ১১.৩ শতাংশ), জনসংখ্যার অনুপাতে বেকারত্বের হার যতই থাকুক, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭.৮৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। অর্থাৎ তারা উন্নয়ন ইস্যুকেই ফোকাস করেছে। ইশতেহার দেখে মানুষ ভোট দেয় কি না, সেটি অন্য তর্ক। কিন্তু ইশতেহারে যেহেতু একটি দলের নির্বাচনকালীন দর্শনের প্রতিফলন ঘটে, ফলে গত এক দশক ধরে দেশে অন্তত অবকাঠামো খাতে যে বিশাল উন্নয়ন চলছে, সেটিকেই ভোট পাওয়ার প্রধান কৌশল হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ‘আগে উন্নয়ন না গণতন্ত্র’—এই তর্ক গত পাঁচ বছরে ঢের হয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশের মতো একটি উঠতি অর্থনীতির দেশে, যেখানে বিপুল জনসংখ্যার চাপ, উপরন্তু আয়তনে ছোট এবং  ভূমি ক্রমহ্রাসমান—সেখানে মানুষের খেয়েপরে বেঁচে থাকাটাই এক নম্বর স্লোগান।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ বা লক্ষ্য ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার। ২০১৪ সালের নির্বাচনকালীন তার সামনে প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় উন্নয়ন। ওই বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ স্লোগানটি দলের নেতাদের মুখে বারবার উচ্চারিত হয়।

এই সময়কালে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে যার মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকায় দ্রুত গণপরিবহনের জন্য মেট্রোরেল ও এমআরটি, পায়রা সমুদ্রবন্দর অন্যতম। তাছাড়া ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে। বর্তমানে এমন ১১টি অঞ্চলে কার্যক্রম চলছে, বাকি ৭৯টি নির্মাণাধীন। ২০০৯ সালের পর থেকে দেশের বিদ্যুৎখাতে ব্যাপক উন্নয়ন হতে শুরু করে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি থেকে বেড়ে ১২১টিতে দাঁড়িয়েছে। সরকারি হিসাবে দেশের ৯৩ শতাংশের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে।  মধ্যে ২০০৯ সাল থেকে মাথাপিছু আয় তিনগুণ বেড়ে যাওয়া ও গত এক দশকে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হওয়ার বিষয় রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধির বেশির ভাগই এসেছে দেশের ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের গার্মেন্টস খাত থেকে, যেখানে ৪৫ লাখ মানুষ কাজ করেন। এ খাতে নারীদের অংশগ্রহণ দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন হলে এই বিশাল উন্নয়নযজ্ঞের ধারাবাহিকতা থাকবে কি না, মানুষের মনে সেরকম আশঙ্কাও ছিল।

 

খ. ব্যবসায়ীদের সমর্থন

রাজনীতি ও নির্বাচনে যে ব্যবসায়ীদের ভূমিকা থাকে সবচেয়ে বেশি, সেই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের আয়োজনে ভোটের মাত্র ১১ দিন আগে ১৯ ডিসেম্বর রাজধানীতে যে ব্যবসায়ী সম্মেলন হয়, সেখানে দলমত নির্বিশেষে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা উপস্থিত ছিলেন এবং সেই সম্মেলনের মধ্যমণি ছিলেন শেখ হাসিনা—যাকে ব্যবসায়ীরা শুধু ‘আশার প্রতীক’ বলেই আখ্যায়িত করেননি, বরং দেশের অর্থনীতির স্বার্থে তাকে আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন। জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে একটি দলের প্রতি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের এভাবে সমর্থন দেয়ার নজির দেশের ইতিহাসে এই প্রথম এবং এর একটি বিশাল রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। ফলে ভোট একশো ভাগ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলেও নির্বাচনের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে যে ব্যবসায়ী সমাজ, তাদের সমর্থনের কারণে আওয়ামী লীগ স্বভাবতই একটি বাড়তি সুবিধা পেত।

 

গ. অপ্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা

বঙ্গবন্ধু, জিয়া ও এরশাদের পরে সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া এতটাই অপরিহার্য এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন যে, এই দুজনের বাইরে মানুষ তৃতীয় কাউকে ভাবে না, ভাবতে পারে না অথবা ভাবতে চায় না। ফলে দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে খালেদা জিয়া কারাবন্দি হবার পরে শেখ হাসিনা প্রকারান্তরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নানা সমালোচনার পরও গত এক দশকে তার নেতৃত্বে দেশ যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়েছে, ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বের কাছে মানবিক বাংলাদেশের যে নতুন পরিচয় তিনি উপস্থাপন করেছেন, তাতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত (একতরফা) নির্বাচনের পরে যেসব দেশ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ওপর নাখোশ ছিল, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পদক্ষেপ সেইসব বিরোধী রাষ্ট্রের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তা পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রেখেছে। যে কারণে বিএনপিকে মার্কিনপন্থি বলে অভিহিত বা অভিযুক্ত করা হলেও, এবারের নির্বাচনে মার্কিনীদের তৎপরতা নিরপেক্ষ বলেই মনে হয়েছে।

 

ঘ. মানুষ শান্তি চায়

সাধারণ মানুষ ঝুঁকি নিতে চায় না। ভোটারদের একটি বড় অংশের মধ্যে এরকম একটি ধারণা ছিল বা এরকম একটি ধারণা দেয়া সম্ভব হয়েছে যে, যদি এবার বিএনপি ও তার জোট ক্ষমতায় আসে, যারা প্রায় এক যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে, তাদের দল গোছাতেই এক বছর লেগে যাবে। দ্বিতীয় বছরে গিয়ে তারা টানা ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে বের করে গণহারে নেতাদের গ্রেপ্তার করবে এবং এখানে অনেক প্রতিহিংসারও প্রতিফলন ঘটবে। আওয়ামী লীগ যেসব মেগা প্রকল্প নিয়েছে, তার অনেকগুলোই থেমে যাবে বা বন্ধ করে দেয়া হবে। আবার কাজগুলো স্থবির হয়ে গেলে এগুলোর খরচ অনেক বেড়ে যাবে যা কায়দা-কানুন করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই আদায় করা হবে। দল হিসেবে, বিশেষ করে মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ যেহেতু বিএনপির তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী, ফলে বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও তারা খুব স্বস্তিতে থাকবে না। দেশ অস্থিতিশীল হয়ে যাবে। দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আইনি প্রক্রিয়ায় জেল থেকে মুক্ত করে এবং দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমানকে লন্ডন থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের হাতে ক্ষমতা অর্পনের প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং এই ইস্যুতে জোটের সাথে বিএনপির টানাপড়েন শুরু হবে। এসব অভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটাতে গিয়ে সরকার তার মূল কাজ গোছাতে পারবে না। সব মিলিয়ে ভালোমন্দ যাই হোক, দুর্নীতি ও অনিয়ম যাই থাক, গত এক দশকে দেশ যে একটা উন্নয়নের ট্র্যাকে উঠেছে, ব্যবসায়ীরা যে মোটামুটি স্বাধীনভাবে ব্যবসা করছেন, সেই প্রক্রিয়াটি হুট করে বাধাগ্রস্ত হলে আখেরে দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এসব ভাবনা নাগরিকের মধ্যে ছিল।

 

উপসংহার

অনেকেই এটি মনে করেন যে, ভোটবিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নয়, বরং বিএনপির লক্ষ্য ছিল এটি প্রমাণ করা যে, দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয় না। কিন্তু সেটি প্রমাণ করে তাদের লাভ কী হলো? আগামী ৫ বছর তাদের ক্ষমতার বাইরেই থাকতে হবে এবং এই সময়ে তাদের মূল সংকট হবে মাঠকর্মীর সংকট। ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তাদের দল গোছানোও বেশ কঠিন হবে। পঁচাত্তরের আগস্ট ট্র্যাজেডির পরে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে যেমন ২১ ব্ছর লড়াই করতে হয়েছে, বিএনপিকেও সম্ভবত সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।  খালেদা ও তারেক পরবর্তী অন্য কোনো নেতৃত্বে হয়তো বিএনপিকে সংগঠিত হতে হবে।

লেখক: চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সাংবাদিক; সংবিধান ও রাজনীতি গবেষক।

এবিএন/রাজ্জাক/জসিম/এআর

এই বিভাগের আরো সংবাদ