আজকের শিরোনাম :

বিএনপি এখনও সমর্থক নির্ভর দল যে কারণে

  মোশাররফ হোসেন মুসা

২৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ২১:০১ | অনলাইন সংস্করণ

বলা হয়, আজকের শিশু আমাদের ভবিষ্যৎ। তবে সেই শিশুই জাতির ভবিষ্যৎ হতে পারে যে শিশু সঠিকভাবে লালিত-পালিত হয় এবং শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ পায়। বিএনপি’র বর্তমান কর্মকা- দেখলে মনে হয় এ দলের নেতাকর্মীরা এখনও শিশু পর্যায়েই রয়ে গেছে। বিএনপি’র জন্ম ১৯৭৮ সালে। প্রায় ৩৬% ভোটার এ দলটির সমর্থক। কিন্তু দীর্ঘ ৪০ বছরে সমর্থকরা কেন কর্মীতে রূপান্তরিত হলো না সেটি বিশ্লেষণের দাবি রাখে। অন্যদিকে জামায়াত মাত্র ৬% ভোটের মালিক। ভোটাররা সকলেই কর্মী হওয়ায় বিএনপি এ দলটির উপর চরমভাবে নির্ভরশীল। আওয়ামীলীগ ও বিএনপি’র শ্রেণীগত কোনো পার্থক্য না থাকলেও আওয়ামীলীগের লক্ষ্য থাকে সকল জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার। তারা নির্বাচনে গিয়ে সমর্থক চিহ্নিত করে এবং পরবর্তীতে সেই সমর্থককে কর্মী হিসেবে গড়ে তোলে। কেউ কেউ বলেন- বিএনপি’র আদর্শিক ভিত্তি না থাকায় বিএনপি’র এই দৈন্য দশা। আবার কেউ কেউ আরেকটু এগিয়ে বলেন- বিএনপি’র জন্ম ক্যান্টনমেন্টে হওয়ায় দলটি কখনও গণতান্ত্রিক দলে রূপান্তরিত হবে না। কথাগুলো সম্পূর্ণ ঠিক নয়। বিএনপি’র বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, তথা ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ  কিংবা নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে উত্তম। বিএনপি মুখবন্ধে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা লিখেছে বটে; কার্যত এ দলটি এটিকে কখনোই আদর্শ হিসেবে নেয় নি। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদের অধীনে সকল ধর্মাবলম্বী ও সকল নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নিরাপদে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে তারা পাহাড়ি এলাকায় চরভাঙ্গা মানুষদের ঘরবাড়ি নির্মাণ করার সুযোগ করে দেয় এবং সাম্প্রদায়িকতাকে পুঁজি করে রাজনীতি শুরু করে। একটি দলের জন্ম কোথায় হয়েছে সেটি বড় কথা নয়, পরবর্তী সময়ে দলটি যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নীতি পাল্টিয়েছে কি না সেটাই আসল কথা। আওয়ামীলীগ মুসলিমলীগের ঔরশজাত হয়েও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে রাজনীতি শুরু করে। আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টি পূর্বে দাস প্রথার পক্ষে ছিল। দলের একমাত্র নেতা আব্রাহাম লিঙ্কনই দাস প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। পরবর্তীতে রিপাবলিকান পার্টি দাস প্রথা উচ্ছেদে ভূমিকা রাখে। বর্তমানে লোকরঞ্জনবাদী দলগুলোতেও একটি চাতুরী কৌশল লক্ষ্য করা যায়, তাহলো তারা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের মান্য করেই রাজনীতি করছেন। যেমন- ভারতের নরেন্দ্র মোদি ও তুরস্কের এরদোয়ানের রাজনীতি উদাহরণ হতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো বিএনপি এতকিছু জানার পরেও কেন পরিবর্তিত হচ্ছে না! বিএনপি জন্মের সময় প্রচুর আওয়ামী বিদ্বেষী লোকের অংশগ্রহণ ঘটে। তাদের মধ্যে ভাসানী ন্যাপ, চীনা পন্থী কমিউনিস্ট পার্টিসহ স্বাধীনতা বিরোধী লোকজনও ছিল। ফলে বিএনপি হয়ে পড়ে আওয়ামীলীগ বিরোধী বড় প্লাট ফরম। শুরুতে দলটি চরম জনপ্রিয়তা পায়। এখানে বলে রাখা ভালো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু না হলে এবং আওয়ামীলীগের শাসন দীর্ঘায়িত হলে হয়ত পরবর্তীতে জাসদই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতো। জাসদের লক্ষ্য সঠিক না হলেও জাসদ মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে নি। অনেকে মনে করেন, জাসদের রোপনকৃত ফসল কেটে গোলায় তোলে বিএনপি। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট দলের বিরোধীতা কখনও আরেকটি দলের একমাত্র আদর্শ হতে পারে না। বিএনপি’র ব্যর্থতার পিছনে রয়েছে চৈনিকপন্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক অসততাও। তারা পূর্বে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ভোট বিরোধী ছিলেন। তাদের চরমপন্থী রাজনীতির প্রতি এদেশের মানুষ কখনও সমর্থন দেয় নি। আওয়ামীলীগের প্রতি রয়েছে তাদের প্রচ- ক্ষোভ-আক্রোশ। তারা বিএনপিতে যোগ দিলেও পূর্বের চিন্তা ত্যাগ করে নি। তারা বিএনপিকে একটি গণতান্ত্রিক দলে রূপান্তরিত করতে কোনো পরামর্শ দেন নি এবং কোনো কর্মসূচীও গ্রহণ করেন নি। এখানে একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হবে। শহীদ জিয়াউর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো মৃত্যুবরণ করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেদনা জানাতে খালেদা জিয়ার বাসভবনে ছুটে যান। বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারি শিমুল বিশ্বাস তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন। মনীষীরা বহু পূর্বেই বলেছেন- গণতন্ত্র মুখে প্রচারের বিষয় নয়, এটি বুকে ধারণ করার বিষয় এবং সর্বক্ষেত্রে চর্চার বিষয়। জনৈক চৈনিকপন্থী বুদ্ধিজীবী এক টক্ শোতে বলেন- ‘বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস শুরু হয়েছে দ্বাদশ শতাব্দিতে এদেশে মুসলমান শাসকদের আগমনের পর থেকে। সেজন্য আমাদের আত্ম পরিচয়ের সংকট ঘোচাতে হলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ইসলামী জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ ঘটাতে হবে’। এখানে ভুলে গেলে চলবে না, শুধু বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গেও যদি ইসলামী জাতীয়তাবাদের মিশ্রণ ঘটে তাহলে আখেরে ইসলামী জাতীয়তাবাদীরাই লাভবান হবেন। বিএনপি’র তরুণ জনগোষ্ঠী ধর্মকে সংস্কৃতি হিসেবে নিতে পছন্দ করে কিন্তু জামায়েতে ইসলামী সংস্কৃতিকে মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারেক জিয়া একাধিক বার বলেছেন- ‘জামায়েতে ইসলামী হলো বিএনপি’র সহোদর ভ্রাতার মতো’। ইসলামের ইতিহাসে ক্ষমতার জন্য ভ্রাতাকে অন্ধ করে দেওয়া এমনকি নৃশংসভাবে হত্যা করার বহু নজির রয়েছে। আমেরিকা ইচ্ছা করলেই যেমন ইসরাইল প্রীতি ত্যাগ করতে পারে না, তেমনি বিএনপি ইচ্ছা করলেই জামায়াতকে ত্যাগ করতে পারবে না। কারণ আমেরিকাকে শক্তিধর রাষ্ট্রে গড়ে তোলার পিছনে ইহুদিদের ব্যাপক অবদান রয়েছে। তারা আমেরিকার বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, গবেষণা সহ প্রতিরক্ষার বিভিন্ন মূল  পয়েন্টে অবস্থান করছে। তেমনি বিএনপি’র নীতি নির্ধারক মহলেও বসে আছেন জামায়াত মাইন্ডের লোকজন। সম্প্রতি বিএনপি জামায়াত ত্যাগ করার বড় সুযোগ পেয়েছিল। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট যদি জামায়াতকে বর্জন করে প্রার্থী মনোনয়ন দিত তাহলে ঐক্যফ্রন্টের আন্দোলন অন্যদিকে মোড় নিত-সেটি এখন বহু রাজনীতিকই স্বীকার করা শুরু করছেন। অন্য দিকে কতিপয় আওয়ামী বুদ্ধিজীবী বলা শুরু করেছেন- নির্বাচনের পর বিএনপি বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। পূর্বে মুসলিমলীগের বিলুপ্তি ঘটায় জামায়াত লাভবান হয়েছিল। বর্তমানে বিএনপির বিলুপ্তি হলে জামায়াতই লাভবান হবে বেশী। জামায়াত যদি ২০% ভোটারদের কর্মীতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়,  তখন সেটা আওয়ামীলীগ কিংবা দেশের জন্য কি মঙ্গলজনক হবে ?

লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক

এই বিভাগের আরো সংবাদ