‘অবাধ ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচন : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
কানাই দাশ
১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:৪৩ | অনলাইন সংস্করণ
দেশে এখন একাদশ সংসদ নির্বাচনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে জোরেশোরে। রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে বরাবরের মত কিছু পত্র-পত্রিকা, সুশীল সমাজ বলে পরিচিত সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক একটি অংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দুনিয়া একটি “অবাধ ও নিরপেক্ষ” নির্বাচনের কথা বলছে যাতে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ও ক্ষমতাসীন দলকে কার্যকর জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রকৃত স্বরূপ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। কিন্তু সুশাসন, জবাবদিহিতা, অসামপ্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাতাবরণ, প্রকৃত গণতন্ত্রের এই মূল উপাদানগুলো ১৯৯০ পরবর্তী মোটামুটিভাবে সাধারণ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে পালাক্রমে নির্বাচিত দুই বৃহৎ দল ও জোটের শাসনামলে সরাসরি উপেক্ষিত বরং বলা ভাল প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তারপরেও একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ঘুরে ফিরে এদের উপরে ভরসা রাখা হচ্ছে। কয়েকটি পত্রিকা, কথিত সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার একাংশের ভূমিকায় মনে হচ্ছে বর্তমানে ক্ষমতার বাইরে থাকা জামাত-নির্ভর বৃহৎ দলটি ক্ষমতায় আসলেই যেন দেশের গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা কার্যকর হয়ে যাবে অথচ বাস্তবতা হলো আজকের এই পরিস্থিতির জন্য ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে তিনবার ক্ষমতায় আসা ঐ দলটি অনেকাংশে দায়ী। তবে কেন এই প্রচারণা? কেন এই অর্থহীন বাগাড়ম্বর?
বস্তুত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ৪৭ বছরের ইতিহাসে এদেশের মানুষ যথার্থ অর্থে আশা ও স্বপ্ন নিয়ে কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি। মাস্তানি, কালো টাকা ও সামপ্রদায়িক প্রচারণা-এসব কারণে প্রায় স্থায়ীভাবে সৃষ্ট অসমতল ভূমিতে এ দেশে কোন নির্বাচনএ পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে নিরপেক্ষ হয়নি। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে ১৯৭৩ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিজয় নিশ্চিত থাকার পরেও অনাকাংক্ষিত ও অপ্রয়োজনীয় ভাবে বেশ কিছু আসনে দৃষ্টিকটু জবরদস্তি ও কারচুপি করা হয় অথচ জামাত-বিএনপির অনুপস্থিতিতে সদ্যস্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী আওয়ামীলীগ ও ন্যাপ-সিপিবি’র মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মডেল হতে পারত সেই নির্বাচনটি। এবং তা যদি হতো বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারতো। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসনের অধীনে জিয়া ও এরশাদের আমলে ১৯৭৯, ৮৬ ও ৮৮ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয়ও চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনকার্যত প্রহসনের নির্বাচনে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সাধারণ নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ বলা হলেও তা প্রকৃত অর্থে কালো টাকার খেলা ও তীব্র সামপ্রদায়িক প্রচারে কলুষিত ছিল। স্বৈরাচার বিরোধী দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মূল নেতৃত্ব দানকারী ১৫ দলীয় জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ সেই আন্দোলনের পটভূমিতে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অবিশ্বাস্যভাবে পরাজিত হয় কেননা ততদিনে জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনের বদৌলতে পাকিস্তানী ধারার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সামপ্রদায়িক জামাতী রাজনীতি বিকশিত হয়েছে ও এক বিকৃত সামপ্রদায়িক সামাজিক মনস্তস্ত্বে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে পুরো সমাজ। সেই নির্বাচনের মাত্র চার মাস আগে ১৯৯০ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসকদের ইঙ্গিতে স্বাধীন দেশে প্রথমবারের মত দেশব্যাপী ব্যাপক সামপ্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয় ভারতের বাবরি মসজিদ ইস্যুতে। ১৯৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পিত উপায়ে রাজনীতিতে লালিত ধর্মান্ধ রাজনীতিও সামপ্রদায়িকতা, অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকার ইন্ধনে প্রচলিত মুক্ত বাজার অর্থনীতি তথা লুটপাটের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর প্রভাবে সৃষ্ট দূর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সামাজিক শক্তির নোংরা নেঙাস ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী শক্তি তথা বিএনপি-জামাত জোটকে জয়ী হতে সাহায্য করে। তখন নিশ্চিত বিজয়ের স্বপ্নে মশশুল আওয়ামী লীগ সমাজে ঘটে যাওয়া এই পশ্চাদগামী পরিবর্তনের প্রভাব এবং সামপ্রদায়িক সামাজিক মনস্তত্বের শক্তি অনুধাবনে ব্যর্থ হয় এবং পরাজয়ের হতাশা থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সমাজের পশ্চাদগামী প্রতিক্রিয়ারশীল পরিবর্তনকে প্রতিরোধ করার পরিবর্তে ক্ষমতার প্রত্যাশায় ধর্মাশ্রয়ী মূল্যবোধ, রাজনীতি ও লুটপাটের অর্থনীতির ধারায় নিজেই গা ভাসিয়ে সমাজকে আরো পেছনে চলে যাবার সুযোগ করে দেয় ও এভাবে নিজের দীর্ঘ দিনের অবস্থান ও আদর্শের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নিজেই রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী একটি বিরুদ্ধ শক্তির বিকাশকে বৈধতা প্রদান করে। ফলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনএ অর্থে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি কারণ তা সামপ্রদায়িক কুৎসা, সহিংসতা ও ঘৃণায় কলুষিত সমাজ ও কালো টাকার প্রভাব এবং ঐ ভাবাদর্শে পুষ্ট সিভিল ও মিলিটারী ব্যুরোক্র্যাসি মিলিয়ে সে নির্বাচনকে অনেকটা পক্ষপাত দুষ্ট করে তুলে। সূক্ষ্ম কারচুপি বলতে সেদিন শেখ হাসিনা সেটাই বুঝাতে চেয়েছিলেন কিনা জানি না। বস্তুত ১৯৯১ এর নির্বাচনএদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এ অর্থে যে জবরদস্তি করে সামরিক শাসক জিয়া-এরশাদের চাপানো সামপ্রদায়িক ও লুটেরা রাজনৈতিক-অর্থনীতির ধারা, ধর্মাশ্রয়ী সামাজিক সংস্কৃতি ও রাজনীতি এতে সাংবিধানিক বৈধতা লাভ করে। সেই থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনপর্যন্ত প্রত্যেকটি কথিত “অবাধ ও নিরপেক্ষ” নির্বাচনে কালো টাকা, সামপ্রদায়িক ভাবাদর্শ ও ধর্মান্ধতার প্রভাব মূল ভূমিকা পালন করেছে। এ সময়ে সমাজে ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতি যেমন ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে তেমনি অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পদের মালিক একটি লুটেরা শ্রেণি গড়ে উঠেছে যারা পুরো দেশকে শাসন করছে। এ দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতির কবলে এখন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। জন্মদাতা হিসেবে সেই অদৃশ্য শাসক গোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ যেমন বিএনপি-জামাত-জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে তেমনি একটি অংশ বর্তমানে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণের ভূমিকা পালন করছে। ১৯৭০ ও ’৮০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির দল আওয়ামী লীগ আজ বৃহৎ লুটেরা ধনিক গোষ্ঠীর দলে রূপান্তারিত হয়েছে। এর অনুষঙ্গ হিসেবে মাঠে বিএনপি’র সাথে তাল মিলিয়ে আওয়ামী লীগ ধর্মকে রাজনীতির অপরিহার্য উপাদানে পরিণত করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে। কাজেই গণতন্ত্রের মূল উপাদান অসামপ্রাদায়িকতা, সামাজিক সমতা এখন ঐ দলটির কাগুজে শ্লোগানে পরিণত হয়েছে এবং আদতে তারা তা সবধহ করে না। নয়তো গত দশ বছরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পনের কাজটি সামান্যতমও এগুলোনা কেন? রামুও নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সামপ্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় জামাত-বিএনপি ও কিছু আওয়ামী লীগের কর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও এদের বিচারের আওতায় কেন আনা গেল না? এজন্য আওয়ামী লীগ দশবছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরেও সংখ্যালঘুদের মনে আস্থা ফিরে আসে না এবং তারা দেশ ত্যাগ করছে। এ সব বিষয় নিয়ে কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীদের কথা দূরে থাক জেলা ও কেন্দ্রের নেতারাও ভাবেন বা এতে উৎকন্ঠিত বা প্রতিবাদী হন তার কোন চিহ্ন কারো চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। মনে রাখতে হবে যে সমাজে সামপ্রদায়িকতা তীব্র রূপ নেয়, অর্থনীতিতে চলে অবাধ লুটপাট সে সমাজ দুর্বলতর ও সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ নয়। শুধু “অবাধ নির্বাচনে” জনকল্যাণকামী তথা প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা অসম্ভব একটি কাজ। এ জন্য আমূল পরিবর্তন প্রত্যাশী অসামপ্রদায়িক ও প্রগতিশীল একটি কমিটেড রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োজন যা এখন দুর্বল এবং সে শক্তি আজ গণতন্ত্র প্রত্যাশী বলে স্বঘোষিত একটি ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিক ও অন্যান্য মিডিয়ায় সামান্য প্রচারও পায় না। এই বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার দায়িত্ব শুধু বামপন্থীদের একার নয়, বিবেকবান বুদ্ধিজীবী, এমনকি প্রগতিশীল মুক্তিবুদ্ধির আওয়ামী লীগের কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল শক্তিকে এ কাজে নামতে হবে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াশীল গণঅভ্যুত্থান মোকাবেলার জন্য। কোন রাষ্ট্রশক্তি চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। মানুষের জীবনে মৌলিক সমস্যা সমাধান করেও সোভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ণ ইউরোপের কমিউনিস্টরা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। মানুষের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এর অন্যতম কারণ। বিকল্প প্রগতিশীল শক্তির অনুপস্থিতিতে সেখানে বিকৃত পুঁজিবাদ ফিরে আসে। রাজনৈতিক অবস্থানে নৈতিকতা বর্জিত পরিবর্তন কোন সমাধান নয় তা সুবিধাবাদের নামান্তর।
এ প্রসঙ্গেই আসে অনৈতিক রাজনৈতিক ডিগবাজীর কথা। আওয়ামী লীগের সাবেক কিছু কেন্দ্রীয় নেতা ও কর্মী-কামাল হোসেন, অধ্যাপক আবু সাঈদ, বঙ্গবীর খ্যাত কাদের সিদ্দিকী, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী রব ও মান্না বিএনপি’র সাথে যুক্তফ্রন্ট করেছেন “গণতন্ত্র” পুনরুদ্ধারে লক্ষ্যে। তাঁরা সভাসমাবেশ করছেন জন্মগতভাবে গণতন্ত্র বিরোধী বিএনপি জামাতের কর্মী সমর্থকদের নিয়ে। যে দল জন্মই নিয়েছে অগণতান্ত্রিকভাবে সামরিক গ্যারিসনের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে, মুসলিম লীগের ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের বিপরীত ভাবাদর্শ যে দলের ঘোষিত আদর্শ এবং সামপ্রদায়িকতাকে যে দল রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছে সে দল দিয়ে কি করে গণতন্ত্র উদ্ধার হবে একথা ঐ সব নেতারা বলছেন না। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে বিএনপি ও জামাতের কর্মীরা দেশের বিশেষ করে বৃহত্তর বরিশাল, ফরিদপুরের ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণসহ নারকীয় তান্ডব চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে এবং সে জন্য আজ পর্যন্ত তারা সামান্যতম দুঃখ প্রকাশও করেনি। সে দল ক্ষমতায় এসে আবারও প্রতিহিংসার আগুনে নিঃসন্দেহে আরো হিংসাশ্রয়ী হবে ও তা প্রতিরোধ করার নিশ্চয়তা কি কামাল হোসেন সাহেবরা দিতে পারবেন? বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী মান্না তো প্রয়োজনে ঘোমটা ফেলে জামাতের সাথেও ঐক্যে আগ্রহী। সব দলের বর্জনের মুখে ১৯৮৮ সালের এরশাদের সংসদের বিরোধী নেতা রব সাহেব সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভাল। মান্না-রব, ইনু-বাদল সাহেবরা তো ৭২ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর সরকার বিরোধী রাজনৈতিক মাঠ তৈরি ও বাম শ্লোগানের আড়ালে বাম বিরোধী রাজনীতিতেই আজীবন ব্যস্ত ছিলেন। আজকে কেউ নৌকায় কেউ ধানের শীষ হাতে নিয়ে মাঠে আছেন। নির্মম পরিহাসের বিষয় হলো এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগকারী সব সামরিক স্বৈরাচারের ভণ্ড সাইকোফ্যান্ট মওদুদের কাছ থেকে দেশবাসীকে আজ গণতন্ত্র ও গণআন্দোলনের সবক পেতে হচ্ছে যা দেশের অত্যন্ত বিবেকহীন রাজনীতি ও দূর্বল, অসুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই প্রতিফলন মাত্র। কিন্তু দু:খ হয় যখন এসব নেতারা মানুষের স্মূতি শক্তিকে খুবই দুর্বল ভাবে। ১৫ আগষ্ট ও ৩ নভেম্বরের নৃশংসতার বেনিফিসিয়ারী, ২১ আগস্টের গণহত্যার জন্য দায়ী, জামাত সম্পৃক্ত একটি অগণতান্ত্রিত দলের দিকে তাকিয়ে থাকা গণতন্ত্রের এসব উদ্ধার কর্মীদের কে উদ্ধার করবে জানি না।
সামপ্রদায়িকতার বিষবাষ্পে পরিপূর্ণ ও লুটেরা একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনহতেই পারে না। উগ্র জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদী ও ইহুদী বিরোধী সামপ্রদায়িক বিদ্বেষে কলুষিত জার্মানিতে ১৯৩৩ সালে একটি অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে হিটলার ক্ষমতায় এসেছিল। কংগ্রেসের ব্যর্থতা ও সামপ্রদায়িক সামাজিক পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ধর্ম্মান্ধ মোদি ক্ষমতায় এসে ভারতের অসামপ্রদায়িক গণতন্ত্রিক ঐতিহ্যকে আজ টুটি চিপে ধরে ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও জীবিকাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। আর্থিক সংকটে বিপর্যস্ত ও অভিবাসন বিরোধী ক্রমবর্ধমান জনমতের সমর্থনে ট্রাম্পের মত একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী উন্মাদ নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতায় এসেছে। সেকুলার সমাজ মানস ও গণমুখী, কল্যাণকামী রাজনীতি ও অর্থনীতি হলো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রধানতম পূর্বশর্ত। কাজেই কথিত নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে কারো ক্ষমতায় যাওয়া নয় বরং অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের দেখতে হবে ক্ষমতা প্রত্যাশী দলের অতীত ও বর্তমান শ্রেণি ও ভাবাদর্শগত অবস্থান। সমাজ ও লুটপাটতন্ত্রের বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যাভিসারী তথা ভিশন ’৭১-এ বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ছাড়া গণতন্ত্র উদ্ধার ও দেশকে এ অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা থেকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। অবশ্যই ক্ষমতায় এবং ক্ষমতার বাইরে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ তথা ’৭২ এর সংবিধানের মৌলিক চেতনায় বিশ্বাসী শক্তিকে থাকতে হবে। তবেই রাজনীতি ও নির্বাচনসংঘাত ও শংকামুক্ত পরিবেশে পরিচালিত হবে। সামপ্রদায়িক ও লুটেরা অগণতান্ত্রিক দল দিয়ে গণতন্ত্র আসবে না, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না। (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া) লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
বস্তুত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ৪৭ বছরের ইতিহাসে এদেশের মানুষ যথার্থ অর্থে আশা ও স্বপ্ন নিয়ে কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি। মাস্তানি, কালো টাকা ও সামপ্রদায়িক প্রচারণা-এসব কারণে প্রায় স্থায়ীভাবে সৃষ্ট অসমতল ভূমিতে এ দেশে কোন নির্বাচনএ পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে নিরপেক্ষ হয়নি। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে ১৯৭৩ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের বিজয় নিশ্চিত থাকার পরেও অনাকাংক্ষিত ও অপ্রয়োজনীয় ভাবে বেশ কিছু আসনে দৃষ্টিকটু জবরদস্তি ও কারচুপি করা হয় অথচ জামাত-বিএনপির অনুপস্থিতিতে সদ্যস্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী আওয়ামীলীগ ও ন্যাপ-সিপিবি’র মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মডেল হতে পারত সেই নির্বাচনটি। এবং তা যদি হতো বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতে পারতো। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসনের অধীনে জিয়া ও এরশাদের আমলে ১৯৭৯, ৮৬ ও ৮৮ সালে অনুষ্ঠিত যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয়ও চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনকার্যত প্রহসনের নির্বাচনে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সাধারণ নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ বলা হলেও তা প্রকৃত অর্থে কালো টাকার খেলা ও তীব্র সামপ্রদায়িক প্রচারে কলুষিত ছিল। স্বৈরাচার বিরোধী দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মূল নেতৃত্ব দানকারী ১৫ দলীয় জোটের প্রধান দল আওয়ামী লীগ সেই আন্দোলনের পটভূমিতে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অবিশ্বাস্যভাবে পরাজিত হয় কেননা ততদিনে জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনের বদৌলতে পাকিস্তানী ধারার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সামপ্রদায়িক জামাতী রাজনীতি বিকশিত হয়েছে ও এক বিকৃত সামপ্রদায়িক সামাজিক মনস্তস্ত্বে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে পুরো সমাজ। সেই নির্বাচনের মাত্র চার মাস আগে ১৯৯০ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসকদের ইঙ্গিতে স্বাধীন দেশে প্রথমবারের মত দেশব্যাপী ব্যাপক সামপ্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয় ভারতের বাবরি মসজিদ ইস্যুতে। ১৯৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পিত উপায়ে রাজনীতিতে লালিত ধর্মান্ধ রাজনীতিও সামপ্রদায়িকতা, অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাংক ও আমেরিকার ইন্ধনে প্রচলিত মুক্ত বাজার অর্থনীতি তথা লুটপাটের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর প্রভাবে সৃষ্ট দূর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সামাজিক শক্তির নোংরা নেঙাস ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী শক্তি তথা বিএনপি-জামাত জোটকে জয়ী হতে সাহায্য করে। তখন নিশ্চিত বিজয়ের স্বপ্নে মশশুল আওয়ামী লীগ সমাজে ঘটে যাওয়া এই পশ্চাদগামী পরিবর্তনের প্রভাব এবং সামপ্রদায়িক সামাজিক মনস্তত্বের শক্তি অনুধাবনে ব্যর্থ হয় এবং পরাজয়ের হতাশা থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সমাজের পশ্চাদগামী প্রতিক্রিয়ারশীল পরিবর্তনকে প্রতিরোধ করার পরিবর্তে ক্ষমতার প্রত্যাশায় ধর্মাশ্রয়ী মূল্যবোধ, রাজনীতি ও লুটপাটের অর্থনীতির ধারায় নিজেই গা ভাসিয়ে সমাজকে আরো পেছনে চলে যাবার সুযোগ করে দেয় ও এভাবে নিজের দীর্ঘ দিনের অবস্থান ও আদর্শের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নিজেই রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী একটি বিরুদ্ধ শক্তির বিকাশকে বৈধতা প্রদান করে। ফলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনএ অর্থে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি কারণ তা সামপ্রদায়িক কুৎসা, সহিংসতা ও ঘৃণায় কলুষিত সমাজ ও কালো টাকার প্রভাব এবং ঐ ভাবাদর্শে পুষ্ট সিভিল ও মিলিটারী ব্যুরোক্র্যাসি মিলিয়ে সে নির্বাচনকে অনেকটা পক্ষপাত দুষ্ট করে তুলে। সূক্ষ্ম কারচুপি বলতে সেদিন শেখ হাসিনা সেটাই বুঝাতে চেয়েছিলেন কিনা জানি না। বস্তুত ১৯৯১ এর নির্বাচনএদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা এ অর্থে যে জবরদস্তি করে সামরিক শাসক জিয়া-এরশাদের চাপানো সামপ্রদায়িক ও লুটেরা রাজনৈতিক-অর্থনীতির ধারা, ধর্মাশ্রয়ী সামাজিক সংস্কৃতি ও রাজনীতি এতে সাংবিধানিক বৈধতা লাভ করে। সেই থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচনপর্যন্ত প্রত্যেকটি কথিত “অবাধ ও নিরপেক্ষ” নির্বাচনে কালো টাকা, সামপ্রদায়িক ভাবাদর্শ ও ধর্মান্ধতার প্রভাব মূল ভূমিকা পালন করেছে। এ সময়ে সমাজে ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতি যেমন ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে তেমনি অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পদের মালিক একটি লুটেরা শ্রেণি গড়ে উঠেছে যারা পুরো দেশকে শাসন করছে। এ দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক অর্থনীতির কবলে এখন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। জন্মদাতা হিসেবে সেই অদৃশ্য শাসক গোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ যেমন বিএনপি-জামাত-জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে তেমনি একটি অংশ বর্তমানে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণের ভূমিকা পালন করছে। ১৯৭০ ও ’৮০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির দল আওয়ামী লীগ আজ বৃহৎ লুটেরা ধনিক গোষ্ঠীর দলে রূপান্তারিত হয়েছে। এর অনুষঙ্গ হিসেবে মাঠে বিএনপি’র সাথে তাল মিলিয়ে আওয়ামী লীগ ধর্মকে রাজনীতির অপরিহার্য উপাদানে পরিণত করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে চাইছে। কাজেই গণতন্ত্রের মূল উপাদান অসামপ্রাদায়িকতা, সামাজিক সমতা এখন ঐ দলটির কাগুজে শ্লোগানে পরিণত হয়েছে এবং আদতে তারা তা সবধহ করে না। নয়তো গত দশ বছরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পনের কাজটি সামান্যতমও এগুলোনা কেন? রামুও নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সামপ্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় জামাত-বিএনপি ও কিছু আওয়ামী লীগের কর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও এদের বিচারের আওতায় কেন আনা গেল না? এজন্য আওয়ামী লীগ দশবছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরেও সংখ্যালঘুদের মনে আস্থা ফিরে আসে না এবং তারা দেশ ত্যাগ করছে। এ সব বিষয় নিয়ে কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীদের কথা দূরে থাক জেলা ও কেন্দ্রের নেতারাও ভাবেন বা এতে উৎকন্ঠিত বা প্রতিবাদী হন তার কোন চিহ্ন কারো চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। মনে রাখতে হবে যে সমাজে সামপ্রদায়িকতা তীব্র রূপ নেয়, অর্থনীতিতে চলে অবাধ লুটপাট সে সমাজ দুর্বলতর ও সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ নয়। শুধু “অবাধ নির্বাচনে” জনকল্যাণকামী তথা প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা অসম্ভব একটি কাজ। এ জন্য আমূল পরিবর্তন প্রত্যাশী অসামপ্রদায়িক ও প্রগতিশীল একটি কমিটেড রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োজন যা এখন দুর্বল এবং সে শক্তি আজ গণতন্ত্র প্রত্যাশী বলে স্বঘোষিত একটি ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিক ও অন্যান্য মিডিয়ায় সামান্য প্রচারও পায় না। এই বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার দায়িত্ব শুধু বামপন্থীদের একার নয়, বিবেকবান বুদ্ধিজীবী, এমনকি প্রগতিশীল মুক্তিবুদ্ধির আওয়ামী লীগের কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল শক্তিকে এ কাজে নামতে হবে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াশীল গণঅভ্যুত্থান মোকাবেলার জন্য। কোন রাষ্ট্রশক্তি চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। মানুষের জীবনে মৌলিক সমস্যা সমাধান করেও সোভিয়েত রাশিয়া ও পূর্ণ ইউরোপের কমিউনিস্টরা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। মানুষের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এর অন্যতম কারণ। বিকল্প প্রগতিশীল শক্তির অনুপস্থিতিতে সেখানে বিকৃত পুঁজিবাদ ফিরে আসে। রাজনৈতিক অবস্থানে নৈতিকতা বর্জিত পরিবর্তন কোন সমাধান নয় তা সুবিধাবাদের নামান্তর।
এ প্রসঙ্গেই আসে অনৈতিক রাজনৈতিক ডিগবাজীর কথা। আওয়ামী লীগের সাবেক কিছু কেন্দ্রীয় নেতা ও কর্মী-কামাল হোসেন, অধ্যাপক আবু সাঈদ, বঙ্গবীর খ্যাত কাদের সিদ্দিকী, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী রব ও মান্না বিএনপি’র সাথে যুক্তফ্রন্ট করেছেন “গণতন্ত্র” পুনরুদ্ধারে লক্ষ্যে। তাঁরা সভাসমাবেশ করছেন জন্মগতভাবে গণতন্ত্র বিরোধী বিএনপি জামাতের কর্মী সমর্থকদের নিয়ে। যে দল জন্মই নিয়েছে অগণতান্ত্রিকভাবে সামরিক গ্যারিসনের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে, মুসলিম লীগের ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এবং মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের বিপরীত ভাবাদর্শ যে দলের ঘোষিত আদর্শ এবং সামপ্রদায়িকতাকে যে দল রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছে সে দল দিয়ে কি করে গণতন্ত্র উদ্ধার হবে একথা ঐ সব নেতারা বলছেন না। ২০০১ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে বিএনপি ও জামাতের কর্মীরা দেশের বিশেষ করে বৃহত্তর বরিশাল, ফরিদপুরের ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণসহ নারকীয় তান্ডব চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে এবং সে জন্য আজ পর্যন্ত তারা সামান্যতম দুঃখ প্রকাশও করেনি। সে দল ক্ষমতায় এসে আবারও প্রতিহিংসার আগুনে নিঃসন্দেহে আরো হিংসাশ্রয়ী হবে ও তা প্রতিরোধ করার নিশ্চয়তা কি কামাল হোসেন সাহেবরা দিতে পারবেন? বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী মান্না তো প্রয়োজনে ঘোমটা ফেলে জামাতের সাথেও ঐক্যে আগ্রহী। সব দলের বর্জনের মুখে ১৯৮৮ সালের এরশাদের সংসদের বিরোধী নেতা রব সাহেব সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভাল। মান্না-রব, ইনু-বাদল সাহেবরা তো ৭২ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর সরকার বিরোধী রাজনৈতিক মাঠ তৈরি ও বাম শ্লোগানের আড়ালে বাম বিরোধী রাজনীতিতেই আজীবন ব্যস্ত ছিলেন। আজকে কেউ নৌকায় কেউ ধানের শীষ হাতে নিয়ে মাঠে আছেন। নির্মম পরিহাসের বিষয় হলো এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী গণ আন্দোলনের মুখে পদত্যাগকারী সব সামরিক স্বৈরাচারের ভণ্ড সাইকোফ্যান্ট মওদুদের কাছ থেকে দেশবাসীকে আজ গণতন্ত্র ও গণআন্দোলনের সবক পেতে হচ্ছে যা দেশের অত্যন্ত বিবেকহীন রাজনীতি ও দূর্বল, অসুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই প্রতিফলন মাত্র। কিন্তু দু:খ হয় যখন এসব নেতারা মানুষের স্মূতি শক্তিকে খুবই দুর্বল ভাবে। ১৫ আগষ্ট ও ৩ নভেম্বরের নৃশংসতার বেনিফিসিয়ারী, ২১ আগস্টের গণহত্যার জন্য দায়ী, জামাত সম্পৃক্ত একটি অগণতান্ত্রিত দলের দিকে তাকিয়ে থাকা গণতন্ত্রের এসব উদ্ধার কর্মীদের কে উদ্ধার করবে জানি না।
সামপ্রদায়িকতার বিষবাষ্পে পরিপূর্ণ ও লুটেরা একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনহতেই পারে না। উগ্র জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদী ও ইহুদী বিরোধী সামপ্রদায়িক বিদ্বেষে কলুষিত জার্মানিতে ১৯৩৩ সালে একটি অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে হিটলার ক্ষমতায় এসেছিল। কংগ্রেসের ব্যর্থতা ও সামপ্রদায়িক সামাজিক পরিস্থিতিতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ধর্ম্মান্ধ মোদি ক্ষমতায় এসে ভারতের অসামপ্রদায়িক গণতন্ত্রিক ঐতিহ্যকে আজ টুটি চিপে ধরে ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও জীবিকাকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। আর্থিক সংকটে বিপর্যস্ত ও অভিবাসন বিরোধী ক্রমবর্ধমান জনমতের সমর্থনে ট্রাম্পের মত একজন কট্টর জাতীয়তাবাদী উন্মাদ নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতায় এসেছে। সেকুলার সমাজ মানস ও গণমুখী, কল্যাণকামী রাজনীতি ও অর্থনীতি হলো অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রধানতম পূর্বশর্ত। কাজেই কথিত নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে কারো ক্ষমতায় যাওয়া নয় বরং অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের দেখতে হবে ক্ষমতা প্রত্যাশী দলের অতীত ও বর্তমান শ্রেণি ও ভাবাদর্শগত অবস্থান। সমাজ ও লুটপাটতন্ত্রের বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যাভিসারী তথা ভিশন ’৭১-এ বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ছাড়া গণতন্ত্র উদ্ধার ও দেশকে এ অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা থেকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। অবশ্যই ক্ষমতায় এবং ক্ষমতার বাইরে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ তথা ’৭২ এর সংবিধানের মৌলিক চেতনায় বিশ্বাসী শক্তিকে থাকতে হবে। তবেই রাজনীতি ও নির্বাচনসংঘাত ও শংকামুক্ত পরিবেশে পরিচালিত হবে। সামপ্রদায়িক ও লুটেরা অগণতান্ত্রিক দল দিয়ে গণতন্ত্র আসবে না, নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচনের প্রশ্নই আসে না। (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া) লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
এই বিভাগের আরো সংবাদ