আজকের শিরোনাম :

এবারের বিজয় দিবসের তাৎপর্য

  মুহাম্মদ শামসুল হক

১৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৫১ | অনলাইন সংস্করণ

বাঙালি জাতির কাছে মহান বিজয় দিবস একটি ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যমণ্ডিত দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৯৩ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সৈন্যকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার মাধ্যমে বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করে।
১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত এ দুটি দেশ ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকে বাঙালিদের ওপর নানাভাবে শাসন-শোষণমূলক আচরণ করতে থাকে। শিক্ষা, সামরিক-বেসামরিক ক্ষেত্রে চাকরি, শিল্প-কারখানা স্থাপন-সবদিক থেকে পূর্ব বাংলাকে অবহেলিত রাখা হয়। এমনকি পাকিস্তান রাষ্ট্রটি জন্মের শুরু থেকেই বাঙালির মায়ের ভাষা বাংলার পরিবর্তে এককভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চালায় শাসকগোষ্ঠী। কথায় কথায় গ্রেপ্তার ও নির্যাতন চালায় আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের ওপর। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালালে সালাম-রফিক-জব্বারসহ অনেকে হতাহত হন। শাসকগোষ্ঠীর এমন নিষ্ঠুরতায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পুরো জাতি। এভাবে শোষণ-শাসনের মাত্রা বাড়তে থাকলে বাঙালিরা স্বায়ত্বশাসনের দাবি তোলে। ১৯৫৪ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিরা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে বাঙালিদের স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীদের জয়যুক্ত করে। কিন্তু পাকিস্তানিরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে নানা কৌশলে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে পুনরায় স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে একের পর এক ষড়যন্ত্র ও বৈষম্যমূলক শাসন-শোষণের কারণে বাঙালিরা বুঝতে পারে পাকিস্তানের অধীনে থেকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বেঁচে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানা অপকর্মের তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে তাদের কবল থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে থাকেন বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ সাহসী নেতারা। এদের মধ্যে ১৯৬৬ সালে বাঙালিদের জন্য সবচেয়ে যুগান্তকারী ও মুক্তির বার্তাবহ ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি নিয়ে হাজির হন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গশার্দুল শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছয় দফাকে বাঙালির মুক্তিসনদ হিসেবে অভিহিত করেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আলাদা আর্থিক ব্যবস্থা, পৃথক মুদ্রানীতি, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আধা সামরিক বা মিলিশিয়া বাহিনী গঠনসহ বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নানা শর্তসম্বলিত এই ছয় দফা অচিরেই দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর এই ছয় দফাকে পাকিস্তান ভাঙার চক্রান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করে শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানসহ আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের ওপর চরম নির্যাতন শুরু করে। এরই মধ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে কথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলায় বঙ্গবন্ধুকে ১ নং আসামি করে সামরিক- বেসামরিক ৩৫ ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করে আইউব খান সরকার। ছয় দফার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি এবং ছাত্র সমাজের ১১ দফা যুক্ত করে ব্যাপক গণ ছাত্র-আন্দোলন গড়ে তোলে-জনতা। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে এই আন্দোলনের তীব্রতায় বেসামাল হয়ে মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুসহ অন্যদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় আইউব সরকার। এরপর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসে জনদাবির মুখে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একচ্ছত্র বিজয় অর্জন করলেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জাতি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে মার্চের শুরু থেকে।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। এই প্রস্তুতির এক পর্যায়ে পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়া খান ও তাঁর দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টো আলোচনার নামে ঢাকায় এসে গোপনে বাঙালিদের ওপর সামরিক হামলার নীল নকশা তৈরি করে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার ও বাঙালিদের ওপর গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে পাকিস্তান চলে যায়। এদিকে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে যান। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। লক্ষাধিক সুপ্রশিক্ষিত, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সৈন্যের বিরুদ্ধে নামমাত্র অস্ত্র নিয়ে বাঙালি-ছাত্র-যুবক-জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। প্রতিবেশি দেশ ভারতের সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে লড়াই করে। দীর্ঘ নয় মাসে প্রায় ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হন। সম্ভ্রম হারান দুই লক্ষাধিক নারী। সারা দেশে হাজার হাজার গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু
‘অবাক পৃথিবী তাকিয়ে রয়,
জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়’
অবশেষে ডিসেম্বরের শুরু থেকে বাংলাদেশ-ভারত মিত্রবাহিনীর যৌথ প্রতিরোধ অভিযান শুরু হলে পাকিস্তানিদের দিন শেষ হয়ে আসে। উপায়ান্তর না দেখে তারা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। ৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অবসান ঘটে ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা আর নির্যাতনের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের। অন্যদিকে অসীম ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে বিশ্বসমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯ সালের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৭১ এর ২৫ মার্চের মধ্যরাতে, বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তার পূর্ণ রূপ পায় ১৬ ডিসেম্বর।
প্রতিটি জাতির মুক্তি সংগ্রামের একটা লক্ষ্য থাকে। বাঙালি জাতির আশা ছিল, তারা একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের অপশাসন থেকে মুক্ত হয়ে এমন একটি রাষ্ট্র পাবে যেখানে থাকবে না কোনো জাতি-ধর্ম বর্ণ বিভেদ বঞ্চনা আর শোষণ। এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে যেখানে মানুষ আইনের শাসন, শিক্ষা স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের সুযোগ পাবে।
৪৭ বছর পর বিজয়ের মাসে প্রশ্ন জাগে বাঙালি জাতি কি তার সেই আশা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখতে পেয়েছে নিজেদের জীবনে? রাষ্ট্রই বা তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে কতটুকু ভূমিকা পালন করছে? দেখা গেছে, ৩০ লাখ শহীদ ও কোটি মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেলেও প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য থেকেই গেছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের আইনশৃঙ্খলা, অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা, সংবিধান প্রণয়ন, উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সাহায্য-এসব কিছুর দিকে মনোযোগ দিতেই অধিকাংশ সময় চলে যায় বঙ্গবন্ধুর সরকারের। এ ছাড়া, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, পর্যায়ক্রমিক বন্যা ও খরা মোকাবেলা এবং খাদ্য সমস্যাসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মোকাবেলায় অনভিজ্ঞ নতুন সরকারের কিছু কিছু ত্রুটি বিচ্যুতিও ছিল। তা সত্ত্বেও মোটামুটি স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দেশি বিদেশি চক্রের হাতে সপরিবারে নিহত হন রাষ্ট্রের জনক। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত হলো সামরিক-বেসামরিক একনায়ক ও তাঁদের দ্বারা পুনর্বাসিত স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠীর হাতে। এসময় নতুন করে গোপন টাকা ও অস্ত্রের খেলার প্রভাবে রাজনীতিতে কদর্য পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতার বিরোধী গোষ্ঠী আত্মপরিচয় গোপন করে অবস্থান নেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সরকারি-বেসরকারি প্রশাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চতম পর্যায়ে। এ অবস্থায় উল্টে যেতে থাকে প্রগতির চাকা। সর্বত্র সামপ্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রভাবে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলে ইতিহাস বিকৃতির ধারা। নতুন প্রজন্ম হয়ে পড়ে বিভ্রান্ত ও ইতিহাস বিমুখ। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো পালন করা হয় দায়সারাভাবে। যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে ওড়ে জাতীয় পতাকা। দেশ হয়ে ওঠে জঙ্গিবাদের বিচরণ ক্ষেত্র।
অবশেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী শক্তি ক্ষমতায় আসার পর অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে।
এবার এমন এক সময়ে জাতি বিজয় দিবস উদযাপন করছে যখন দেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বেকারত্ব দূরীকরণ ও প্রযুক্তিসহ সার্বিক অর্থনৈতিক সূচকে অনেক উন্নতির দিকে এগিয়ে গেছে। দেশ উন্নীত হয়েছে মধ্যম আয়ের দেশে। দেশ-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রমেও সফল হয়েছে সরকার। ব্যাপক নজরদারি ও অভিযানের ফলে জঙ্গিবাদের উত্থান প্রক্রিয়া অনেকটা নেতিয়ে পড়েছে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের ইতিহাস বলা যাচ্ছে নির্ভয়ে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া দেখে জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশী সংস্থাগুলো সরকার ও জনগণের প্রশংসা করছে। তাই এই বিজয় দিবস বাঙালিদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত ও গৌরবের। এরপরও বলতে হবে মানুষের মুখে হাসি ফোটানো এবং প্রগতির চাকাকে স্থায়ীভাবে সামনের দিকে চলমান রাখার জন্য আরও অনেক কিছু করতে হবে। দুর্নীতি, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের অবসানসহ রাজনীতি ও প্রশাসনে স্থিতিশীলতা আনার জন্য পরিকল্পিত ও আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারের নাম ভাঙ্গিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ও প্রশাসনের ভেতর লুকিয়ে থেকে সরকারের দুর্নাম সৃষ্টিকারী সুযোগ সন্ধানীদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা। আগামী নির্বাচনে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তারা জাতির বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত অসামপ্রদায়িক, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক ভূমিকা রাখবে এটাই কাম্য। (দৈনিক আজাদী থেকে সংগৃহীত)

লেখক : মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী, সম্পাদক-ইতিহাসের খসড়া

এই বিভাগের আরো সংবাদ