আজকের শিরোনাম :

দোয়া করি, নকল নৈরাজ্যের যুগ এবং ভোট ডাকাতির যুগ যেন ফিরে না আসে

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:৫৭

শীতকাল, বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে। আমার বাসা যেখানে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, পাহাড়ের ভেতরে, সেখানে শহরের তুলনায় ঠান্ডা বেশী। শরীর কর্মক্ষম রাখার জন্য কাঠখড় পোড়াতে হয়। শীতের মধ্যে চাদর সোয়েটার খুলে পাহাড়ের ভেতর দৌড়াতে হয়। মেপে মেপে খানা খেতে হয়। বাজার থেকে তাজা তাজা কাগজি লেবু, জলপাই, কলার মোচা, সজনে ডাটা, লাল মেছওয়াক গোটা, পুরোনো তেঁতুল কিনে আনতে হয়। এখানকার বাজারে এসব সামগ্রী পাওয়া যায়। চর্বিওয়ালা গরুর সিনা, খাসীর মাথা, দু’কেজি, আড়াই কেজি ওজনের ঘরের পালা মুরগিকে গুডবাই জানাতে হয়। গরুর কলিজা, ৫ কেজি ওজনের রুইয়ের পেটি, গরুর নলা সামনে রেখে চোখের জল ফেলতে হয়। গতকাল দুপুরে একটা মিটিং ছিল। মিটিং- এ ভাল নাস্তাপানি দেয়। প্লেটে কাটলেট আর গুড়ের সন্দেশ দেখে খাবার আগ্রহ জাগে। ভাবলাম, চামচ দিয়ে সন্দেশ এক চিমটি কেটে চেখে দেখি। চেখে দেখতে গিয়ে পুরোটা সাবাড় করে ফেলি। ডাক্তার বলেই যাচ্ছেন, গুড়ের সন্দেশ খেলে ডায়াবেটিস বাড়ে। ভাই, গুড় ধোয়া তুলসি পাতা নয়। সে চিনির ভাই। যা পান- তা খাবেন না। মাথায় চিন্তা এলো, আমরা ভাল অতীত পার করে এসেছি। আমাদের বাচ্চারা কেমন সময় কাটাচ্ছে?
সকালে পত্রিকায় আত্মহত্যার নিউজটা দেখি। রাত্রে ফেসবুকে এ বিষয়ে দু’একজন পোস্ট দিয়েছে- তা চোখে পড়েছে। ঢাকায় ভিকারুননিসা নুন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী আত্মহত্যা করেছে। অরিত্রী অধিকারী মোবাইল নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকেছিল। এক শিক্ষক এটা টের পেয়ে মোবাইল কেড়ে নেন। তিনি অভিভাবককে দেখা করতে বলেন। বলা হয় অরিত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিউজে বলা হয়েছে মা বাবা অধ্যক্ষের সাথে দেখা করেন। তারা অধ্যক্ষের কাছে ক্ষমা চান। অধ্যক্ষ নাকি অভিভাবককে বের হয়ে যেতে বলেছিলেন। একজন ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে- এটা দুঃখ পাওয়ার মতো ঘটনা। এতে সকলের ক্ষোভ অধ্যক্ষ বা স্কুল প্রশাসনের উপর পড়বে, এটাও স্বাভাবিক ব্যাপার। যে কোন মৃত্যু মানুষকে কষ্ট দেয়। অরিত্রীর মা বাবাকে আল্লাহ শোক সহ্য করার শক্তি দিন। ওই কলেজের অধ্যক্ষ হাসপাতালে গিয়েছিলেন মৃত্যু সংবাদ শুনে, অরিত্রীর পরিবারের লোকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে অধ্যক্ষের গাড়ি ঘিরে ফেলে। এই ছোট্ট মেয়েটির মৃত্যুতে আমিও কষ্ট পেয়েছি। মা বাবাকে সাত্ত্বনা দেয়ার ভাষা আমার জানা নাই। আমাদের সকলের আরো অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হওয়া দরকার।
এক সময় আমরা কি রকম নকলের প্রকোপে ছিলাম, সে কথা ভোলার মত নয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নকলের দৌরাত্ম সম্পর্কে বলতে বললে, বয়স্ক লোকেরা স্মৃতি হাতড়ে অনেক নৈরাজ্যের কথা আপনাকে বলতে পারবে। এখন বাচ্চারা নকল করে না। নকলের স্মৃতি সমূহ এত তাড়াতাড়ি ম্লান হওয়ার কথা নয়। নকল- নৈরাজ্যের যুগ আমরা পেরিয়ে এসেছি। তবে পুরোনো লোকেরা শুধু “এনালগ- নকলের” গল্প শোনাতে পারবেন। এখন কিন্তু নকল ডিজিটাল হয়ে গেছে। ডিজিটাল নকল আগের ওল্ড মডেল- কাগুজে-নকল- শাড়ি, কামিজ, টেবিল, বেঞ্চ, স্কেল, ওড়নায় লেখা নকলের মতো নয়। যেমন সম্প্রতি প্রশ্ন ফাঁস কান্ড সম্পর্কে শুনেছেন। এটা কিন্তু “ই-নকলের” নতুন ভার্সন। আমি এ বছর এবং গত কয়েক বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করেছি। অবাক করা পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বনে অসদুপায়ের চেষ্টা কোন কোন পরীক্ষার্থী করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে “এন্টিপ্রঙি” বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছে, তা আমাদের মতো মানুষকে কেবল অবাক করেছে। বেশ কিছুদিন ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রোভিসি, ডীনগণ খাবার দাবার, ঘুম ভুলে গেছেন। উনাদের ওঈঞ বিভাগ এবং অটোমেশন কর্মী বাহিনীকে নিয়ে উনারা যে ভাবে অন-লাইন যুদ্ধ করেছেন, তা বিস্ময়কর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। হানিফ সিদ্দিকীর মতো ডাইনামিক শিক্ষককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। উপাচার্য একটা ভাল ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। সবাইকে কাজে উদ্বুদ্ধ করছেন। আমি একদিন আইসিটি ভবনে গিয়ে দেখি, হানিফ সিদ্দিকী, নোমান এবং তাদের কর্মীরা রাত জেগে ভর্তির কাজ করছেন। উপাচার্য অটোমেশনের প্রতি অনেক মনযোগী। উনি নিখাদ পরীক্ষা নিবেন। উনার স্ত্রী (ভাবী) আমাকে বলেছেন, “ইফতেখার খানাপিনা ছেড়ে দিয়েছে।” (হিবা দুইজ্যা ভাত ন খা।) একদিন বেলা আড়াইটায় ভিসি সাহেবের কনফারেন্স রুমে আমার একটা মিটিং- এ আমন্ত্রণ ছিল। আমন্ত্রন পেয়ে আমি ভাবলাম, আজ দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় পাব না। যাক, মিটিং-এ গুড়ের সন্দেশ টন্দেশ পাওয়া গেলে খেয়ে নিব। উপাচার্য মহোদয়ের অফিসে গিয়ে দেখি, আড়াইটা বাজতেছে। উপাচার্য ভেতরে আরেকটা মিটিং করছেন। আমি জাহাঙ্গীরকে বল্লাম, উনি খানা খাবেন কখন? এখনই তো আরেকটা মিটিং শুরু হবে? চন্দন পাশ থেকে বলে, স্যার, ভিসি স্যার দুপুরে বিস্কুট টিস্কুট খান। সকল প্রোগ্রাম সেরে রাত্রে বাসায় গিয়ে খাবার খান। এত প্রাণান্তকর চেষ্টার পর বিশ্ববিদ্যালয় একটি পারফেক্ট ভর্তি প্রক্রিয়া উপহার দিয়েছে। পরীক্ষায় ডিজিটাল অসদুপায় অবলম্বন প্রক্রিয়া, যার মধ্যে প্রশ্ন ফাঁস প্রক্রিয়াও আছে, তা কত ভয়াবহ হতে পারে, তা বিগত বছরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় আপনারা দেখেছেন। সরকার পরীক্ষা পদ্ধতিতে পারফেকশন আনা ও নিষ্কুলুষ রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সরকার যুদ্ধ করেছে। সরকার সফলও হয়েছে। কেন ছাত্রছাত্রীরা নকলে উদ্বুদ্ধ হয়- তার সঠিক কারণ কেউ আমাদের বলে দেবেনা। এই প্রশ্ন ধরে টান দিলে, আমাদের সমাজে কম নৈতিকতা, আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকারসহ অনেক কথা চলে আসবে। স্কুল-কলেজের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কেবল জিপিএ-৫ ও ১০০% পাসের জন্য হেড মাস্টার ও অধ্যক্ষকে চাপ দেয়। অভিভাবকরা ও অধ্যক্ষকে দায়ী করে জিপিএ-৫ কতজন পেয়েছে? কম কেন?
নকল- নৈরাজ্য এবং ভোট ডাকাতি আমাদের মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। আমরা অসহায় ছিলাম। নকলের নৈরাজ্য এবং ভোট ডাকাতি- এ দুটি বিষয়ে আমার অনেক মজার ও দুঃখের অভিজ্ঞতা আছে। তবে সবই এনালগ অভিজ্ঞতা। ডিজিটাল ভোটিং কিংবা অন-লাইন ভর্তি প্রক্রিয়া, ডিজিটাল পরীক্ষার পদ্ধতির খোঁজ খবর আমরা পাচ্ছি- ৯৬ সালের পর। তার আগে ইরশাদুল হক নামে একজন শিক্ষা সচিব ছিলেন। তিনি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কাজটা তখন শুরু হয়েছিল। শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারনার আওতায় আজ যত অগ্রগতি হয়েছে তা প্রশংসনীয়। ১৯৭৪ সালের ১১ নভেম্বর আমি চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে যোগদান করি। আমি যা দেখেছি, তা হলো, এই কলেজে সিএ- চাটার্ড একাউন্টেন্সি, আই সি এম এ এই দুই কোর্সের সান্ধ্যকালীন ক্লাস হতো। কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ রাত্রে অফিস করতেন। আমি আইসিএমএবিতে ড়ভভরপব সধহধমবসবহঃ পড়াতাম। সিএ ফাইনালে কোম্পানী ল’ পড়াতাম। এই পরীক্ষাগুলোও কমার্স কলেজ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হতো। ল পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল কমার্স কলেজ। এখন যে আইবিএম আছে, সে তখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা মনে পড়ছেনা, তবে ব্যাংকারদের প্রফেশনাল পরীক্ষা এই কেন্দ্রে হতো। আমার এক সহকর্মী এখন একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে। সে আর আমি কমার্স কলেজের ২ নং গ্যালারী ভবনে ব্যাংকারদের পরীক্ষার ডিউটি করছি। খাতা প্রশ্ন দেয়ার পর আমরা লক্ষ্য করি, যে- পরীক্ষার্থীরা পকেট থেকে কাগজপত্র বের করছেন। উনারা তো চাকরিজীবী- আমাদের ছাত্র নন। চক্ষু লজ্জার ব্যাপার আছে। আর সবাই যে এ রকম তা নয়। অধিকাংশ ভাল মানুষ। বয়স্কও আছেন। তবে খুব কম বয়সেরও আছেন। ৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত দেশে কি অবস্থা ছিল তা কেবল বুড়োরা বলতে পারবে। আজকের তরুণরা সে সময়ের নৈরাজ্যকর অবস্থার কথা কল্পনাও করতে পারবেনা। ব্যাপক নকল আমাদের পরীক্ষার হলে শুরু হয়েছে তা আমরা বুঝতে পারি। তখন সরকারি কমার্স কলেজ একটা ব্যতিক্রমধর্মী কলেজ ছিল। এই কলেজের ছাত্ররা নকল করতনা। কিন্তু বাইরের পরীক্ষা আমরা নকলমুক্ত নিতে পারবনা, তা তো হতে পারে না? আমরা অনেকের কাছ থেকে বই, অবৈধ কাগজপত্র নিয়ে ফেলি। কিন্তু ব্যাংকের কিছু পরীক্ষার্থী বেপরোয়া ছিলেন। আমার সহকর্মী গ্যালারীর পেছন থেকে এসে আমাকে বল্লেন, পেছনের অবস্থা খারাপ। উনাকে ক্লান্ত এবং বিমর্ষ মনে হচ্ছিল। আমি বলি, কি হয়েছে? উনি বল্লেন, পেছনে আসেন। গ্যালারীর শেষ প্রান্তে যাই। ও দিকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। দুই পরীক্ষার্থী বই খুলে লিখছে। আমি ও আমার সহকর্মী বই নিয়ে নিই। একজন কোমর থেকে পিস্তল বের করে খট্ করে টেবিলের উপর রাখে। আমার দিকে তাকিয়ে বলে, এই দেশে ঘুষ বন্ধ করতে পারছেন? দূর্নীতি বন্ধ করতে পারছেন? আমাদের নিয়ে টানাটানি করতে আসছেন কেন? আমার মাথায় একটা চিন্তা আসে, যারা পেশাদার সন্ত্রাসী, তারা আর্মস ব্যবহার করে। অস্ত্রই ওদের পুঁজি। ওরা এমুনেশন কে ওয়ার্ম রাখে। পিস্তলের ব্যারেলে ফুল থ্রো মেরে পরিষ্কার রাখে। কিন্তু ব্যাংকের কর্মচারী বা ব্যাংকের চাকরি প্রার্থী কোন পেশাদার খুনি নয়। সে ভয় দেখানোর জন্য পিস্তল এনেছে। তার ম্যাগজিনে চকচকে গুলি ঢোকানো হয়নি। তার হাত কাঁপবে। তার ট্রিগার তার সাথে বিট্রে করবে। রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার মতো দুঃসাহস তার নাই। এই কক্ষে শতাধিক মানুষ আছে। এখানে কিছু করতে সে যাবে না। গেলে মব সৃষ্টি হবে। আমি তার পিস্তলে হাত রাখি। নকল বন্ধ করার জন্য এক কালে এদেশে অনেক শিক্ষককে অনেকভাবে হেনস্তা হতে হয়েছে। সাফায়াত আহমদ সিদ্দিকী স্যার চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। সনটা এক্যুরেট মনে নাই। ৭৬/৭৭ সালের দিকে। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি এক অভিনব কাজ করেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, আমি এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নকলমুক্ত ভাবে নিব। তখন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কমার্স কলেজের এইচএসসি ছিল- কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে। অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। আমি স্যারকে বলি, স্যার শিক্ষা বোর্ডের কন্ট্রোলার শাখায় জনবল আছে ৫/৭ জন। এদের দিয়ে আপনি সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত এত শত পরীক্ষা কেন্দ্র কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন? রহিম স্যার পাশে ছিলেন। বল্লেন, তোমার সাহস কি? তুমি স্যারের সাথে মুখে মুখে কথা বলছ? স্যার, পারবেন না, এটা হতে পারে? আমি অবাক বিস্ময়ে বলেছিলাম, স্যার, সিলেট অঞ্চল, কুমিল্লা অঞ্চল, চট্টগ্রাম অঞ্চল গোটা বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ নিয়ে গঠিত কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা সুপারভিশনের জন্য আপনি এত লোকবল কোথায় পাবেন? সিদ্দিকী স্যার আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। বল্লেন, ফজুল হক? (এভাবে ডাকতেন তিনি আমাকে) বাংলাদেশ কি ভাবে স্বাধীন করেছ? তোমাদের রেগুলার সৈন্য বাহিনী ছিল? লোকবল আগে? না, উদ্যম আগে? লোকবল আগে? নাকি সদিচ্ছা আগে? আমরা শিক্ষকরা নকলের কাছে মাথা নত করতে পারি? একজন ইঞ্জিনিয়র যদি নকল করে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে, তাহলে ভবিষ্যতে দেশে সকল ৮০/৯০ তলা ভবন ধসে পড়বে। ডাক্তার যদি নকল করে ডাক্তারি পাস করে, তাহলে বাতের রোগীকে ক্যান্সারের ওষুধ খাওয়াবে। একজন নকল করা লোক যদি শিক্ষক হন, তাহলে উনি জাতির মেরুদণ্ডে ঘুনপোকা ঢোকাবেন। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তদান ব্যর্থ হবে। যদি নকল বন্ধ করতে না পার, ঘুষ দুর্নীতি, ব্যাংক ডাকাতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থায়- ধস কোন কিছু বন্ধ হবে না। রাজনীতি বিকলাংগ হবে। “ভবিষ্যৎ কালিঝুলি” এমন শব্দগুলো আমাদের অভিধান থেকে মুছে ফেলো- ফজুল হক। বাঁচতে যদি চাও সম্মানের সাথে বাঁচবে। মরতে যদি হয় বীরের মতো মরবে। কার এমন শক্তি আছে- নকলে বাধা দিলে গায়ে হাত তুলবে?
আপনারা যারা পুরোনো শিক্ষক- অধ্যাপক আছেন, হয়ত আপনাদের মনে আছে, সিদ্দিকী স্যার, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার পর পাবলিক পরীক্ষায় উনি উনার শিক্ষা বোর্ড অঞ্চলের সকল কলেজ দুদিন বন্ধ রেখে ইংরেজি ও বাংলা পরীক্ষায় সকল কলেজ শিক্ষককে পরীক্ষা সুপারভিশন করতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে পাঠিয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীকে এ ব্যাপারে স্যার কনভিন্স করতে পেরেছিলেন। আমি আপনাদের বোঝাতে চাচ্ছি, তখন নকল কি ব্যাপক মহামারী ছিল- হয়ত আজ অনেকের চিন্তায় সেটা আসবে না। আমরা আর নকলের নৈরাজ্যের দিনে ফিরে যেতে চাই না। নকলের সে মহোৎসবে অভিভাবক, কিছু শিক্ষক, পলিটিক্যাল টাউট সবাই যোগ দিত। এখন পরীক্ষা পদ্ধতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
ভোট ডাকাতির ঘটনা দেখেছি। ১৯৮৪ সালে আমাকে সরকারি কমার্স কলেজ থেকে পটিয়া সরকারি কলেজে বদলি করা হয়। আমি পটিয়া কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করি। তখন অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন ননী গোপাল চৌধুরী, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগে ছিলেন হোসাইন আহমদ স্যার- আরো অনেক নামকরা শিক্ষক পটিয়া কলেজে ছিলেন। তখন পটিয়ার টিএনও ছিলেন আমার ক্লাস মেট আবদুল বাকি। এখন সে প্রয়াত। এরশাদ সাহেবের সরকার সম্পর্কে, উনার আমলের নির্বাচন সম্পর্কে, আমি কোন মন্তব্য করব না। ইতিহাস সবাই জানে। নির্বাচনে পটিয়া কলেজের শিক্ষকদের পটিয়া থানার বিভিন্ন কেন্দ্রে ডিউটি দেয়া হয়েছে। হোসেন স্যারের কথা বলতে পারবো না, তবে ননী বাবু, নাজিম ভাই, শিহাব, সেকান্দার, শফিক সাহেব সকলে ডিউটি পেয়েছেন। পশ্চিম পটিয়া ডাংগারচর বা ফকিরনির হাটের দিকে কোন একটি কেন্দ্রে আমার এক সহকর্মীকে ডিউটি দেয়া হয়েছে- সেখানে যেতে হবে কালুরঘাট ব্রিজ হয়ে শহর ঘুরে। তখন আমানত ব্রিজ ছিল না। তাকে নদী ও পার হতে হবে। আমাকে সুপারভিশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। শহরের বাসা থেকে পটিয়া এসে এ দায়িত্ব পালন করা আমার জন্য কষ্টকর ছিল। নির্বাচনের দিন তো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ থাকে। কেন্দ্র থেকে ফলাফল আসছে। রেডিওতে ফলাফল ঘোষণাও হচ্ছে। টিভিও ঘোষণা করছে। তখন টিভি মানে- বিটিভি- সাহেব, বেগম, গোলামের বাঙ। কি ফল আসছে আর কি ঘোষণা হচ্ছে, কোন সেনসিবল লোক যদি এখানে থাকে, সে দুঃখ পাবে। সে জীবনে কোনদিন স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নিয়া কথা বলবে না। আমরা ৭১ সালে স্বাধীনতা একবার এনেছি। কিন্তু বহুবার এই স্বাধীনতাকে হয় কলংকিত করেছি, না হয় হত্যা করতে চেয়েছি। পশ্চিম পটিয়াতে যে প্রিসাইডিং অফিসারকে পাঠানো হয়েছিল সে রাত্রে ভোটের মেটেরিয়াল নিয়ে পটিয়া ফিরতে পারেনি। সে না আসা পর্যন্ত টিএনওর ঘুম হারাম। এখান থেকে তো ফলাফল চলে গেছে। কিন্তু সে প্রিসাইডিং অফিসার তো আসে নাই। ওই কেন্দ্রের ফলতো টিভিতে দেখানো হচ্ছে। যদি সে সাংবাদিকের খপ্পড়ে পড়ে? আমরা এই ভোটিং সিস্টেমে আর ফেরৎ যেতে চাই না।
এখন স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা নকল করে না। পরীক্ষার পদ্ধতি বদলে গেছে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থা ডিগ্রিমুখী এবং পরীক্ষা নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। জিপিএ-৫ এর জন্য শিক্ষক ও মা বাবা বাচ্চাকে চাপের মধ্যে রাখে। কোচিং সেন্টারগুলো আরো বিপজ্জনক। ৩০ টা ক্লাস নিলে তারা ৩০ টা টেস্ট নেয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো হেড মাস্টার বা অধ্যক্ষকে বলে ১০০% পাস করাতে হবে। জিপিএ- ৫ এর সংখ্যা বাড়াতে হবে। ভাল স্কুল মানে, বেশি জিপিএ। ভাল ছাত্র সে, যে পায় গোল্ডেন জিপিএ বা ডায়মন্ড জিপিএ। গত বছর গণমাধ্যমে খবর বেরোলো চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ- ৫ কমেছে। পাসের হার কমেছে। যেন ওটা শিক্ষা বোর্ডের দোষ। আমরা বাচ্চাদের সঠিক মানুষ বানাবো? না, জিপিএ-৫ প্রাপ্ত বানাবো? (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া)

লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

এই বিভাগের আরো সংবাদ