আজকের শিরোনাম :

ঠাকুরের চিকিৎসা-ভাবনা ও সিংহ রায়ের বই

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০১৮, ১৫:২৭ | আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০১৮, ১৬:৩১

।। যতীন সরকার ।।

সুভাষ সিংহ রায়-এর বইটি হাতে নিয়েই মনে পড়ে গেল কবিগুরুর ‘খাপছাড়া’ সেই ছড়াটি-
        “পাড়াতে এসেছে এক নাড়ীটেপা ডাক্তার,
        দূর থেকে দেখা যায় অতি উঁচু নাক তার।
            নাম লেখে ওষুধের
            এ দেশের পশুদের
        সাধ্য কি পড়ে তাহা এই বড়ো জাঁক তার।
            যেথা যায় বাড়ি বাড়ি
            দেখে যে ছেড়েছে নাড়ী,
        পাওনাটা আদায়ের মেলে না যে ফাঁক তার।
        গেছে নির্বাকপুরে ভক্তের ঝাঁক তার।”

সেই সঙ্গে আরও অনেক অনেক কথা মনের কোণে এসে ভিড় করল। সুভাষের বইটি পড়তে পড়তে সে-সবেরও অনেক কিছুই নতুন করে ঝালিয়ে নিলাম। অনেক আগে পড়েছিলাম নির্মল কুমারী মহলানবিশের ‘বাইশে শ্রাবণ’ বইটি। সেটিই আবার পড়লাম।
প্রথম যখন ‘বাইশে শ্রাবণ’ পড়েছিলাম, তখনই আমার মনে ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে কবিগুরুর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, তিনি ‘নিহত’ হয়েছেন, ডাক্তাররাই তাঁর নিহন্তা। কবির ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করেই ডাক্তাররা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, এবং ১৯৪১ সালের জুলাই মাসের ৩০ তারিখে কবির দেহে সেই অস্ত্রের উপচার ঘটিয়েছিলেন- অর্থাৎ ‘অপারেশন’ করেছিলেন। ডাক্তারি পরিভাষার এই ‘অপারেশন’ শব্দটি ‘অস্ত্রাঘাত’-এর মতো নির্দয়তার দ্যোতক নয় নিশ্চয়ই, তবু অনেক ক্ষেত্রে অনেক ডাক্তারের প্রয়াস-যে প্রমাদে পরিণত হয়ে অনেক অঘটন ঘটায়- সে-কথাও তো অস্বীকার করা চলে না। এ-রকম মহা-অঘটন কি ঘটেছিল বা ঘটানো হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও?

সেদিন একান্ত ক্ষোভের সঙ্গে আমার ভেতর যে-প্রশ্নের উদ্ভব ঘটেছিল, এতদিন পর সেই ক্ষোভ আর তেমনভাবে নেই। তবে একেবারেই যে নেই, তা-ও বলতে পারছি না। তবু, নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি যে, সুভাষ সিংহ রায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিকিৎসা-ভাবনা’ আমার ভাবনায় বেশ কিছু নতুনত্বের সঞ্চার ঘটিয়েছে। হোমিওপ্যাথি ও বায়োকেমিক চিকিৎসায় যে কবির গভীর অনুরাগ ও দক্ষতা ছিল, বিভিন্ন সূত্রেই সে-কথা আমরা জেনেছি, পরিচিত হয়েছি তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে। সুভার সিংহ রায় তাঁর লেখায় অনেক দৃষ্টান্ত সহযোগে কবির সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে একালের পাঠকদের সামনে স্পষ্টতর করে তুলে ধরেছেন। সুভাষের লেখা থেকেই আমরা কবির ভাবনাধারার জঙ্গমতার পরিচয়ও পেয়ে যাই। যেমন-

“প্রথম জীবনে হোমিওপ্যাথিতে আসক্ত রবীন্দ্রনাথ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানকে সেভাবে কাছে টানতে পারেন নি। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবধান দ্রুতলয়ে ঘুচে গেছে। যত বয়স বেড়েছে তত আরও বেশি ‘মুক্ত’ হয়েছেন রবিঠাকুর। বেড়েছে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনুরাগ, বেড়েছে অনুরক্ত অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসকদের সঙ্গে সখ্য, অন্তরঙ্গতা।
‘প্রবৃত্তির মধ্যে’ বিজ্ঞান ছিল গভীরভাবে, বিজ্ঞান ছিল তাঁর অনুশীলনের মধ্যেও। তাই সাহিত্যিক হয়েও রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞাননিষ্ঠ, বিজ্ঞাননিষ্ঠ হয়েও কবি।...

ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়া-সহ বহু দেশের অসংখ্য স্বনামধন্য চিকিৎসকের সঙ্গে শ্রদ্ধাপূর্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল পরিণত বয়সের রবীন্দ্রনাথের। পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী-সহ অনেককে নানা সময়ে রোগ সারাতে পরিচয়জ্ঞাপক চিঠি-সহ কবি পাঠিয়েছেন এ-রকম নানা বিদগ্ধ চিকিৎসকের কাছে।

কম বয়স থেকে ‘কুসংস্কারের জঞ্জাল ঠেলতে ঠেলতে’ বেড়ে উঠেছেন যে-কবি, হোমিওপ্যাথি বা বায়োকেমিকে তীব্র বিশ^াস থাকলেও প্রয়োজনে তিনি-যে সংস্কারমুক্ত খোলা মনে আঁকড়ে ধরবেন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানকে, এতে বিস্মিত হবার কোনো কারণ থাকে না। মহাপ্রতিভার বিরল সৃজন-আবর্তে জন্ম নিয়েছে তীব্র সৃজনদক্ষতা।

 ব্যাধি নিরাময়ের ক্ষেত্রে সংগীত-প্রয়োগের (Music Therapy) যে উল্লেখনীয় ভূমিকা রয়েছে তা নিয়ে আজকাল বিশেষভাবে আলোচনা হচ্ছে ও প্রয়োগ হচ্ছে। আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ পূর্বে ওষুধ-ব্যবহারের সঙ্গে চিকিৎসা-পদ্ধতির সহায়ক রূপে রোগ-উপশমে সংগীত-প্রয়োগের যে কার্যকর ভূমিকা রয়েছে রবীন্দ্রনাথ তা হাস্যপরিহাসে ব্যক্ত করেছেন।”

ভাবনার জঙ্গমতাই কবিকে অতীতের রাহুগ্রাস থেকে সর্বদা মুক্ত করে রেখেছে, করে তুলেছে আধুনিক। শুধু আধুনিক নয়, যথার্থ আধুনিক। ফ্যাশনদুরস্ত আধুনিকতা নয়, প্রাতিস্বিক ও স্বকীয়তাদীপ্ত আধুনিকতা। সে-আধুনিকতা বিগত দিনের ঐতিহ্যের ঘাতক নয়, নয় বৃন্তহীন কুসুম। চিকিৎসা-ভাবনাতেও এ-রকম আধুনিকতার অনুবর্তিতাতেই রবীন্দ্রনাথ “সারাজীবন ধরে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার বিকল্প সন্ধান করেছেন। মধ্যবয়সে তিনি ছিলেন হোমিওপ্যাথির ভক্ত, শেষজীবনে বায়োকেমিক ও কবিরাজির অনুরক্ত। একান্ত নিরুপায় না হলে তিনি অ্যালোপ্যাথিকে এড়িয়ে চলতেন।”

‘কবিরাজি’ মানে আয়ুর্বেদ। প্রাচীন ভারতবর্ষে উদ্ভূত ও চর্চিত আয়ুর্বেদকে কেবল ‘চিকিৎসাশাস্ত্র’ রূপে চিহ্নিত করলে খুবই ভুল করা হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে আয়ুর্বেদ হলো ‘আয়ু সম্পর্কীয় বিদ্যা’। [‘বেদ’ আর বিদ্যা’- দুটো শব্দেরই মূলে আছে ‘বিদ্’ ধাতু। ‘বিদ্’ মানে ‘জানা’ বা জ্ঞান লাভ করা। আয়ু বা জীবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায় যে-বিদ্যার সাহায্যে তা-ই ‘আয়ুর্বেদ’। আয়ু সম্পর্কীয় সামগ্রিক জ্ঞানের আকরই হলো আয়ুর্বেদ। এ-কারণেই একে ‘পঞ্চম বেদ’-এর মর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছে।]

শুধু মানুষের আয়ু বা জীবন নয়, সকল জীবের (এমনকি গাছপালারও) জীবন নিয়ে আয়ুর্বেদজ্ঞ পন্ডিতগণ মাথা ঘামিয়েছেন। গজায়ুর্বেদ, অশ্বায়ুর্বেদ, গবায়ুর্বেদ, বৃক্ষায়ুর্বেদ ইত্যাদি শাস্ত্রনামই এ-কথার সত্যতা প্রমাণ করে।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্র নিয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গভীর ও বিস্তৃত আলোচনা করেছেন বিশিষ্ট বস্তুবাদী দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘সায়েন্স এন্ড সোসাইটি ইন এনশিয়েন্ট ইন্ডিয়া’ গ্রন্থটিতে। এ-বিষয়ে বাংলায়ও তাঁর কিছু লেখা আছে। দেবীপ্রসাদের লেখাগুলো পাঠ করলে আমরা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের বৈজ্ঞানিকতা সম্পর্কে অবহিত হতে পারব।

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রচর্চাকারীদের যে ‘কবিরাজ’ বলা হয়- এ-বিষয়টিও বিশেষ তাৎপর্যবহ। উনিশ শতকের বাংলার সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে, “ভারতবর্ষে পূর্বে জ্ঞানী মাত্রকেই কবি বলিত, শাস্ত্রবেত্তারা সকলেই কবি।” আয়ুর্বেদ শাস্ত্রবেত্তাদের ‘কবিরাজ’ (কবিশ্রেষ্ঠ) বলার মধ্যদিয়ে সকল শাস্ত্রের ভেতর আয়ুর্বেদকেই যে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে- এ-কথা সহজেই বোঝা যায়।

কবিসার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ শুধু কবিতা-রচয়িতা রূপেই কবি নন, আয়ু-সম্পর্কীয় বিদ্যা তথা প্রাচীন ও আধুনিককালের সর্বপ্রকার ‘আয়ুর্বেদ’ বিদ্যার ধারক রূপেও তিনি ‘কবিরাজ’। এই কবিরাজ জীবনের শেষ পর্বে যে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছিলেন- সে-কথা নির্মলকুমারী মহলানবীশসহ অনেকের লেখা পড়েই আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু দুঃখ এই, তাঁর সেই শ্রদ্ধাশীলতাকে তখনকার অনেক বাঘা বাঘা অ্যালোপ্যাথই যথাযথ মর্যাদা দেন নি। অথচ একান্ত গভীর প্রত্যয় থেকেই মৈত্রেয়ী দেবীকে রবীন্দ্রনাথ বলতে পেরেছিলেন,-
“... অ্যালোপ্যাথিতে যত ওষুধ যে-পরিমাণ শরীরে ঢোকান হয় তার কোনো প্রয়োজন নেই। শরীর সেসব গ্রহণ করে না, করতে পারে না। এই দেখ না ক্যালসিয়াম। অ্যালোপ্যাথিতে যে রকমভাবে খাওয়ায় এই এতখানি করে তার কিছুই Assimilated হয় না। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম Cell, তাদের গ্রহণ-বর্জন সবই সূক্ষ্ম। একগাদা করে ওষুধ খেলেই কি কাজ হয়? শরীর ফিরিয়ে দেয়। এক এক সময়ে আমার মনে হয় আমি যদি ইচ্ছে করতুম তাহলে ভালো ডাক্তার হতে পারতুম। ডাক্তারের একটা Instinct থাকা চাই। শুধু জানা আর Experience নয়, Instinct। আমার মনে হত আমার সেটা আছে। কারও অসুখ করেছে শুনলে যতক্ষণ না তার একটা ব্যবস্থা হয় আমি তো নিশ্চিত হতে পারিনে। অধিকাংশ লোকই দেখি এ সম্বন্ধে এত উদাসীন।...”

মৈত্রেয়ী দেবীর বই থেকে রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেয়ার পরই সুভাষ সিংহ রায় লিখেছেন,-
“এইসব আলোচনা থেকে এটিই মনে হয় যে, ভারতের নিজস্ব চিকিৎসাপ্রণালীকে তিনি [রবীন্দ্রনাথ] বোধ হয় কল্পনা করতেন একটি বৃক্ষরূপে, যার শিকড় থাকবে আয়ুর্বেদে, আর যার শাখা-প্রশাখায় থাকবে হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, বায়োকেমিক, যোগ-প্রাকৃত চিকিৎসা, অস্টিওপ্যাথি, হাইড্রোথেরাপিক্স ও অন্যান্য পরিপূরক চিকিৎসাপ্রণালী। আয়ুর্বেদই তো ছিল ভারতের নিজস্ব চিকিৎসা জুগিয়েছে এবং এখনো বর্তমান প্রজন্মের অনেককে জুগিয়ে চলেছে। পাশ্চাত্যের ভালো জিনিসকে নিতে গিয়ে আমরা নিজেদের ভালো জিনিসকে বর্জন করেছি, আয়ুর্বেদকে ব্রাত্য করেছি। ঐতিহ্যের প্রতি মমতা না থাকলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না।”

ডাক্তারদের যে-রকম Instinct থাকা দরকার, সে-রকম Instinct যে তাঁর মধ্যে আছে, অত্যন্ত বিস্ময়কর রূপে রবীন্দ্রনাথ তা নিজেই উপলব্ধি করেছিলেন, এবং স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছিলেন। সেই Instinct-এর বলেই বোধ হয় জীবনের সর্বশেষ বৎসরে কবির উপলব্ধিতে এসেছিল যে : কবিরাজি চিকিৎসায় তিনি আরোগ্য লাভ করবেন, তাঁর দেহে অস্ত্রোপচার করার কোনোই প্রয়োজন হবে না। কিন্তু, নির্মল কুমারী মহলানবীশ তাঁর বইয়ে লিখেছেন,-
“কম বয়সী ডাক্তাররা, বিশেষ করে সার্জনের দল, যেমন ডা. প্রেমনীহার রায় প্রভৃতির মত, যে তখনই অপারেশন করে ফেলা দরকার।

রথীবাবু [অর্থাৎ কবির পুত্র] অত্যন্ত বিপন্ন বোধ করলেন এ প্রস্তাবে। আমার স্বামী [অর্থাৎ প্রশান্ত মহলানবিশ] পরামর্শ দিলেন মেজমামার [অর্থাৎ ডাক্তার স্যার নীলরতন সরকারের] মত না নিয়ে কিছু করা ঠিক হবে না। অল্পবয়সী ডাক্তাররা এখন স্যার নীলরতনকে বেশি আমল দিতে চান না; মনে করেন যে, বার্ধক্যে ওঁর সেই আগের প্রতিভা মøান হয়ে এসেছে, কাজেই তাঁর বিচারশক্তির উপর সব সময় নির্ভর করা যায় না। উনি বড়ো বেশি সেকেলে মতামতের লোক ইত্যাদি। তবু আমাদের কাজে তিনি এখনও ‘মরা হাতি লাখ টাকা’। অতএব তাঁর ডাক পড়লো। অন্যান্য ডাক্তারদের সব যুক্তি-তর্ক বৃদ্ধ স্থির হয়ে বসে শুনলেন। সকলের বলা হয়ে গেলে স্বভাবসুলভ মিষ্টি গলায় মৃদু হাসির সঙ্গে বললেন, আপনাদের কথা সবই ঠিক যে, এ অপারেশন খুবই সহজ। অনেকবার অনেক বৃদ্ধের রোগ আপনারা সারিয়েছেন, সামান্য একটা ফোড়া কাটার মতো ব্যাপার। সবই মানলাম, কিন্তু আপনারা একটা কথা মনে রাখছেন না যে, রুগী অন্য কোনো লোক নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সর্বসাধারণের মতো ওঁর ‘নার্ভাস সিস্টেম’ নয়। সুকুমার দেহ ওঁর, কাজেই অন্য লোকের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। খুব ভালো করে সুরে বাঁধা একটা বাদ্যযন্ত্রের মতো। বাইরে থেকে আঘাত করতে গেলে যে ধাক্কা শরীরে লাগবে, তাতে ওঁর সমস্ত দেহযন্ত্রটাই বিকল হয়ে যাবার আশঙ্কা। আমার মনে হয় না এই ‘রিস্ক’ নেওয়া উচিত হবে। ওষুধ দিয়েই এখন চিকিৎসা হোক না! রথীবাবু যেন বেঁচে গেলেন, বললেন- নীলরতন বাবুর মতের বিরুদ্ধে কিছু করা হবে না। আমরা সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম সেদিন অস্ত্রাঘাত বন্ধ হল বলে।”

কিন্তু হায়, এই স্বস্তি হলো খুবই স্বল্পস্থায়ী। অল্পবয়সী ডাক্তারদের প্রবল প্রতাপের সামনে হার হলো বৃদ্ধ নীলরতনের। প্রবল প্রতাপান্বিত ডাক্তারদের অন্যতম ছিলেন প্রখ্যাত বিধানচন্দ্র রায়ও।
এসব বিষয়ের দিনানুদৈনিক খবর জানার জন্যই নির্মলকুমারীর ‘বাইশে শ্রাবণ’ অবশ্যপাঠ্য একটি পুস্তক। পুস্তকটির উপক্রমণিকায় তিনি ‘কবি প্রসঙ্গ’ বিষয়ে বলতে গিয়ে উপস্থাপন করেছেন তিনটি প্রবন্ধ- ‘ওঁ পিতা নোহসি’, ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’ এবং ‘আনন্দমেলায় কবির গল্প’। এরপরই শুরু মূল ‘বাইশে শ্রাবণ’ এবং তার শুরুতেই-
“মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে, ১৯৪০ সালে অগস্ট মাসের সাত তারিখে, রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ডের ডিগ্রি পেলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রনাথের জন্য এই বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন শান্তিনিকেতনেই করেছিলেন- কারণ শরীর অপটু, অন্যত্র কোথাও গিয়ে ডিগ্রি নেওয়া সম্ভব হতো না।”

শরীর ‘অপটু’ হলেও সেই অপুটতা দূর করার জন্য অস্ত্রোপচারের বিধানকে কোনোমতেই কবি মেনে নিতে পারছিলেন না। ১৯৪১ সালের জুলাই মাসের নবম দিনেও নির্মলকুমারীকে তিনি বলেছিলেন,-
“দেখো রানী, আমি কবি- আমি সুন্দরের উপাসক। বিধাতা আমার এই দেহখানা সুন্দর করে গড়েছিলেন। এখান থেকে বিদায় নেবার সময়, এই দেহখানা সুন্দর অবস্থাতেই তাঁকে ফিরিয়ে দিতে চাই। গাছ থেকে শুকনো পাতা যেমন আপনি ঝরে যায়, পক্ব সুপারি ফল যেমন বৃন্ত থেকে আপনি খসে পড়ে, আমারও ঠিক তেমনি ভাবেই সহজে বিদায় নেবার ইচ্ছে চিরকাল। কেন এরা যাবার আগে ছেঁড়াখোঁড়া করে দিতে চাচ্ছে? বয়স তো তের হয়েছে, আর কদিনই-বা মানুষ বাঁচে, কাজেই ছেড়ে দিক না আমাকে। ফুলের মতো, ফলের মতো, শুকনো পাতার মতো আমার পরিসমাপ্তি ঘটুক।”

সে-সময়কার কবির ‘শুভানুধ্যায়ীরা’ তাঁর এ-রকম ‘পরিসমাপ্তি’ ঘটতে দিতে কোনোমতেই রাজি হলেন না। কবি যে অনেক ভরসা নিয়ে কবিরাজি চিকিৎসা করাচ্ছিলেন, সেটিও তাঁরা চলতে দিলেন না। কবি-পুত্র রথীন্দ্রনাথকে তাঁরা বোঝালেন,
“... এখনও সময় থাকতে অপারেশনটা করিয়ে ফেললে কবির মাথাটাকে বাঁচানো যাবে, আরও বহুদিন উনি সাহিত্যের ভা-ারে অনেক রতœ যোগাতে পারবেন। এখন রোগের বিষয়টা শরীর থেকে বেরোতে পারছে না, তাই মাথাটা আগের চেয়ে ঝাপসা হয়ে আসছে। এরপরে সেটা আরও বেশি হবে, তখন আর ফিরবার রাস্তা থাকবে না। তার চেয়ে এই অতি সহজ অপারেশনটা করিয়ে নিলে ওঁকে কার্যক্ষম করেই আরও দশ বছর বাঁচানো যাবে- ওঁর শরীরের অন্যান্য যন্ত্রগুলো এখনও এত ভালো আছে।”

এ-রকম ‘অকাট্য যুক্তির’ কাছে কবি-পুত্রকে মাথা নোয়াতেই হলো। এবং আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হলো এর করুণ পরিণতিও। ১৯৪১-এর ৩০ জুলাই অস্ত্রোপচার, আর আট দিন পর ৭ আগস্ট মহাকবির মহাপ্রস্থান।
অস্ত্রোপচারের কয়েক ঘণ্টা পর কবিকে দেখতে গেলেন নির্মলকুমারী মহলানবিশ। লিখেছেন,-
“আন্দাজ বারোটার সময় রুগীকে [অর্থাৎ কবিকে] তাঁর নিজের খাটে এনে শোয়ানো হলো। আমি আর আমার স্বামী খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখেই বিরক্ত মুখে বললেন, ‘জ্যোতি মিথ্যে কথা বলেছে। কেন বলেছিল যে, কিছু লাগবে না। আমার খুব লেগেছে- এত কষ্ট হচ্ছিল যে আমি জোর করে ঠোঁট টিপে চোখ বুজে পড়ে রইলুম- পাছে আমার মুখ দিয়ে কোনোরকম আর্তনাদ বেরিয়ে যায়।’ বলতে বলতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। উত্তেজিত হচ্ছেন দেখে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

সত্যসখা দাদা তখনও বাড়ি যান নি দেখে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি রকম বুঝছো? বললেন, এখনকার মতো তো হলো, কিন্তু শেষ রক্ষা হলে হয়। সত্যসখা দাদার মনেও মেজমামা স্যার নীলরতন সরকারের মতো কবির শরীরে অস্ত্রাঘাত সম্বন্ধে একটা আশঙ্কা ছিল। আর সেই জন্যেই তাঁকে এবার অপারেশনের পরামর্শের মধ্যে ডাকা হয়নি। দাদার মনোভাব জানতাম, তাই গোড়া থেকেই আমারও মনে এত ভয়।”

আমরা সকলেই জানি : ‘শেষ রক্ষা’ হয়নি। হবে না-যে কবিগুরু নিজে তা জানতেন, আর জানতেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ডাক্তার স্যার নীলরতন সরকার। দুজনই ছিলেন যথার্থ Instinct এর অধিকারী। সেই অধিকারের বলেই কোনো প্রকৃত কবি-শিল্পীর সঙ্গে অন্য মানুষের পার্থক্য-রেখাটি সম্পর্কে তাঁরা সুস্পষ্ট রূপে অবহিত ছিলেন।

শুধু Instinct এর কথা নয়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের সূত্রাবলির সঙ্গেও তাঁদের যে মোটামুটি পরিচয় ছিল বিভিন্ন সূত্র থেকেই তা জানা যায়। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদভিত্তিক পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান দেখিয়েছে যে, মানুষের সঙ্গে পশুর প্রধান পার্থক্য হলো : পশুর স্নায়ু প্রক্রিয়ায় থাকে একটি মাত্র সাংকেতিকতন্ত্র (Signalling System), আর মানুষের মধ্যে বিদ্যমান দুটো তন্ত্র। এই দুটো সাংকেতিক তন্ত্রের অবস্থান, কার্যপদ্ধতি ও পারস্পরিক সম্পর্কের গভীর ও বিস্তৃত পর্যালোচনার ভিত্তির ওপরই গড়ে উঠেছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানের বিশাল সৌধ। অথচ, এই মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে প্রকৃত পরিচয় ঘটেছে আমাদের দেশের খুব কম লোকেরই।

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়, বিশেষ করে তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে, অন্য বহু দেশের মতোই আমাদের দেশেও ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। শিল্প-সাহিত্যের স্রষ্টা ও সমালোচকদেরও অনেকেই ফ্রয়েডবাদের অনুসারী ও অনুগামী হয়ে উঠেছিলেন। ফ্রয়েডবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে প্রকৃত মনোবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যিনি, সেই রুশ মনোবিজ্ঞানী ইভান পেত্রেভিচ পাভলভের কৃতির সঙ্গে বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকের আগে আমাদের পরিচয়ই ঘটেনি। একুশ শতকেও সে-পরিচয়ের প্রসার ও বিস্তার ঘটেছে

এমন কথা বলা যাবে না।

রবীন্দ্রনাথও, সম্ভবত, পাভলভীয় মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। তাঁর কোনো লেখায় কিংবা আলাপচারিতায় পাভলভ-প্রসঙ্গ উঠে এসেছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে পাভলভীয় মনোবিদ্যার সঙ্গে কবির পরিচয় থাকুক বা না-ই থাকুক, ফ্রয়েডবাদের বিষয়ে যে তিনি পূর্ণ অবহিত ছিলেন,- সে-ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। খোদ ফ্রয়েডের সঙ্গে ভিয়েনায় তাঁর দেখা হয়েছিল ১৯২৬ সালের ২৫ অক্টোবর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের প্রতি ফ্রয়েডের প্রীতি জন্মায় নি। রবীন্দ্রনাথও ফ্রয়েডের মতবাদকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন নি, তিনি বরং ফ্রয়েডের চিন্তার গলদ ও ভ্রান্তিগুলিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন।

১৯৭৮ সালের ৩ মার্চ কলকাতার সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায় বিশিষ্ট লেখিকা সুমিতা মিত্রের ‘বিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। লেখিকা জানিয়েছে : শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক বিনয় গোপাল রায় ১৯৪০ সালের শেষ ভাগে ‘মানবজীবনে অবচেতনার প্রভাব’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখে এর পা-ুলিপি রবীন্দ্রনাথকে পড়তে দিয়েছিলেন। প্রবন্ধটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ সেই পাণ্ডুলিপির মার্জিনে যে চোখা চোখা মন্তব্য লিখেছিলেন, সেগুলো হলো :

“১.    স্বভাবের কোনটা আসল কোনটা আসল নয় সে-ও এমন একান্ত করে বলা যায় না। সমষ্টিগত স্বভাব চেতনায়-অবচেতনায় মিলিয়ে। বিশ্লিষ্ট করলে ধরা পড়ে সবুজ রঙের মতো তার এক উপাদান নীল আর এক উপাদান হলদে। প্রশ্ন এই অবচেতনায় যেটা ধরা পড়ে সেইটিই কি আসল স্বভাব? তার সঙ্গে মিলেছে অভ্যাস শিক্ষা ও ভয়-লজ্জার প্রভাব- চরিত্র সব জড়িয়েই কি নয়? বিশেষ মানসিক রোগে ঐক্য ভেঙে যায়, তখন উপরকার চামড়া ছিঁড়ে গিয়ে ভিতরের চামড়া দেখা দেয়। কিন্তু সহজ অবস্থায় আচরণটা স্বভাবের অন্তর্গত নয় কি?

২.    আমরা চা খাই, তাতে আছে দুধ, চিনি ও চা, চেতন মন ভোগ করে সম্মিলিত স্বাদ- অবচেতন মনে সেই স্বাদ কি বিশ্লিষ্ট করে জানি? অনেক ঢেউ যে শব্দ করে সব জড়িয়ে সেটা এক করে জানি। প্রত্যেক ঢেউয়ের শব্দ স্বতন্ত্রভাবে মৃদু- অবচেতন মনে কি হাজার হাজার মৃদু শব্দ বিশ্লিষ্ট হয়েই থাকে, এক হয় চেতন মনে? ইন্দ্রিয়বোধের অনেকগুলিই যৌগিক- যেমন নীলের সঙ্গে হলদে মিললে হয় সবুজ- অবচেতন মন কি সবুজকে দেখেই না? বড় শব্দ ছোট শব্দের সমষ্টি- অবচেতন মন কি সেই সমষ্টি ভাঙতে পারে?

৩.    পরস্পরের অবচেতন স্বভাব নিয়েই যদি আমাদের স্বভাব হোত তাহলে তো সমাজ একটা পাগলা গারদ হয়ে উঠত।”

এরও ১২ বছর আগে, ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা ‘প্রবাসী’তে ফ্রয়েডপন্থি ডাক্তার সরসীলাল সরকারের সঙ্গে কবিবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কথোপকথন’-এর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। ডাক্তার সরসীলাল জানিয়েছিলেন- “আমাদের Psycho analysis বিজ্ঞানানুযায়ী প্রধানত Sexual feelings-এর বিশ্লেষণ ধরেই মানুষকে বুঝবার চেষ্টা করা হয়।”

এর বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ বলেন,-
Freud-এর School-এর সঙ্গে এইখানেই আমার প্রধান ঝগড়া। আমি বলি, Sex-instinct একেবারে গোড়ার কথা নয়। আরও গোড়ার কথা হচ্ছে Self-assertion, এই শেষোক্ত instinct Sex-instinct অপেক্ষা বেশি পুরাতন এবং ওতপ্রোতভাবে আমাদের জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। মানুষ জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই অহংজ্ঞান (Ego Conseiousness) নিয়ে জন্মেছে। প্রতিপদে এই Ego নিজেকে Assert করতে চাইছে, হয়তো প্রতিপদে বিফলও হচ্ছে। একটি ছোট শিশু- সেও চায় Recognition পেতে- আর সব ভাইয়েদের মধ্য হতে মা তাকেই বিশেষ স্নেহ করুক, সেটা না হলেই তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। তারপর সে যখন school-এ যায়, সেখানেও সে চায় মাস্টারের কাছে সমপাঠীদের কাছে Recognition পেতে। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে এই জিনিসটা আরও বেশি করে দেখতে পাওয়া যায়। প্রণয়প্রার্থীরা (Lovers) যেখানে অকৃতকার্য হয় সেখানেও তার দুঃখ আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে বলে- কাম-প্রবৃত্তি চরিতার্থ হয়নি বলে নয়। এমন কি, আমি বলি Self-preservation এবং Self-propagation এই দুটা Self-assertion-এরই অন্যতম বিকাশ। ঊমড় মরতে চায় না, নিজেকে জীবিত দেখতে চায়- তার সন্তান-সন্ততির মধ্য দিয়ে। সুতরাং দেখতে পাচ্ছি এই Sex-instinct-এর গোড়ার কথা Ego assertion। এমন কি স্বর্গ সৃষ্টির পরিকল্পনার মূলেও এই রহস্য রয়েছে। মানুষ যখন দেখে যে, এ জীবনে তার অনেক জিনিস অসম্পূর্ণ রয়ে যায়, তখন সে মনে মনে সৃষ্টি করলে আর এক কল্পনা জগতের কথা যেখানে সে তার সমস্ত আকাক্সক্ষা ও ইচ্ছাকে সফলতায় পূর্ণ দেখতে পেলে। এই হল স্বর্গ। অমরত্ববাদের (Theory of Immotality) মধ্যেও এই কথা রয়েছে। নিজেকে একেবারে মুছে ফেলতে চায় না, তাই সে বলে আমি মরব না, অমর হয়ে রইবো,- এ জগতে নয়, অন্য জগতে।”

এই কয়েকটি কথার মধ্যেই কি বিজ্ঞানী রূপে-পরিচিত সিগমুন্ড ফ্রয়েডের চেয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে অধিকতর বিজ্ঞান-সচেতন ছিলেন, তারই পরিচয় পাওয়া যায় না? বোঝা যায় না কি যে ‘নাস্তিক’ ফ্রয়েডের চেয়ে ‘আস্তিক’ রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনেক বেশি বস্তুনিষ্ঠ? রবীন্দ্রনাথের ‘চিকিৎসা-ভাবনা’য় মনোচিকিৎসাও একটি বড় স্থান দখল করে নেয়নি কি?

রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা-ভাবনার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে অনেক অনেক দৃষ্টান্তই আহরণ করা যেতে পারে। সুভাষ সিংহ রায় তাঁর বইয়ের এক স্থানে লিখেছেন,-

“রোগের সঙ্গে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের গভীর তত্ত্বকে সামনে নিয়ে আসেন রবি ঠাকুর- যা অনেকাংশে প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদের ‘ব্যক্তিনির্দিষ্ট, ব্যক্তিনিরপেক্ষ নয়’ এমন চিকিৎসা (সাবজেকটিভ ট্রিটমেন্ট)-তত্ত্বের সমার্থক। মাঝে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই তত্ত্ব পুরোপুরি বাতিল হয়ে সব মানুষকে এক ছাঁচে ফেলে ব্যক্তিনিরপেক্ষ চিকিৎসা (অবজেকটিভ ট্রিটমেন্ট) করা চালু ছিল বহুকাল।”

রবীন্দ্রনাথ সারাজীবনভর বিভিন্ন জনের কাছে অনেক অনেক চিঠি লিখেছেন। যে-সব চিঠিতে কোনো-না-কোনোভাবে তাঁর চিকিৎসা-ভাবনার পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে, সে-রকম অনেকগুলো চিঠি সংকলন করে সুভাষ তাঁর বইয়ে তুলে এনেছেন। খুবই পরিশ্রমসাধ্য এই কাজটির মাধ্যমে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন তিনি।

‘রোগের মূলকে অক্ষত রেখে উপরে উপরে জীবণুরোধক প্রয়োগ-করা’ যে কোনোমতেই ‘সুচিকিৎসা’ নয়- সে কথাটি খুবই স্পষ্ট ভাষায় ওষুধবিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র সুভাষ সিংহ রায় আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। খুবই সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও শল্যচিকিৎসার প্রকৃতি ও ইতিহাস সম্পর্কেও তিনি আমাদের অবহিত করেছেন।

সবদিক বিবেচনা করে বলতেই হবে যে : ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে ঢাকার ‘অনন্যা’ থেকে প্রকাশিত সুভাষ সিংহ রায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিকিৎসা-ভাবনা’ অনন্য একটি পুস্তক।

এবিএন/এআর/জসিম/রাজ্জাক

এই বিভাগের আরো সংবাদ