ইদানিং ঢাকার পুজো
১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৩:৩৮ | অনলাইন সংস্করণ
উনিশশছিয়াশি সালে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই ঢাকার পুজো দেখে আসছি। নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রায় এক যুগ ধরে। এর পর আবার এক যুগ কর্মসূত্রে ঢাকার বাইরে কাটিয়ে আবার ঢাকায় ফেরা। দু’বছরের ব্যস্ত জীবন। তারপর বিদেশে। পাঁচ বছর পর ঘটনাচক্রে দুহাজার সতেরর পুজো কেটেছে ঢাকায়। ইতিমধ্যে ঢাকার পুজোর বয়েস বেড়েছে কমপক্ষে কুড়ি বছর। কেমন যাচ্ছে ইদানিং ঢাকার পুজোর হালচাল?
শৈশব কেটেছে গ্রামে। পুজোর স্মৃতি বলতে পুরোটাই জুড়ে মামাবাড়ির রাধা কবিরাজের পুজোখোলার পূর্বপুরুষের সুপ্রাচীন পারিবারিক পুজোর শিউলিঘ্রাণ মাখা শিশিরভেজা স্মৃতি। সে তুলনায় রাজধানীর আলোকসজ্জিত সালঙ্কারা রমণীকুলবিভূষিত নাগরিক পুজোসেই তরুণ বয়েসে ছিল এক মোহনীয় আকর্ষণে ভরা। জগন্নাথ হলের পুজো তখন আমাদের জন্যে একরকম পারিবারিক পুজোর মতই। রোকেয়া-শামসুন্নাহার হলের পূজার্থীনীরা প্রায় সবাই মুখ চেনা। ফলে ঐ তারুণ্য-চপল দিনগুলোতে সমবয়েসী বন্ধুদের মূল আকর্ষণ ছিল পুষ্পাঞ্জলি বা প্রতিমা দর্শনের অতিরিক্ত অন্য কিছু। বন্ধুরা দল বেঁধে যেতাম ঢাকেশ্বরী, সিদ্ধেশ্বেরী, টিকাটুলি রামকৃষ্ণ মিশন, কাপ্তানবাজার, তাঁতি বাজার এলাকায়। প্রায়শই পুস্পাঞ্জলির ফুলগুলো মায়ের চরণ অবধি পৌঁছানোর অবকাশ পেতো না। সম্মুখ বা পার্শ্ববর্তিনী সিঁদুরবিহীন তরুণী সুন্দরীর বিন্যস্ত বেণী অথবা কুণ্ডলায়িত খোঁপার কাঁটা চুম্বকের মতো সব ফুলগুলো আকর্ষণ করে নিতো। তা ছিল নিতান্ত নির্দোষ বিনোদন। কোনো কোনো প্রিয় মুখ মানসচক্ষে ঘুরে ফিরত পরের বছরের পুজো অব্দি। এমনকি সেই মুখ পুনঃদর্শনের দুরাশায় একাধিকবার সেই নির্দিষ্ট মণ্ডপের আশেপাশে সবান্ধব উৎসুক নেত্রে ইতস্তত বিচরণ ছিল সাধারণ ঘটনা।
এবার একটু সিরিয়াস প্রসঙ্গ। আশির দশকের পুরোটাই ছিল স্বৈরাচার বিরোধী উত্তাল রাজনৈতিক আন্দোলনে আন্দোলিত। রাজধানীর পুজোতে এই আন্দোলনের আঁচ লাগতে সময় লাগেনি। এই দশকের শেষ ভাগেই উন্মেষ ঘটে কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের। এরশাদ আমলে সংঘটিত কতিপয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ কর্মসূচির স্মারক ব্যানার-ফেস্টুন মহানগরীর পূজামণ্ডপ গুলোতে প্রথম নজরে পড়তে শুরু করে। স্বৈরাচার বিরোধী নাটক এবং অনুরূপ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড শারদীয় সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। নগরীর পূজাবার্ষিকীগুলোর চরিত্রও হয়ে দাঁড়ায় যেন স্বৈরাচার বিরোধী মুখপত্র। ঢাকার পুজোর এই রাজনৈতিক মাত্রাটি একান্তই ঢাকার পুজোর। পৃথিবীর আর কোথাও এমনটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। বলাবাহুল্য, এই নতুন মাত্রাটি ঢাকার পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে খালেদা জিয়ার শাসনামলে সাম্প্রদায়িক আচরণের বিরুদ্ধে একবার সারাদেশে অভিনব প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয়। সেবার দেশে কোথাও প্রতিমা গড়ে পূজা করা হয় নি। পরিবর্তে শুধুমাত্র মৃৎপাত্র (মঙ্গল ঘট) স্থাপন করে সবরকম আড়ম্বর বর্জন করেই পূজা সম্পন্ন করা হয়েছিল।
ধারাটি এখন ঢাকার পুজোর ঐতিহ্যের অঙ্গ। রাজনৈতিক আচরণেও এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যেত। রাজধানীর রাজপথে পূজার্থীদের পক্ষে স্বাগত-সূচক বৃহৎ ব্যানার যেমন চোখে পড়তো, ঠিক বিপরীত ভাবে স্থানীয় এমনকি জাতীয় পর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের পক্ষ থেকেও শারদীয় শুভেচ্ছার ব্যানার-ফেস্টুন রাজপথ-অলি-গলিতে হরহামেশাই চোখে পড়তো। ঢাকার নাগরিক জীবনের এই পরিচিত চিত্রটি ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। দু’হাজার সতেরোর পুজোতে বলতে গেলে শারদীয় শুভেচ্ছার কোনো ব্যানার-ফেস্টুন নগরীর কোথাও নজরে পড়ে নি। সেটি নগর পরিচ্ছন্নতাজনিত অতিসাম্প্রতীক কোনো নিষেধাজ্ঞার কারণে কিনা, সেটি আমার জানা নেই।
ঈদের মতো এতটা ব্যপক না হলেও শারদীয় দুর্গাপুজোর একটা অর্থনৈতিক মাত্রা আগাগোড়াই ছিল। ঢাকার নিউমার্কেট, গাউছিয়া, গুলিস্তান, সদরঘাট সহ বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জের বিপণিকেন্দ্রগুলোতে পূজা মৌসুমের অতিরিক্ত বাণিজ্যিক তৎপরতা দৃষ্টি এড়িয়ে যাবার মতো ঘটনা নয়। আশির দশকে দেখেছি অনেকটা ঈদের শুভেচ্ছার অনুরূপ বড় বড় বিপণিকেন্দ্র গুলোতে শারদীয় শুভেচ্ছার ব্যানার-ফেস্টুন। এমনকি এরশাদ আমলে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পরেও এই ধারা অব্যাহতই ছিল। খালেদা জিয়ার সাথে জোটবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী জামাতের ক্ষমতা গ্রহণের পর উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের সাথে শারদীয় শুভেচ্ছার ব্যানার-ফেস্টুন বিপণিকেন্দ্রগুলো থেকে ক্রমশ অপসৃত হতে থাকে। দু হাজার সতেরো সালের পূজা মৌসুমে মহানগরী ঘুরে হাতেগোনা দু তিনটি বিপণিবিতানে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকারে শারদীয় শুভেচ্ছা-সূচক স্মারক নজরে পড়েছে। লক্ষণীয়, কয়েকটি ক্ষেত্রে তাও আবার এক ধরণের ক্যামোফ্লাজে আড়াল করার সচেষ্ট প্রয়াস।
ইদানিং রাজধানীতে পুজোর সংখ্যা বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে বাজেট, জাঁক জমক, লোকদেখানো বাহুল্য। গুলশান-বনানী-কলাবাগানসহ নতুন পূজামণ্ডপগুলোর সাজসজ্জা-আড়ম্বর অনেক ক্ষেত্রে কলকাতার বড় কিছু পুজোকেও ছাড়িয়ে যায় বলে মন্তব্য চালু আছে বাজারে। একেবারে অমূলকও নয়।ঘাটতি যেটুকু চোখে পড়েছে তা হলো সাজ-সজ্জায় আধুনিক শিল্পকলার শৈল্পিক মিশেল আর প্রতিমা ও মণ্ডপ সজ্জায় থিম-ভিত্তিক আয়োজনের কিছুটা অভাব। এটুকু বাদে ইদানিং ঢাকার পুজো নিয়ে গর্ব করা যেতেই পারে।
ইদানিং পূজা মৌসুমের মহানগরী ঘুরে কিছু প্রবণতা চোখে পড়েছে যা উল্লেখ করা আবশ্যকীয় মনে করছি। রাজধানীর পূজামণ্ডপ গুলোতে পাশ্চ্যতের কূটনীতিকদের উপস্থিতি দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বেড়েছে। আগে এমনটি ছিল বলে আমার জানা নেই। দ্বিতীয়ত, পূজা অনুষ্ঠানের ধর্মীয়-অর্থ-সামাজিক গুরুত্বের পাশাপাশি রাজনৈতিক গুরুত্ব ও বেড়েছে। তৃতীয়ত, পূজা উৎসবে কর্পোরেট ও এলিট শ্রেণীর সম্পৃক্ততা যেমন একদিকে বেড়েছে, তেমনি একটি বিপরীত প্রবণতাও বেড়েছে বলে মনে হয়। সাধারণ সংখ্যাগুরু গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ক্রমশ নিম্নগামী কিনা এবং অলক্ষ্যে একটা 'আমরা'-'অন্যেরা' বিভাজন বর্ধিষ্ণু কি-না, সেটি সমাজতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণসাপেক্ষ।
প্রসঙ্গত, সামাজিক গণমাধ্যমের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। জাতীয় ক্রিকেট দলের জনৈক সদস্য নিকট অতীতে ফেসবুকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানালে কতিপয় ব্যক্তি ফেসবুকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তাদের যুক্তি ছিল শারদীয় শুভেচ্ছা জানানো দেশের নব্বই ভাগ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের অনুকূল নয় বলে সেটি গর্হিত কাজ হয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় দলেরই অন্য কয়েকজন সদস্য যারা নিজেরাই নব্বই ভাগের বিশ্বাসের অনুসারী, তারা প্রথমোক্ত সদস্যের শুভেচ্ছা জানানোকে সমর্থন করেপোস্টদেন।সর্বশেষ, গণ অনুষ্ঠানে রাজনীতিকদের উপস্থিতি এবং ভোটের হিসাব নতুন কোনো বিষয় নয়। ইদানিং এই জায়গাটিতে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। শারদীয় অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আসছেন, শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। একই সাথে তাঁদেরকে মাথায় রাখতে হচ্ছে একটি স্পর্শকাতর সূক্ষ্ম সীমারেখা যেটি অতিক্রম করে আবার যেন কারো বিরাগভাজন না হন। বিষয়টি নতুনএবংসেটিসমসাময়িক রাজনীতিকদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রেএক নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপসংহারে একটি কথা বলতে হবে যে উপরোক্ত পর্যবেক্ষণগুলো একান্তই ব্যক্তিগত এবং সকলক্ষেত্রে প্রমাণসাপেক্ষও নয়। তবে রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব উল্লিখিত সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলো বিবেচনায় রাখলে তা জাতির জন্যে অসাম্প্রদায়িক, ন্যায়ভিত্তিক, সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মানে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা যায়।
লেখক: কানাডা প্রবাসী প্রাবন্ধিক, গবেষক