আজকের শিরোনাম :

বাঙালির দুর্গোৎসব : সময় ও প্রেক্ষিত বিবেচনা

  সুভাষ সিংহ রায়

১৪ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৫৮ | অনলাইন সংস্করণ

লেখার শিরোনাম একেবারে ছোট নয়, বিষয়বস্তু হিসেবে বেশ গুরুত্ব বহন করে। অতি সম্প্রতি দুদিনের সফরে কলকাতায় গিয়েছিলাম। পূজার কাছাকাছি সময়ে আর কখনও কলকাতা যাওয়া হয় নি। বেশ ক’বার পূজার ঠিক পরে গিয়েছি। অর্থাৎ, বিসর্জনের ঠিক পরে যাওয়ার অবস্থা আর মহালয়ার আগের সময়ের কলকাতা মানে পূজার কলকাতা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘পুতুল পূজা করে না হিন্দু কাঠ মাটি দিয়ে গড়া মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরী হয়ে যায় আত্মহারা’। শিরোনামে উল্লেখ করা আছে, বাঙালির দুর্গোৎসবের সময় ও প্রেক্ষিত বিবেচনা। ঢাকার ঢাকেশ^রীর পূজা, কয়েক বছর আগে চালু হওয়া বনানীর নতুন কলেবরে দুর্গাপূজা, কলকাতার রাস্তায় পূজা আর কানাডার দুর্গাবাড়ির পূজার মধ্যে নিশ্চয় সময় ও প্রেক্ষিত বিবেচনার বিষয় রয়েছে।

কবি মদুসূদন দত্ত খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও সুদূর ভার্সাই নগরে বসে লিখে গিয়েছেন-

সু-শ্যামাঙ্গ বঙ্গ এবে মহাব্রতে রত।
এসেছেন ফিরে উমা, বৎসরের পরে
মহিষমর্দিনী রূপে ভকতের ঘরে;
পূর্বকথা কেন কয়ে, স্মৃতি,
আনিছ হে, বারিধারা আজি এ নয়নে?

আমরা ভালো করেই জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্ ব্রহ্ম’ মন্ত্রে বিশ্বাসী। পরে সেই বিশ্বাস কেন্দ্রীভূত হয়েছিল দরিদ্র-শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। তবুও তিনি দুর্গাপূজার বিরোধিতা করেন নি। আবার দুর্গাপূজার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়েও পড়েন নি। কবিগুরুর মতে, ‘দুর্গোৎসব এই বাংলার সমাজজীবনে অনন্যতা দান করেছে। পরিবার থেকে রাষ্ট্রজীবনের বিকাশে এর সমাজমূল্য অসাধারণ।’

স্বামী লোকেশ্বরানন্দ বলেছিলেন, ‘ঈশ^র সর্বব্যাপী। তিনি নির্গুণ, আবার সগুণ; নিরাকার, আবার সাকারও। তাকে কোনো বিশেষণ দিয়ে বিশেষিত করা যায় না। তিনি বাক্যভাবনাতীত। তিনি যখন সর্বব্যাপী, তখন সর্বভূতে নিশ্চয়ই বিরাজমান। মানুষ, জীবজন্তু, উদ্ভিদ, সবার মধ্যে তিনি আছেন।’ শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘তিনিই জীব, জগত চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়েছেন।’ বস্তুত তিনিই সব। তিনি নাম-রূপের অতীত, আবার যত নাম, যত রূপ, সব তার। বস্তুত তাকে বাদ দিয়ে কিছুই নেই। তিনি যেমন জগতের মধ্যে আছেন, তেমন জগতের বাইরেও আছেন। তিনি স্ত্রী, তিনিই পুরুষ, তিনি বালক, তিনিই বালিকা। তিনিই বিভিন্ন নাম ও রূপ নিয়ে আমাদের সামনে ঘোরাফেরা করে বেড়াচ্ছেন। তিনি ছাড়া আর কেহ নেই। তিনি না থাকলে কেউ থাকতে পারে না। তিনি ব্যক্তি, আবার নৈর্ব্যক্তিকও বটে। কোনো কোনো ব্যক্তির মধ্যে তার বিশেষ প্রকাশ। তাদের আমরা অবতার বলি। তিনি যখন নৈর্ব্যক্তিক, তখন আমাদের ধারণাতীত।

কিন্তু যেহেতু আমরা ব্যক্তি, আমরা ঈশ^রকে ব্যক্তিরূপেই দেখতে চাই। তাহলে তার কাছে আমরা আমাদের সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারি। তার সঙ্গে একটা সম্পর্কও পাতাতে চাই। সবচেয়ে মধুর সম্পর্ক মাতৃসম্পর্ক। তাই মাতৃরূপে তার পূজা এত জনপ্রিয়। মাটি বা কোনো ধাতু দিয়ে এক বিগ্রহ গড়ি, আর তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে মহাসমারোহে পূজা করি। তিনি আমাদের মা, সকলের মা, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কারিণী যিনি আদ্যাশক্তি, তার প্রতীক। কিন্তু কে এই আদ্যাশক্তি? রামকৃষ্ণ বলতেন, ‘তোমরা যাকে ব্রহ্ম বলো, আমি তাকেই কালী বলি।’ আরও বলতেন, ‘সাপ শুয়ে থাকলেও সাপ, হেললে দুললেও সাপ।’ বারো মাসে তেরো পর্বণ কথাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য প্রচলিত থাকলেও, শারদীয়া বা দুর্গাপূজাই বেশি আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে পালন করা হয়।

দুই

দেবী দুর্গা হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অন্যান্য দেব-দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তার বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দূর্গতিনাশিনী’ বা সকল দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিণী। পুরাকালে দেবতারা মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ^র’র শরীর থেকে আগুনের মতো তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল এক আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়। ঐ আলোকপুঞ্জ থেকে আবির্ভূত এক দেবী মূর্তি। এই দেবীই হলেন দুর্গা। দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যশক্তি মহামায়া অসুরকুলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা বিশ্ব ব্রহ্মা-যে শান্তি স্থাপন করেন।

দেবী দুর্গা ত্রি-নয়না বলে তাকে ‘ত্রৈম্বক্যে’ বলা হয়। তার বাম চোখ হলো বাসনা (চন্দ্র), ডান চোখ কর্ম (সূর্য) ও কেন্দ্রীয় চোখ হলো জ্ঞান (অগ্নি)। দুর্গার দশ বাহুতে যে দশটি অস্ত্র রয়েছে, সেই অস্ত্রসমূহও বিভিন্ন প্রতীকের ইঙ্গিতবাহী।

শঙ্খ ‘প্রণব’ বা ওঙ্কার ধ্বনির অর্থবহতা নির্দেশ করে। তীর ধনুক দেবীর শক্তিমত্তার প্রতীক। মায়ের হস্তে ধৃত বজ্রাগ্নি হলো ভক্তের সংকল্পের দৃঢ়তা। দুর্গার হাতের পদ্ম বা ‘পঙ্কজ’ অর্থ হলো পদ্ম যেমন কাদামাটির ভেতর হতে অনাবিল হয়ে ফোটে, তেমনি দেবীর উপাসকরাও যেন লোভ-লালসার জাগতিক কাদার ভেতর হতে আত্মার বিকাশ ঘটাতে পারে। দেবীর তর্জনীতে ধরা সুদর্শন চক্র তার শুভতার লালন ও অশুভের বিনাশের ইচ্ছের প্রকাশ। দুর্গার হাতে ধরা তলোয়ার জ্ঞানের ইঙ্গিত ও ত্রিশূল হলো সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের প্রকাশ। হিন্দু শাস্ত্রমতে, দৈত্য বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা।

দুর্গাপূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল তা জানা যায় না। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। সিন্ধু সভ্যতায় (হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা) দেবীমাতা, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। দুর্গা শিবের অর্ধাঙ্গিনী সে হিসেবে অথবা দেবী মাতা হিসেবে পূজা হতে পারে। তবে কৃত্তিবাসের রামায়ণে আছে, শ্রী রাম চন্দ্র কালিদহ সাগর (বগুড়ার) থেকে ১০১টি নীলপদ্ম সংগ্রহ করে সাগর কূলে বসে বসন্তকালে সীতা উদ্ধারের জন্য সর্বপ্রথম শক্তি তথা দুর্গোৎসবের (বাসন্তি পূজা বা অকাল বোধন) আয়োজন করেছিলেন। মারকেন্দীয়া পুরাণ মতে, চেদী রাজবংশের রাজা সুরাথা খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ বছর আগে কলিঙ্গে (বর্তমানে উড়িষ্যা) নামে দুর্গাপূজা প্রচলন করেছিল। যদিও প্রাচীন উড়িষ্যার সাথে নেপালের পূজার কোনো যোগসূত্র আছে কি না জানা নেই।

ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গাপূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ১১০০ শতকে অভিনির্ণয়-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনীতে দুর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। বঙ্গে ১৪০০ শতকে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল কি না ভালোভাবে জানা যায় না। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ^ সিংহ কুচবিহারে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। ১৬১০ সালে কলকাতার বারিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৭৯০ সালের দিকে এই পূজার আমেজে আকৃষ্ট হয়ে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার গুপ্তি পাড়াতে বারোজন বন্ধু মিলে টাকা-পয়সা (চাঁদা) তুলে প্রথম সার্বজনীনভাবে আয়োজন করে বড় আকারে দুর্গা উৎসব। যা বারোইয়ার বা বারো বন্ধুর পূজা নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়।

আধুনিক দুর্গাপূজার প্রাথমিক ধাপ ১৮০০ শতকে নানা বাদ্যযন্ত্র প্রয়োগে ব্যক্তিগত, বিশেষ করে জমিদার, বড় ব্যবসায়ী, রাজ-দরবারের রাজ-কর্মচারী পর্যায়ে প্রচলন ছিল। পাটনাতে ১৮০৯ সালের দুর্গাপূজার ওয়াটার কালার ছবির ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে।

উড়িষ্যার রামেশ্বরপুরে একই স্থানে ৪০০ বছর ধরে সম্রাট আকবরের আমল থেকে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে। ১৯১০ সালে সনাতন ধর্মউৎসাহিনী সভা ভবানীপুরে বলরাম বসু ঘাট লেনে এবং একই জেলায় অন্যরা রামধন মিত্র লেন, সিকদার বাগানে একই বছরে ঘটা করে প্রথম বারোয়ারী পূজার আয়োজন করে।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুর্গা স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে জাগ্রত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এই পূজা ঐতিহ্যবাহী বারোয়ারী বা কমিউনিটি পূজা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আর স্বাধীনতার পর এই পূজা পৃথিবীর অন্যতম প্রধান উৎসবের মর্যাদা পায়।

সরকারি বা জাতীয়ভাবে এই উৎসবকে দুর্গাপূজা বা দুর্গা উৎসব হিসেবে অভিহিত করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাকে শরৎকালের বার্ষিক মহোৎসব হিসেবে ধরা হয় বলে একে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় দিন থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত এই উৎসবকে মহালয়া, ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও দশমী নামে পালন করা হয়। অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ বলে বসন্তকালের এই উৎসবকে বাসন্তি পূজা বা অকালবোধনও বলা হয়।

দুর্গাপূজা ভারতে আসাম, বিহার, ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে উদযাপন করা হয়। সেখানে পাঁচ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় (যেখানে বাঙালি হিন্দুরা ব্যাপক সংখ্যায় বসবাস করে) সবচেয়ে বড় সামাজিক, ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয়। এছাড়াও পূর্ব ভারতের বা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, হুগলি, শিলিগুড়ি, কুচবিহার, লতাগুড়ি, বাহারাপুর, জলপাইগুড়ি এবং ভারতের অন্যান্য অঞ্চল যেমন- আসাম, বিহার, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গোয়া, গুজরাট, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, অন্ধ্র প্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাড়– ও কেরালায় ঘটা করে এই উৎসব পালন করা হয়। নেপাল ও ভুটানেও স্থানীয় রীতিনীতি অনুসারে প্রধান উৎসব হিসেবে পালন করা হয়।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কলারোয়ায় ১৮ শতকের মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে (১৭৬৭) দুর্গাপূজা হতো বলে লোকমুখে শোনা যায়। ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দু-ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরত্ন দেবী দুর্গার, যা সংস্কারের ফলে মূল চেহারা হারিয়েছে। মন্দিরের প্রাচীন গঠনশৈলী বৌদ্ধ মন্দিরের মতো। ধারণা করা হয়, দশম শতকে এখানে বৌদ্ধ মন্দির ছিল, যা পরে সেন আমলে হিন্দু মন্দির হয়েছিল এবং ১১০০ বা ১২০০ শতক থেকে এখানে কালীপূজার সাথে দুর্গাপূজাও হতো।

ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে রমনায় কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং এখানেও কালীপূজার সাথে দুর্গাপূজা হতো।

তিন

‘মূর্তি’ কথাটি এসেছে ‘মূর্ত শব্দ থেকে; যার মানে প্রকাশিত বা প্রকটিত হওয়া। সুতরাং, যা-ই মূর্ত বা প্রকাশিত তাই মূর্তি। আর প্রত্যেকটি মূর্তিই একটি বিশেষ ভাবের দ্যোতক বা প্রতীক। কোথাও কোথাও আবার সম্মিলিত ভাবেরও প্রকাশ করা হয় মূর্তির মাধ্যমে। এই মূর্তির মধ্যে বিশেষ বিশেষ শক্তির আরাধ্য বা আরাধিকা দেব বা দেবীর ভাব জাগিয়ে আমরা সেই মূর্তিকে আরাধ্য করে তুলি। আমাদের ভক্তি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই ঐ দেব বা দেবীর মূর্তিকে। অবনতমস্তকে ঐ মূর্তির সামনে শক্তির প্রার্থনা করি। মূর্ত বিগ্রহ হয়ে ওঠে অমূর্ত। রূপের মধ্যেই আমরা রূপাতীত সৌন্দর্যের খোঁজ পাই। এভাবেই আমাদের আত্মিক শক্তি পরমাত্মিক শক্তিতে মিলনের উপায় খোঁজে। দেবী দুর্গার পূজা প্রবর্তন ও তার প্রচলনকাল সম্পর্কে প-িত মহলে বহু মত প্রচলিত। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় অভিমতটি হলো তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ কর্তৃক দেবীপূজার উদ্ভব (ষোড়ষ শতাব্দী)। দ্বিতীয় মতটি হলো, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কর্তৃক দেবীপূজার প্রচলন (অষ্টাদশ শতাব্দী)।

অথচ ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে আমরা জানতে পারি, এর বহু পূর্ব থেকেই লোকসমাজে দেবীর অর্চনা প্রচলিত ছিল। দেবীর মূর্তি তো প্রথম শতাব্দী থেকেই পাওয়া গেছে। দেবীমূর্তি সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গে পরে আসছি। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে চৈনিক পরিব্রাজক হিউ এন সাঙের জীবনী রচয়িতা শমন হুইলির গ্রন্থ থেকে জানা যায়, অযোধ্যা অঞ্চলের ডাকাতরা শরৎকালে সুপুরুষ বলি দিয়ে দেবী মহিষমর্দিনীর পূজা করত। জীমূতবাহনের ‘দুর্গোৎসব নির্ণয়’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, দুর্গোৎসব আদিতে শবরজাতির উৎসব ছিল। পুরাণবিদ আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ও শবরজাতির পালিত ‘শবরোৎসব’কে আমাদের ‘শারদোৎসবের’ বীজ বলে মন্তব্য করেছেন। সুতরাং, উক্ত মতামতগুলোর নিরিখে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে দুর্গাপূজার প্রচলন সূচনালগ্নে একেবারেই মূলধারার পূজা ছিল না, তা মূলত অনার্যজাতির লোকসমাজে প্রচলিত ও সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে আর্যীকরণের যুগে এই অনার্য উপাসিত দেবী ও দেবীর পূজা পদ্ধতি পৌরাণিক ও শাস্ত্রীয় বিধিবিধান দ্বারা পরিমার্জিত হয়ে বৃহত্তর সমাজে বিশেষত উচ্চকোটির মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে।

বলা ভালো, আর্য ও অনার্য ভাবধারার এক আশ্চর্য সমন্বয় সাধিত হয়েছে। এখন সেসব সমন্বয়গুলো প্রসঙ্গে যাওয়া যেতে পারে। দুর্গাপূজাকে বিভিন্ন পুরাণের সমন্বিত রূপ বলা যেতেই পারে। ‘দুর্গা’ শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় কৃষ্ণযজুর্বেদের ‘তৈত্তিরীয় আরণ্যকের’ অন্তর্গত ‘যাজ্ঞিকা উপনিষদ’-এ। সেখানেই সর্বপ্রথম দেবীর গায়ত্রী মন্ত্র উল্লিখিত হয়েছে। মন্ত্রটি হলো-
“তমগ্নিবর্ণাং তপসা জ¦লন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্।
দুর্গাং দেবীং শরণামহং প্রপদ্যে সুতরাসি তরসে নমঃ \”

চার

এখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, দেবীর নাম দুর্গা কেন? এর উত্তরে বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্নভাবে দেওয়া হয়েছে, যেমনÑ শ্রীশ্রী চ-ীর একাদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, দেবী দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন বলে দেবীর নাম দুর্গা-

“তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যাং মহাসুরম্।
দুর্গাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি \”

আকর উক্ত গ্রন্থেরই চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, দেবী জীবকে দুর্গম ভবসাগর থেকে ত্রাণ করেন বলে তিনি দুর্গা। আকর দেবীপুরাণ ও দেবী ভাগবতে দেবীকে নগরপালিকা দুর্গরক্ষিণী হিসেবে বন্দনা করা হয়েছে। সংস্কৃত ‘শব্দকল্পদ্রুম’ গ্রন্থ দুর্গা শব্দের একটি সমন্বিত অর্থ পাওয়া যায়-

“দুর্গে দৈত্য মহাবিঘ্ন ভববন্ধ কুকর্মানি।
শোকে দুঃখে চ নরকে যমদ- চ জন্মনি \
মহাভয়েতি রোশে চাপ্যা শব্দো হন্তৃবাচকঃ।
এতান হন্তেব্য যা দেবী যা দুর্গা পরিকীর্তিতা

আবার কোনো কোনো পত্নি দুর্গা শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন নিম্নরূপভাবেÑ
দ = দৈত্যনাশিনী, উ = বিঘ্ননাশিনী, র = রোপনাশিনী, প = পাপনাশিনী, আ = ভয় ও শত্রুনাশিনী। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে যে বর্তমানে প্রচলিত দুর্গা শব্দটিতে একটি জটিলদর্শন ও মিশ্রতত্ত্বের ফলস্বরূপ।

‘দুর্গোৎসব’ বিষয়ে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা লিখেছিল (আশি^ন ১৭৯৮ শতক ১৮৭৬ খ্রি.)। দুর্গোৎসব হিন্দুজাতির একটি মহোৎসব। ইহার সহিত ইতিহাস, দর্শন, সমাজ ও সময়ের বিশেষ সংস্রব দৃষ্ট হয়।...এই উৎসবে সমাজের বহুতর আয়োজন। লোক সংবৎসরকাল মিতাচারে অবস্থানরূপ ধন সংগ্রহ করিয়াছে, এখন তাহা ব্যয় করিবার সময় উপস্থিত। হিন্দুজাতি স্বার্থপর নয়, কেবল স্ত্রী-পুত্র ইহাদের সর্বস্ব নয়। ইহারা লৌকিকতা রক্ষা করা বিলক্ষণ বুঝে। স্বসম্বন্ধী স্বগন্ধী কে কোথায় আছে এই সময় তাহার তত্ত্ব লওয়া হয়। ফলত এ সময়ে হিন্দু সমাজ একটি নূতন জীবন ধারণ করিয়া থাকে। বিদেশী কর্ম্মস্থান হইতে বিদায় লইয়াছে, বহু দিবসের পর গুরুজনের শ্রীচরণ দর্শন করিবে, পত্নী উৎসুক মনে পথের পানে চাহিয়া আছে, তাহাকে সাদর সম্ভাষণে আপ্যায়িত করিবে; শিশুগুলি চটুল নেত্রে প্রতীক্ষা করিতেছে, তাহাদিগকে আলিঙ্গন করিবে, এবং বন্ধুবান্ধব বহুদিন যাবৎ দূরে আছেন, তাহাদিগকে পাইয়া সুখী হইবে; এই জন্যেই দুর্গোৎসব মহোৎসব।

লেখক: বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও রাঝনৈতিক বিশ্রেষক

এই বিভাগের আরো সংবাদ