আজকের শিরোনাম :

অপ্রতিরোধ্য এক স্বপ্নের নাম রুবিনা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৮, ১৮:৩০

এনায়েতুল্লাহ, ১৯ মে, এবিনিউজ : রুবিনা শুধু একটি নাম নয় একটিও স্বপ্নও বটে। পৃথিবীতে চলার পথে যেমন রয়েছে বাঁধা তেমনি রয়েছে এর সমাধান। রেল গাড়ির নিচে কাটা পড়ে দু’পা হারানো রুবিনা আজও স্বপ্ন দেখে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। পা হারানোকে সে কোনো বাঁধা মনে করে না। রুবিনা মনে করে পৃথিবিতে অনেকেরই হাত পা নেই। কিন্তু তারা গুরুত্বপূর্ণূ কাজ করছে। সুতরাং সেও পারবে বলে বিশ্বাস আছে মনে।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার শান্তিনগর গ্রামের মেয়ে রুবিনা। জন্মের পরেই দেখা হয় দারিদ্র নামক দানবের সাথে। যার সাথে পেরে উঠা খুব কঠিন ছিল। তারপরও লড়ে যাচ্ছে জীবনের সমস্ত শক্তি দিয়ে। শত বাঁধা বিপত্তিকে জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে তার জীবনের একমাত্র লক্ষ। অন্যান্য দশটা ছেলে মেয়ের মত তার জীবনের পথচলা এতটা সহজ ছিল না। জীবনটা শুরুই হয়ে ছিল যুদ্ধ দিয়ে। আষাঢ়ের টিপ টিপ বৃষ্টিতে গ্রামের কর্দমাক্ত মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে যেতে হত তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাবা ছিলেন দিনমজুর। খুব কষ্টে দিন পার করতে হতো তাদের। এই শিক্ষার্থী ২০০৬ সালে প্রাথমিকে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন বিনয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ২০১১ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ছিনিয়ে আনে জিপিএ ৫। এইচএসসিতেও তার বিকল্প ঘটেনি। এই অপ্রতিরোধ্য মেয়েটিকে বাবা-মার দারিদ্রতার ছোবল কিছুতইে থামাতে পারেনি।

অন্যান্য সকল ছেলেমেয়েদের সাথে পাল্লা দিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য চলে আসে রাজধানী ঢাকা শহরে। স্বপ্ন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। অবশেষে রাতের আঁধার ঘুচিয়ে নেমে আসলো দিনের আলো। দেখা মিলল বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সেই স্বপ্নের সাথে। সে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত। একটি শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। মন থেকে সৃষ্টিকর্তার নিকট কৃতজ্ঞতা আদায় করল। ২০১৩-১৪ শিক্ষা বর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল সমাজকর্ম বিভাগে। শত সহস্র কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে চলছিল সামনের দিকে। ঠিক এমন সময় পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াল একটি দুর্ঘটনা। চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি দুপুরে কমলাপুর রেলস্টেশনে বিষন্ন মন নিয়ে বাড়ি যেতে চেয়ে ছিল এই অদম্য মেধাবী ছাত্রী। এক প্লাটফর্ম থেকে অন্য প্লাট ফর্মে যাওয়ার পথে রেলের একটি ইঞ্জিনের নিচে পড়ে দুই পা হারান রুবিনা আক্তার। এরপর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৩য় তলায় ৬৭ নাম্বার কেবিনে অবস্থান করছেন রুবিনা।

দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া এই মেধাবী ছাত্রী প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে হাসপাতালের  বেডে শুয়ে নিজের স্বপ্নের কথা ভাবছেন। পুরণ হবেকি তার স্বপ্ন ? সেকি খোঁজে পাবে তার সোনালী দিন ? এই চিন্তায় দিন পার হয়ে রাত আসে, রাতের পরে আবার দিন। সংগ্রামী এই শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়িয়েছেন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। দুর্ঘটনার পর থেকে টানা সাড়ে তিন মাস যাবত নিয়মিত ছাত্র শিক্ষকরা টিম গঠন করে রাতে দিনে সেবা ও দেখাশোনা করছেন। রুবিনার সাথে কথা বলে জানা গেছে, পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছেন শিক্ষকরা এবং সে অনুযায়ী সেবাও দিয়ে যাচ্ছেন। সাথে সাথে পুনর্বাসনের দায়িত্বও নিয়েছেন শিক্ষকরা।

এখানেই শেষ নয় দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসার জন্য শিক্ষকরা প্রতি মাসে তাদের বেতন থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।এব্যাপারে সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, রুবিনার জন্য আমরা যথাসাধ্য সবধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তাকে কিভাবে সুস্থ করে তোলা যায়। অন্যদিকে সে সুস্থ হওয়ার পর তাকে কিভাবে পুনর্বাসন করা যায় সে বিষয়েও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা তার চাকরির জন্য ইতিমধ্যেই রেলমন্ত্রী ও বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করেছি। তার পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এই শিক্ষক। তার জন্য ইতিমধ্যেই একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। তারপরও সংগ্রামী রুবিনার পিছু ছাড়ছেনা চিন্তা নামক শক্তি। সারক্ষণ ভাবছে কি হবে তার? কিভাবে চলবে তার পরিবার? তার ছোট ভাইকি লেখা-পড়া করতে পারবে? তার স্বপ্ন কি সত্যি হবে, নাকি স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে? জীবনে চলার পথে কখনোই হার মানেনি। এবার কি তাহলে তাকে হার মানতে হবে? এই চিন্তায় ব্যাস্ত থাকে সারাদিন। এত অল্প বয়সেই তার জীবনে এমন একটি দুর্ঘটনা নেমে আসবে এটা সে কখনো কল্পনা করেনি। তবে এই বাঁধাকেও সেই জয় করতে চায়। তার চোখে মুখে এখনও সফলতার স্বপ্ন।

রুবিনার সাথে কথা বলে জানা যায়, জীবনে যত বাঁধাই আসুক সে থামতে চায় না। সে একটি সুন্দর সোনাালী ভবিশষ্যতের আজও স্বপ্ন দেখে। অন্যন্য সকলের মত সেও চায় বিসিএস ক্যাডার হতে। প্রমাণ করতে চায় বাঁধা মানুষকে দমিয়ে রাখতে পারে না। তবে পড়ালেখা শেষ করার পর আপাতত চলার এবং বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য একটি চাকুরি দরকার। সে বিষয়ে ইতোমধ্যেই রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে জানান রুবিনা আক্তার। রেল ইঞ্জিনের নিচে পড়ে দুই পা হারানো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবিনা আক্তারের (২২) শরীরে কৃত্রিম পা সংযোজনের জন্য গত ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যায় রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রুবিনার হাতে তিন লাখ টাকার চেক তুলে দেন।

এছাড়াও রুবিনার পরিবারকে খরচের জন্য আরও ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। যেটি হয়েছিল জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি তরিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক শেখ জয়নাল আবেদিন রাসেলের চেষ্টায়। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, রুবিনাকে কৃত্রিম পায়ের জন্য আমরা অনুদান দিয়েছি। সিএমএইচ-এ তাকে কৃত্রিম পা পরানো হবে। সেখানে হাঁটার বিষয়েও তাকে কয়েকদিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। গত ১৭ এপ্রিল ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তার কৃত্রিম পা সংযোজনের মাপ নেওয়া হয়। পরবর্তীতে প্রস্তুতি সমপন্ন হলে সংযোজনের তারিখ জানানো হবে বলে জানিয়ে দেন সিএমএইচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রুবিনার সহপাঠীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সে প্রথমবর্ষ থেকেই নিজের পড়ালেখার খরচ সে নিজেই যোগাড় করত টিউশনি করে। সাথে বাড়ির খরচের জন্যও পাঠাতে হত টাকা। কারণ গত চার বছর আগেই তার দিনমজুর বাবার মৃত্যু হয়। ঘরে আছে তার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বোন জুলেখা।

অন্যদিকে একমাত্র ভাই রুবেলের পড়ালেখার খরচ চালাতে হত তাকেই। কারণ তার পরিবারের একমাত্র ভরসা ছিল সেই। যে কারণে তাকে অনেক কষ্ট করতে হত। তার বন্ধু রেজাউল করিম বলেন, সে প্রথম থেকেই অনেক কষ্ট করে চলত। কিন্তু আমরা সেটা জানতাম না। কারণ সে এসমস্ত কথা কখনো কারও সাথে শেয়ার করত না। দুর্ঘটনার পর আমরা জানতে পারি। তার ছোট ভাই বর্তমানে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়ছে। রুবিনা আক্তার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের ছাত্রী। সে বর্তমানে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েই শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে।

গত ১৪ মে তার প্রথম পরীক্ষা ছিল। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোছা. মুনিরা সুলতানা ও সহকারী অধ্যাপক জাফর ইকবালের তত্বাবধানে পরীক্ষাটি সমাপ্ত করেন। রুবিনা অনার্স শেষ করে একটি চাকরি পেতে চায়া। সে চায় কারও করুনার পাত্র না হয়ে কর্ম করে বেঁচে থাকতে। আত্মসম্মান নিয়ে জীবনের বাকিটা সময় অতিক্রম করতে। এব্যাপারে সে বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগ ও সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছে।

লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরো সংবাদ