কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের আদ্যোপান্ত

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৮, ১৪:০২

মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, ১৯ মে, এবিনিউজ : যেসব জ্যোতিষ্কের তাপ ও আলো নেই এবং মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সূর্যকে (নক্ষত্র) কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তিত হয় তাদের গ্রহ বলে। আর যেসব বস্তু মহাকর্ষ বলের প্রভাবে নির্দিষ্ট কক্ষপথে গ্রহের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় সেগুলো উপগ্রহ। গ্রহের সঙ্গে উপগ্রহ কথাটার মিল আছে। গ্রহের আগে উপ যোগ করে উপগ্রহ কথাটা এসেছে। পৃথিবী একটা গ্রহ। এ পৃথিবী ঘিরে যদি কোনো বস্তু নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে তাহলে সেটি পৃথিবীর উপগ্রহ। চাঁদ প্রাকৃতিকভাবেই পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়ায়। সেজন্য চাঁদ পৃথিবীর প্রাকৃতিক উপগ্রহ। অন্যদিকে মানুষের প্রয়োজনে পৃথিবী নামে গ্রহের চারপাশে ঘুরে বেড়ানোর জন্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম উপায়ে উদ্ভাবিত ও মহাকাশে উেক্ষপিত উপগ্রহই হলো কৃত্রিম উপগ্রহ।

কৃত্রিম উপগ্রহ এমনভাবে পৃথিবীর চারদিকে ঘূর্ণায়মান হয় যে, এর গতির সেন্ট্রিফিউগাল বা বহির্মুখীন শক্তি ওকে বাইরের দিকে গতি প্রদান করে। কিন্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একে পৃথিবীর আওতার বাইরে যেতে দেয় না। উভয় শক্তি কৃত্রিম উপগ্রহকে ভারসাম্য প্রদান করে এবং কৃত্রিম উপগ্রহটি পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। যেহেতু মহাকাশে বায়ুর অস্তিত্ব নেই, তাই এটি বাধাহীনভাবে পরিক্রমণ করে। কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর উেক্ষপণের সময়ই পর্যাপ্ত জ্বালানি গ্রহণ করতে হয়। কারণ মহাকাশে রিফুয়েলিংয়ের কোনো সুযোগ নেই। তবে কিছু উপগ্রহ জ্বালানি হিসেবে সৌরশক্তি ব্যবহার করে। এদের গায়ে সৌরকোষ লাগানো থাকে, যা ব্যবহার করে সূর্য থেকে তার প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করে।

স্যাটেলাইট একটি কৃত্রিম উপগ্রহ, যা পৃথিবীকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে প্রতিনিয়ত ডিম্বাকার পথে ঘোরে। মানুষের তৈরি করা অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারপাশে আবর্তিত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের প্রয়োজনে পৃথিবীর কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠিয়ে থাকে। মহাকাশে স্যাটেলাইটগুলো যে ডিম্বাকার পথে ঘুরতে থাকে, সে পথকে বলা হয় অরবিট বা কক্ষপথ। ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা অনুসারে এ কক্ষপথকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১. নিম্নকক্ষপথ (ভূপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা দুই হাজার কিলোমিটার); ২. মধ্যকক্ষপথ (ভূপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা দুই হাজার কিলোমিটার থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার পর্যন্ত) এবং ৩. উচ্চকক্ষপথ (ভূপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার থেকে অসীম)। কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে স্যাটেলাইটটি কত উচ্চতায় বসবে।

কৃত্রিম উপগ্রহ ও মহাকাশ যাত্রার ইতিহাস খুব একটা পুরনো নয়। মহাকাশে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ উেক্ষপণের কৃতিত্ব সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের। ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর উেক্ষপিত স্পুটনিক-১ নামের কৃত্রিম উপগ্রহটির নকশা করেছিলেন সের্গেই করালিওভ নামে একজন ইউক্রেনীয়। একই বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে দ্বিতীয় কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-২ উেক্ষপণ করে। স্পুটনিক-২ লাইকা নামের একটা কুকুর বহন করে নিয়ে যায়। অবশ্য উেক্ষপণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে তা মারা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা করে। তাদের পরিকল্পনা সফল হয় ১৯৫৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। তাদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ এক্সপ্লোরার-১ এদিন মহাকাশে উেক্ষপণ করা হয়।

মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ উেক্ষপণ করেছে, বিশেষ করে যোগাযোগের কাজে স্যাটেলাইট অনেক বেশি ব্যবহার হয়। বেশির ভাগ টেলিভিশন চ্যানেল তাদের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে এর মাধ্যমে। তাছাড়া ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিফোন সংযোগ, উড়ন্ত বিমানে নেটওয়ার্ক প্রদান, দুর্গম এলাকায় নেটওয়ার্ক প্রদান, জিপিএস সংযোগসহ বিভিন্ন কাজে কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবহার হয়।

আশার কথা হচ্ছে, বিশ্বের স্যাটেলাইট ক্ষমতাধর ৫৭তম দেশ হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। ২০১৫ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ নির্মাণ চুক্তির পর কথা ছিল ২০১৭ সালেই সেটি মহাকাশে পৌঁছে যাবে। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সে বছরও উেক্ষপণের নির্ধারিত দিন পার হয়ে যায়। এরপর সাতবার উেক্ষপণের তারিখ পরিবর্তন করে অবশেষে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে যাত্রা করে।

২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী স্যাটেলাইটের কাঠামো, উেক্ষপণ ব্যবস্থা, ভূমি ও মহাকাশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ভূস্তরে দুটি স্টেশন পরিচালনা সহায়তা ও ঋণের ব্যবস্থা করবে ফ্রান্সের নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। স্যাটেলাইটটি উেক্ষপণ এবং তা কক্ষপথে রাখার জন্য রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ (অরবিটাল স্লট) কেনা হয়। মহাকাশে এ কক্ষপথের অবস্থান ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে সম্পাদিত চুক্তির ভিত্তিতে প্রায় ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য এ কক্ষপথ কেনা হয়।

‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ কৃত্রিম উপগ্রহটি একটি জিও-স্টেশনারি স্যাটেলাইট বা ভূস্থির উপগ্রহ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ২৬ কু-ব্যান্ড ও ১৪ সি-ব্যান্ড মিলিয়ে মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার থাকবে। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হবে। বাকি ২০টি বিদেশী বা প্রতিবেশী দেশের কাছে ভাড়া দিতে পারবে। মহাকাশে স্যাটেলাইট উেক্ষপণের প্রক্রিয়া দেশের বাইরে সম্পন্ন হলেও গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে এটি নিয়ন্ত্রণ
করা হবে।

বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সফল হলে টেলিযোগাযোগ, টিভি, বেতার ও ইন্টারনেট যোগাযোগসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে  টেরিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা বহাল রাখবে, দেশের দুর্গম দ্বীপ, নদী ও হাওড় এবং পাহাড়ি অঞ্চলে স্যাটেলাইট প্রযুক্তিতে নিরবচ্ছিন্ন টেলিযোগাযোগ সেবা চালুও সম্ভব হবে। বাংলাদেশের সব স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল যারা এখন বিদেশের স্যাটেলাইটনির্ভর ফ্রিকোয়েন্সিতে প্রচারণা চালাচ্ছে, তাদের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রির মাধ্যমে দেশের টাকা দেশেই থাকবে, বিদেশী নির্ভরতা কমবে। (বণিক বার্তা থেকে সংগৃহীত)

লেখক : প্রোগ্রামার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা

[email protected]

এই বিভাগের আরো সংবাদ