আজকের শিরোনাম :

বাংলাদেশের সাফল্যের নায়ক তরুণ উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ মে ২০১৮, ১৫:৫০

ড. আতিউর রহমান, ০৬ মে, এবিনিউজ : বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং বর্তমানে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিক বসু বরাবরই বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম শুভাকাঙ্ক্ষী। আরেক বাঙালি অর্থনীতিবিদ নোবেলজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের প্রিয় ছাত্র কৌশিক বসু। কৌশিকদার সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। আশির দশকে তিনি এসেছিলেন বিআইডিএস-এ অতিথি গবেষক হিসেবে। সেই তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। এই পরিচয় আরো সুদৃঢ় হয় যখন তিনি বিশ্বব্যাংকে যোগ দেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে বছরে অন্তত দুবার যেতাম বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তর ওয়াশিংটন ডিসিতে। প্রতিবারই দেখা হতো তাঁর সঙ্গে। কথা হতো বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচাল নিয়ে। এর মধ্যে ড. বিরূপাক্ষ পালকে নিয়ে এলাম বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে। বিরুর সঙ্গে কৌশিকদার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। বিরুই প্রস্তাব করল কৌশিকদাকে বাংলাদেশে আনার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। তিনিও আমার আমন্ত্রণ একবাক্যে গ্রহণ করলেন, এলেন বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে দিলেন একটি হৃদয়গ্রাহী জনবক্তৃতা। চ্যানেল আইয়ে বিরুর পরিচালনায় উন্নয়ন আলাপ নামের একটি অনুষ্ঠানেও আমরা অংশগ্রহণ করলাম। গাজীপুরে গেলেন আর্থিক অন্তর্ভুক্তির কার্যক্রম দেখতে। পথেই একটি বিরাট কর্মী বান্ধব গার্মেন্ট কারখানা পরিদর্শন করলেন। কারখানার কর্মপরিবেশ, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেতন পাওয়া, তাদের সন্তানদের দেখভালসহ নানা বিষয় নিয়েই তিনি কথা বললেন। মালিকের কল্যাণে বিনা মাসুলে মোবাইলে বেতন পেয়ে তারা কতটা সন্তুষ্ট তাও জানাতে ভুল করেনি। একেবারে গ্রামে গিয়ে তিনি দেখলেন ডিজিটাল তথ্যকেন্দ্রের পাশাপাশি মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং।

পথে চলতে চলতেই তিনি বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন। তাঁর জনবক্তৃতায়ও তিনি বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা তুলে ধরেছিলেন। তা ছাড়া বিশ্ব মন্দাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কী করে বাংলাদেশ তার আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কয়েক গুণ বাড়িয়েছে সেসব কথা নানা গল্পের অবতারণা করে বললেন। পরবর্তী সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করার পর তিনি এক বিশেষ আমন্ত্রণে আমাকে সপ্তাহখানেকের জন্য বিশ্বব্যাংকে নিয়ে গেলেন। সে সময় চারটি সেমিনার দিয়েছিলাম বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফে। একটিতে তিনি ছিলেন সভাপতি। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ওপর ওই সেমিনারেও তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশের গরিবহিতৈষী উদ্ভাবনীমূলক নীতিমালার দারুণ প্রশংসা করেছিলেন। তাই কদিন আগে ‘প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে’র ব্যানারে ‘হোয়াই বাংলাদেশ ইজ বুমিং?’ কৌশিকদার লেখাটি পড়ে মোটেও অবাক হয়নি। কেননা বাংলাদেশের এই সাফল্যের নায়কদের যে তিনি নিজের চোখে দেখে গেছেন। এই প্রবন্ধের শেষ পর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কথাও বলেছেন। এই প্রথম নয়, সেবার যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন তাঁকে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে তিক্ততার পরিপ্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদের এই মিটিং নিয়ে আমিও খানিকটা উদ্বিগ্ন ছিলাম। শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই এই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। কিছুক্ষণ বাদেই আমি প্রস্তাব করলাম যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রফেসর কৌশিক বসু একান্তে কথা বললে ভালো হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সায় দিলেন। আমরা বের হয়ে এলাম। ২০ মিনিটের নির্ধারিত সভা যখন এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলছিল তখন আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ফের অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকলাম। দেখলাম তাঁরা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। আমিও কিছুক্ষণ তাঁদের আলাপে যোগ দিলাম। আলাপ শেষে বের হয়ে গাড়িতে উঠেই কৌশিকদা বললেন, এমন একজন দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী থাকতে তোমাদের আর চিন্তা কী? সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিবেদিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদার ও লক্ষ্যভেদী নীতি-কৌশলের দারুণ প্রশংসা করলেন তিনি। আমি এই সভার আয়োজন করতে পেরে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম।

অধ্যাপক কৌশিক বসু তাঁর সর্বশেষ লেখায় ‘বাংলাদেশ কী করে এমন সাফল্য দেখাচ্ছে?’ তার ব্যাখ্যা করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণ নেতৃত্বের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন, বাংলাদেশের উদ্ভাবনীমুখী মানুষগুলোর নিরন্তর সৃজনশীলতা ও পরিশ্রমের কারণেই যে বাংলাদেশ এমন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে সে কথাগুলো তিনি ফের বলেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম এক আশ্চর্যজনক সাফল্যের প্রতীক।’ একসময়ের সবচেয়ে দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষপীড়িত তথাকথিত একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে পরিচিত একটি দেশ কী করে হালে পাকিস্তানের চেয়ে অন্তত আড়াই শতাংশ বেশি হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে তা সত্যি বিস্ময়কর। এ বছর বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর সাফল্যের জন্য অধ্যাপক কৌশিক বসু বাংলাদেশের সরকারি ও অসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক উন্নয়নে লক্ষ্যভেদী কর্মকাণ্ডের অবদানের কথা বলেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান মেয়েদের লেখাপড়ার ওপর জোর দিয়েছে বলেই নারীর ব্যাপক ক্ষমতায়ন ঘটেছে। তাই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তা ছাড়া ড. কৌশিক বসু বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পের অসামান্য অগ্রগতিকেও এই অর্জনের জন্য কৃতিত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে নমনীয় শ্রমনীতি, কর্মী বান্ধব পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সরকারের সদিচ্ছার কারণে বাংলাদেশে বড় বড় গার্মেন্ট কারখানা গড়ে উঠতে পেরেছে বলে অধ্যাপক বসু মনে করেন।

তা ছাড়া শিক্ষার পাশাপাশি বাংলাদেশের সরকার যেভাবে শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির উন্নয়নে প্রয়োজনীয় নীতি সমর্থন দিয়েছে সে দিকটিও স্বীকার করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে অধ্যাপক কৌশিক বসু জানিয়েছেন যে দক্ষিণ এশিয়ার সব কটি দেশ থেকেই বাংলাদেশ আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এগিয়ে রয়েছে। তিনি লিখেছেন, ২০১৭ সালে যেসব প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশির ব্যাংক হিসাব রয়েছে, তাদের ৩৪.১ শতাংশই ডিজিটাল লেনদেন করেছে। এ ক্ষেত্রে এশিয়ার গড় অর্জন ছিল ২৭.৮ শতাংশ। বাংলাদেশের ব্যাংক হিসাবগুলোর মধ্যে মাত্র ১০.৪ শতাংশ ছিল নিস্তেজ (অর্থাৎ এক বছরে কোনো লেনদেন হয়নি)। আর ভারতে এমন হিসাবের হার ছিল ৪৮ শতাংশ। আমার ধারণা, স্কুল ব্যাংকিং, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের হিসাব ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাব যুক্ত করলে বাংলাদেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির চিত্রটি আরো উজ্জ্বল হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টার ‘ব্রেইন চাইল্ড’ ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের অভিপ্রায়ের বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির নানামুখী উদ্ভাবনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সবশেষে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশের এই ধারাবাহিক সাফল্য কি টেকসই হবে? উত্তর তিনিই দিয়েছেন। বলেছেন, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এই ধারাবাহিকতা টেকসই হবে। তবে ঝুঁকিও রয়েছে। বিশেষ করে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও বাংলাদেশের সামাজিক অগ্রগতির জন্য উদার বিনিয়োগের যারা বিরোধিতা করে সেই ধর্মীয় মৌলবাদীদের অসহিষ্ণুতা এই অগ্রযাত্রাকে ব্যাহতও করতে পারে। তবে একই সঙ্গে তিনি এ আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব বাধা মোকাবেলার মতো যথেষ্ট সক্ষমতাও রাখেন। যদি তা-ই সত্যি হয়, তাহলে অধ্যাপক কৌশিক বসুর মতে বাংলাদেশই হবে ‘এশিয়ার এক অনন্য সাফল্যের উপাখ্যান’।

উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন নেতৃত্বের ফলেই যে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এমন সাফল্য দেখাতে পারছে সে কথা অধ্যাপক অমর্ত্য সেনও অনেকবার বলেছেন। বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার। তাই সংগ্রাম করেই আমাদের বাঁচতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে লড়াকু মন নিয়ে বাংলাদেশের তরুণরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই মনমানসিকতাই শেষ পর্যন্ত বাঙালিকে সফল উদ্যোক্তা হতে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। কম বয়সী অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্যোক্তারাই বাংলাদেশের এই সাফল্যের মূল নায়ক। তা ছাড়া এ দেশের কৃষক যেভাবে কৃষিতে আধুনিকায়ন করেছে, যেভাবে কৃষির বহুমুখীকরণে উদ্যোগী হয়েছে, কৃষকের সন্তানেরা যেভাবে বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে বিদেশি মুদ্রা আয় করে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠিয়ে গ্রামের পুকুরে মাছ চাষ করার উদ্যোগ নিয়েছে, মুরগির খামার করেছে, গাভির খামার গড়ে তুলেছে, স্কুল-কলেজ গড়েছে, তা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। এসব শুধু সম্ভব হয়েছে প্রবাসী তরুণদের ও তাদের স্বজনদের উদ্যোক্তা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে। তাদের এই উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকার বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছে, আয়কর ছাড় দিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্রামে গ্রামে ব্যাংকের শাখা খুলতে বলেছে, মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংক চালু করে অতিদ্রুত অর্থ প্রেরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কৃষি, এসএমই ও সবুজ ঋণের কার্যক্রমে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহী করেছে। সরকারও উদ্যোক্তাদের সুবিধার্থে রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট, ডিজিটাল পার্ক, ডিজিটাল তথ্যকেন্দ্র স্থাপনে এগিয়ে এসেছে। বর্তমান গ্রামবাংলায় অসাধারণ কানেক্টিভিটি চোখে পড়ে। গ্রাম ও শহরের দূরত্ব প্রায় ঘুচেই গেছে। গ্রামেও শহরের সব সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ই-কমার্স, এফ-কমার্স, আউটসোর্সিং, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার, ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ, অটোমেটিক ক্লিয়ারিং হাউস, মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিং নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রচলন করে  নারী ও অন্যান্য উদ্যোক্তা গড়ে ওঠার বিস্তীর্ণ নীতি-পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের অনেকেই ছোটখাটো ডিজিটাল ব্যবসায় হাত দিচ্ছে। পত্রিকায় দেখলাম, বারিধারায় শিক্ষিত তরুণরা অনলাইন লন্ড্রি চালু করেছে। কয়েক বন্ধু মিলে ‘কুকঅ্যান্টস’ নাম দিয়ে যাঁরা রান্না করতে চান এবং যাঁরা সেই রান্না কিনে খেতে চান তাঁদের মধ্যে অ্যাপসের মাধ্যমে সেতুবন্ধ তৈরি করে দিয়েছে। আজকাল ঘরে বসে রেস্টুরেন্টের খাবার কেনার ই-কমার্স বহুল প্রচলিত। ‘ফুড পান্ডা’ ছাড়াও আরো অনেক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু রয়েছে। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট চান? অ্যাপসনির্ভর ডিজিটাল সেবা নিন। উবারে শত শত তরুণ নিজেরা গাড়ি চালাচ্ছে, কেউ গাড়ি সরবরাহ করে আয় করছে। ‘পাঠাও’, ‘চলো’, ‘ও ভাই’-এর মতো অনেক অ্যাপসভিত্তিক পরিবহন ডিজিটাল সেবামঞ্চ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির উবারাইজন সত্যি উল্লেখ করার মতো।

বর্তমানে সাত লাখেরও বেশি শিক্ষিত তরুণ-তরুণী আউটসোর্সিং প্ল্যাটফর্ম ‘অডেক্স’ ও অন্যান্য সেবামঞ্চের মাধ্যমে আয়-রোজগার করছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২১ সাল নাগাদ ২০ লাখ মানুষ আউটসোর্সিংয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত হবে। প্রায় আট লাখের মতো এজেন্ট মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সেবা নিয়ে মাসে কম করে হলেও এক লাখ টাকা আয়-রোজগার করছে। খুব অবাক হলাম, গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরের এক স্মার্ট গ্রামে গিয়ে। সে গ্রামের নারীরা সোলার বাতি, পাম্প, চুলা কিনছেন, স্মার্টফোনে অ্যাপস ব্যবহার করে এজেন্ট ব্যাংকিং করছেন। রহিমআফরোজের সঙ্গে শত শত সবুজ উদ্যোক্তা যুক্ত হয়ে গ্রামেগঞ্জে জ্বালানি সাশ্রয়ী নানা ধাঁচের সোলার পণ্য বিক্রি করছে। আমার এক ছাত্র মাহিন মতিন নিজে চাকরি না করে চাকরি দেওয়ার জন্য অনেক ডিজিটাল উদ্যোগ নিয়েছে। জাপানি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে মিলে ৪০০-এর মতো স্কুলের পাঠদান বিষয়ে অফলাইন/অনলাইন সংযোজন করে ব্যাকবোন লিমিটেডের ব্যানারে ট্যাব বানিয়েছে। সাড়ে চার হাজার টাকায় এই ট্যাব বিক্রি করে স্কুল পর্যায়ের অসংখ্য ছেলে-মেয়ের শিক্ষার গুণগত মান বাড়াচ্ছে। ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগী ছাত্র-ছাত্রীদের কয়েক ঘণ্টার জন্য অনলাইনে জাপানি স্কুলের ছেলে-মেয়েদের ইংরেজি রচনা সম্পাদনা করার ই-শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে মাহিন। মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় করছে ওই ছেলে-মেয়েরা কয়েক ঘণ্টার পার্টটাইম কাজ করেই। মাহিন আশা করছে, শত শত ছেলে-মেয়ের জন্য এভাবেই আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে পারবে। একই সঙ্গে নিজেরও ব্যবসার প্রসার ঘটবে। এখন সে আন্তর্জাতিক মানের একটি স্কুল নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একই সঙ্গে মন ভরে যায়, যখন দেখি কয়েকজন ছাত্র মিলে গড়ে তুলেছে ‘ফিউচার বাংলা সমাজকল্যাণ সংস্থা’। তারা পথশিশুদের গুণমানে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সামাজিক এই উদ্যোগ হাতে নিয়েছে।

এমনি আরেক তরুণ উদ্যোক্তা রায়হান শামসী। গ্রামীণফোনে কাজ করতেন একসময়। এরপর কুয়ালালামপুরে গেলেন একটি গ্লোবাল প্রযুক্তি কম্পানিতে মূলত বিপিও উদ্যোগ পরিচালনার জন্য। এখন রায়হান নিজেই ডেভো-টেক নামের এক বিশাল ‘টেক-মঞ্চ’ গড়ে তুলেছেন। ঢাকার গুলশানেই ৪৪ হাজার বর্গফুটের আইটি পার্ক স্থাপন করেছেন রায়হান। ইনোভেশনে ল্যাব স্থাপন করে যারা ইনোভেটর হতে চায়, তাদের হাতে ধরে কাজ শেখাবে এই প্রতিষ্ঠান। স্টার্ট-অ্যাপগুলোকে চূড়ান্ত সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য যত ধরনের সহায়তা লাগে তা দেবে এই প্রতিষ্ঠান। ডাটা সেন্টার খুলেছে বড় তথ্যভাণ্ডার নিয়ে কাজ করার জন্য। বিপিও কর্মকাণ্ডের জন্য সব ধরনের সহযোগিতা দেবে ডেভো-টেক। নয়া উদ্যোক্তারা এখানে আড্ডাও দিতে পারবে। সাইবার নিরাপত্তা কেন্দ্রও গড়ে তুলেছে এই প্রতিষ্ঠান। উদ্যোক্তা বানানোর হাতে-কলমে প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে এই আইটি পার্কে। মূলত তরুণ ডিজিটাল উদ্যোক্তা বানাতেই এই আইটি প্ল্যাটফর্ম যাত্রা শুরু করেছে। ‘বাংলাদেশে তৈরি’ স্লোগান নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে উদ্যোক্তা তৈরির এই ডিজিটাল কারখানা।

আমার বিশ্বাস, রায়হানের মতো আরো অনেক ডিজিটাল উদ্যোক্তা এখন ব্যস্ত বাংলাদেশকে নয়া উচ্চতায় নেওয়ার জন্য। সোনিয়া, শামীম, মাশরুর, কামাল কাদিরসহ বিশ্বমানের উদ্যোক্তারা এরই মধ্যে ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যের চোখ ধাঁধানো সব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। চীনের আলীবাবা এখন বাংলাদেশের বিকাশের সঙ্গে অংশীদারির জন্য এগিয়ে আসছে। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ায় নয়া আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। ‘আইপে’ চালু করে জাকারিয়া স্বপন ও তার সহযোগীরা এরই মধ্যে ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে সংযুক্ত নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল লেনদেনের এক আধুনিক প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করিয়েছে। ‘পেপলও’ নিশ্চয় আসবে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের তরুণরাই তাদের মতো করে ‘বাংলাদেশি পেপল’ চালু করার শক্তিও রাখে। বাংলাদেশেও ‘উইচ্যাটের’ মতো ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা শিগগিরই গড়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস।

আমার ভালো লাগছে যে এসব ডিজিটাল উদ্যোক্তাকে আমি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশ আগে থেকেই প্রয়োজনীয় নীতি সমর্থন দিতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ চালু করেছে, ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার চালু করেছে, আরটিজিএস চালু করেছে। আর অটোমেটিক ক্লিয়ারিং হাউস থেকে অনেক দিন ধরেই চালু রয়েছে। এসবের কারণে বাংলাদেশে ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের প্রসারের বিরাট ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আমি খুবই আশাবাদী, আগামী দিনের ডিজিটাল অর্থনীতির ক্রমবিকাশের ধারা আরো এগিয়ে যাবে।

তাই যারা বাংলাদেশের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধিকে ‘জবলেস’ বলে সংশয় প্রকাশ করছে, তাদের এসব অসংখ্য উদ্যোক্তা ও তাদের তৈরি কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিতে বলব। অস্বীকার করব না যে গুণমানের শিক্ষা না পেয়ে অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণী যথেষ্ট চাকরি না পেয়ে বেকার রয়েছে। চাকরি পেলেও বেতন কম। তবে চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনার ক্ষেত্রটি কিন্তু দিন দিনই প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে প্রত্যেক ব্যাংকের প্রত্যেক শাখাকে অন্তত একজন নারী উদ্যোক্তাকে বছরে প্রয়োজনীয় ঋণ দিতে হবে। এর ফলে প্রায় ১০ হাজার নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার কথা। এখন প্রয়োজন যথাযথ ‘অ্যান্ড ইউজ’ভিত্তিক তদারকি। এ ছাড়া খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তা, সিএসআর সমর্থনসহ অনেক সৃজনশীল কর্মসূচির অধীনে অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ১৫ হাজার নারী উদ্যোক্তা এখন ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত। এখন প্রয়োজন তাদের যথাযথ ঋণের সুবিধা দেওয়া। কম খরচে পুঁজি সহায়তা দেওয়া। তাদের মার্কেটিংয়ের জন্য অবকাঠামো সহায়তা দেওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে।

অনেকেই আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশে গার্মেন্ট খাতে দ্রুত অটোমেশন হবে বলে নারীর কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে যাবে। কথাটি পুরোপুরি সত্যি নয়। বাংলাদেশ ধীরে ধীরেই অটোমেশনে যাচ্ছে। তা ছাড়া এই শিল্পের বিকাশও দ্রুতই হচ্ছে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি মোকাবেলা করে যেভাবে এই শিল্প কর্মিবান্ধব চেহারা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে মনে হয় এই শিল্পের বিকাশ আরো ত্বরান্বিত হবে। একই সঙ্গে সবুজও হবে। এখন এই শিল্প জ্বালানি ও পানি সাশ্রয়ী সবুজ শিল্পে রূপান্তরিত হচ্ছে। এরই মধ্যে বিশ্বের ১০টি শ্রেষ্ঠ সবুজ বস্ত্র কারখানার সাতটিই বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে। আরো ২০০টি সবুজ রূপান্তরের পথে। এ শিল্পের তরুণ উদ্যোক্তারা অনেক দূরদর্শী। তাই দ্রুত কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে এই শিল্প কর্মিবিমুখ হবে—এ কথা বলার সময় এখনো আসেনি।

তবু সাবধানেই আমাদের রপ্তানিমুখী শিল্পের অটোমেশনে যেতে হবে। কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষিত কর্মী ও ব্যবস্থাপক তৈরির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দিকে আমাদের নজর বাড়াতে হবে। আরো অনেক দিন আমরা কর্মী সহায়ক রপ্তানিমুখী শিল্প পরিচালনা করার আশা রাখি।

সবশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প আসলে আমাদের নানামুখী তরুণ উদ্যোক্তাদের সাফল্যের গল্প। তারা বাংলাদেশ নিয়ে বড় স্বপ্নে বিভোর। আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশ নিশ্চয় একদিন তাদের স্বপ্নের সমান হতে পারবে। তবে সে জন্য চাই সামাজিক শান্তি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রশাসনিক সুশাসন। সমৃদ্ধ সেই মাথা উঁচু করা বাংলাদেশকে স্বাগত জানাই। আর অভিনন্দন জানাই আমাদের অগুনতি সৃজনশীল পরিশ্রমী তরুণ উদ্যোক্তাকে। জয় হোক লড়াকু বাংলাদেশের। আগামী দিন নিশ্চয় আমাদের। (কালের কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত)

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর
বাংলাদেশ ব্যাংক

[email protected]

এই বিভাগের আরো সংবাদ