স্কুল বন্ধ, রাষ্ট্র নিশ্চল, ভারতের সমাজ?

  অম্লান বিষ্ণু

২৬ জুলাই ২০২১, ১৬:৫৯ | অনলাইন সংস্করণ

সাইফুল মণ্ডল, দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র, তার স্কুলের মাস্টারমশাইদের উদ্দেশে একটা চিঠি লিখেছে: “স্যর, আমি স্কুলে যেতে চাই। বাড়িতে সবাই আমাকে খালি বকাঝকা করে। আর ভাল্লাগে না! স্কুল আমার খুব প্রিয়। বন্ধুদের খুব মিস করছি।”

কোভিড-১৯ প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষার্থীদের স্কুল থেকে আলাদা করে দিয়েছে। তারা যেন নিজগৃহে পরবাসী! শিশুমনে এর প্রভাব যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলা শিক্ষকমাত্রই জানেন। যেমন, তিলক মুখোপাধ্যায়, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার শাঁড়াপুল হাটখোলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। স্কুলের ছেলেমেয়েদের বার্ষিক পত্রিকা রংবেরং-এর বিশেষ লকডাউন সংখ্যার লেখা বাছাই করতে গিয়ে তিলকবাবু দেখেন শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকেই স্কুল খুলে দেওয়ার আর্জি জানাচ্ছে। ক্লাস থ্রি-র লক্ষ্মী, ক্লাস ফোর-এর সারমিন— সব্বার মুখে একই কথা: “স্যর, এ বার স্কুলটা খুলে দাও না!”

এই কোভিড-১৯ কচিকাঁচাদের লেখাপড়া, বেড়ে ওঠা, সব কিছুর উপর, অর্থাৎ আগামী গোটা প্রজন্ম ও সমাজের উপর, ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে বাধ্য। অনেকেই মানেন, এই ক্ষতি আটকাতে এখনই প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ক্লাস চালু করা প্রয়োজন। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? সরকার গোটা সমস্যাটাকেই অগ্রাহ্য করছে। কোনও সরকারি কর্তাকে ২০২০ সালের মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষা নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের কী ভাবে পড়ানো উচিত, এনসিইআরটি তার একটা রূপরেখা তৈরি করেছে। কিন্তু তার প্রয়োগ বিষয়ে কোনও নির্দেশিকা রাজ্যগুলো পেয়েছে কি না, জানা নেই।

অভিভাবকদের একটা বড় অংশই চান লেখাপড়া চালু হোক। লেখাপড়া চালু করতে শিক্ষকদের উদ্যোগ জরুরি। কিন্তু অত্যন্ত রূঢ় হলেও বাস্তব— তাঁদের একাংশ দ্বিধাজর্জর, আর অন্য অংশ এই অবস্থার সঙ্গে নিজেদের বেশ মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছেন! শিক্ষক সংগঠনগুলিও এ ব্যাপারে কোনও গঠনমূলক দিশা দেখাতে পারছে না।

তবে, শিক্ষার্থীদের জন্য চিন্তিত শিক্ষিকা-শিক্ষকের সংখ্যাও কম নয়। করোনার প্রথম ঢেউয়ের জেরে যখন লকডাউন শুরু হয়েছিল, তখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গের সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের কিছু সংগঠন কিংবা কিছু শিক্ষক শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া জারি রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মুর্শিদাবাদ, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলায় বেশ কিছু প্রাথমিক শিক্ষক যথাযথ দূরত্ব বিধি ও সতর্কতা মেনে স্কুলের বাইরের খোলা জায়গায়, চণ্ডীমণ্ডপে, মসজিদের সামনে ফাঁকা প্রাঙ্গণে, কিংবা বাড়ির উঠোনে শিশুদের পাঠ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এর সামর্থ্য নিতান্তই কম। অনেকেই ডিজিটাল শিক্ষার কথা বলছেন। অনলাইন ক্লাস কথাটা শুনতে বেশ, কিন্তু শিশুশিক্ষার ব্যাকরণের একেবারে পরিপন্থী। শিক্ষার তত্ত্বগত দিকটার বাইরেও সমস্যা- কত জন এই সুযোগ নিতে পারে? কিছু বিকল্প খোঁজা চলছে। যেমন, বাঁকুড়া জেলার কিছু শিক্ষক নিজস্ব উদ্যোগে টিভি চ্যানেলের স্লট কিনে ক্লাস নিচ্ছেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা কিছুই নয়।

পরিস্থিতি ভয়াবহ। শিক্ষাব্যবস্থার ফাঁক গলে এক জন শিক্ষার্থীও যদি বাইরে চলে যায়, তবে সেটাকে একটা আপৎকালীন পরিষেবা বলে স্বীকার করলেও ‘ব্যবস্থা’ বলা চলে না। এ বিষয়ে অত্যন্ত সুচিন্তিত মত প্রকাশ করেছেন সুকান্ত চৌধুরী, অচিন চক্রবর্তীর মতো শিক্ষাবিদরা। প্রাথমিক শিক্ষকদের মঞ্চ ‘শিক্ষা আলোচনা’ আয়োজিত এক সভায়, অন্যত্রও, তাঁরা জোর দিয়ে বলেছেন নাগরিক সমাজ তথা লোকসমুদয়ের সক্রিয় ভূমিকার কথা। অধ্যাপক চৌধুরীর প্রস্তাব, স্কুল-শিক্ষক ও অভিভাবকদের সেতুবন্ধন করতে এগিয়ে আসুন স্কুল এলাকার শিক্ষিত যুবসমাজ, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকসমাজ ও উৎসাহী মানুষ। অধ্যাপক অচিন চক্রবর্তী এর পাশাপাশি এলাকার গৃহশিক্ষকদেরও কাজে লাগানোর পক্ষপাতী। এঁদের মতো বেশ কিছু চিন্তাশীল মানুষের বক্তব্য, এই পর্বে সমুদয়কেই মূল চালিকাশক্তি হতে হবে। কোভিড বিধি মেনে শিশুদের স্বেচ্ছাসেবকরা নিয়মিত লেখাপড়ায় সাহায্য করবেন। শিক্ষকরা পড়ানোর পদ্ধতি ও কর্মপত্র তৈরি করে নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবীদের হাতে তুলে দেবেন। অভিভাবকরা পুরো বিষয়টার তদারকি করবেন। রাজ্যের সর্বত্র এমন উদ্যোগ কার্যকর করতে পারলে ক্ষতি খানিকটা সামাল দেওয়া যাবে।

কিন্তু নাগরিক সমাজও কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? অমর্ত্য সেন বার বার বলেছেন, কেবল ভোট নয়, পাশাপাশি গণ-আলোচনা এবং সমালোচনাই পারে গণতন্ত্রকে নিশ্চিত করতে। স্কুলছুট, শিক্ষায় বৈষম্য রুখতে চাইলে শিক্ষক, সরকারের পাশাপাশি অনেক বড়- এবং রাজনৈতিক ভূমিকা নিতে হবে নাগরিকদেরই। সম্পদ, সাহিল, সৌমিদের ভাল রাখার দায়িত্বটা অস্বীকার করা পাপ।

সৌজন্যে: আনন্দবাজার পত্রিকা

এই বিভাগের আরো সংবাদ