আজকের শিরোনাম :

মাহাথির থেকে কি কিছু শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ : আহমদ রফিক

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ মে ২০১৮, ১৩:৫০

ঢাকা, ১৭ মে, এবিনিউজ : মালয়েশিয়া নিয়ে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে রাজনৈতিক চমক বেশ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে। কারণ আর কিছু নয়, আধুনিক, শিল্পোন্নত মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির মোহাম্মদের জাতীয় নির্বাচনে অবিশ্বাস্য বিজয় এবং আবার নতুন করে ক্ষমতায় আসীন হওয়া। আরো বিশেষ করে এ কারণে যে তাঁর বয়স এখন ৯২ বছর। সে জন্যই কাগজগুলোতে এমন সব শিরোনাম : ‘মাহাথিরের রূপকথার মতো রেকর্ড গড়া জয়’, ‘৯২ বছর বয়সী মাহাথিরে উজ্জীবিত মালয়েশিয়া’, মাহাথিরের বিস্ময়কর পুনরুত্থান’, ‘মালয়েশিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল’ কিংবা ভিন্ন নিরিখে শিরোনাম ‘নতুন লক্ষ্যে মাহাথির মোহাম্মদ’ ইত্যাদি।

আসলে ঘটনাটি সাদামাঠা নির্বাচনী বিজয় নয়। এর পেছনে রয়েছে আঁকাবাঁকা সর্পিল রাজনৈতিক ইতিহাস, যা কখনো কখনো দেখা যায় উপনিবেশভুক্ত দেশগুলোর মুক্তিসংগ্রাম-উত্তর স্বাধীন শাসনব্যবস্থায়। যথারীতি সেখানে চলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, একনায়কি শাসনের প্রবণতা ও প্রাধান্য, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রায়শ লাগামহীন রাজনৈতিক-সামাজিক দুর্নীতি। এশিয়া-আফ্রিকার মুক্ত-স্বাধীন দেশগুলোতে এমন উদাহরণ যথেষ্টই মিলবে।

পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে যে মাহাথির তাঁর দুই দশকের শাসনপর্বে পশ্চাৎপদ, কৃষিপ্রধান ও জীর্ণ অর্থনীতির একটি দেশকে শিল্পোন্নত, আধুনিক কেতার রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন তাঁর বিচক্ষণ নীতি ও কৌশলের মাধ্যমে। ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত দেশটি বিশ্ব রাষ্ট্রীয় দরবারে মর্যাদার আসন থেকে পিছিয়ে নেই। বাণিজ্যে, শিল্পপণ্য রপ্তানিতে এশিয়ায় বিশেষ অবস্থান মালয়েশিয়ার।

অস্বীকার করা যাবে না যে উন্নত পশ্চিমা বিশ্ব অনিচ্ছা সত্ত্বেও মালয়েশিয়ার একনায়ক শাসক মাহাথির মোহাম্মদকে মেনে নিতে এবং তাঁর রাষ্ট্রটিকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছে। তার কারণ আর কিছু নয়, মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক উন্নতি। তার প্রমাণ আমরা একসময় দেখেছি, বাংলাদেশের বাজার মালয়েশিয়ার শিল্পপণ্যে (ছোট, বড় ও মাঝারি ধরনের) সয়লাব। অবশ্য পরে, বিশেষত এখন চীনা পণ্য সে জায়গাটির অনেকখানি দখল করে নিয়েছে।

মাহাথির মোহাম্মদের শাসনকালীন কৃতিত্ব হলো, তিনি একনায়ক হোন বা স্বৈরাচারী শাসক হোন, সাংবাদিক দমন বা গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার নায়ক হোন—তিনি মালয়েশিয়াকে একটি উন্নত, শিল্পনির্ভর দেশে পরিণত করেছেন—প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে। ঔপনিবেশিক শোষণে জীর্ণ দেশটি তাঁর চেষ্টায় হয়ে ওঠে উন্নত মানের একটি রাষ্ট্র।

বলতে হয়, ওই দেশের সাধারণ মানুষ মাহাথির শাসনের কাঠিন্যে গুরুত্ব দেয়নি, অর্থনৈতিক উন্নতিকেই বড় করে দেখেছে। সে সুযোগ নিয়েছেন মাহাথির, নিজেকে সব বিরোধিতার ঊর্ধ্বে ধরে রাখতে। রেখেছেনও। তাই গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার—এসব বিবেচনায় নিয়ে অল্পসংখ্যক লোকই মাথা ঘামিয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা, দুই দশকের কিছু বেশি সময় দেশ শাসন করে মাহাথির যখন স্বেচ্ছায় অবসরে গেলেন অনুজপ্রতিম নেতাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে, তখন তিনি জনগণের চোখে মহানায়ক। যেমন—কৃষ্ণাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী মানুষ অনুরূপ মর্যাদা দিয়েছে নেলসন ম্যান্ডেলাকে, এক মেয়াদের পর স্বেচ্ছায় শাসনক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার মহত্ত্বে।

কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল কংগ্রেসের মতোই মাহাথির-পরবর্তী শাসকরা সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেননি। উপনিবেশ শাসনমুক্ত একাধিক দেশের মতোই এঁরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাটি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি, এমনকি পূর্বাবস্থাও ধরে রাখতে পারেননি। রাজনৈতিক অনাচারের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে ব্যক্তিস্বার্থ, ক্ষমতার অপব্যবহার, সর্বোপরি ব্যাপক দুর্নীতি। ‘রাজকোষ থেকে চুরি’—অর্থাৎ অর্থপাচার সবার চোখে বড় হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ হয়তো ভেবেছে, ‘আহা, মাহাথির মোহাম্মদ থাকলে এমন ঘটনা ঘটতে পারত না।’

মাহাথিরের শাসনকালের বড় একটি কালো বিন্দু বলে অনেকে মনে করেন তাঁর উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে সমকামিতার অভিযোগে বিচারের মাধ্যমেই কারাগারে প্রেরণ। বিষয়টি তখন বিশ্বরাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। শাসনব্যবস্থার মতো মালয়েশিয়ার বিচারব্যবস্থাও যে মাহাথিরের ইঙ্গিতে চলে, তেমন অভিযোগ উঠেছিল পশ্চিমা পরাশক্তির পক্ষ থেকে। বিশেষ করে সেখানকার সাংবাদিক মহলে।

আনোয়ার ইব্রাহিম-ঘটিত জটিলতার রহস্য সম্ভবত এখনো কাটেনি, যদিও তখনকার অভিযোগ ও নেপথ্য রাজনীতির রহস্য একালে অনেকেই মনে রাখেননি। এ সম্পর্কে একটি প্রাসঙ্গিক তথ্য স্মরণ করার মতো যে দেশের উন্নয়নধারার প্রাথমিক পর্বে মাহাথিরকে মার্কিন বলয়ের বলে মনে করা হলেও প্রতিষ্ঠিত মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকে একসময় দেখা গেল মার্কিন পরাশক্তির আগ্রাসননীতির কঠোর সমালোচনা করতে। এ উপলক্ষে একটি কলামও লিখেছিলাম।

সে সময় অনেকের ধারণা ছিল, ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষী আনোয়ার ইব্রাহিমকে মাহাথির সন্দেহের চোখে দেখছিলেন, বিশেষ করে তাঁর পক্ষে মার্কিন সুনজর লক্ষ করে। আর সে জন্যই কি অপবাদের অভিযোগে আনোয়ারকে তিনি সরিয়ে দিয়েছিলেন ক্ষমতার বলয় থেকে? আমার মনে আছে, আনোয়ার ইব্রাহিম তখন বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করে অবিচারের দায়ভার প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের ওপর চাপিয়েছিলেন। কিন্তু মাহাথির সর্বেসর্বা। এখন বিজয়ী মাহাথির ২০১৮ সালে পৌঁছে নিজের ভুল স্বীকার করেছেন জনগণের সামনে এবং তা সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। জনগণ তাতেই খুশি। এবং তারা আনোয়ার ইব্রাহিমের দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদকে বিপুলভাবে জিতিয়ে দিয়েছে। ১০ মের নির্বাচন সব পূর্ব জরিপ ভুল প্রমাণ করে মাহাথির মোহাম্মদের গলায়ই জয়মাল্য পরিয়ে দিয়েছে।

এ ক্ষেত্রে লক্ষ করার একটি বিষয় হলো, মাহাথির চাণক্যধর্মী কূটকৌশলী রাজনীতিক। তিনি নিজের শাসনকালের ভুল স্বীকার করলেও আনোয়ারকে নির্দোষ বলেননি। দেশের উন্নতির প্রয়োজনে সব ধরনের বিরোধিতা সরিয়ে রাখতে জনস্বার্থে, দেশের স্বার্থেই তাঁকে কঠোর হতে হয়েছে—এমন বক্তব্যই রেখেছেন মাহাথির জনগণের উদ্দেশে। ভবিষ্যতে সেসব ভুল তিনি শুধরে নেবেন জনভোটে ক্ষমতায় যেতে পারলে। এমন সব আশ্বাস তাঁর।

জনগণ যে তাদের পূর্ব নায়কের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা স্থাপন করেছে, তার প্রমাণ মিলেছে নির্বাচনের ফলাফলে। তিনি নির্বাচনী বক্তৃতায় এমন অঙ্গীকারও করেছেন যে নির্বাচিত হলে তিনি কোনো ধরনের প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি অনুসরণ করবেন না। বয়সের কারণে হয়তো দুই বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকবেন না। তাঁর লক্ষ্য দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা এবং ভেঙে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা, দেশকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া।

এখানে একটি বড় প্রশ্ন—এখন ৯২ বছর বয়সে তিনি কেন আবার রাজনীতিতে ফিরে এলেন, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার শ্রমনির্ভর ঝুঁকি নিতে গেলেন। তা কি শুধু নতুন করে ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার জন্য, নাকি দেশকে ফের উন্নতির বৃত্তে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এই শ্রমনির্ভরতাকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা। এ প্রশ্নের জবাব মাহাথিরই দিতে পারবেন, আর বলে দেবে ভবিষ্যৎ সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিত।

আরো একটি প্রশ্ন স্বাভাবিক নিয়মেই উঠে আসে—নিজের দলের বাইরে একসময়কার বিরোধীর সঙ্গে জোট গড়ে এই যে অভাবিত বিজয়, এ কি মাহাথিরের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির প্রভাবে, নাকি আনোয়ার ইব্রাহিমের প্রতি ভোটারদের সহানুভূতির কারণে। আমার বিশ্বাস, বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অনাচারী শাসন, সাধারণ মানুষের সমস্যাজড়িত জীবন এবং দেশের অর্থনৈতিক অবনতি, দুর্নীতি ইত্যাদি ঘটনাই প্রধান কারণ। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাহাথির ও আনোয়ার ‘ফ্যাক্টরস’।

সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা আদায়ে ব্যর্থতা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নেতিবাচক কারণ ভোটারদের প্রলুব্ধ করে বিকল্প বা বিপরীত ধারার শক্তিকে বেছে নিতে, এটা প্রায়ই পর্যায়ক্রমে ঘটে থাকে। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় মাহাথির মোহাম্মদের মতো রাজনৈতিক নেতার কারিশমা, তাহলে তো আর কথাই নেই, বিজয় সে ক্ষেত্রে অনিবার্য। কেন জরিপের পূর্বাভাস এ সত্য তুলে ধরেনি, তা বলা কঠিন। সম্ভবত তাতে ক্ষমতাসীনদের প্রভাব থাকতে পারে।

এখন দেখার বিষয়, বিজয়ী মাহাথির মোহাম্মদ পরাজিত দল কর্তৃক উত্থাপিত সাংবিধানিক জটিলতা দূর করে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হতে পারছেন কি না। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী মাহাথির তাঁর প্রত্যাশামাফিক প্রতিশ্রুত কাজগুলো যথাযথভাবে করতে পারেন কি না। তিনি বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের আমলে অপহৃত বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রায় সবটুকুই তিনি ফিরিয়ে আনবেন। সেটা কি সম্ভব?

শেষ জয়ও মাহাথির মোহাম্মদেরই। মালয়েশিয়ার সুলতানের প্রাসাদ তাঁকে বিমুখ করেনি। টাইম পত্রিকার এক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক লিখেছেন, ‘অবশেষে তাঁর শপথ নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা শুরু। শপথ শেষে মধ্যরাতে সংবাদ সম্মেলনে এসে সরস মেজাজে কথা বলেছেন মাহাথির। সাংবাদিকদের উদ্দেশে ঠাট্টা করে বলেন, ‘ভুলে যাবেন না কিন্তু, আমি একজন স্বৈরশাসক।’ বাকি কথাগুলো এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে সংস্কার এবং তা দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা, মালয়েশিয়ার পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনা ইত্যাদি।

সত্যি, দেশটি নাকি ‘২৫৩ বিলিয়ন ডলার দেনায় ডুবে আছে’। এমনই শাসন মাহাথির-পরবর্তী ক্ষমতাসীনদের। আগেই বলেছি, এটাই প্রধান কারণ, যে জন্য জনগণ বৃদ্ধ মাহাথির মোহাম্মদকে ফের ভোট দিয়েছে দেশের উন্নয়ন, তাদের ব্যক্তিজীবনে উন্নতির প্রত্যাশায়। এখন দেখার বিষয়, মাহাথির কতটা কী করতে পারেন।

বাংলাদেশের রাজনীতি কি এ ঘটনা থেকে কিছু শিক্ষা নিতে পারে—এমন প্রাসঙ্গিক কথা বা প্রশ্নও উঠে এসেছে সংবাদপত্রের লেখালেখিতে। কী সেই শিক্ষা? ক্ষমতার অপব্যবহারের পরিণাম নাকি জনগণের মেজাজ-মর্জির বৈশ্বিক সত্য, যা রাজনৈতিক সত্যরূপে সর্বত্র দেখা দেয়?

যা হোক, আমরা অপেক্ষা করব দেখে নিতে, মাহাথির তাঁর পুরনো জাদু প্রতিশ্রুত নতুন নিরিখে কতটা বাস্তবে পরিণত করতে পারেন বা আদৌ করেন কি না। তাতেই বোঝা যাবে এ বয়সে ফের তাঁর রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের রহস্য। ব্যক্তিস্বার্থ না সদিচ্ছা—কোনটা অন্তর্নিহিত কারণ রাজনীতিতে ফিরে আসার। (কালের কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত)

লেখক : কবি, গবেষক, ভাষাসংগ্রামী

এই বিভাগের আরো সংবাদ