আজকের শিরোনাম :

নিরাপদ পৃথিবীর জন্য নিরাপদ ওজোন স্তর

  ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি

১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:৫৬ | অনলাইন সংস্করণ

মহাবিশ্বের বৈচিত্র্যময় গ্রহ এ পৃথিবী। এর গঠন, বিকাশ, অবস্থিতি সবকিছুই বৈচিত্রে ভরা। এ বৈচিত্রের অংশ হলো আলো, বাতাস, পানি, মাটি, উদ্ভিদ, প্রাণি–আরও কতো কী। নান্দনিক প্রাণ প্রবাহের বৈচিত্রপূর্ণ আবেশ–পরিবেশ–প্রতিবেশ। শীত, গরম, বর্ষা, আলো আধারি, প্রাণের সংলাপ, বিলাপ, বিলাস সব কিছুই পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করেছে। বহুমাত্রিকতা দান করেছে। পানি, সবুজ ও প্রাণকে ঘিরে পৃথিবী পরিপূর্ণ হয়েছে। আর পৃথিবীকে আশ্রয় করে প্রাণের অনুপম বিকাশ ঘটেছে। প্রাণের স্পন্দনই পৃথিবীকে রসময়, গন্ধময়, বর্ণময়, সুশ্রী, রুপশ্রী করেছে। পৃথিবী ও প্রাণের মাঝে অবিচ্ছিন্ন মায়াবি বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে এভাবেই। এটি ছান্দিক, এটি নান্দনিক, এটি নিবিড়, অবিচ্ছিন্ন।

আমাদের প্রাণের পৃথিবীকে ঘিরে যে বিশাল বায়ুমন্ডল–তা প্রধান চারভাগে বিভক্ত। ১। ট্রপোস্ফেয়ার, ২। ষ্ট্রেটোস্ফেয়ার, ৩। মেসোস্ফেয়ার এবং ৪। থার্মোস্ফেয়ার। আমাদের বাস করা পৃথিবী থেকে ঊর্ধাকাশের প্রায় এগার থেকে পনের কিলোমিটার বিস্তৃত পৃথিবী বেষ্টিত অঞ্চল হলো ট্রপোস্ফেয়ার অঞ্চল। এ অঞ্চল পৃথিবীর প্রায় সব প্রাকৃতিক ঘটনা, রটনা , বিপর্যয়, বিভ্রাট, স্থিরতা, অস্থিরতা প্রভৃতির সাথে যুক্ত। মেঘ বৃষ্টির খেলা– মেলা, বাষ্প– বিদ্যুৎ, ঝড়–ঝঞ্ঝা, সিডর–সাইক্লোন প্রভৃতির দোলাচলা সব কিছুকে প্ররোচিত ও প্রভাবিত করে এ অঞ্চল। বিভিন্ন গ্যাস কণা, বালু কণা, কঠিন বস্তুকণা, জলকণা, মেঘকণা, মেঘ শিলা কুয়াশা প্রভৃতি বিচ্ছিন্ন কণা, অণু, পরমাণু এ অঞ্চলে পরিপূর্ণ থাকে।

ট্রপোস্ফেয়ারের উপর থেকে পৃথিবীর চারিদিকে ঘিরে রাখা অঞ্চলের নাম ষ্ট্রেটোস্ফেয়ার। এর বিস্তৃতি ট্রপোস্ফেয়ারের উপরে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার। এ অঞ্চল ঘিরে পৃথিবীকে বেষ্টন করে যে ঘন নীল স্তর, এটিই পৃথিবীর প্রাণের সুরক্ষা ঢাল–ওজোন স্তর। ওজোন স্তর সূর্যালোর অত্যন্ত ক্ষতিকর রশ্মিসমূহকে শোষণ করে পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয়। পৃথিবীর প্রাণসমূহকে সুরক্ষিত করে।

বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো গত শতাব্দির শেষ দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝাতে সক্ষম হন যে, ওজোন স্তর সংকুচিত হচ্ছে, এর যথাযথ সুরক্ষা দরকার। এ লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে ভিয়েনা কনভেনশনে অগ্রসর ২৮ টি দেশ এক ঐতিহাসিক শিষ্টাচার বিধিতে স্বাক্ষর করে। যা ১৯৮৭ সালে প্রখ্যাত মন্ট্রিল প্রটোকলে মুখ্য বিষয় হিসেবে আলোচনায় স্থান পায়। এভাবেই ওজোন ক্রমাগতভাবে আলোচনায় আসতে থাকে। ওজোন ক্ষয়কারী বস্তুকে চিহ্নিত করা হয়। এদের উৎপাদন ও ব্যবহার সীমিত করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত এবং সময়সীমা নির্দিষ্ট করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সংরক্ষণ দিবসের মর্যাদা দান করে। ১৯৯৫ সালে দিবসটি প্রথমবারের মতো পালন করা হয়। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে ২ ফেব্রুয়ারি এ প্রটোকলে স্বাক্ষর করে। বিভিন্ন সময়ে এটির বিভিন্ন সংশোধনীও মেনে নেয় অর্থাৎ প্রটোকলের লন্ডন, কোপেনহেগেন, মন্ট্রিল, ও বেইজিং সংশোধনী সমূহ যথাক্রমে ১৯৯৪, ২০০০, ২০০১ ও ২০১০ সালে অনুমোদন করে। দেশে ১৯৯৬ সালেই ওজোন সেল গঠন করা হয়েছে। প্রটোকলের শর্ত অনুযায়ী সিএফসি এর পর্যায় ক্রমিক নিয়ন্ত্রন ১৯৯৯ সাল থেকেই শুরু হয়েছে। সরকারের হিসাব মতে ২০১০ সাল থেকেই সিএফসি শূন্যের কোটায়। পৃথিবীর ১৯৭টি দেশ এ প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে। তারা এর আইনগত কাঠামোকে স্বীকৃতি দিয়ে ওজোন ক্ষয়কারী বস্তুর উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার প্রভৃতি বর্জনের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। এ বিবেচনায় মন্ট্রিল প্রটোকলকে পরিবেশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল আন্তর্জাতিক একটি চুক্তির সম্মান দেয়া হয়। অন্যদিকে প্রায়ই উন্নত এবং উন্নয়নশীল পার্টি দেশ (সিএমপি) সমূহের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (সিওপি সম্মেলন) কার্বন ও গ্রীণ হাউস বিভিন্ন গ্যাসসমূহের নির্গমন নিয়ন্ত্রন নিয়ে মতের অনৈক্য স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় । তাই ওজোন বিষয়ক অগ্রগতি মানুষের মাঝে আশার সঞ্চার করে হতাশার জন্ম দেয়।

মন্ট্রিল প্রটোকলের মাল্টিলেটারেল ফান্ডের আওতায় দেশে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলমান। ইতিমধ্যেই ওষুধ শিল্পে মিটারড ডোজ ইনহেলার প্রস্তুতিতে সিএফসি সম্পূর্ণরূপে ফেজ আউট করা হয়েছে। এভাবে সিএফসি–১১ এবং সিএফসি–১২ ফেজ আউট হচ্ছে। ফোম সেক্টর হতে এইচসিএফসি–১৪১বি ফেজ আউট হয়েছে। বিভিন্ন পেশার লোকজনদের প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।

বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত থেকে মনে করা হয় যে, যদি মন্ট্রিলপ্রটোকল এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট চুক্তি বা বিধিবিধান অনুসৃত না হতো, তবে ২০৫০ সাল নাগাদ ওজোনের স্তর সে সময়ের তুলনায় দশগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হতো। শুধু তাই নয়, চর্মরোগী এবং ত্বক ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব এতোবৃদ্ধি পেতো যে, তা মহামারী আকার ধারন করতো। এছাড়াও ওজোন ক্ষয়কারী গ্যাসের মধ্যে যেগুলো শক্তিশালী গ্রীণ হাউস গ্যাস, স্বল্প মাত্রায় হলেও সেগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়ে বৈষ্ণিক উষ্ণায়ণ নিয়ন্ত্রনে কাজ করছে। এটিই আশার কথা।

কিন্তু দুর্ভাবনার কথা হলো, পৃথিবীতে মানুষ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিড়ম্বনাও থেমে নেই। বিভিন্ন প্রকার ঈঋঈ কে এখনো অ্যারোসল সামগ্রীতে এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম ধোয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। ক্যান্সার থ্যারাপিতে, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত এবং হিমায়িত করতে, ধূঁয়া সৃষ্টিতে, তামাক সামগ্রীতে, ওষুধ প্রস্তুতে এবং কৃষির সায়নে CFC প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। UNDP, UNEP, UNIDO বিশ্ব ব্যাংক প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থার সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা থাকা সত্বেও উন্নয়নশীল ও উন্নত অনেক দেশেই শিল্পসামগ্রী এবং বিভিন্ন ম্যানুফেক্চারিং এ CFC, হ্যালোন, HCFC প্রভৃতি ব্যবহার হয়। এয়ার কোলার, রিফ্রিজারেটর, ফটোকপিয়ার প্রভৃতিতে ওজোন ক্ষয়কারী গ্যাসের ব্যবহার অত্যন্ত বেশি। এজন্য এটিও হিসেব করা হয় যে, ২০৭৫ সাল নাগাদ পৃথিবীতে শুধু ত্বকের ক্যান্সার বিড়ম্বনা নিয়ে জন্ম নেবে প্রায় ষাট মিলিয়ন মানুষ। সুতরাং আমাদের আরও অধিক সতর্ক পথ অবলম্বন করা দরকার।

এ পৃথিবী আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র আবাস স্থল। একে ধারন করে, এর আলো বাতাস, পানি মাটি প্রতিটি অমূল্য অংশকে ব্যবহার করে আমরা বেঁচে থাকি, স্বপ্ন দেখি, জীবনের চর্চা করি।

আমাদের বেঁচে থাকা, জীবনচর্চা করা পৃথিবীর নিবিড় সুস্থতার উপর সর্বাংশে নির্ভরশীল। এ বোধ ও জাগরন আমাদের মাঝে আরও তীব্র এবং তীক্ষ্ণ হওয়া প্রয়োজন। Keep Cool And Carry On! The Montreal Protocol– এ বছরের প্রতিপাদ্য এ প্রত্যয়কে আমরাও তীব্র ভাবে ধারন করি, জীবনের জন্য, অস্তিত্বের জন্য। এ বোধ যতোই তীব্র হবে, পৃথিবীর প্রতি আমাদের দায়বোধও তাড়না ততোই অর্থবহ হবে। আসুন, বিশ্ব ওজোন দিবসে ওজোন স্তরকে সুরক্ষিত করার দৃঢ প্রত্যয়ের মধ্য দিয়ে পরিবেশ ও নিজেদের অস্তিত্বকে নিরাপদ করি। নিরাপদ পৃথিবীই শুধু অনন্ত আশা, ভরসা আর নিরঙ্কুশ ভালোবাসার আধার হতে পারে। (দৈনিক আজাদী থেকে নেয়া)

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, পরিবেশ কর্মী

এই বিভাগের আরো সংবাদ