এই ঈদে আসুন ঘরেই থাকি

  আ ব ম ফারুক

১৪ মে ২০২১, ০৮:৫৮ | অনলাইন সংস্করণ

ঈদ এসেছে। দেশজুড়ে করোনার সংক্রমণও অনেক বেড়ে এখন কিছুটা থমকে আছে। লকডাউন পুরোপুরি সফল না হলেও যতটুকু হয়েছে তার কিছুটা সুফল পাওয়ার কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় এখন কিছুটা কম। অথচ এই লকডাউন যদি সফল করা যেত, তাহলে আমরা এই হারগুলো অনেক কম দেখতে পেতাম। অনেক দেশেই এই সফলতার উদাহরণ রয়েছে। দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকার পর তাদের দেশে এখন মার্কেট, রেস্টুুরেন্ট, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সবই খুলছে; কিন্তু শর্ত সাপেক্ষে এবং স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে। নইলে তারা জানে যে এই শর্ত ও বিধিগুলো না মানলে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার আবার বেড়ে যাবে এবং আবার লকডাউনের প্রয়োজন হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব মনিটরিংয়ের উপাত্ত মতে, আমাদের পাশের দেশ ভুটানে করোনার প্রথম রোগী ধরা পড়ে আমাদের দেশের মতোই গত বছরের মার্চ মাসে। ৬ তারিখে। আমাদেরটা ছিল ৮ তারিখে। ল্যাব পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে তাকে খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া শুরু করে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। কিন্তু এই ছয় ঘণ্টার মধ্যে সে কার কার সঙ্গে মিশেছিল, তা গোয়েন্দাদের মতো ট্রেকিং করে বের করে তাদেরও, যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০০, কোয়ারেন্টিন করে ফেলা হয়। তারপর হয় তাদের করোনা টেস্ট। এরপর চিকিৎসা। করোনাকে রুখতে আসুন না আমরা ভুটানের মতো হই।

আমাদের দেশে বিদেশ থেকে যারাই আসে, তাদের অনেকেই নিজেদের ছোটখাটো স্বাধীন রাজা বলেই বোধ হয় ভাবে। যে কারণে তারা কোনো স্বাস্থ্যবিধিরই তোয়াক্কা করে না। তারা সরকারি কোয়ারেন্টিনে থাকতে রাজি হয় না। তাদের সরকার নিজেদের বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে থাকতে বললে তারা অঙ্গীকার করে এবং পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে উপরোক্ত কাজগুলো করে। বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে, আজকের পৃথিবীতে ২১ এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত করোনার খুব সাংঘাতিক ১২টি ভেরিয়েন্ট দাপটের সঙ্গে তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। অসমর্থিত সূত্র মতে, এর মধ্যে বাংলাদেশে নাকি ১১টিরই অস্তিত্ব আছে। এগুলো হলো ইউকে বা কেন্ট, সাউথ আফ্রিকান, ব্রাজিলিয়ান বা আমাজন, রাশিয়ান, সৌদি অ্যারাবিয়ান, নিউ ইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, মালয়েশিয়ান, নাইজেরিয়ান, ইন্ডিয়ান ডাবল মিউটেন্ট এবং ইন্ডিয়ান ট্রিপল মিউটেন্ট ভেরিয়েন্টগুলো। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে প্রথম দুটির। সম্প্রতি ভারতীয় মিউটেন্টও পাওয়া গেছে ভারত থেকে আসা বেশ কিছু যাত্রীর শরীরে। যদিও করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট জোগাড় করেই তারা এসেছে, তবে সেগুলো ছিল ফলস। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার পালিয়েও যায়। পুলিশ তাদের আবার ধরে আনে। কিন্তু পালিয়ে যাওয়া ও ধরে আনার মধ্যের সময়কালে তারা কতজনের সংস্পর্শে এসেছে তা চিহ্নিত করা, অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যের নিয়মে ট্রেকিং করা, তা করা হয়নি বা যায়নি। ভুটানের সঙ্গে আমাদের এটাও একটা পার্থক্য।

এই এত ভেরিয়েন্ট বাংলাদেশে এসেছে এবং ছড়িয়েছে বিদেশ থেকে আসা মানুষের মধ্যে যারা কোয়ারেন্টিন ও স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানেনি প্রধানত তাদের মাধ্যমে। তারপর কিছু লোকের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়ার পর এই ভেরিয়েন্টগুলোর সংক্রমণ ছড়িয়েছে ঝড়ের বেগে দেশে থাকা লোকদের দায়িত্বহীন চলাফেরা, মাস্ক না পরা, ভিড়ের মধ্যে যাওয়া, টিকা নিতে অনীহা বা অপপ্রচারে বিশ্বাস করা ইত্যাদি কারণে। এরা এতটা অসচেতন ও অবিবেচক কিভাবে হলো তা ভাবতে অবাক লাগে।

এই নতুন ভেরিয়েন্টগুলো মূল করোনাভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি সংক্রামক এবং অনেক দ্রুত ফুসফুস নষ্ট করে ফেলে। আরো মুশকিল হলো, এগুলো শরীরের নিজস্ব কিংবা টিকা নেওয়ার কারণে অর্জিত ইমিউনিটিকে অনেকাংশে পরাজিত করে তার ধ্বংসকাজ চালিয়ে যায় বলে মূল ভাইরাসের চেয়ে মৃত্যুর হারও অনেক বেশি। তবে টিকা নেওয়ার সুবিধা হলো, এতে ভেরিয়েন্ট কিছুটা বাধা পায় বলে টিকাবিহীন লোকদের চেয়ে ধ্বংস ও মৃত্যু তুলনামূলকভাবে কিছুটা কমে।

আজকে যারা ঈদের বাজারে শপিং মলে ভিড় করছে, তাদের আরো কয়েকটি তথ্য জানাতে চাই। একজন করোনা সংক্রমিত মানুষ স্বাস্থ্যবিধিগুলো না মেনে, মাস্ক না পরে ভিড়ের মধ্যে গেলে এক দিনে গড়ে ১৫২ জন সংক্রমিত করতে পারে। ভাবুন একবার। এই ১৫২ জনের প্রত্যেকে যদি আবার আরো ১৫২ জনকে ছড়াতে পারে এবং যদি এই গতিতে ছড়াতে থাকে, তাহলে দেশে দাবানলের মতো করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে মাত্র কয়েক দিনের সময়ই যথেষ্ট।

আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হলো, করোনা আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ থাকে লক্ষণহীন, অর্থাৎ তারা বা তার পরিবার-আত্মীয়-বন্ধুরা জানেই না যে সে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। সংক্রমণ ছড়াতে এরা ভূমিকা রাখে বেশি।

কেউ কেউ বলেন, করোনা হলেও তরুণ বয়সের কারণে তাদের তেমন মারাত্মক সমস্যা হবে না কিংবা তারা মারা যাওয়ার ঝুঁকি কম। কথাটা সত্য হতেও পারে। কিন্তু বয়স্ক যারা মারা যাচ্ছে তারা তো এই তরুণদেরই মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানি বা মুরব্বি-নিকটজন। কোনো তরুণ-তরুণী যদি মনে করে, করোনা হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তারা সেরে উঠবে, তাহলে তাদের বলছি ‘লং কভিড’ নামক অসুখের কথা। তরুণরা বেশির ভাগই হয়তো সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেলে বেঁচে যাবে ঠিকই; কিন্তু সারাটা জীবন তাদের বয়ে বেড়াতে হবে শারীরিক ও মানসিক নানা ধরনের জটিল সমস্যা। তাদের শ্বসনতন্ত্র, রক্ত সংবহনতন্ত্র, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, মেধা, মনোজগত, ঘুমের স্বাভাবিকতা, পরিশ্রমের ক্ষমতা, প্রজননতন্ত্র, যৌনতাসহ সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই লং কভিড এখন বিজ্ঞানীদের মহাচিন্তিত করে তুলেছে।

কভিড একবার হলে আর হবে না এটাও সত্যি নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, কারো শরীরে অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব কম হলেই তিনি আবার করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন।

কভিডের চিকিৎসা যদিও এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়, তবুও বেশ কিছু ওষুধ এখন ব্যবহার করে কিছু ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে, যদিও এগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যারা করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি নিচ্ছে তারা কি এর চিকিৎসার খরচের ও অসুখকালীন তীব্র কষ্টের বিষয়টা মাথায় রেখেছে? তাই সংক্রমিত না হওয়ার চেষ্টাই হচ্ছে সবচেয়ে জরুরি।

এই ঈদের সময়ে মানুষ যেভাবে গাদাগাদি ভিড় করে কেনাকাটা করছে, যেভাবে ফেরিগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে এবং জনতা যেভাবে মাস্কবিহীন হচ্ছে, তাতে আশঙ্কা হয় যে ঈদের কয়েক দিন পরেই আমাদের দেশে হয়তো আবার করোনার অতি ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটবে। কিংবা হয়তো এবারের সংক্রমণ হবে আগেরটার চেয়েও বেশি।

এ কথার সমর্থন পাওয়া যায় ভারতে মাত্র কিছুদিন আগে হোলি উৎসব, পুণ্যস্নান, নির্বাচনী মিছিল-সমাবেশ ইত্যাদির পর সেখানে এযাবৎকালের সবচেয়ে ভয়াবহ সংক্রমণ ও মৃত্যুর মিছিল দেখে। আমরা কি ভারতের মতো দুর্দশায় পড়তে চাই? কী হয়, আমরা যদি একটা ঈদে নতুন জামা-পাঞ্জাবি-শাড়ি না কিনি বা বাড়ি না যাই? এই ক্ষণিক আনন্দের চেয়ে বেঁচে থাকা কি অনেক বেশি আনন্দের ও প্রয়োজনীয় নয়?

লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: দৈনিক কালের কণ্ঠ

এই বিভাগের আরো সংবাদ