আজকের শিরোনাম :

আধুনিক বাংলাদেশের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা এ এস এইচ কে সাদেক

  দেবাশীষ আইচ

০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৪:২৮ | আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:৫৭ | অনলাইন সংস্করণ

কপোতাক্ষ বিধৌত কেশবপুরের মাটিকে, কেশবপুরকে সমগ্র বিশ্ব দরবারে ঊনবিংশ শতাব্দিতে উপস্থাপন করেছিলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। পৃথিবীর মাঝে কেশবপুরকে পরিচিত করেছিলেন তিনি। আর সেই কেশবপুরকে আধুনিক পৃথিবীর কাছে, এই একবিংশ শতাব্দির পৃথিবীর কাছে কেশবপুরের নামটি, কেশবপুরের মানুষকে; সর্বোপরি বাংলাদেশকে পরিচিত করেছিলেন এ এস এইচ কে সাদেক মহোদয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত করেছিলেন সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। আর এ এস এইচ কে সাদেক মহোদয় করেছেন বাংলা ভাষাকে বিশ্ব দরবারে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। আমরা ভুলতে পারি না এ এস এইচ কে সাদেক মহোদয়কে।

আজ এমন এক সময়ে আমরা তাঁকে স্মরণ করছি, যখন সমগ্র বাংলাদেশে আলোকিত মানুষের বড় অভাব। সততা, নিষ্ঠা এবং সেবাপরায়ণতার মানুষিকতা যখন সমাজ ও রাজনীতি থেকে নির্বাসিত।

১৯৩৪ সালের ৩০ এপ্রিল যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার বড়েঙ্গা গ্রামে যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছিল সেই এ এস এইচ কে সাদেক মহোদয় ১৯৯৮ সালে সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে সফল হয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিতে পেরেছিলেন। যার ফলস্রুতিতে ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার সাদেক সাহেবকে মরণোত্তর একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করেন।

মানুষ রাজনীতি করে এক একটি উদ্দেশ্য নিয়ে। তবে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যারা রাজনীতি করতে আসেন তাদের সংখ্যা নিতান্তই নগন্য। আমাদের প্রয়াত শিক্ষামন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছিলেন এই কেশবপুরের অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্রপীড়িত এবং জলাবদ্ধতার কারণে মানবেতর জীবন-যাপনকারী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য, এই কেশবপুরের অনুন্নোত জনপদকে সমৃদ্ধশালী জনপদে পরিণত করার জন্য। কেশবপুরে শৈশকালে তিনি দেখেছেন এখানকার মানুষ কি মানবেতর জীবন-যাপন করে। এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা কতটা অনুন্নোত। মানুষের জীবন-যাত্রার মান কতটা নিম্নমানের। হয়ত, তখনই উপলব্ধি করতেন কিভাবে এ মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়ানো যায়।

এরপর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি দেশের বাইরে থেকেছেন। উচ্চশিক্ষা লাভের পর সি.এস.পি পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেন। সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল যায়গায় থেকে অত্যন্ত দক্ষতা এবং সততার সাথে সেই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে সাদেক সাহেব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতির মুখ্যসচিব ছিলেন। তিনি ১৯৭৮ সালে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ১৯৮২ সালে তিনি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। ১৯৮৩-৮৫ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। চাকুরির সুবাদে তিনি কথনও দেশে বা দেশের বাইরে থেকেছেন।

তিনি যেখানেই থেকেছেন না কেন, এই কেশবপুরের মাটি ও মানুষকে কখনও ভোলেন নি। তাইতো তিনি কর্মজীবন শেষ করে যখন তাঁর অবসর জীবনটা আরাম আয়াশে কাটানোর কথা ছিল; তিনি সেটা না করে এই কেশবপুরবাসীর পাঁশে এসে দাঁড়ানোর জন্য এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ১৯৯২ সালে সক্রিয়ভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তখন থেকেই তিনি কেশবপুরে আসতেন, এখনকার দলীয় নেতাকর্মী এবং আপামর জনসাধারনের খোঁজ খবর নিতেন, তাদের সমস্যার কথা শুনতেন।

১৯৯৬ সালে তিনি যখন এ আসন থেকে নির্বাচন করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তখন ছিল এক প্রতিকূল পরিবেশ। ১৯৯৬ সালের পূর্বে এই কেশবপুর থেকে নৌকা প্রতিক নিয়ে কোনো প্রার্থী জয়লাভ করতে পারেন নি। এমনকি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনেও এই আসনটি হারাতে হয়েছিল। তেমনি এক বৈরী পরিবেশে যেখানে আওয়ামী লীগ ছিল সাংগঠনিকভাবে দুর্বল সেখানে তিনি তার মেধা, মনন এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে সকলকে একসাথে নিয়ে কাজ করেছিলেন এবং জয়লাভ করেছিলেন। এই কেশবপুরকে তিনি আওয়ামী লীগের মাতৃভূমিতে পরিণত করেছিলেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পুরষ্কৃত করতে ভোলেন নি। ১৯৯৬ সালে ২৩ জুন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সাদেক সাহেব মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক এবং গণশিক্ষা বিভাগ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তিনি প্রথমে ভবদহের জলাবদ্ধতার অনেকটা সমাধান করেছিলেন। কপোতাক্ষ নদের সংস্কারের কাজ শুরু করেছিলেন।

সাগরদাঁড়িতে মধুপল্লি, পর্যটনকেন্দ্র এবং আবু শারাফ সাদেক কারিগরি ও বাণিজ্য মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কেশবপুরে শিশু একাডেমি ও পাইলট স্কুলে সাদেক অডিটোরিয়াম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১২টি জেলায় যেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না, সেখানে তিনি ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপকার ছিলেন। তারমধ্যে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একটি। ২০০১ সালে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী, প্রগতিশীল, বিচক্ষন, কুসংস্কারমুক্ত এবং সর্বোপরি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন মানুষ। তিনি ছিলেন বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী। সাহিত্যচর্চা তাকে বেশ আকর্ষণ করত। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর একটিা বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তিনি ভাল কবিতা আবৃত্তি করতেন। তিনি কবিগুরুর সেই পরিচিত কবিতা আবৃত্তি করতেন-
তোরা যে যা বলিস ভাই,
আমার সোনার হরিণ চাই।

তিনি ভাল ফুটবল খেলতেন। তিনি তাঁর স্কুলের ফুটবল দলের প্রথমসারির একজন খেলোয়াড় ছিলেন। আমরা যে স্বপ্ন দেখি, কেশবপুরবাসী যে স্বপ্ন দেখে, সেটি আমাদের স্বপ্ন নয়; প্রয়াত শিক্ষামন্ত্রী দেখানো স্বপ্ন। তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সমগ্র বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে এই কেশবপুর থেকে।

তিনি যখন উন্নয়নের সেই অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই আামাদের সকলের আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে ২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। আমরা আশাহত হলেও সান্ত্বনা খুঁজি এই ভেবে তিনি এই কিশবপুরের মানুষকে ভালোবাসতেন বলেই হয়তো জীবনের শেষ দিনটি এই কেশবপুরে কাটিয়েছিলেন। প্রয়াত মহান এই স্বপ্নদ্রষ্টার ১১তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সাবেক উপ-গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

এই বিভাগের আরো সংবাদ