আজকের শিরোনাম :

ধর্ম ও দেশত্যাগের ট্র্যাজেডি

  কুলদীপ নায়ার

১৬ এপ্রিল ২০২১, ১৮:৫২ | অনলাইন সংস্করণ

দেশভাগের ট্র্যাজেডি অত্যন্ত গভীর। এটাকে হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নে পর্যবসিত করা হলে সমস্যাটির গায়ে আসলে রাজনৈতিক রং চড়ানো হয়। দেশভাগের সময় দাঙ্গায় লাখ দশেক মানুষ মারা যায়, প্রায় দুই কোটি হিন্দু, মুসলমান ও শিখ বাস্তুচ্যুত হয়। পাকিস্তানের কিছু পক্ষপাতদুষ্ট গোষ্ঠী এর মধ্যে ‘মুসলিম নিপীড়ন’কেই প্রধান করে দেখাতে চায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এর ফলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘৃণার মনোভাব সৃষ্টি হয়। হিন্দুরা পাকিস্তানে সংখ্যালঘু, ঠিক যেমন ভারতে মুসলমানেরা।

নির্মম হত্যাযজ্ঞ সত্ত্বেও সে সময় মানবিক সাহসিকতার নজিরও স্থাপন করেছেন অনেকে। অনেক হিন্দু মুসলমানদের বাঁচিয়েছেন, অনেক মুসলমান বাঁচিয়েছেন হিন্দুদের। ভারতের বুদ্ধিজীবী আশিষ নন্দীর মতে, হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষেরাই আর্তের জীবন রক্ষা করেছেন। কোনো হিন্দু আগ্রাসী মুসলমানদের সামনে পড়লে অন্য মুসলমানেরা তাঁকে বাঁচিয়েছেন, আবার এর উল্টোটাও ঘটেছে। এভাবে সহিংসতার মুখোমুখি হওয়া মানুষদের মধ্যে প্রায় ৫০ ভাগ মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে।

ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে দেশভাগের সমার্থক, এর বয়স ৬৭ বছর হলো। ১৪ আগস্ট আমি নিজে আমার শিয়ালকোটের বাড়ি ছেড়েছি। কারণ, পাকিস্তান রাষ্ট্র চায়নি তার ভূখণ্ডে হিন্দুরা থাকুক, ঠিক যেমন পূর্ব পাঞ্জাবও চায়নি সেখানে মুসলমানেরা থাকুক। আমি শিয়ালকোটের বাড়িতে বসে জওহরলাল নেহরুর বিখ্যাত ‘মিলন’ বক্তৃতা শুনেছি। এসবে কোনো কাজ হয়নি, আকাশ-বাতাসে তখন বাজছিল বিভেদের সুর।

স্বাধীনতার ৩২ দিন পর ১৭ সেপ্টেম্বর আমি সীমান্ত অতিক্রম করি। সে সময়ের মধ্যে খুন ও লুটপাট অনেকটাই কমে এসেছিল। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে কোনো ঝগড়া-বিবাদ বা যুদ্ধ আমি দেখিনি। কিন্তু মাথায় পোঁটলা নিয়ে ভীত-আতঙ্কিত চেহারার লাখো নর-নারী দেশ ত্যাগ করছেন আর সেই মানুষদের সন্ত্রস্ত সন্তানেরা তাঁদের অনুসরণ করছে, এ দৃশ্য আমি দেখেছি। যাঁরা দেশ ত্যাগ করেছেন, তাঁরা আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু, বাড়িঘর—সবই হারিয়েছেন। তাঁরা ইতিহাসের জাঁতাকলে পড়ে পিষ্ট হয়েছেন, অগ্নিগর্ভ সময়ের লেলিহান শিখায় তাঁদের সব পুড়েছে। হিন্দু-মুসলমান উভয়েই শরণার্থী জীবন যাপন করেছে।

এই মানুষগুলো একসঙ্গে শতাব্দীর পর শতাব্দী থাকার পরও কেন একে অপরকে খুন করেছে? এই দেশভাগের জন্য দায়ী কে, সেটা খুঁজতে গেলে গলদঘর্ম হতে হয়। তারপর ছয় দশক পেরিয়ে গেছে, এখন এ নিয়ে গবেষণা করা অ্যাকাডেমিক পাঠের পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে ১৯৪০-এর দশকে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়, তাতে দেশভাগের মতো কিছু ঘটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ক্রমাগত বলেছেন, হিন্দু ও মুসলমান পৃথক জাতিসত্তা। এতে এই বিভাজন আরও বেড়ে যায়।
দেশভাগ ছিল অনেকটা গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো। সবাই জানত, কী হচ্ছে। তার পরও এটা বন্ধ করার জন্য কেউই কিছুই করতে পারেনি। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এত কলুষিত ছিল যে হানাহানি ও অভিবাসন ঠেকানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তৃতা ও মহাত্মা গান্ধীর প্রচেষ্টাও সংকীর্ণতার আবহ দূর করতে পারেনি—পাকিস্তানের জন্মের ন্যায্যতা বিধান করতে গিয়ে যা সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁরা বলার চেষ্টা করেছেন, আপনি হয় ভারতীয়, না-হয় পাকিস্তানি, আর রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এসব ধোপে টেকেনি।

দেশভাগের ফলে মুসলমানদের কোনো স্বার্থলাভ হয়েছে কি? আমি জানি না। পাকিস্তান সফরে গিয়ে আমি লোকদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুনেছি, ‘যাক, হিন্দুবিহীন একটা জায়গা পাওয়া গেল, এখন আমরা নিরাপদ। হিন্দু শাসন ও আগ্রাসন থেকে মুক্তি পাওয়া গেল’ ইত্যাদি। মুসলমানেরা এখন তিনটি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে—পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ। চিন্তা করুন, একীভূত কোনো দেশে থাকলে তারা কত বড় শক্তি হতে পারত! তাদের ভোটের কত শক্তি হতো! মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই হতো তারা।

দেশভাগের পর সীমান্তে উত্তেজনা কমলেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার দূরত্ব আরও বেড়েছে। ইতিহাসের জের এখনো আমরা টেনে নিয়ে যাচ্ছি। পারস্পরিক দোষারোপ বাদ দিয়ে এই সাম্প্রদায়িকতার কুপ্রভাব মোকাবিলার উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

ওয়াঘা-অমৃতসর সীমান্ত থেকে ভগ্নহৃদয় নিয়ে আমি ফিরে এসেছি। না, সেখানকার সেনারা সূর্যাস্তের কুচকাওয়াজে এখনো যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে অংশ নেয় সে কারণে নয়; সেখানে নতুন এক দানবের জন্ম হয়েছে, সে কারণে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কিছু তথ্য প্রদর্শন করছে সেখানে: হিন্দু ও শিখেরা মুসলমানদের কীভাবে হত্যা করেছে এবং তাদের বাড়িঘর লুট করেছে। এই বোর্ড এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে তা শুধু সীমান্তের ভারতীয় অংশ থেকেই দেখা যায়। পাকিস্তান প্রান্ত থেকে সেটা দেখা যায় না, সে প্রান্ত থেকে এটাকে শুধু একটি বড় আকারের বিলবোর্ড বলেই মনে হয়।

ওই বোর্ডে যেসব ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো আক্রমণাত্মক, উদ্দেশ্যের দিক থেকেও সেটা কলুষিত। গত দুই মাসে এসব করা হয়েছে। সম্ভবত ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার শান্তি আলোচনার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে বলেই বোর্ডটি বসানো হয়েছে। গত বছর ৫০ জন মানুষ এসে সীমান্তের জিরো পয়েন্টে মোমবাতি প্রজ্বালন করেছে; স্বাধীনতার ছয় দশকের মধ্যে সেবারই তা প্রথম ঘটেছে, এটাও একটা কারণ হতে পারে।

আবার এতে কিছু তথ্যবিকৃতিও ঘটানো হয়েছে। যেসব তথ্য প্রদর্শন করা হয়েছে, সেগুলো উভয় পক্ষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখরা হত্যার শিকার হয়েছে আর ভারতে মুসলমানেরা। ভারতের মতো নবসৃষ্ট পাকিস্তানেও একই রকম নৃশংসতা ঘটেছে, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল নারী ও শিশুরা।

বিশ্বাসের নামে উভয় ধর্মের লোকদেরই আমি খুনোখুনি করতে দেখেছি। তারা হর হর মাধব ও ইয়া আলী বলে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তরবারি দিয়ে হাজার বছরের প্রতিবেশীর বুক ঝাঁঝরা করেছে।

লেখক: ভারতের প্রয়াত সাংবাদিক।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

সৌজন্যে: দৈনিক প্রথম আলো।

এই বিভাগের আরো সংবাদ