আজকের শিরোনাম :

করোনা রোগী ব্যবস্থাপনায় করণীয়

  ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ

১২ এপ্রিল ২০২১, ১২:৪০ | অনলাইন সংস্করণ

করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃত পদ্ধতিগুলো বিজ্ঞমহলের নিশ্চয়ই অজানা নয়। একদিকে যেমন সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন, অন্যদিকে তেমন রোগী শনাক্তকরণ ও তাদের সেবার ব্যবস্থা করা জরুরি। আর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ যে সবচেয়ে ভালো পন্থা তা তো সবারই জানা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কৌশলগুলো নিজস্ব আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চিহ্নিতকরণ এবং তার সফল প্রয়োগ জরুরি। সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে মাস্ক পরা এবং জনসমাগম এড়ানো। এই দুটি কাজ জনগণ ঠিকমতো পালন করলে সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর জনগণ ও প্রশাসন চাইলে এই দুটো কাজ সহজেই করা যায়। কিন্তু অন্যগুলো যেমন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সঙ্গ-নিরোধ, কোয়ারেন্টাইন ইত্যাদি বাংলাদেশের বাস্তবতায় কতটুকু করা সম্ভব তা নিশ্চয়ই আমরা ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছি।

মোটকথা, মাস্ক পরিধান করা ও জনসমাগম এড়ানোই আমাদের দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মূল মন্ত্র। আর এই দুটো কাজের জন্য দরকার ব্যাপক জনসমর্থন। এক বছরের বেশি সময় পার হলেও এই জনসমর্থন কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি তাও আমাদের অজানা নয়। তবে কার্যকরী কৌশল অবলম্বন করে জনসমর্থন অসম্ভব কিছু নয়। এর জন্য দরকার জনগণকে সম্পৃক্ত করা।

জনসমাগম এড়ানোর জন্যে অনেকগুলো বিকল্পের মধ্যে সবচেয়ে অ-জনপ্রিয় কৌশল হচ্ছে লকডাউন। আর বৈশাখী উৎসব, রোজা, ঈদ সামনে রেখে লকডাউনে যে মানুষের কোনো সমর্থন নেই তা গত এক সপ্তাহের ঢিলেঢালা লকডাউন থেকে তা আরও বেশি প্রমাণিত হয়। এ বিষয়ে নীতি নির্ধারণী মহল নিশ্চয়ই অবগত আছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা লকডাউন বিষয়ে যতই পরামর্শ দেন, আমাদের কিন্তু সার্বিক বিষয় বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পরিস্থিতির দায়ভার সবসময় প্রশাসনের উপর বর্তায়। তাই লকডাউন ছাড়া জনসমাগম এড়ানোর বিকল্প কৌশলের সার্থক প্রয়োগের উপর মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। ইনিশিয়েটিভ ফর হেলথ এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি) এর পক্ষ থেকে কিছু কৌশল প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলো হলো।

•    জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজকর্মী, এনজিওকর্মী, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সর্বত্র মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। প্রয়োজনে কঠোর পন্থা অবলম্বন করা। বাজার, বাস এবং রেল স্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনালসহ জনসমাগম বেশি হয় এমন জায়গার প্রবেশমুখে বিনামূল্যে মাস্ক সরবরাহ করা।

•    স্বাস্থ্যবিধি মানা, কোভিডের প্রকৃত ঝুঁকি বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিকরণে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেওয়া ও প্রয়োজনে হেলথ কমিউনিকেশন এক্সপার্টদের পরামর্শে কার্যকর কমিউনিকেশন মেটেরিয়াল তৈরিকরণ এবং তদনুযায়ী কার্যকরভাবে প্রচারণা চালানো।

•    কোভিড টিকা নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজতর করা এবং প্রয়োজনে অন-স্পট রেজিস্ট্রেশন চালু করা।

•    টিকা নিতে মানুষকে উৎসাহিত করার জন্য জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সমাজকর্মী, এনজিওকর্মী, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাপক প্রচারণা চালানো।

•    টিকার কার্যকারিতা নিয়ে জনমনে বিদ্যমান সংশয় দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

•    ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল বৃদ্ধি এবং উৎসাহিত করার জন্য বাস্তবতার নিরিখে প্রণোদনা প্যাকেজ যৌক্তিকভাবে সংশোধন করে তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

•    জিনোম সিকুয়েন্সিং ও সেরো প্রিভালেন্স স্টাডি রেগুলার করা যাতে প্রকৃত অবস্থা জানা যায়। বিশেষত, হাসপাতালের শয্যার কি অবস্থা তার রিয়েল-টাইম আপডেট ড্যাশ বোর্ডের মাধ্যমে প্রকাশ করা।

•    গবেষণা ও তথ্য শেয়ারিং জোরদার করা। কোন তথ্য কার কাছে পাওয়া যাবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করা।

•    প্রথম দফায় ৩১ মে, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়সহ সকল প্রকার জনসমাবেশ এবং জনসমাগম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধকরণ।

•    সারাদেশে পর্যটন কেন্দ্র এবং বিনোদন কেন্দ্র ৩১ মে, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বন্ধকরণ।

•    ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ সহ অধিক সংক্রমিত এলাকা থেকে ঈদ বা অন্য যেকোনো উৎসবের সময় এলাকা ত্যাগ করা নিষিদ্ধকরণ।

তবে সংক্রমণের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে করোনা রোগী ব্যবস্থাপনার উপরে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। বর্তমান সংক্রমণ যে অবস্থায় পৌঁছেছে তা কার্যকরী কারফিউ দিলেও আগামী এক মাসের মধ্যে সংক্রমণের গতি কমবে এমনটি ধারণা করা অমূলক।  হাসপাতালগুলোতে বেশি রোগী স্থান দেওয়ার সুযোগ নেই। এখনই কার্যকরী ব্যবস্থা না নিলে জাতিকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। মনে রাখতে হবে, আমরা যতই ক্ষমতাশালী হই বা সুরক্ষিত অট্টালিকায় বাস করি, কেউ কিন্তু করোনার আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত নই। আর তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রোগী ব্যবস্থাপনার উপর সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। এ বিষয়ে কী করণীয় তাও আমরা ইতোমধ্যে জাতিকে জানানোর চেষ্টা করেছি। পাঠকের সুবিধার্থে তা নিম্নে বর্ণিত হলো

•    আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সকল জেলা হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল এবং সরকারি ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা বা রিব্রিদার অক্সিজেন মাস্ক ব্যবহার উপযোগী অক্সিজেন সরবারহের ব্যবস্থা করে জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে কোভিড চিকিৎসা নিশ্চিত করা।

•    আগামী তিন মাসের মধ্যে সকল জেলা হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল এবং সরকারি ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কার্যকর সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ সিস্টেম গড়ে তোলা।

•    কম গুরুতর কোভিড ও নন-কোভিড রোগীকে হোম কেয়ারে রাখার জন্য উৎসাহিত করা এবং স্থানীয় ডাক্তারদের মাধ্যমে তাদেরকে সেবা প্রদান করা। প্রয়োজনে, স্বাস্থ্য বাতায়ন ও অন্যান্য ন্যাশনাল হেল্প লাইনকে শক্তিশালী করে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করা।

•    বিভাগীয় ও জেলা সদর পর্যায়ের উপযুক্ত প্রাইভেট, এনজিও এবং অলাভজনক হাসপাতালে কোভিড চিকিৎসার প্রয়োজনীয় কাঠামো গড়ে তুলতে নির্দেশনা ও সহযোগিতা করা। এক্ষেত্রে সরকারকে সেবার মান নিশ্চিতকরণ এবং ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একই সাথে নির্ধারিত মূল্যের তালিকা হাসপাতালের প্রবেশ মুখে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা।

•    বড় হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্ত সময়ে সময়ে পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

এছাড়াও আমাদের আরও কিছু বাড়তি প্রস্তুতি থাকা দরকার। গত বছর দ্রুততার সাথে বেশ কিছু ডাক্তার ও নার্স নিয়োগের ফলে এই দুই ধরনের লোকবলের ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছি। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে এটা আঁচ করা কঠিন নয় যে, ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ স্বাস্থ্য খাতে জনশক্তি বাড়ানোর চিন্তা আগেই করে রাখতে হবে। আমাদের দেশে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বেকার ডাক্তার আছে, এদের মধ্যে যারা আগ্রহী তাদেরকে নিয়ে একটা পুল তৈরি করা যেতে পারে। তাদের অনলাইনে করোনা ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের আপাতত তিন থেকে ছয় মাসের খণ্ডকালীন নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। ঠিক একইভাবে নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এবং প্যারামেডিকদের মধ্য থেকে একটা পুল তৈরি করে তাদেরও খণ্ডকালীন নিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, স্থায়ী চাকরির ক্ষেত্রে এদেরকে পরবর্তী সময়ে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।

অন্যদিকে মেডিকেল কলেজ এবং সদর হাসপাতালের খালি জায়গায় অস্থায়ীভাবে তাঁবু টাঙিয়ে রোগী ব্যবস্থাপনায় কাজ করা যেতে পারে। কাজে লাগুক আর না লাগুক, এসব বাড়তি প্রস্তুতি আমাদের একান্তই দরকার। ভয়াবহতার মাত্রা আরও দুই তিন মাস বাড়তে পারে। তাই সময়মতো প্রস্তুত না হতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
লকডাউন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তেমন ফলদায়ক হবে এটা ভাবার যুক্তি নাই। তারপরও যদি লকডাউন দিতে হয় তাহলে তা সফল করার জন্যে নিম্নলিখিত বিষয়ের উপর জোর দিতে হবে।

•     প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স এর পুল তৈরি করা, ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণ করা এবং তা কার্যকর করা। জনগণকে এই বিষয়ে অবহিতকরণে কার্যকর প্রচারণা চালানো।
•    কোভিড টেস্টের নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত চালু করা এবং শহরাঞ্চলে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা।
•    কোভিড টেস্টের সরকার নির্ধারিত ফি রাখা।
•    সরকারি ব্যবস্থাপনায় কিছু গণপরিবহন চালু রাখা যাতে ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী, জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি এবং রোগীদের যাতায়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।
•    ব্যাংকের লেনদেনের সময়সীমা সীমিত করার কারণে সৃষ্ট ভিড় এড়াতে লেনদেনের সময়সীমা পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক রাখা এবং গ্রাহকদের মাঝে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা। বাজারগুলোর ব্যাপারেও একইভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
•    কোভিড চিকিৎসার পাশাপাশি হাসপাতালে মাতৃত্বকালীন সেবাসহ অন্যান্য সকল সেবা চালু রাখা। এক্ষেত্রে প্রতিটা হাসপাতালে কোভিড রোগী এবং নন-কোভিড রোগী চিহ্নিতকরণে ট্রায়াজ সিস্টেম গড়ে তোলা।
•    সর্বোপরি, জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে এলাকাভিত্তিক দরিদ্র মানুষদের চিহ্নিতকরণ এবং নিয়মিতভাবে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য প্রদান করা।

লেখক: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এই বিভাগের আরো সংবাদ