আজকের শিরোনাম :

অভিশপ্ত করোনায় বিপর্যস্ত নারী

  ফাহমিদা হক

০৫ মার্চ ২০২১, ২০:৪৪ | আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২১, ২১:১২ | অনলাইন সংস্করণ

ফাহমিদা হক
করোনাভাইরাস মহামারিতে সারাবিশ্ব যখন বেঁচে থাকা নিয়ে আতন্কিত, নারী তখন নিজ গৃহে আপনজনের অত্যাচারেজর্জরিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পারিবারিক সহিংসতার খবর ভেসে আসছে বিভিন্ন মাধ্যমে। সারাবিশ্বে পারিবারিক সহিংসতাঅনেক বেড়ে গেছে এবং চরম অনিরাপত্তায় ভুগছে নারীরা।বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মার্চ মাসে প্রকাশিত একাধিক রিপোর্ট ওসমীক্ষা বলছে, করোনার কারণে গৃহবন্দি বহু দেশেই পারিবারিক সহিংসতার ছবিটা প্রায় একই রকম। এই নির্যাতনের মাত্রাএতোটাই বেশী যে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। যেখানে তিনি বলেছেন, করোনাপরিস্হিতিতে নিজের ঘরে সবচেয়ে নিরাপদ থাকার কথা ছিলো নারীর। অথচ পারিবারিক নির্যাতন এমন আকার ধারণ করেছেযে, অনেক নারীর কাছে আপন ঘর এখন নরকের মতো হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশে করোনায় লকডাউনের সময় পারিবারিক সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে তার নির্দিষ্ট কোন তথ্য উপাত্তের  জরুরিব্যবস্হা গ্রহণ করা হয়নি বলেই জানি। তবে বেশকিছু সহিংসতার খবর বিভিন্ন মাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে, মর্মান্তিক কিছু ঘটনাসারাদেশের মানুষকে কাঁদিয়েছে।চট্টগ্রামে এক গৃহবধুকে ভাত দিতে দেরী হবার কারণে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে স্বামী। দিনাজপুরেগৃহবধুকে হত্যা করা হয়েছে নিজ গৃহে। নোয়াখালীতে ঘরের বউকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে এক স্বামী। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকেযতটুকু নির্যাতনের খবর বাইরে প্রকাশিত হয়েছে ততটুকুই মানুষ দেখেছে, তার বাইরে বহু সহিংসতার খবর কোনদিন প্রকাশিতওহয় না। এসব নির্যাতনের খবর প্রকাশিত না হবার কারণ, নারী নির্যাতনের শুরুটাই হয় নারীর আপন ঘর থেকে।এসব নির্যাতনএমন মানুষের দ্বারা সংঘটিত হয় যে, পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তা প্রকাশিতও হয় না। এক্ষেত্রেপারিবারিক সহিংসতা বলতে মানসিক, শারীরিক , যৌন এবং অর্থনৈতিক সবগুলো সহিংসতার কথাই বোঝায়।

করোনাকালীন সময়ে শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো বিশ্বটাই বন্দী জেলখানায় পরিনত হয়েছে, সেই জেলখানার আসামী হয়েছে কেবলনারী ও শিশুরা। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন পুরুষরা ঘরে বন্দি নারীর উপর নির্যাতন বাড়িয়ে দিলো? উত্তরটা হলো,  যারানির্যাতনকারী, পরিস্হিতি তাদের কাছে কোন বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে হাতের কাছে পাওয়া দুর্বল অসহায় মানুষটা কতটা তারআয়ত্বে আছে। যে অত্যাচারী সে সবসময় দুর্বলের উপর তার কর্ম করে যাবে। সেটা সময় সুযোগে  যখন তখন যেখানে সেখানে।গৃহবন্দীত্বকালে নারীর দীর্ঘসময় তার অত্যাচারীর কাছাকাছি থাকা, চাইলেও ঘরের বাইরে যেতে না পারা, কারো কাছে সাহায্যচাওয়ার পথ না থাকা, সংকটের অনেক কাপনের কয়েকটি মাত্র। সবমিলিয়ে করোনাও বিশ্বব্যাপী নারীকে নতুন করে শিখিয়েদিলো উন্নত, অনুন্নত দেশ বলে কিছু না, কর্তৃত্ববাদী পুরুষ সর্বকালে তার সকল নিরাপত্তাহীনতার, সকল চাপ, ক্ষোভ, হতাশাউগড়ে দেয় দুর্বল নারীর উপর।কারণ একটাই, এটিই সবচেয়ে সহজ উপায় তার নিজেকে হাল্কা করার।

পুরুষশাসিত বর্হিজগতে নারীরা অনুপ্রবেশকারিনী।জন্মের পর থেকে যে মতাদর্শ শিখে বাল্যকাল থেকে বেড়ে উঠে নারী, প্রাত্যহিক জীবনে এসে তার প্রতিফলন হয় উল্টা।অবমাননার সাথে তখন যুক্ত হয় অন্তর্দন্ধ।এসব টানাপোড়েনের ভারসাম্য রক্ষাকরতে নারীরা নিজেকে উপস্হাপন করতে হচ্ছে স্বপ্রহরায়।লিঙ্গ মতাদর্শ, ধর্মীয় সামাজিক মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক প্রয়োজনমিটাতে নারী নিজেকে ঘর থেকে বের করতে পারলেও সঙ্গতি রক্ষা করেই চলতে হয়। ভীতি, হতাশা, বন্চনাবোধের কারণে নারীতার নিজেকে রক্ষা করার কৌশল অবলম্বন করলেও এখনো পুঁজিবাদী দুনিয়া পুরুষের আয়ত্বে।

অর্থনৈতিক প্রয়োজনে পুরুষ অভিভাবকহীন হাজার হাজার নারী গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছে, শ্রমের বিনিময়ে পুরো পরিবারের হালধরছে। সর্বাধিক রপ্তানী পণ্যের বিনিময়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার কাজে প্রধান শর্ত সঠিকউৎপাদনের দায়িত্বটি সাফল্যের সাথে পালন করে যাচ্ছে যেই অবলা কিশোরীরা তাদের সংখ্যা এদেশের সেনাবাহিনীর চাইতেকয়েকগুন বেশী। এতো বিশাল সংখ্যক নারীগোষ্ঠী ঘরে বাইরে উন্মুক্ত কর্পোরেট জগতের অর্থনীতির বিশ্বকর্মযজ্ঞে অসামান্য  অবদান রেখে চলছে, তা সত্ত্বেও নারীকে পুরুষের চেয়ে শিক্ষা, পুষ্টি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল দিক থেকে অমানবিক স্তরেরেখেই এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে অমানবিক কর্তৃত্বপরায়ন বিশ্ব।

পুঁজিবাদের উত্থানে সমাজতন্ত্রের ধ্বস নারীকে পুঁজি করে গড়ে তুলেছে শোষনের সাম্রাজ্য। পণ্য বিকেন্দ্রিকরণের বিশাল কাজেনারী পাচারের পণ্য, আবার অন্যদিকে বাজারের পণ্যকে আকৃষ্ট করার জন্যেও পণ্য হিসেব গন্য হচ্ছে। নারীর ব্যবহার বৃদ্ধি হয়েছে, বৃদ্ধি হয়নি নারীর মান উন্নয়ন। এখনো নারীশ্রম মানে সস্তাশ্রম, যা বিশ্ব বিবেকের জন্য লজ্জাজনক। নারীর কর্মের অধিকারমুক্তির অধিকার, মানুষ হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার। বাংলাদেশ জাতিসংঘ গৃহীত নারীর প্রতি সকল বৈষম্যবিলোপ সনদে (CEDAW) স্বাক্ষর করে। অন্যদিকে একই সনদের ২.১৩ (ক), এবং ১৬(গ)৫ ধারা অনুমোদন না করে, সকলক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করা থেকে দুরে থেকে, উভয় কুল রক্ষা করে চলেছে কেবল পুঁজিবাদ, মৌলবাদের মতাদর্শরক্ষা করতে।

এতো কিছু বলার একটাই কারন, নারী কোন কালেই কোথাও নিরাপদ নয়। পারিবারিক সহিংসতার স্বীকার নারীর জন্য কোনদেশই নিরাপদ নয়। কোয়ারেন্টাইন তাদের নির্যাতনকারীর একেবারে কাছাকাছি নিয়ে গেছে। শুধু ভয়ংকর ভাইরাসই নয় এইঅবস্হা নারীকে এমন এক পৃথিবীর কাছে নিয়ে গেছে , যেখানে অধিকাংশ দরজাই তার জন্য বন্ধ। বিশ্বব্যাপী নারীআন্ন্দোলনকারীরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতা ভয়াবহ ভাবে বেড়েছে চারদিকে।বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার নারী ওশিশুদের সেবা গ্রহনের  সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। সরকারের জাতীয় হেল্পলাইন‘১০৯’ থেকে চলতি বছরের অগাষ্ট পর্যন্ত ৯ লাখ ৩ হাজার ৮৩০ জন নারী ও শিশু সহায়তা নিয়েছেন। এছাড়া চলতি বছরেরঅক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ৭৭১ টি নির্যাতনের তথ্য পেয়েছে মহিলা পরিষদ। এর মধ্যে এক মাসে ১৭১ টি ধর্ষণ, ৪৪ টি গণধর্ষণ সহসবচেয়ে বেশী ৪৩৬ টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে।

পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও উন্নত রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রও এর বাইরে নয়। যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় পারিবারিক সহিংসতা বিষয়ক হটলাইনেগত বছরের ১০ থেকে ২৪ মার্চের ভেতর অসংখ্য ফোন এসেছে। নির্যাতনকারীরা নির্যাতিতাদের তাদের বাড়ি ছেড়ে যেতে দিচ্ছে না, আবার নির্যাতনও চালিয়ে যাচ্ছে।।ভিকটিমকে সহযোগিতাকারী নিউইয়র্ক ভিত্তিক প্রোগ্রাম সেইফ হরাইজন বলছে, পারিবারিকসহিংসতার শিকার মেয়েরা কখনো ফোনই ধরতে পারছে না।আমেরিকাতে চ্যাট সার্ভিস ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছে ভিকটিমদেরজন্যে।

ফ্রান্সে পারিবারিক নির্যাতন ৩০ % বেড়েছে।  রাজধানী প্যারিসে এ সংখ্যা বেড়ে ৩৬ %। ফরাসি সরকার ভিকটিমদের সরাসরিফার্মেসিতে যোগাযোগ করতে বলেছে, ওখান থেকে পুলিশে যোগাযোগ করে সাহায্য করা হবে। ইতালিতে পরিসংখ্যান না থাকলেওনির্যাতিত নারীদের সাহায্য সংস্থা ইভা কোঅপারেটিভা এনবিসি নিউজকে জানিয়েছে, নির্যাতিতদের কাছ থেকে অনবরত ইমেইলও হোয়াটস অ্যাপে বার্তা পাচ্ছেন। অনেকে যোগাযোগ করতে পারছে না। সরকারী সংস্হা টেলিফোনো রোসাও বলেছে, আমরাবুঝতে পারছি সহিংসতা বেড়েছে তাই সরকার নতুন অ্যাপ চালু করেছে যেখানে ফোন না করেও সাহায্য পাওয়া যাবে।

স্পেনে লকডাউনে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে, স্পেনের নারীরা ওষুধের দোকানে গিয়ে মাস্ক ১৯ বললে বুঝা যাবে তার সাহায্যদরকার। ব্রিটেনে জাতীয় পারিবারিক নির্যাতন বিষয়ক হেল্পলাইন জানিয়েছে এইখানেও অভিযোগ আসার পরিমান বেড়েছে২৫%। ওয়েবসাইটেও দ্বিগুন অভিযোগ আসার পরিমান বেড়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিন আফ্রিকাতে সহিংসতা বেড়েছে চারভাগের একপরিমানে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালযের এক জরিপে বলা হয়েছে ইয়েমেন, মরক্কো, মিশরে নারীরা নিয়মিত স্বামীদের দ্বারা নির্যাতিতহচ্ছে। তিউনিসিয়ার নারী মন্ত্রী আসামা সিরি বলেছেন, করোনার লকডাউনে ২০২০ -এর মধ্য মার্চের পর থেকে পারিবারিকনির্যাতন বেড়েছে ৫ গুন।

লেবানন ও মালয়েশিয়াতেও গতবছরের তুলনায় দ্বিগুন বেড়েছে সহিংসতার পরিমান। চীনা সামাজিক মাধ্যমে পারিবারিকসহিংসতার কথা বারবার উঠে আসছে। সেখানকার মানবাধিকার কর্মী গুয়া জিং বলেছেন, গত নভেম্বরে উনি নিজেই বহু কলরিসিভ করেছেন শিশুদের কাছ থেকে, যারা প্রত্যেকেই পারিবারিক সহিংসতায় বাবা মায়ের বিরুদ্ধ কি করবে বুঝতে পারছে না।চীনে এই সহিংসতা নিয়ে প্রায় ৩০০০ বার আলোচনা হয়েছে। ইউএন উম্যান খুবই উদ্বিগ্ন এই ভেবে যে, করোনা হয়তো থাকবেনা, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া থেকে যাবে বহুদিন। বহু নারী কাজ হারাবে, বাড়বে আরো নির্যাতনের হার। 

করোনা মহামারীতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসায়, মানুষের মধ্যে অনেক রকমের পরিবর্তন  এসেছে, অস্হিরতারপরিমান বেড়েছে চারদিকে বহুগুনে। পুরুষ কর্মহীন হয়ে ঘরে বসে গেছে। নারীর উপর অত্যাচারের মাত্রা বিগত যে কোন সময়েরতুলনায় বিপদজনক হারে বেড়ে গেছে। এহেন অবস্হা গোটা বিশ্বের নারীর জন্য আতংকের। এবারের নারী দিবসে এই সংকটকেইসামনে নিয়ে আসতে হবে গোটা বিশ্বজুড়ে। বিশ্বময় দুর্যোগ বা অসময় আসবে, চলে যাবে একদিন, কিন্তু নারীর  দুর্দিন  শেষ হবেকবে? যুগে যুগে যতো দুর্যোগ-দু্র্বিপাক আসে, তার বহুগুন হয়ে কেন আছড়ে পড়ে নারীর উপর?

লেখক: নিউ মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর, সিজিএস; পরিচালক, সিসিএন।

এই বিভাগের আরো সংবাদ