অনিরাপদ সড়ক আর আমাদের অসচেতনতা : শতরূপা দত্ত
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০১৮, ১৩:৪৮
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও ট্রাফিক সপ্তাহ শেষে আবারো আগের চিত্রে ফিরে গেছে সড়কগুলো। রাস্তা জুড়ে আগের মতোই চলছে যানবাহনের এলোমেলো চলাফেরা এবং পথচারীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়া। অবাক হওয়ার বিষয় হলো, নিরাপদ সড়কের দাবি নিয়ে শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন আমাদের সবাকার চেতনার বন্ধ দরোজা-জানালা খুলে দিয়ে গেছে বলে আমরা অনেকেই ধারণা করেছিলাম, আসলে বাস্তবতা কিন্তু তা প্রমাণ করছে না। যা আগে ঘটেছে, তা-ই এখনও ঘটে চলেছে।
গত ২৯ জুলাই দুই বাসের রেষারেষির সময় রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা উড়াল সেতুর ঢালে অপেক্ষারত শিক্ষার্থীদের ওপর উঠে যায় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। এতে নিহত হয় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই জন শিক্ষার্থী। আবদুল করিম এবং দিয়া খানম মিম। আহত হয় আরো প্রায় ১২ জন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলো শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সবমহলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সর্ষের মধ্যেই রয়েছে ভূতের আস্তানা। লাইসেন্স ও ফিটনেস না থাকায় অজ¯্র গণপরিবহন শিক্ষার্থী হাতে আটক হয়। যাদের আইনের হাতে তুলে দেয়া হয় পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাতে একই অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ায় আটক হয় অনেক সরকারি গাড়িও। দেখা গেছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এবং অনেক ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতারাও মানছেন না তাদেরই দ্বারা প্রণীত আইন। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যানবাহনগুলোকে লেন মেনে চলতেও বাধ্য করেছে শিক্ষার্থীরা। সুশৃঙ্খলভাবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীগণ বাংলাদেশের সড়কে প্রথমবারের মতো ইমারজেন্সি লেন তৈরি করে দেখিয়েছে। এভাবে প্রমাণিত হয়েছে, প্রত্যেক্ষে স্ব স্ব ক্ষেত্রে আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতি যথাযথ রূপে মেনে চললে অব্যবস্থা অনেকখানিই দূর হয়ে যায়। দুর্ঘটনার মিছিল সড়কে-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াতে পারে না।
এই আন্দোলনের মধ্যেই ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতা করুন, ট্রাফিক শৃঙ্খলা একটি জাতির সভ্যতার প্রতীক’ Ñ এই শ্লোগানে ৪ আগস্ট থেকে ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু করে সরকার। পরে, ৩দিন সময় বৃদ্ধির করে গত ১৪ আগস্ট শেষ হয় ১০ দিনের ট্রাফিক সপ্তাহ। এসময় রাস্তায় পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের সাথে কাজ করেছে রোভার স্কাউট ও গার্লস গাইডের সদস্যরা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অনলাইন নিউজ পোর্টাল সূত্রে জানা যায়, ১০ দিনের ট্রাফিক সপ্তাহে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জন্য মোট মামলা করেছে ৮৮ হাজার ২শ’ ৯৩ টি। জরিমানা করা হয়েছে ৫ কোটি ১০ লাখ ৯৬ হাজার ২শ’ ৭৭ টাকা।
১১ আগস্ট ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক প্রেস বিফ্রিংয়ে ডিএমপি কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা আইন না মানার সংস্কৃতি। একটি দেশে আইন তৈরি করা হয় তা মানার জন্য। বিদেশে শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ আইন মানে কিন্তু আমাদের দেশে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ আইন মানতে চায় না। ডিএমপি কমিশনারের এই উক্তিতে কোনো অতিরঞ্জন নেই। এদেশের অধিকাংশ মানুষই এমন মানসিকতায় আক্রান্ত। এটি আমাদের দেশে একটি সামাজিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার মতোই আচরণ। এর চিকিৎসা দরকার। চিকিৎসা ধারা খোঁজার দায়িত্ব বিশেষজ্ঞদের। তবে, লাঠ্যাষৌধি বলে একটি কথা আছে। এ নিয়েও ভাবা যায়। অর্থাৎ আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার।
১৭ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত পাঠকের মতামত-এ অধিকাংশ পাঠকই একমত হয়েছেন আইন না-মানার প্রবণতাই আমাদের বড়ো দোষ। তবে, তারা এটাও মনে করেন, মানুষকে আইন মানাতে আইনের যথাযথ প্রয়োগও হওয়া প্রয়োজন। প্রথম থেকেই কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ ঘটলে মানুষ আইন মানতে বাধ্য হতো বলেও মনে করেন তারা। পাশাপাশি আইন মানার জন্য আইন জানাটাকেও জরুরী বলে মন্তব্য করেছেন পাঠকরা। অভিমত প্রকাশকারীদের এই উপলব্ধি নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। সরকারকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে প্রাথমিকভাবে। সেই সাথে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোও কিছু দায়িত্ব নিতে পারে। এনজিওগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রত সেমিনার কক্ষ থেকে বের হয়ে রৌদ্র ঝলসানো রাস্তায় কিছু ঘাম ঝরাতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালীন পথচারী ও যানবাহনগুলো আইন মানতে বাধ্য হলেও, ট্রাফিক সপ্তাহে তাদের আইন মানাতে হিমসিম খেতে হয়েছে পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের। দুই-পা বেশি হেঁটে গিয়ে ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস বা জেব্রাক্রসিং ব্যবহারের চাইতে রাস্তার মাঝখান দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হতেই যেন আমরা বেশি পছন্দ করি। গণপরিবহনগুলোও স্টপেজে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করানোর চাইতে রাস্তার মোড়ে হঠাৎ গাড়ি বাঁকা করে দাঁড় করিয়ে দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ট্রাফিক সপ্তাহে রাস্তায় কাজ করতে নামা স্কাউট সদস্যদের দেখেছি মানুষকে ঠিক পথে রাস্তা পার হতে এবং স্টপেজ থেকে বাসে উঠতে অনুরোধ করে গলদঘর্ম হতে। বেশিরভাগ মানুষকেই দেখেছি তাদের কথা না-শুনতে এবং তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে মাঝ রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পার হতে। মনে রাখতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শুধুমাত্র পরিবহন চালকরাই দায়ী নন, পথচারীদের অসচেতনতাও অনেকাংশে দায়ী। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাধারণ মানুষের নিজেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরীর কোন বিকল্প নেই।
আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা বেশি। শাস্তির ভয় না দেখানো পর্যন্ত কেউই আসলে আইনের পরোয়া করেন না। পথচারীদের আইন না-মানার প্রধান কারণ সময় বাঁচানোর চেষ্টা এবং অলসতা। এর সাথে যুক্ত হয় ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডার পাসগুলোতে নিরাপত্তার অভাব। ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীরা থাকতে পারে Ñ এই ভয়ে অনেক সময়ই এসব জায়গা এড়িয়ে মূল সড়ক দিয়ে পার হতে চায় মানুষ। এক্ষেত্রে এসব জায়গায় পুলিশ চৌকি বাড়িয়ে ও জোরালো আলোর ব্যবস্থা করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করি। এছাড়া এসব ফুটওভার ব্রিজ এবং আন্ডারপাস যখন মানুষ নিয়মিত ব্যবহার করতে শুরু করবে, তখন এসব জায়গা এমনিতেই অসামাজিক কর্মকা-মুক্ত হয়ে যাবে। জেব্রাক্রসিংগুলো যাতে ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে থাকা গাড়ির নিচে চাপা না পড়ে, সেদিকে ট্রাফিক পুলিশের নজর রাখা উচিৎ বলেও মনে করি।
আইন না-মানার আরেকটি প্রধান কারণ, আইন না-জানা। আমি ছোটবেলায় মা-বাবার কাছ থেকে হাতেকলমে রাস্তায় চলার টুকটাক কিছু নিয়ম শিখেছি। আর, বাকিটা শিখেছি প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে। পাঠ্যবইতে কোনোদিনই এ বিষয়ে কিছু পড়েছি বলে মনে পড়ে না। নিশ্চয়ই উল্লেখযোগ্য কিছু ছিলো না, থাকলে হয়তো মনে থাকতো। অথচ থাকা উচিৎ ছিলো। রাস্তা পারাপারের নিয়ম জানা, ফুটপাত ব্যবহারের নিয়ম জানা, রোড সাইন চেনা, ট্রাফ্রিক আইন জানা- এসব বিষয়ে আলাদা আলাদা শ্রেণীতে আলাদা আলাদা পাঠ্যসূচী থাকা উচিৎ ছিলো। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় তৃতীয় শ্রেণীতে একটি বিশেষ অধ্যায় এবং চতুর্থ শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ে একটি ছড়া ছাড়া এ সংক্রান্ত আর কোন পাঠ নেই। ধারাবাহিকভাবে ট্রাফিক আইন শিক্ষা আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। ছোটবেলা থেকে এসব বিষয় শিখে আসলে, ব্যবহারিক জীবনে এসব বিষয়ের যথাযথ প্রয়োগ না করলে, এর জন্যে আইনের আওতায় শাস্তির বিধান থাকলে এবং সেই শাস্তি যথাযথভাবে প্রযুক্ত হলে আইন না-মানার প্রবণতা হয়তো বিলুপ্ত হবে। আশার কথা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রাফিক আইন ও নিয়মকানুন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
সড়কে শৃংখলা বজায় রাখতে ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে সকলেরই কিছু-না-কিছু দায়িত্ব রয়েছে। পথচারীদের দায়িত্ব হাঁটার জন্য ফুটপাত ব্যবহার করা, ফুটপাত না থাকলে রাস্তার বামদিকে ঘেঁষে হাঁটা, রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রীজ বা আন্ডারপাস ব্যবহার করা, ডানে-বামে তাকিয়ে সাবধানে রাস্তা পার হওয়া এবং মোবাইল ফোনে কথা বলা অবস্থায় ও হেডফোন কানে লাগিয়ে রাস্তা পার না-হওয়া। চালকের দায়িত্ব সিট বেল্ট ব্যবহার করা, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি না-চালানো, মোটরসাইকেল চালাতে হেলমেট ব্যবহার করা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি না-চালানো, যেখানে সেখানে পার্কিং না-করা, বাস স্টপেজে যাত্রী ওঠা-নামা করানো ও বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স সাথে রাখা। মালিকের দায়িত্ব গাড়ির সব ডকুমেন্ট আপডেটেড রাখা, গাড়ির ফিটনেস ঠিক রাখা, বৈধ ও দক্ষ ড্রাইভার নিয়োগ দেয়া, চুক্তিতে গাড়ি না চালিয়ে ড্রাইভারকে বেতনভুক্ত করা এবং চালককে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া।
একটি দেশ কখনো শুধু মাত্র সরকারের উপর নির্ভর করে পারফেক্ট হতে পারে না। কোনো সিস্টেম কোনো সরকার একা পরিবর্তন করে দিতে পারে না। সেজন্য প্রয়োজন দেশের প্রতিটি নাগরিকের সহৃদয় সহায়তা। আমরা সকলেই যদি সচেতন হই, নিজেরা আইন মেনে চলি এবং অন্যদের আইন মেনে চলতে উৎসাহিত করি, তাহলে সড়ক দুঘর্টনা কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। আসুন না, সবাই মিলে চেষ্টা করে দেখি, নিরাপদ থাকা যায় কি-না। (দৈনিক পূর্বকোণ থেকে সংগৃহীত) লেখক : সাংবাদিক, নিউজ রুম এডিটর, একুশে টিভি, ঢাকা
গত ২৯ জুলাই দুই বাসের রেষারেষির সময় রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে কুর্মিটোলা উড়াল সেতুর ঢালে অপেক্ষারত শিক্ষার্থীদের ওপর উঠে যায় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। এতে নিহত হয় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই জন শিক্ষার্থী। আবদুল করিম এবং দিয়া খানম মিম। আহত হয় আরো প্রায় ১২ জন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলো শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা সবমহলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সর্ষের মধ্যেই রয়েছে ভূতের আস্তানা। লাইসেন্স ও ফিটনেস না থাকায় অজ¯্র গণপরিবহন শিক্ষার্থী হাতে আটক হয়। যাদের আইনের হাতে তুলে দেয়া হয় পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের হাতে একই অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ায় আটক হয় অনেক সরকারি গাড়িও। দেখা গেছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এবং অনেক ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতারাও মানছেন না তাদেরই দ্বারা প্রণীত আইন। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যানবাহনগুলোকে লেন মেনে চলতেও বাধ্য করেছে শিক্ষার্থীরা। সুশৃঙ্খলভাবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীগণ বাংলাদেশের সড়কে প্রথমবারের মতো ইমারজেন্সি লেন তৈরি করে দেখিয়েছে। এভাবে প্রমাণিত হয়েছে, প্রত্যেক্ষে স্ব স্ব ক্ষেত্রে আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতি যথাযথ রূপে মেনে চললে অব্যবস্থা অনেকখানিই দূর হয়ে যায়। দুর্ঘটনার মিছিল সড়কে-মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াতে পারে না।
এই আন্দোলনের মধ্যেই ‘ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, ট্রাফিক পুলিশকে সহযোগিতা করুন, ট্রাফিক শৃঙ্খলা একটি জাতির সভ্যতার প্রতীক’ Ñ এই শ্লোগানে ৪ আগস্ট থেকে ট্রাফিক সপ্তাহ শুরু করে সরকার। পরে, ৩দিন সময় বৃদ্ধির করে গত ১৪ আগস্ট শেষ হয় ১০ দিনের ট্রাফিক সপ্তাহ। এসময় রাস্তায় পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের সাথে কাজ করেছে রোভার স্কাউট ও গার্লস গাইডের সদস্যরা। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অনলাইন নিউজ পোর্টাল সূত্রে জানা যায়, ১০ দিনের ট্রাফিক সপ্তাহে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ট্রাফিক আইন ভঙ্গের জন্য মোট মামলা করেছে ৮৮ হাজার ২শ’ ৯৩ টি। জরিমানা করা হয়েছে ৫ কোটি ১০ লাখ ৯৬ হাজার ২শ’ ৭৭ টাকা।
১১ আগস্ট ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক প্রেস বিফ্রিংয়ে ডিএমপি কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা আইন না মানার সংস্কৃতি। একটি দেশে আইন তৈরি করা হয় তা মানার জন্য। বিদেশে শতকরা ৯৮ ভাগ মানুষ আইন মানে কিন্তু আমাদের দেশে শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ আইন মানতে চায় না। ডিএমপি কমিশনারের এই উক্তিতে কোনো অতিরঞ্জন নেই। এদেশের অধিকাংশ মানুষই এমন মানসিকতায় আক্রান্ত। এটি আমাদের দেশে একটি সামাজিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার মতোই আচরণ। এর চিকিৎসা দরকার। চিকিৎসা ধারা খোঁজার দায়িত্ব বিশেষজ্ঞদের। তবে, লাঠ্যাষৌধি বলে একটি কথা আছে। এ নিয়েও ভাবা যায়। অর্থাৎ আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার।
১৭ আগস্ট দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত পাঠকের মতামত-এ অধিকাংশ পাঠকই একমত হয়েছেন আইন না-মানার প্রবণতাই আমাদের বড়ো দোষ। তবে, তারা এটাও মনে করেন, মানুষকে আইন মানাতে আইনের যথাযথ প্রয়োগও হওয়া প্রয়োজন। প্রথম থেকেই কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ ঘটলে মানুষ আইন মানতে বাধ্য হতো বলেও মনে করেন তারা। পাশাপাশি আইন মানার জন্য আইন জানাটাকেও জরুরী বলে মন্তব্য করেছেন পাঠকরা। অভিমত প্রকাশকারীদের এই উপলব্ধি নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। সরকারকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে প্রাথমিকভাবে। সেই সাথে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোও কিছু দায়িত্ব নিতে পারে। এনজিওগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রত সেমিনার কক্ষ থেকে বের হয়ে রৌদ্র ঝলসানো রাস্তায় কিছু ঘাম ঝরাতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালীন পথচারী ও যানবাহনগুলো আইন মানতে বাধ্য হলেও, ট্রাফিক সপ্তাহে তাদের আইন মানাতে হিমসিম খেতে হয়েছে পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের। দুই-পা বেশি হেঁটে গিয়ে ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস বা জেব্রাক্রসিং ব্যবহারের চাইতে রাস্তার মাঝখান দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হতেই যেন আমরা বেশি পছন্দ করি। গণপরিবহনগুলোও স্টপেজে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করানোর চাইতে রাস্তার মোড়ে হঠাৎ গাড়ি বাঁকা করে দাঁড় করিয়ে দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ট্রাফিক সপ্তাহে রাস্তায় কাজ করতে নামা স্কাউট সদস্যদের দেখেছি মানুষকে ঠিক পথে রাস্তা পার হতে এবং স্টপেজ থেকে বাসে উঠতে অনুরোধ করে গলদঘর্ম হতে। বেশিরভাগ মানুষকেই দেখেছি তাদের কথা না-শুনতে এবং তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে মাঝ রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পার হতে। মনে রাখতে হবে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শুধুমাত্র পরিবহন চালকরাই দায়ী নন, পথচারীদের অসচেতনতাও অনেকাংশে দায়ী। সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাধারণ মানুষের নিজেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরীর কোন বিকল্প নেই।
আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা বেশি। শাস্তির ভয় না দেখানো পর্যন্ত কেউই আসলে আইনের পরোয়া করেন না। পথচারীদের আইন না-মানার প্রধান কারণ সময় বাঁচানোর চেষ্টা এবং অলসতা। এর সাথে যুক্ত হয় ফুটওভার ব্রিজ বা আন্ডার পাসগুলোতে নিরাপত্তার অভাব। ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীরা থাকতে পারে Ñ এই ভয়ে অনেক সময়ই এসব জায়গা এড়িয়ে মূল সড়ক দিয়ে পার হতে চায় মানুষ। এক্ষেত্রে এসব জায়গায় পুলিশ চৌকি বাড়িয়ে ও জোরালো আলোর ব্যবস্থা করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করি। এছাড়া এসব ফুটওভার ব্রিজ এবং আন্ডারপাস যখন মানুষ নিয়মিত ব্যবহার করতে শুরু করবে, তখন এসব জায়গা এমনিতেই অসামাজিক কর্মকা-মুক্ত হয়ে যাবে। জেব্রাক্রসিংগুলো যাতে ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে থাকা গাড়ির নিচে চাপা না পড়ে, সেদিকে ট্রাফিক পুলিশের নজর রাখা উচিৎ বলেও মনে করি।
আইন না-মানার আরেকটি প্রধান কারণ, আইন না-জানা। আমি ছোটবেলায় মা-বাবার কাছ থেকে হাতেকলমে রাস্তায় চলার টুকটাক কিছু নিয়ম শিখেছি। আর, বাকিটা শিখেছি প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা থেকে। পাঠ্যবইতে কোনোদিনই এ বিষয়ে কিছু পড়েছি বলে মনে পড়ে না। নিশ্চয়ই উল্লেখযোগ্য কিছু ছিলো না, থাকলে হয়তো মনে থাকতো। অথচ থাকা উচিৎ ছিলো। রাস্তা পারাপারের নিয়ম জানা, ফুটপাত ব্যবহারের নিয়ম জানা, রোড সাইন চেনা, ট্রাফ্রিক আইন জানা- এসব বিষয়ে আলাদা আলাদা শ্রেণীতে আলাদা আলাদা পাঠ্যসূচী থাকা উচিৎ ছিলো। আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় তৃতীয় শ্রেণীতে একটি বিশেষ অধ্যায় এবং চতুর্থ শ্রেণীর ইংরেজি বইয়ে একটি ছড়া ছাড়া এ সংক্রান্ত আর কোন পাঠ নেই। ধারাবাহিকভাবে ট্রাফিক আইন শিক্ষা আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। ছোটবেলা থেকে এসব বিষয় শিখে আসলে, ব্যবহারিক জীবনে এসব বিষয়ের যথাযথ প্রয়োগ না করলে, এর জন্যে আইনের আওতায় শাস্তির বিধান থাকলে এবং সেই শাস্তি যথাযথভাবে প্রযুক্ত হলে আইন না-মানার প্রবণতা হয়তো বিলুপ্ত হবে। আশার কথা, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রাফিক আইন ও নিয়মকানুন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
সড়কে শৃংখলা বজায় রাখতে ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে সকলেরই কিছু-না-কিছু দায়িত্ব রয়েছে। পথচারীদের দায়িত্ব হাঁটার জন্য ফুটপাত ব্যবহার করা, ফুটপাত না থাকলে রাস্তার বামদিকে ঘেঁষে হাঁটা, রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রীজ বা আন্ডারপাস ব্যবহার করা, ডানে-বামে তাকিয়ে সাবধানে রাস্তা পার হওয়া এবং মোবাইল ফোনে কথা বলা অবস্থায় ও হেডফোন কানে লাগিয়ে রাস্তা পার না-হওয়া। চালকের দায়িত্ব সিট বেল্ট ব্যবহার করা, মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি না-চালানো, মোটরসাইকেল চালাতে হেলমেট ব্যবহার করা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি না-চালানো, যেখানে সেখানে পার্কিং না-করা, বাস স্টপেজে যাত্রী ওঠা-নামা করানো ও বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স সাথে রাখা। মালিকের দায়িত্ব গাড়ির সব ডকুমেন্ট আপডেটেড রাখা, গাড়ির ফিটনেস ঠিক রাখা, বৈধ ও দক্ষ ড্রাইভার নিয়োগ দেয়া, চুক্তিতে গাড়ি না চালিয়ে ড্রাইভারকে বেতনভুক্ত করা এবং চালককে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া।
একটি দেশ কখনো শুধু মাত্র সরকারের উপর নির্ভর করে পারফেক্ট হতে পারে না। কোনো সিস্টেম কোনো সরকার একা পরিবর্তন করে দিতে পারে না। সেজন্য প্রয়োজন দেশের প্রতিটি নাগরিকের সহৃদয় সহায়তা। আমরা সকলেই যদি সচেতন হই, নিজেরা আইন মেনে চলি এবং অন্যদের আইন মেনে চলতে উৎসাহিত করি, তাহলে সড়ক দুঘর্টনা কমিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ নয়। আসুন না, সবাই মিলে চেষ্টা করে দেখি, নিরাপদ থাকা যায় কি-না। (দৈনিক পূর্বকোণ থেকে সংগৃহীত) লেখক : সাংবাদিক, নিউজ রুম এডিটর, একুশে টিভি, ঢাকা
এই বিভাগের আরো সংবাদ