আজকের শিরোনাম :

বাংলাদেশের পরমাণুবিজ্ঞানের জনকের স্বীকৃতি তার প্রাপ্য

  অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:০৭ | অনলাইন সংস্করণ

ভারতের পরমাণু বিজ্ঞানের জনক হিসেবে হোমিও জাহাঙ্গীর ভাবা ও পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানের জনক ডক্টর আব্দুল কাদির খানকে তাদের দেশ স্বীকৃতি প্রদান করলেও আমরা পরমাণু বিজ্ঞানের পথিকৃৎ ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের পরমাণু বিজ্ঞানের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারিনি। অথচ তিনি পরমাণু বিজ্ঞানকে অন্য দু’জনের থেকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে তোলার চেষ্টা করে গেছেন আমৃত্যু।

অন্যরা যখন পরমাণু শক্তিকে ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর কৌশল হিসেবে দেখেছেন সেখানে তিনি পরমাণু শক্তিকে মানব কল্যাণের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রযুক্তি যখন মানবিক চিন্তাধারা দ্বারা তাড়িত হয় তখন তা ইতিবাচক মৌলিক শক্তিতে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধুর দর্শন থেকে উৎসারিত দেশপ্রেম তার প্রযুক্তি চিন্তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এর সাথে পরমাণুশক্তির গবেষণা, সম্প্রসারণ ও ব্যবহারের জন্য যে একটা আত্মপরিচয় দরকার তা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ১৯৭২ সালের কথা। স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সোনার বাংলার স্বপ্ন নিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠার পদযাত্রা শুরু করেছে। সে সময় এক বিজ্ঞান সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হলো, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আনবিক শক্তি কমিশন পৃথকভাবে না রেখে ড. কুদরত-ই-খুদা কতৃক প্রতিষ্ঠিত সায়েন্স ল্যাবরেটরির সঙ্গে একীভূত করা হবে। কিন্তু ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কারণ তিনি জানতেন বাংলাদেশের পরমাণু সংক্রান্ত গবেষণা ও কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে আনবিক শক্তি কমিশনকে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে হবে।

এই প্রেক্ষিতে পরদিন সকালে তিনি সে সময়ের আনবিক শক্তি কমিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ড. আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাদেশে আনবিক শক্তি কমিশনের স্বতন্ত্রভাবে কাজ করার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার মতো প্রযুক্তিবান্ধব ও মানবিক দৃষ্টিসম্পন্ন একজন মহতী মানুষের চিন্তার সাথে সহমত পোষণ করলেন।

পরবর্তী ১৯৭৩ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশন গঠিত হয়। পরমাণুশক্তি নিয়ে গবেষণা করতে গেলে তেজস্ক্রিয়তার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হতে পারে। এ বিষয়টি ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে খুব ভাবিয়েছে, তবে এর সমাধানের পথটিও তিনি বের করে এনেছেন। গবেষণারত মানুষকে তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণ থেকে সুরক্ষিত রাখতে তিনি আনবিক শক্তি কমিশনে পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। নিভৃতচারী এই মানুষটি বাংলাদেশকে পরমাণুশক্তিতে এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে অনেক গবেষকের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি নিজেও পরমাণু গবেষণায় সম্পৃক্ত ছিলেন।

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া পরমাণু শক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে গবেষণামুলক প্রবন্ধ লিখেছেন তা এখন সারাবিশ্বের সম্পদে পরিণত হয়েছে। তার সে গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে নতুন নতুন মৌলিক ও ফলিত জ্ঞান সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালির মতো উন্নত দেশগুলোতে তিনি নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানের উপর দিনের পর দিন, রাতের পর রাত গবেষণা করেছেন সেখানে থেকে যাবার জন্য নয় বরং সেখান থেকে অর্জিত জ্ঞান ও ধারণা তিনি যাতে পরমাণু বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় কাজে লাগাতে পারেন এটিই ছিলো তার জীবনের মূল লক্ষ্য।

পরমাণুশক্তিতে বাংলাদেশ যাতে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে এটি তিনি মনে প্রাণে চাইতেন। উদারভাবে বিশ্বাস করতেন ও বাস্তবে তার প্রতিফলনও ঘটিয়েছেন। তবে সারা পৃথিবী যখন পরমাণুশক্তিকে ধ্বংসযজ্ঞের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে তখন তিনি পরমাণুশক্তিকে মানুষের কল্যাণের কাজে লাগানোর গবেষণা যেমন করেছেন, বাস্তবে তা প্রয়োগ করেও দেখিয়েছেন।

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আনবিক শক্তি কমিশনের অধীনে চট্রগ্রামে রেডিয়েশন টেস্টিং ল্যাবরেটরি মানুষের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন। এই ল্যাবরেটরির মাধ্যমে বিদেশ থেকে দুধসহ যে সব খাদ্য দ্রব্য আমদানি করা হয় তাতে কোনো তেজস্ক্রিয়তা আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। ১৯৯৭ সালে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যা আগে কেউ ভেবে দেখেনি।

২০১৩ সালের অক্টোবরে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পূরণ হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। সফল হবে বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার আমরণ প্রচেষ্টা এবং সুফল ভোগ করবে সারা দেশের মানুষ। যথার্থই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণায় আলোকিত হয়ে উঠা ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আজ পৃথিবীর পারমাণবিক ক্লাবের ৩২তম সদস্য দেশ। এটা আমাদের সবার জন্য গর্বের আর মর্যাদার।

কৃষির উন্নয়নকে অন্তরে ধারণ করে ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের ‘বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)’ তার প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে। কৃষিতে স্বনির্ভরতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়াকে প্রভাবিত করেছে নানাভাবে। দেশের প্রয়োজনে রাজনীতি করেছেন, তবে ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকেও ক্ষমতার মোহ তাকে কখনো প্রভাবিত করতে পারেনি। বিজ্ঞান চর্চার ও নিউক্লিয়ার গবেষণার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তাপবিদ্যা, সাম থটস অন সাইন্স টেকনোলজি, বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান ও ইলেক্ট্রোমাগনেটিক্স এর উপর গবেষণালব্ধ বই লিখছেন উদারচিত্তে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের কালজয়ী উত্থানকে চির স্মরণীয় করে রাখতে লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ। সেখানে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘটনা আগামী প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্যের যে যোগসূত্র রয়েছে তা তিনি বিশ্বাস করতেন। কবিতা লিখেছেন তিনি জীবনবোধ থেকে। এই সাহিত্যচর্চা ও লেখালেখির মাধ্যমে তিনি বুঝিয়েছেন গবেষণা করতে গেলে কল্পনাশক্তি সৃষ্টির সক্ষমতা থাকতে হয় আর সেটি তৈরি করে দেয় সাহিত্য।

প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে একজন নারীর অবদান আছে। আবার প্রত্যেক সফল নারীর পিছনে একজন পুরুষের অবদান থাকে। যেমন থেকেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া। দু’জন দু’জনের অমিতশক্তি, পথ চলার সাথী ছিলেন, থাকবেন জীবনে। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া আমাদের জাতির অমূল্য সম্পদ ও প্রেরণার উৎস। তার জন্মবার্ষিকীর এই শুভমাহেন্দ্রক্ষনে তাকে বাংলাদেশের পরমাণু বিজ্ঞানের জনক এর স্বীকৃত রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া হোক। এটা সময়ের দাবি, মানুষের দাবি।

লেখক : পরিচালক (গবেষণা ও সম্প্রসারণ), ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

এই বিভাগের আরো সংবাদ